Friday, June 7, 2019

ফেদেরিকো গারসিয়া লরকা-র পরাবাস্তববাদী কবিতা ( ১৮৯৮ - ১৯৩৬ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী


চাঁদ চাঁদের গাথাসঙ্গীত
কনচিতা গারসিয়া লরকার জন্য
চাঁদ কামারের কাছে এলো
সুগন্ধনির্যাসে তৈরি পেটিকোট পরে
যুবক দ্যাখে আর দেখতেই থাকে
যুবক চাঁদের দিকে তাকায়
অশান্ত বাতাসে
চাঁদ নিজের বাহু তুলে ধরে
দেখায় - বিশুদ্ধ আর যৌন --
ওর টিন-পাতের বুক
দৌড়োও চাঁদ দৌড়োও চাঁদের চাঁদ
যদি জিপসিরা আসে
শাদা আঙটি আর শাদা গলার হার
তারা তোমার হৃদয় থেকে স্পন্দিত হবে
যুবক তুমি কি আমায় নাচতে দেবে --
যখন জিপসিরা আসবে
ওরা তোমায় নেহাইয়ের ওপরে পাবে
তোমার ছোট্টো চোখ বন্ধ করে
দৌড়োও চাঁদ দৌড়োও চাঁদের চাঁদ
আমি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি
আমাকে রেহাই দাও যুবক । কথা বোলো না
আমার শাদা মাড়ের গলিতে
ঘোড়সওয়াররা বাজাতে বাজাতে এলো
সমতলের ঢোলক
কামারশালায় যুবক
নিজের ছোটো চোখ বন্ধ করে নিয়েছে
অলিভগাছের বন দিয়ে
কাঁসায় আর স্বপ্নে
জিপসিরা এসে পড়ল
ওদের মাথা উঁচু করে
ওদের চোখ নামিয়ে

রাতের সারস কেমন গান গায়
কেমন গাছে বসে গান গায়
চাঁদ আকাশ পেরিয়ে চলে যায়
যুবকের হাত ধরে

কামারশালায় জিপসিরা
কাঁদে আর তারপর চেঁচায়
বাতাস লক্ষ রাখে লক্ষ রাখে
বাতাস চাঁদের দিকে লক্ষ রাখে
----------------------------------------------------------------------------------------------------
অবিশ্বস্ত গৃহিণী
মেরি পিসের জন্য
তারপর আমি ওকে নদীতে নিয়ে গেলুম
নিশ্চিত যে ও অক্ষতযোনি
যদিও ওর একজন স্বামী ছিল ।
জুলাইয়ের চতুর্থ শুক্রবারে,
কথা দেবার মতন নির্দিষ্ট।
রাস্তার আলোগুলো উবে যাচ্ছিল
আর জোনাকিরা জ্বলে উঠছিল ।
শহরের শেষ বাঁকে
আমি ওর ঘুমন্ত বুক আদর করলুম।
তারা হঠাৎ কুসুমিত হয়ে উঠল
হায়াসিন্থের ডগার মতন
আর ওর পেটিকোটের মাড়
আমার কানে রেশমের মতন হইচই তুললো
ডজনখানেক ব্লেডে চেরা ।
পাইনগাছগুলো, তাদের জ্যোতি
রুপোর, বাদ দিয়ে, বিশাল হয়ে উঠলো
আর কুকুরের দিগন্ত
নদী থেকে বহুদূর কান্না শোনাতে লাগলো ।

জামগাছের পাশ দিয়ে,
নলখাগড়া আর কাঁটাঝোপ,
যুবতীর এলোচুলের তলায়
আমি বালিতে ডুব দিলুম ।
আমি খুলে ফেললুম আমার গলার রুমাল।
যুবতী ওর পোশাকের বাঁধন খুলে ফেলল।
আমি আমার পিস্তল আর তার খাপ,
ও নিজের কাপড়কানির পরত…
রজনীগন্ধা নয়, খোল নয়,
মসৃণতার অর্ধেকের মতন ত্বক
আয়নার কাচের মতনও নয়
চকমকানির অর্ধেক আছে।
ওর নিতম্ব আমার জন্যে পাখনা নাড়ালো
এক জোড়া সচকিত পোনামাছের মতন:
একটা পুরো আগুনময়
আরেকটা ঠাণ্ডায় ভরপুর ।

