Thursday, May 30, 2019

ফ্রেডরিক নিৎশে-র কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

   

ফ্রেডরিক নিৎশে-র কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

সমবেত সম্বোধনগীতি               

হে জীবনের দুপুর ! উৎসব-পালনের সময় !
ওহ গ্রীষ্মের বাগান !
অস্হির আনন্দ ঠায় দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে, অপেক্ষায় :--       
আমি বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করি, দিন আর রাতে তৈরি থাকি ।
তোমরা বন্ধুগণ, কোথায় আছো ? এসো ! সময় হয়ে গেছে ! সময় হয়ে গেছে !
তোমাদের জন্যই নয়কি হিমবাহের ধূসরতা
আজকে গোলাপ দিয়ে নিজেদের সাজিয়েছে ?
স্রোতস্বিনী তোমাকে চাইছে, এবং বাতাস ও মেঘদল
আকাঙ্খায় নিজেদের নীলাকাশের উচ্চতায় আজকে নিয়ে যাচ্ছে
পাখি-দেখা দৃষ্টির চেয়ে বহুদূরে তোমার খোঁজে ।
তোমার জন্য শীর্ষে সাজানো হয়েছে আমার টেবিল ।
নক্ষত্রদের অতো কাছে কে থাকে ?
আশাহীন অতলের কাছে পৌঁছোবার জন্য কে রয়েছে ?
আমার এলাকা--কোন এলাকা এতো দূর প্রসারিত ?
আর আমার মধু -- কে তার স্বাদ নিয়েছে ?....

এসে পড়েছ, বন্ধুরা ! --- হায়, আমি সেই লোক নই,
যাকে তোমরা খুঁজছ সেই মানুষ কি ?
তুমি ইতস্তত করো, অবাক ! ---আহ, তুমি ক্রুদ্ধ হলে ভালো হতো !
আমি কি আর সেই লোক নই ? এক বদলে-যাওয়া হাত, শান্তি, আর মুখ ?
আর আমি তাহলে কি --- বন্ধুগণ তোমাদের কাছে কি সেই মানুষ নই ?

আমি কি অন্যলোক হয়ে গেছি ? নিজের কাছে আগন্তুক ?
আমি কি নিজের অন্তরজগত থেকে উৎসারিত ?
একজন কুস্তিগির যে নিজের বিরুদ্ধে প্রায়ই জেতে ?
প্রায়ই নিজের নিশ্চিত ক্ষমতার বিরুদ্ধতা করে,
নিজের বিজয় দিয়ে আহত ও নিয়ন্ত্রিত ?

আমি তাকিয়ে দেখবো যেখানে বাতাস সুরম্য বয়
আমি কি বেঁচে থাকতে শিখেছি
যেখানে কেউ থাকে না, জনহীন বরফের দেশে
মানুষ আর ঈশ্বরকে ভুলে গিয়ে, অভিশাপ আর প্রর্থনাকে ?
হিমবাহের ওপরে ঘুরে বেড়ায় তেমন এক প্রেত হয়ে গেছি ?

---তোমরা পুরোনো বন্ধুরা ! দ্যাখো ! এখন তোমাদের দৃষ্টি ফ্যাকাশে,
প্রেম আর আতঙ্কে ভরপুর !
না, সরে যাও ! ক্ষুব্ধ হোয়ো না ! তুমি এখানে থাকতে পারো না :
এখানে বরফ আর পাথরের মাঝে বহুদূরের এলাকায়---
এখানে একজনকে শিকারী হতে হবে, কৃষ্ণসার হরিণের মতন ।

আমি হয়ে গেছি এক সিংহ শিকারী ! দ্যাখো, কতো বাঁকা
আমার ধনুক হতে পারে !
সবচেয়ে শক্তিমান মানুষ ছিলাকে এতো টানতে পেরেছিল---
শোচনীয় হতভাগা ! তীর অত্যন্ত বিপজ্জনক--
তীরের মতন --- এখান থেকে দূরে যাও ! তোমাদের নিজেদের ভালোর জন্য !...

