Sunday, June 30, 2019

মার্গারেট র‌্যানডাল-এর কবিতা ( ১৯৩৬ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী



মার্গারেট র‌্যানডাল-এর কবিতা ( ১৯৩৬ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
   
পরবর্তী সূর্যের সন্ধানে       
তেওতিহুয়াকানে আমি অসহায় দেখি তুমি পিছলে চলে যাচ্ছ,
চুষে ফেলা, নিয়ে নেয়া
এই সময় থেকে অন্য সময়ে ।   
তুমি আমার পাশে হাঁটো,
ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিরা ভুলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে  
সূর্য আর চাঁদের পিরামিডের মাঝে
মৃতের চওড়া রাস্তা বরাবর,
কিন্তু আমি জানি যে তোমার খোলোস কেবল আমার সঙ্গে থাকে
খড়ির মতন ফ্যাকাশে আর বোবা ।

পরে তুমি বর্ণনার চেষ্টা করো কোথা থেকে পালিয়ে এসেছ
কতো কষ্ট করে : ঝুরঝুরে আর শীতল
দুই সহস্র বছর যা গেছে আর আছে তার মাঝে ।
কেমন করে তুমি সাক্ষীর কাছ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিলে
তোমার হলোগ্রাম চোখদুটো,
একের পর এক বুকের ভেতরে ঢুকে-যাওয়া 
আগ্নেয়শিলার ছুরি, রক্তে জবজবে হৃদয়গুলো
অন্ধকার থেকে আকাশে তোলা
পরবর্তী সূর্যের সন্ধানে ।

দেবতাদের জন্মস্হান, তার মহাগৌরবের মুহূর্তে
পিরামিডের স্পন্দিত শহর
আর প্রজাপতি প্রাসাদসারি,
২০০০০০ ওটোমি, জাপোটেক, মিক্সটেক,
মায়া, নাহুয়া আর টোটোনাকদের বাড়ি,
কারিগরদের, কুমোরদের, 
কোয়েৎজালকোটলের উপাসকরা :
পালকদেহ সাপ যা ওদের দিয়েছিল
সাধারণ জীবনের ঝর্ণা ।

কোনও বীভৎস ব্যাপার এখানে ঘটেছিল,
এটুকুই কেবল তুমি বলতে পারো
যখন তুমি শেষ পর্যন্ত আমার কাছে ফিরে এলে,
কোনও ঘটনা যা বলা যায় না,
আর তুমি তা বললে না
যতদিন না আমাদের কবিবন্ধু মেয়েটি
তার নিজের মৃত্যুর মুখে-পড়া অভিজ্ঞতার কথা বলল
পিরামিডের সর্বোচ্চ শিখরে আটক
নামতে অসমর্থ ।

চাকোতেও তুমি সেই সন্ত্রাস অনুভব করো,
বিশেষ করে পুয়েবলো বোনিতোতে : বিশাল বাড়ি
মাটির তলায় ৬০০টা ঘর রেড ইনডিয়ানদের
গোলাকার অসম্পূর্ণ দেয়াল, ছোটো দরোজা আর উঁচু জানালা
ফ্রেমের মতন উড়ন্ত মেঘদলের সৌন্দর্য ধরে রাখতো
৮০০ বছর আগে যা ঘটেছিল তাকে আড়াল করে রাখা
সেসময়ে যখন এটাই ছিল কেন্দ্র,
পথের মোড় গাণিতিক বাতাসে সর্পিল চলে গেছে ।

আর কেঅন দ্য চেলিতে, নাভাহো ৎসেগিদের সঙ্গে
স্পেনিয়দের ঘোটালা -- “গুহার ভেতরে”
১৮০৫ সালে যেখানে দুটো স্রোতোধারা মেশে
সাক্ষী হিসাবে রয়ে গেছে এক বিধ্বস্ত গুহা ।
আক্রমণকারীরা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের গণহত্যা করল,
আর দুই শতক পরে
তাদের ভয় তোমার দেহে বাস করে,
তুমি নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে নাও,
সেদিন মরুভূমির বাতাসকে চিরে ফেলেছিল আর্তচিৎকার। 