সেই রাতে আমি হয়তো
বরং চাপতুম
পথগুলোর মধ্যে বেছে নিয়ে
মুক্তো রঙের ঘোটকীর পিঠে
লাগাম আর রেকাব ছাড়াই।
যেহেতু আমি একজন ভদ্রলোক,
আমি সেসব টুকরোকথা বলব না
যা যুবতী ফিসফিস করে বলেছিল।
সেখানেই ভোর হয়ে এলো
আমার ঠোঁটে কামড়ের দাগ নিয়ে।
চুমু আর কাদায় নোংরা
আমি ওকে নদী থেকে নিয়ে গেলুম
আর লিলিফুলের ফলক
বাতাসের সঙ্গে লড়ছিল ।

আমি তেমন আচরণই করেছিলুম
আমার মতন বজ্জাত যেমন করবে।
আমি ওকে বড়ো খালুই দিতে চাইলুম
খড়ের রঙের সাটিনের তৈরি ।
আমার ইচ্ছে ছিল না ওর প্রেমে পড়ার।
ওর তো একজন স্বামী আছে,
যদিও ও তখনও অক্ষতযোনি
যখন ওকে নদীতে নিয়ে গেলুম ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------
সন্ধ্যার দুটি চাঁদ
আমার বোনের বন্ধু, লরিতার জন্য
চাঁদ মৃত মৃত
---বসন্তকালে তা জীবনে ফিরবে
যখন দখিনা এক বাতাস
পপলারের ভ্রুকে এলোমেলো করে দেবে
যখন আমাদের হৃদয় দীর্ঘশ্বাসের শষ্য ফলায়
ছাদগুলো যখন ঘাসের টুপি পরে থাকে
চাঁদ মৃত মৃত
---বসন্তকালে তা জীবনে ফিরবে
আমার বোন, ইসাবেলার জন্য
সন্ধ্যা ঘুমপাড়ানি গান গায়
কমলালেবুর জন্য

আমার ছোট্ট বোন গায়
“পৃথিবী একটা কমলালেবু”

চাঁদ ফুঁপিয়ে বলে
“আমি কমলালেবু হতে চাই”

হতে পারবে না তুমি -- আমার আদুরি --
তুমি গোলাপি হয়ে গেলেও
কিংবা সামান্য পাতিলেবু
কতো দুঃখের !