তুমি কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছ ? -- ও হৃদয়, তুমি বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করো,
তোমার আশা শক্তি বজায় রাখলো :
নতুন বন্ধুদের জন্য তোমার দরোজা খুলে দাও !
পুরোনোদের যেতে দাও ! স্মৃতিকেও যেতে দাও !
কখনও তুমি যুবক ছিলে, এখন তুমি আরও বেশি যুবক !

কি তখন আমাদের বন্ধন ছিল, আশার বাঁধন--
চিহ্ণগুলো কে বুঝতে পারে,
প্রেম সেখানে একবার খোদাই করেছিল -- এখন ফ্যাকাশে ?
আমি তার সঙ্গে পশুচামড়ায় লেখার তুলনা করি যাতে হাত
তাতে দিতে ভয় পায় --সেই রঙহীন, পুড়িয়ে ফেলার মতন ।

আর বন্ধু নয় -- ওরা...কিন্তু কেমন করে আমি তার নামকরন করব ?--
স্রেফ বন্ধু প্রেতের দল !
যারা রাতে আমার জানালায় আর হৃদয়ে টোকা দেয়,
আমার দিকে তাকায় আর বলে, ‘কিন্তু আমরা তো বন্ধু ছিলুম ?’--
---ও শিহরিত শব্দ, একদা গোলাপের মতন সুগন্ধিত !

ও যৌবনের আকুল আকাঙ্খা যা নিজেকে ভুল বোঝে !
যা অনুভবে প্রকাশিত হয়েছিল,
আমি যাকে ভেবেছিলুম আমার আত্মীয়ে পরিবর্তিত,
তারা বুড়ো হয়ে গেছে, নিজেদের নির্বাসন দিয়েছে ।
কেবল যে বদলে যায় সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে ।

ও জীবনের দুপুর ! আরেক দ্বিতীয় যৌবনের সময় !
ওহ গ্রীষ্মের বাগান !
অস্হির আনন্দ ঠায় দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে, অপেক্ষায় !
আমি বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করি, দিন আর রাতে তৈরি থাকি ।
তোমরা বন্ধুগণ, কোথায় আছো, এসো ! সময় হয়ে গেছে ! সময় হয়ে গেছে !

গান ফুরিয়ে গেছে -- আকুল আকাঙ্খার মিষ্টি কান্না
আমার মুখের ভেতরে মারা গেছে :
তা করেছে এক জাদুকর, সঠিক সময়ে এক বন্ধু,
দুপুরবেলার বন্ধু --- না ! জানতে চাইবেন না সে কে হতে পারে--
দুপুরবেলাতেই একজন বদলে দুজন হয়ে গেল...

এখন আমরা উৎসবপালন করি, বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত, একত্র,
ভোজনোৎসবের ভোজনোৎসব :
বন্ধু জরাথুষ্ট্র এলেন, অতিথিদের মাঝে অতিথিতম !
এখন পৃথিবী হাসে, আতঙ্কের পর্দা ছিন্ন হয়,
আলো আর অন্ধকারের জন্য বিবাহের আগমন হয়….