এক হাজার বছরে যদি আমরা এখনও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি
পরবর্তী সূর্যের জন্য
আমি অবাক হবো যদি কোনো পর্যটক আউশউইৎস,
রামাল্লা, বাগদাদ, কাবুল, সোয়েটো, 
মোরাজান, অ্যাকটেল কিংবা পোর্ট-অউ-প্রিন্স প্রমুখ জায়গায়
সেখানে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে জানতে পারেন
তাহলে হয়তো অনুভব করবেন তাঁকে একটা দিকে 
টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে 
তাদের আর আমাদের সময়ের মাঝে, ভয় হয় তাঁরা
এখনও একে আরেকের সঙ্গে যা করি তা থেকে পালাতে পারবেন না ।

মাইনের ভেতরের ক্যানারি পাখি
ড্রেসডেন আর টোকিও, হিরোশিমা, বাগদাদ,
কাবুল, পাইনট্রি রেজ কিংবা সাউথ ব্রংকস,
ক্যানারিদের মনে করা হয়  কোল্যাটারাল ড্যামেজ 
সেই লোকগুলোর কাছে যারা গুলি চালাবার, বোমা ফেলার হুকুম দেয় ।

ও এক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে যা ওরা বলেছিল আমাদের স্বাধীন রাখবে।
এখন বাসা হয়ে গেছে টুকরো সাজাবার ধাঁধা যেখানে অনেক টুকরো নেই।
কেউ আর পুরোনো অবস্হায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না, কেউই নয়
নৈঃশব্দ্য এখন চলমান স্বপ্ন ।

দুই ঘণ্টা পর আর প্রতিটি গোপনতার একটি মিথ্যা বরাদ্দ,
মেয়েটি ভেবেছিল ভেটেরান অ্যাসিসট্যান্স সাহায্য করবে
কিন্তু মহিলা সেনাদের জন্য তেমন সাহায্যের ব্যবস্হা নেই
আর যেখানেই আরোগ্যের প্রতারণা ঘাপটি মেরে আছে সেখানে ধর্ষণ লুকিয়ে।

দেহরক্ষার সাম্প্রতিকতম বর্ম বেশি বিকলাঙ্গের উৎস।
যদি কোথাও কিছু অবশিষ্ট থাকে
তা কৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে ফেরত পাঠিয়ে দাও
পতাকায় মোড়া বাক্সের গরিমায় ।    

যারা বাড়ি ফেরে না তাদের জন্য :    দীর্ঘ নিরবতা,
মেয়েটি কখনও পরিচিত হয়নি এমন প্রিয় মুখগুলো,
কন্ঠস্বরগুলো মেয়েটিকে বলে
ও হলো মাইনের ভেতরের ক্যানারি পাখি   

ডেভিড আর গলিয়াথ     
পাহাড়ের ওপর থেকে সময় গড়িয়ে যায়,
অ্যালাব্যাস্টারের পাতলা চাদর
মরুভূমির পালিশের মতন পোক্ত ।   
ভয় জেগে ওঠে
বুকের হাড় আর হৃদয়ের মাঝে
তার ধাক্কা খাবার অধিকার জানায়
যৎসামান্য রেশসহ
ভিয়েৎনামের জাতীয় সঙ্গীতের ।   
সময় আর সঙ্গীতের পংক্তি
আমার সংস্কৃতি থেকে এতো বিচ্ছিন্ন
মনে হয় পর্যটক পাখিদের
মিল নেই এমন এক জুটি 
আর আমি স্মৃতির টুকরো ওছলাই
লাইনাস কম্বলের ওপরে
---লূতাতন্তু-আলো এখনও জড়িয়ে
প্রতিটি অমীমাংসিত পুরস্কারে ।   

ভিয়েৎনাম : ডেভিড আর গলিয়াথ
আমার প্রজন্মের ।
প্রতিটি ন্যায়নিষ্ঠ সংঘর্ষ
লোভ ও দোষের দেবতাদের বিরুদ্ধে,
প্রতিটি নারী ব্যবহৃত ও অপব্যবহৃত
কেবল তারা নারী বলে,
প্রতিটি ক্ষুধার্ত শিশু
বাড়ি সম্পর্কে আতঙ্কিত ।