তোমার একটা চুমু পাবার জন্য    
তোমার একটা চুমু পাবার জন্য
আমি কিই বা দেবো
একটা চুমু যা তোমার ঠোঁট থেকে বিপথে গিয়েছিল
ভালোবাসার প্রতি মৃত
আমার ঠোঁট স্বাদ পায়
ছায়াদের কাদা
তোমার কালো চোখের দিকে তাকাবার জন্য
আমি কিই বা দেবো
রামধনু তামড়ির ভোর
ঈশ্বরের সামনে নিজেকে মেলে ধরছে---
নক্ষত্রগুলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে
মে মাসের এক সকালে
আর তোমার পবিত্র উরুতে চুমু খাবার জন্য
আমি কিই বা দেবো
আকরিক গোলাপী স্ফটিক
সূর্যের পলল
----------------------------------------------------------------------------------------------------
ছোটো নগরচত্বরের গাথাসঙ্গীত
খোকাখুকুর গান
রাতের নৈঃশব্দে :
স্রোতোস্বিনীর আলো, আর
ঝর্ণার শান্তি !
খোকাখুকুরা তোমাদের হৃদয়ে কিসে পূর্ণ
দৈব আনন্দে  ?
আমি ঘণ্টাঘরের এক নিনাদ,
অস্পষ্টতায় হারিয়ে গেছি।
খোকাখুকুরা গান গেয়ে আমাদের ছেড়ে যাও
এই ছোটো নগরচত্বরে ।
স্রতোস্বিনীর আলো, আর
ঝর্ণার শান্তি !
কী ধরে আছো তুমি
তোমার বসন্তকালের হাতে ?
আমি রক্তের এক গোলাপ, আর
শাদার লিলিফুল ।
খোকাখুকুরা জলে ডুব দেয়
প্রাচীনকালের গানের ।
স্রোতিস্বিনীর আলো, আর
ঝর্ণার শান্তি !
তোমাদের জিভ কি অনুভব করে,
লাল আর তৃষ্ণার্ত ?
আমি হাড়ের এক স্বাদ
আমার চওড়া কপালের ।
খোকাখুকুরা স্হির জল পান করে
প্রাচীনকালের গানের ।
স্রোতোস্বিনীর আলো, আর
ঝর্ণার শান্তি !
কেন তোমরা অনেক দূরে চলে যাও
এই ছোটো নগরচত্বর থেকে ?
আমি খুঁজতে যাই পূর্বজগদ্বাসী জ্ঞানীদের
আর রাজকুমারীদের ।
খোকাখুকুরা যারা তোমাকে সেখানের পথ দেখিয়েছিল,
তা কবিদের পথ ?
আমি স্রোতোস্বিনীর উৎস
প্রাচীনকালের গান ।
খোকাখুকুরা তোমরা কি অনেক দূরে চলে যাও
পৃথিবী আর সমুদ্র থেকে ?
আমি আলোয় পরিপূর্ণ, রয়েছে
রেশমের তৈরি আমার হৃদয়, আর
ঘণ্টাগুলো যা হারিয়ে গেছে,
মৌমাছির সঙ্গে লিলিফুলের সঙ্গে,
আর আমি বহুদূরে চলে যাবো,
ওখানে ওই পাহাড়গুলোর পেছনে,
নক্ষত্রের আলোর কাছে,
যিশুকে সেখানে প্রশ্ন করার জন্য
হে নাথ, আমাকে ফিরিয়ে দাও
আমার শিশুর আত্মা, প্রাচীন,
কিংবদন্তিতে ভরা,
পালকের টুপিতে,
আর কাঠের তরোয়াল নিয়ে ।
খোকাখুকুরা তোমরা আমাদের গাইতে গাইতে ছেড়ে যাও
এই ছোটো নগরচত্বরে ।
স্রোতোস্বিনীর আলো, আর
ঝর্ণার শান্তি !
বিশাল চোখের তারা
রোদে পোড়া খেজুরপাতার
বাতাসে হাহত, ওরা
মৃত পাতার জন্য কাঁদে ।

অশ্বারোহীর গান
করদোবা।
বহু দূরে, আর একা ।
পূর্ণিমা, কালো ঘোড়া,
আমার জিনের পাশে অলিভ ।
যদিও আমি সব রাস্তাঘাট চিনি
আমি কখনও করদোবায় পৌঁছোতে পারব না ।
মৃদুমন্দ হাওয়ার ভেতর দিয়ে, উপত্যকা বেয়ে,
লাল চাঁদ, কালো ঘোড়া।
মৃত্যু আমার দিকে তাকাচ্ছে
করদোবার মিনারগুলো থেকে ।
ওহে, কতো দীর্ঘ এই পথ !
ওহে, আমার সাহসী ঘোড়া !
ওহে, মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে,
আমি করদোবা পৌঁছোবার আগেই।
করদোবা ।
বহু দূর, আর একা ।

এটা সত্যি
ওগো, যে ব্যথা আমি সয়েছি
তোমাকে ভালোবাসতে যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি।
তোমাকে ভালোবাসার জন্য, বাতাস, এটা ব্যথা দেয়,
আর আমার হৃদয়,
আর আমার টুপি, তারা ব্যথা দেয়।
কে-ই বা আমার থেকে কিনবে,
এই রিবন যেটা ধরে আছি,
আর কাপড়ের দুঃখ,
শাদা, যা দিয়ে রুমাল তেরি হবে ?
ওগো, যে ব্যথা আমি সয়েছি
তোমাকে ভালোবাসার জন্যে যেমন তোমাকে ভালোবাসি !