উন্মাদের রূপক   
আপনি কি সেই উন্মাদের কথা শোনেননি
যে এক উজ্বল সকালবেলায়  লন্ঠন জ্বালিয়েছিল   
দৌড়ে গিয়েছিল বাজারে, আর অবিরাম চিৎকার করেছিল :
‘আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি ! আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি !
অনেকে যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো না
সেখানে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল,   
লোকটা হাসির খোরাক হয়ের উঠল ।
ও কি  হারিয়ে গেছে ? একজন জিগ্যেস করল ।
ও কি বাচ্চাদের মতন পথ হারিয়েছে ? জানতে চাইল আরেকজন ।
নাকি ও লুকিয়ে আছে ?
ও কি আমাদের ভয় পায় ? ও কি ভ্রমণে বেরিয়েছে ? অন্য দেশে পাড়ি মেরেছে ?
এইভাবে তারা চেঁচামেচি আর হাসাহাসি করল ।
উন্মাদ লোকটা তাদের মাঝে লাফিয়ে চোখ সরু করে দেখল
‘ঈশ্বর কোথায় ?’ লোকটা বলল চেঁচিয়ে ; ‘আমি তোমাদের বলছি।
আমরা তাকে খুন করেছি -- তোমরা আর আমি ।
আমরা সকলে তার হত্যাকারী ।
কিন্তু কেমন করে আমরা তা করলুম ?
কেমন করে আমরা সমুদ্রকে পান করে ফেললুম ?
সম্পূর্ণ দিগন্ত মুছে দেবার কাপড় কে আমাদের দিলো ?
আমরা তখন কি করছিলুম যখন পৃথিবীকে সূর্য থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করলুম ?
এটা কি এখনও গতিশীল ? আমরা কি গতিশীল ?
সূর্য থেকে দূরে ?
আমরা কি অবিরাম ঝাঁপিয়ে পড়ছি না ?
পেছনদিকে, পাশে, সামনে, চতুর্দিকে ?
এখনও ওপর আর নীচে বলে কিছু আছে ?
আমরা কি বিপথগমন করছি না, যেন অনন্তকালীন শূন্যের ভেতর দিয়ে ?
আমরা কি শূন্যতার শ্বাস অনুভব করছি না ?
এটা কি ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি ? এটা কি চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে কাছে আসছে না ?
আমাদের কি সকালবেলায় আলোর লন্ঠনের দরকার নেই ?
আমরা কি কবর-খুঁড়িয়েদের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না যারা ঈশ্বরকে গোর দিচ্ছে ?
আমরা কি ঈশ্বরের পচে যাবার দুর্গন্ধ পাচ্ছি না ?
ঈশ্বররাও পচে যান ।
ঈশ্বর মৃত ।
ঈশ্বর মরে পড়ে আছেন ।
আর আমরা তাকে খুন করেছি ।

‘আমরা কেমন করে নিজেদের সান্ত্বনা দেবো, খুনিদের চেয়েও বড়ো খুনি ?
যাকে আমরা সবচেয়ে পবিত্র আর সর্বশক্তিমান বলে পৃথিবী এতোকাল জানতো সে আমাদের ছুরিতে রক্তে ভেসে গিয়ে মারা গেছে ; কে আমাদের গা থেকে এই রক্ত ধুয়ে দেবে ?
কোন জল আছে যা দিয়ে আমরা নিজেদের ধুয়ে পরিষ্কার করতে পারব ?
প্রায়শ্চিত্তের কোন উৎসব, কোন পবিত্র খেলা আমরা আবিষ্কার করব ?
এই কাজের মহানতা কি আমাদের জন্য অনেক বেশি মহান নয় ?
আমরা কি নিজেরাই দেবতা হয়ে যাবো যাতে কেবল তার সমকক্ষ দেখায় ?
এর চেয়ে মহান কাজ আর হয়নি : আর যারা আমাদের পরে জন্মাবে--
এই কাজের জন্য তারা আমাদের তুলনায় উৎকৃষ্ট ইতিহাসের অংশ হবে ।’

এরপর উন্মাদ লোকটা কথা বন্ধ করে তার শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে দেখল;
আর তারাও, লোকটার দিকে নিঃশব্দে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
শেষে লোকটা লনহঠন ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিলো,
ভেঙে চুরমার করে ফেললো আর নিভে গেলো।

‘আমি অনেক আগে এসে গেছি।’ লোকটা বলল ; ‘আমার সময় এখনও আসেনি।
এই ভয়ঙ্কর ঘটনা আসতে চলেছে, এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে ;
তা এখনও মানুষের কানে পৌঁছোয়নি ।
বজ্র আর বিদ্যুতের সময় দরকার হয় ;
নক্ষত্রের আলোর সময় দরকার হয় ;
কাজ, হয়ে গেলে, তা শোনার আর দেখার সময় দরকার ।

এই কর্মকাণ্ড সবচেয়ে দূরের নক্ষত্রের চেয়েও অনেক দূরে রয়ে্ছে---
অথচ তারা তা নিজেরাই করে ফেলেছে ।

আরও বলা হয়েছে যে সেই দিনেই
উন্মাদ লোকটা জোর করে অনেক গির্জায় ঢুকে পড়েছিল
আর সেখানেই শুনিয়েছিল মৃতের আত্মার শান্তির জন্য গান ।
হিসাবরক্ষককে ডেকে তাকে বাইরে বের করে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সে প্রতিবার একই উত্তর দিয়েছিল :
‘এই গির্জাগুলো এখন কোন কাজ করে
যদি না তা ঈশ্বরের সমাধি আর তাঁকে এখানে সমাহিত করা হয়ে থাকে ?’

Wednesday, May 29, 2019

পল ভালেরি-র কবিতা ( ১৮৭১ - ১৯৪৫ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী




পল ভালেরি’র কবিতা ( ১৮৭১ - ১৯৪৫ )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
       
তন্বীপরী
অদেখা অজানা,
আমি সুগন্ধ
বাতাসের ওপরে জন্মেছি,
ফভাকাশে, বেঁচে আছি !
অদেখা অজানা,
প্রতিভা না সৌভাগ্য ?
যখনই এসে পড়ো
কাজ হয়ে যায় !
অপঠিত অনুপলব্ধ,
সর্বশ্রেষ্ঠ মন
সেখানে হোঁচট খাবে !
অদেখা অজানা,
বুকের উঁকি
ঢিলে পোশাকের ফাঁক দিয়ে !

ভুল মৃত্যু

হৃতমান, অভিমানী, চমৎকার সমাধির গায়ে,
           অননুভূত স্মৃতিসৌধ
যা ছায়ার বাইরে, পাতঝোপে, প্রেমোৎসর্গ করেছিল
           তোমার বিষণ্ণ মাধুর্য জাদুবিস্তার করেছে
আমি পড়ি যাই, মারা যাচ্ছি তোমার পাশে, মারা যাচ্ছি -- তবু,
নীচু কবরে পড়ে যেতেই
যার বাগানে ছড়ানো ছাই আমায় ডাক দেয়,
তার প্রতীয়মান মৃত্যুতে জীবন আরেকবার জেগে ওঠে ;
মেয়েটি স্পন্দিত হয়, আলতো চোখ মেলে ধরে, আর কামড়ায়,
আর আমার বুক থেকে অন্যান্য মৃত্যুকে মোচড় দিয়ে বের করে
জীবনের চেয়ে মূল্যবান ।

হারিয়ে যাওয়া মদ
একদিন আমি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিলুম
( মনে নেই কেমন আকাশের তলায় )
শূন্যতায় উৎসর্গ করার মতন,
দামি মদের যতোটা বাকি ছিল তার পুরোটা…
কে তোমার ক্ষতির নির্দেশ দিয়েছিল, হে সুরাসার ?
স্বর্গ কি আমার হাতকে প্ররোচিত করেছিল ?
হয়তো আমার হৃদয়ের আচ্ছন্নতা,
রক্তের স্বপ্ন দেখে, মদ চলকে ফেলেছিল ?
কিছুক্ষণের জন্য গোলাপি উদ্গীরণ হয়েছিল
ধোঁয়ার, আর তারপর সমুদ্র হয়ে উঠল
স্বচ্ছ, যেমন আগে থেকে ছিল…
মদ হারিয়ে গেল...ঢেউগুলো মাতাল !
আমি দেখতে পেলুম অস্বাভাবিক আকৃতিরা
তিক্ত বাতাসে লাফিয়ে উঠছে...

মৌমাছি
তোমার হুল যতোই ধারালো হোক,
যতোই মারাত্মক, হলুদ মৌমাছি,
আমার ডালাকে ঢেকে রেখেছি
ভাসমান লেসের সহজ স্বপ্ন দিয়ে ।
অতএব ফোলা লাউয়ে হুল ফোটাও, আমার বুক
প্রেম যেখানে ঘুমিয়ে আছে, কিংবা মারা গেছে।
আমার আমি যৎসামান্য উঠে যাবে
লাল থেকে ফোলা, দ্রোহী মাংস !
এক আচমকা যন্ত্রণা হল যা আমার প্রয়োজন :
এক যন্ত্রণা যা দ্রুত ঘটে আর মিলিয়ে যায়
আমি চাইবো এই তন্দ্রাময় দুঃখ ।
আমার ইন্দ্রিয়দের দীপ্তিময় করে তুলবো
তোমার সূক্ষ্ম সোনালি সঙ্কেত দিয়ে
যাকে বাদ দিলে প্রেম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় বা মারা যায় !