নিষ্ফলা কমলালেবু গাছের গান

কাঠুরিয়া ।
আমার ছায়াকে কেটে ফ্যালো ।
এই অত্যাচার থেকে আমাকে মুক্তি দাও
আমাকে নিষ্ফলা দেখার ।
আমি কেন আয়নাদের মাঝে জন্মেছিলুম?
দিনের আলো আমার চারিপাশে ঘোরে ।
আর রাত নিজেই আমার পুনরাবৃত্তি করে
তার যাবতীয় নক্ষত্রপূঞ্জে ।
আমি বেঁচে থাকতে চাই নিজেকে না দেখে।
আমি খোসা আর কীটদের স্বপ্ন দেখবো
আমার স্বপ্নে বদলে যাচ্ছে
আমার পাখিতে আর লতাপাতায়।
কাঠুরিয়া ।
আমার ছায়াকে কেটে ফ্যালো ।
এই অত্যাচার থেকে আমাকে মুক্তি দাও
নিজেকে নিষ্ফলা দেখার ।

চাঁদ জেগে থাকে
চাঁদ যখন পাল তুলে বেরিয়ে যায়
ঘণ্টাধ্বনি মিইয়ে যায় স্হিরতায়
আর দেখা দেয় পথরেখা
যার মধ্যে যাওয়া যায় না ।
চাঁদ যখন পাল তুলে বেরিয়ে যায়
পৃথিবীর পৃষ্ঠতলকে লুকিয়ে ফ্যালে জল,
হৃদয় নিজেকে দ্বীপের মতন অনুভব করে
শাশ্বত নৈঃশব্দে ।
কেউই কমলালেবু খায় না
চাঁদের প্রাচুর্যের তলায় ।
খাওয়া ঠিক কাজ, তাহলে
সবুজ আর শীতল ফল ।
চাঁদ যখন পাল তুলে বেরিয়ে যায়
একই রকমের একশো-মুখসহ,
রুপোর তৈরি পয়সাগুলো
তোমার পকেটে ফোঁপায় ।

বিদায়
আমি মরে যাচ্ছি,
বারান্দাটা খোলা রাখো ।
বাচ্চাটা কমলালেবু খাচ্ছে ।
( বারান্দা থেকে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি ।)
ফসলকাটিয়ে যবের ফসল তুলছে ।
( বারান্দা থেকে, আমি তাকে শুনতে পাচ্ছি ।)
আমি মরে যাচ্ছি,
বারান্দাটা খোলা রাখো ।