কৌশলী ইঙ্গিত
ওহ বাঁক যা সর্পিল
গোপন মিথ্যার মতো।
শ্লথতা নয় তা
কি কোমলতম শিল্প ?
আমি জানি কোথায় যাচ্ছি,
তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো,
আমার কালো অভিসন্ধিগুলো
তোমার ক্ষতি করবে না…
( যদিও মেয়েটি হাসে
ঝলমলে গর্বে,
অতো স্বাধীনতা
মাথা খারাপ করে দ্যায় ! )
ওহ বাঁক যা সর্পিল
গোপন মিথ্যার মতো,
আমি তোমায় অপেক্ষা করাবো
কোমলতম শব্দের খাতিরে ।

কোমরবন্ধ
যখন, গালের মতো রক্তিম হয়, আকাশ
শেষ পর্যন্ত চোখের শ্রদ্ধাকে স্বীকৃতি দ্যায়
এবং সময়, সোনালি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে
গোলাপের মাঝে কিছুক্ষণ খেলা করে,
এক ছায়া, ঢিলে কোমরবন্ধ পরে, নাচে
আহ্লাদের নিরবতার মাঝে
অমন ছবি যে প্রেরণা দিয়েছে,
সন্ধ্যা মেয়েটির হেমসেলাইতে টান দিয়েছে।
কোমরবন্ধ, সরল ভেসে চলেছে
বাতাসের শ্বাসের ওঠা-নামায়,
একক সূত্রকে পেঁচিয়ে
যা এই পৃথিবীর সঙ্গে আমার নৈঃশব্দকে বাঁধে ।
অনুপস্হিতি, উপস্হিতি...আমি সত্যিই
ছায়ায় একা, মৃতের চাদরকে লোভ দেখাই ।

সমুদ্রের ধারের গোরস্তান       
“খুঁজো না, আমার আত্মা, অবিনশ্বরদের জীবন;
বরং যা আয়ত্তে তার সমস্ত উপাদানের
আনন্দ নিন” ( পিনডার, ফিথিকস ।।। )
১.
পাইনের ওপর দিয়ে এই মনোরম ছাদ স্পন্দিত হয়
পায়রারা পাল ভাসিয়ে দেয় স্মৃতিমন্দিরের ওই পারে ;   
তখন উদাসীন দুপুর সমুদ্রকে আগুনের সঙ্গে রাংঝালে জুড়ে দ্যায় :       
সমুদ্রের পুনরারম্ভ চিরকাল হবে
কিংবা এক চিন্তার পর ক্ষতিপূরণ দেবে আর আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে
যা পাবার জন্য দেবতারা দীর্ঘ শান্তিময় দৃষ্টি মেলে ধরেন।
সূক্ষভাবে বোনা বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ যা উপভোগ করতে পারে
ক্ষণজীবী ফেনায় অজস্র হীরক,   
আর কোন আপাতশান্তি তা এনে দিতে পারে !   
যখন, গভীর ও গভীরের ওপরে, এক সূর্য থমকে দাঁড়াতে পারে   
তার শাশ্বত কর্তব্যের বিশুদ্ধ কাজে,
সময় ঝলমল করে আর চাহিদা হলো জানার ।
মিনার্ভার স্মৃতিমন্দির, ঐশ্বর্য, সরল নিশ্চয়,   
শান্তির বিস্তার, দেখা যায়, অটল,
ঢেউখেলানো জল । চোখ যা নিজেই ধরে রাখতে পারে
আগুনের ঘোমটার তলায় বহুক্ষণের ঘুম
হে আমার নৈঃশব্দ !...আত্মার কাঠামোয় গড়া,
কিন্তু আকরিকে ঠাশা, সহস্র সোনার পাত ।
আমি সময়ের মন্দির থেকে এক একক দীর্ঘশ্বাস, আরম্ভ করি
বিশুদ্ধতার চূড়ায় পৌঁছোতে আর নিজের ঐক্যবিধানে
ঘিরে-থাকা সমুদ্রের সমগ্র বীথি ;
আর দেবতাদের প্রতি আমার সরাসরি উৎসর্গ
উচ্চতায় শান্তিময় স্ফূলিঙ্গের বীজ বপন করে
যেখানে সর্বময় কর্তৃত্ব সুযোগ করে দ্যায় অবজ্ঞার ।
ফলের মতন, স্বাদ নিলে, আহ্লাদের বিগলিত হয়,
কামড়ের সাথে-সাথে সৃষ্টি করে অনুপস্হিতি,
যখন তার আঙ্গিক ঠোঁটের ওপরে মারা যাচ্ছে,
আমি এখানে ধোঁয়ায় আমার ভবিষ্যতের গন্ধ পাই
কন্ঠরুদ্ধ আত্মাকে যখন ধূসর আকাশ গান শোনায়
নিঃশব্দে কাঁদতে-থাকা স্পন্দিত সমুদ্রতীরে বদল ঘটিয়ে ।
সুন্দর স্বর্গ এবং সত্য, দ্যাখো আমি কেমন বদলে যাই !
অমন গর্বের পরে, যা অতো অদ্ভুত তার পরে,
এক আলস্য অথচ তবু ক্ষমতায় ভরপুর,
অমন পরম শূন্যতায় যেমন আমি পরিত্যক্ত,
মৃতদের বাড়ির ওপরে আমার ছায়া অনুসরণ করতে পারে
এক পথ যা আমায় পোষমানায় যেখানে আমি গিলে ফেলতে পারি ।
আত্মা উত্তরায়ণের আগুনে মেলে ধরে,
আমি তোমাকে সমর্ধন করি, প্রশংসনীয় বিচার
আর তোমার মমতাহীন ছুরির ঔজ্বল্যকে !
বিশুদ্ধ, আমি তোমাকে তোমার প্রাথমিক জায়গায় ফিরিয়ে দিই
নিজের দিকে তাকাও !... কিন্তু অনুমতি দাও আলোকে খুঁজে নেবার
অর্থেক ছায়া তার দুর্বল আড়ালে ।
ও আমার ভেতরে ছাড়াও আমার থেকে আর তারপর,
আমি, কবিতার উৎসে, এর নিশ্চিত হৃদয়,
শূন্যতা ও ঘটনার মাঝে কতো বিশুদ্ধ,
আমার অন্তর্গত খ্যাতির অপেক্ষায় থাকে,
তা প্রতিধ্বনির হৃদ যা, লজ্জায় কর্কশ,
ভবিষ্যতের আত্মায় ফাঁকা মনে হয় !৯
তুমি কি, এই বনানীর নকল বন্দী, জানো
কেমন করে এই সরু ডালগুলো বাইরের ঔজ্বল্যকে গিলে খায়,
কেমন কে গোপনীয়তা আমার বন্ধ চোখ দিয়ে ঝলমল করে ।
কোন ক্ষমতা আমার প্রলম্বিত শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়,
হাড়ের টুকরো পৃথিবীতে তাকে ঝোঁকাতে পারবে ?
একটা স্ফূলিঙ্গ আমাকে ভাবাতে পারে কি হারিয়েছি ।
১০
আগুন গুরুত্বহীন, পবিত্র ও ঘেরাটোপে,
পার্থিব টুকরো আলোয় উন্মুক্ত,
মশাল দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, এই জায়গাটা আমাকে আনন্দ দেয়,
সোনায় গড়া, পাথরের তৈরি আর ছায়াময় বনমাঝে,
যেখানে বহু ছায়ারঙে শ্বেতপাথর কাঁপে ;
আর সেখানে, আমার সমাধিগুলোর ওপরে, ঘুমন্ত, বিনীত সমুদ্র !