স্বপ্নচর রোমান্স
সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
সবুজ বাতাস, আর সবুজ গাছের শাখারা ।
সমুদ্রে অন্ধকার জাহাজ
আর পাহাড়ে ঘোড়াটা ।
মেয়েটির সঙ্গে যার কোমর ছায়ায় গড়া
উঁচু বারান্দায় স্বপ্ন দেখি,
সবুজ মাংস, আর সবুজ বিনুনি,
আর জমাট রুপোর চোখ ।
সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
জিপসিদের চাঁদের তলায়
নিঃশব্দ জিনিসেরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে
জিনিসগুলো যা মেয়েটি দেখতে পায় না ।
সবুজ, আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
শাদা তুহিনের বিশাল নক্ষত্রদল
সকালের পথ খুলে দিচ্ছে ।
ডুমুরগাছ গা ঘষছে ভোরের বাতাসে
তার শাখাদের কর্কশ কন্ঠস্বরে,
আর পাহাড় বিড়ালের মতন চোর
তার খামখেয়ালি চোরকাঁটায় রাগ দেখাচ্ছে ।
কে আসছে ? আর কোথা থেকে…?
মেয়েটি উঁচু বারান্দায় অপেক্ষায়,
সবুজ মাংস আর সবুজ বিনুনি,
স্বপ্ন দেখছে তেতো সমুদ্রের ।
--’বন্ধু, ভাই, আমি অদলবদল করতে চাই
আমার ঘোড়ার সঙ্গে তোমার বাড়িকে,
তোমার আয়নার জন্য বিক্রি করব আমার জিন,
তোমার কম্বলের বদলে আমার ছোরা ।
প্রিয় ভাই আমার, আমি এসেছি রক্তাক্ত
কাবরা’র গিরিপথ ধরে ।’
--’ যদি পারুম, আমার যুববন্ধু,
তাহলে দরদস্তুর করতে পারতুম,
কিন্তু আমি আর আমি নই,
আর এই বাড়িটা আমার, আমার নয়।’
--’বন্ধু, ভাই, আমি এখন মরতে চাই,
আমার বিছানার সাজসজ্জায়,
লোহার তৈরি, যদি তা পারা যায়,
মিহিন ক্যামব্রিক কাপড়ের চাদরে ।
তুমি কি আমার জখম দেখতে পাচ্ছ
আমার গলা থেকে হৃদয় পর্যন্ত ?’
--’তিনশো লাল গোলাপ
তোমার শাদা জামায় এখন ।
তোমার রক্ত থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে আর চুইছে,
তোমার রক্তবর্ণ কাটা থেকে ।
কিন্তু আমি আর আমি নই,
আর এই বাড়ি আমার, আমার নয় ।’
--’তাহলে আমাকে, অন্তত, ওখানে চড়তে দাও,
উঁচু বারান্দার দিকে ।
আমাকে চড়তে দাও, আমাকে ওখানে চড়তে দাও,
উঁচু সবুজ বারান্দায় ।
চাঁদের আলোয় তৈরি উঁচু বারান্দা,
যেখান থেকে শুনতে পাচ্ছি জলের আওয়াজ ।’
এবার ওরা আরোহণ করে, দুই সহযোগী,
ওপরে উঁচু বারান্দায়,
রক্তের ফোঁটা ঝরাতে ঝরাতে
চোখের জলের রেখা ফেলতে-ফেলতে ।
ভোরের ছাসগুলোয়,
কাঁপে, টিনের ছোতো লন্ঠন ।
স্ফটিকের হাজার খঞ্জনি
ভোরের আলোকে জখম করেছে ।
সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।
সবুজ বাতাস, আর সবুজ গাছের শাখারা ।
ওরা ওপরে আরোহণ করল, দুই সহযোগী ।
মুখের ভেতরে, অন্ধকার আওয়া
এক অদ্ভুত গন্ধ রেখে গেলো,
হীরাকষ, আর পুদিনা, আর মিষ্টি তুলসীপাতার।
--’বন্ধু, ভাই ! মেয়েটি কোথায়, আমাকে বলো,
মেয়েটি কোথায়, তোমার তেতো সুন্দরী ?
প্রায়ই তো, মেয়েটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছে !
প্রায়ই তো, মেয়েটি অপেক্ষা করতে পারতো,
শীতল মুখাবয়ব, আর অন্ধকার এলোচুলে,
এই সবুজ বারান্দায় !’
জলাধারের ঢাকনার ওপরে
জিপসি মেয়েটা দোল খাচ্ছিল ।
সবুজ মাংস, সবুজ এলোচুল
জমাট রুপোর চোখ ।
চাঁদের আলোর তৈরি বরফরশ্মি
ওকে জলের ওপরে তুলে ধরে আছে।
রাত কতো অন্তরঙ্গ হয়ে এলো,
এক ছোটো, লুকোনো বাজারের মতন ।
মাতাল সিভিল গার্ডরা টোকা দিচ্ছে,
টোকা দিচ্ছে, দরোজা চৌকাঠে টোকা দিচ্ছে ।
সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
সবুজ বাতাস, আর গাছের সবুজ শাখারা ।
সমুদ্রে অন্ধকার জাহাজ,
আর পাহাড়ের ওপরে ঘোড়া ।



অপ্রত্যাশিত প্রেমের হরিণ
কেউই বুঝতে পারেনি সুগন্ধ
তোমার তলপেটের ম্যাগনিলোয়া ছায়াকে ।
কেউই জানে না তুমি সম্পূর্ণ পিষে দিয়েছ
তোমার দাঁতের মাঝে প্রেমের টুনটুনি পাখিকে ।
এক হাজার ছোটো পারস্যের ঘোড়া ঘুমিয়েছিল
তোমার কপালের চাঁদের আলোর বাজারে,
যখন কিনা, চার রাত ধরে, আমি জড়িয়ে ধরেছিলুম
তোমার কোমর, তুষারপাতে সে শত্রু ।
পলেস্তারা আর জুঁইফুলের মাঝে,
তোমার দৃষ্টি ছিল ফ্যাকাশে এক শাখা, বীজপ্রসূ ।
আমি তোমাকে দেবার চেষ্টা করলুম, আমার বুকের হাড়ে,
হাতির দাঁতের অক্ষরে যা বলছিল ‘চিরকাল’।
চিরকাল, চিরকাল । আমাকে অত্যাচারের বাগান,
তোমার দেহ, আমার কাছে থেকে চিরকালের জনভ বিদায় নেয়,
তোমার শিরার রক্ত এখন আমার মুখে,
ইতিমধ্যে আমার মৃত্যুতে আলোমুক্ত ।


গোলাপের গীতিকাব্য
গোলাপ
সকালের খোঁজ করছিল না :
তার শাখায়, প্রায় অবিনশ্বর,
তা অন্যকিছু চাইছিল ।
গোলাপ
জ্ঞানের খোঁজ করছিল না, কিংবা ছায়ার :
মাংসের কিনার আর স্বপ্ন দেখছিল
তা অন্যকিছু চাইছিল ।
গোলাপ
গোলাপের খোঁজ করছিল না,
স্বর্গে ছিল অবিচলিত
তা অন্যকিছু চাইছিল ।


অন্ধকার পায়রাদের গীতিকাব্য
জলপাই গাছের শাখার ভেতর দিয়ে
আমি অন্ধকারে দুটি পায়রা দেখতে পেলুম।
একটা ছিল সূর্য’ আরেকটা ছিল চাঁদ ।
আমি বললুম : ‘ছোট্ট প্রতিবেশীরা
আমার সমাধিফলক কোথায় ?’
‘আমার লেজের পালকে,’ বলল সূর্য ।
‘আমার গলায়,’ বলল চাঁদ।
আর আমি যে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল
আমার শরীরে পৃথিবীকে জড়িয়ে নিয়ে,
শাদা তুষারে গড়া দুটো ঈগল দেখতে পেলো,
আর একটি মেয়ে যে ছিল নগ্ন ।
আর একজন ছিল অন্যজন,
আর মেয়েটি, সে দুটির কিছুই ছিলনা ।
আমি বললুম, ‘ছোট্ট ঈগলরা
আমার সমাধিফলক কোথায় ?’
‘আমার লেজের পালকে,’ সূর্য বলল ।
‘আমার গলায়,’ চাঁদ বলল ।
জলপাই গাছের শাখার ভেতর দিয়ে,
আমি দুটো পায়রাকে দেখতে পেলুম, দুটোই নগ্ন ।
আর একজন ছিল অন্যজন,
আর দুজন কিছুই ছিল না ।



ওহে অন্ধকার প্রেমের গোপন কন্ঠ
হে লুকোনো ভালোবাসার গোপন কন্ঠস্বর !
হে পশাম ছাড়াই ভেড়ার ডাক দিচ্ছ ! হে জখম !
হে শুকনো চিরহরিৎ-গুল্ম, তেতো ছুঁচ !
হে সমুদ্রহীন স্রোত, দেয়ালহীন শহর !
হে শাণিত পরিলেখে গড়া বিশাল রাত,
স্বর্গীয় পর্বতমালা, সরু উপত্যকা !
হে হৃদয়ের ভেতরের কুকুর, কন্ঠস্বর উবে যাচ্ছে,
সীমাহীন স্তব্ধতা, পূর্ণবিকশিত রামধনু !
আমাকে হতে দাও, হিমশৈলের উষ্ণ কন্ঠস্বর,
আর আমাকে বিলুপ্ত হতে বোলো না
জংলিঘাসে, যেখানে আকাশ আর মাংস ফলহীন ।
চিরতরে ছেড়ে চলে যাও আমার হাতির দাঁতের করোটি,
আমাকে দয়া করো । অত্যাচার বন্ধ করো !
হে আমিই প্রেম, হে আমিই প্রকৃতি ।

প্রতিটি গান
প্রতিটি গান
অবশিষ্টাংশ
ভালোবাসার ।
প্রতিটি আলো
অবশিষ্টাংশ
সময়ের ।
একটা গিঁট
সময়ের ।
আর প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস
অবশিষ্টাংশ
এক কান্নার ।


No comments:

Post a Comment