ধূর্ততা ছদ্মবেশ পরে থাকে শুশ্রুষার,
মানচিত্রে ঘুরে বেড়ায় পথগুলো
যতক্ষণ না তারা টলতে-টলতে কিনারায় গিয়ে পড়ে যায়
খেলার বিশাল টেবিল থেকে ।
বরফের অদৃশ্য ফালি
ত্বকের তলায় গর্ত করে
যা কেবল আদর খেতে চায়
প্রতিটি ক্লান্ত গহ্বরে ।

মানাগুয়া থেকে লেখা চিঠি
একমাত্র যা তুমি চাও তা হল আমাদের হত্যা, যারা টিকে গেছে
তোমাদের অজস্র পোশাক-মহড়ায়
এখনও ব্যাপারটা তেমন গুরুতর নয়, আমাদের অনেকেই তোমাদের
আশা ব্যক্তিগত স্তরে পূরণ করে না :  তাগড়া বা নীল-চোখ বা সম্ভাবনাময়
কেউই করে না তোমাদের বর্তমান আই কিউ অনুযায়ী
কিংবা ররশাখ যা তোমাদের জীবনের বোধ সম্পর্কে সংজ্ঞা তৈরি করেন ।
তোমাদের সঙ্গে মতের মিল না হলে ক্ষমা করো
তোমাদের আণবিক বোমার সংজ্ঞা প্রয়োগ করে
যুগ্মবৈপরীত্যের রাসায়নিক সমাধান
কিংবা সালভাদোরের  সমাধান যথেষ্ট ব্যথা-নির্মূলক হিসাবে।
আমরা অত্যন্ত অনুন্নত আমাদের ব্যথা নিজেদের প্রাগতৈহাসিক
উপায়ে সামলাবার জন্য ।
আমাদের সমাজ নিয়ে তোমাদের প্রশ্নের যদি সম্পূর্ণ উত্তর দিতে না পারি 
তাহলেও আমাদের ক্ষমা কোরো, যদি একে মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট
কিংবা সামাজিক-গণতান্ত্রিক, বহুমাত্রিকতাকে মান্যতা দেওয়া
কিংবা যথেষ্ট খোলা বাজার ।  
যদি আমরা আমাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার প্রক্রিয়া অনুসন্ধানের 
অপক্বতায় জোর দিই 
আমাদের স্বদেশকে তীব্রভাবে ভালোবাসি
৫০০০০ বোন আর ভাইরা আমাদের কন্ঠে শিকড় বিছিয়ে রাখে ।
আমাকে ক্ষমা করবেন, দয়া করে, আমরা সব সময়ে ভুলে যাই
আমাদের সত্যকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের অনুমতি নেবার প্রয়োজন ছিল
আর যেমন ভালো বুঝি তেমন করে আমাদের হাসি বিতরণ করা দরকার ছিল।
নিজেদের মাথা ঘামাবেন না এটুকু বোঝার জন্য যে
আমাদের সৈন্যদের লড়াই করতে শেখার সঙ্গে কবিতাপাঠও শিখতে হয়
আত্মসন্মানবোধ আর কেমন করে রক্তের বদলে কালি দিয়ে তাদের নাম লিখবে,
যখন আমাদের দাদুদিদারা এই জমি খুঁচিয়ে তাঁদের জীবন কাটাতেন
 তোমরা তোমাদের সৈন্য পাঠালে । পরে তোমরা আমাদের দিলে
“আমাদেই একজন” : কিনলে আর দাম মেটালে
তোমাদের মার্কিন জীবনযাত্রা দিয়ে ।
তার ছিল এক ভাই আর এক ছেলে, এক নাতি
আর অজস্র পকেট ।
আমরা একাধিকবার বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছি
কিন্তু তোমরা বিপুল সংখ্যায় আমাদের ভাইদের শিক্ষা দিলে
তাদের কিনে ফেললে আর ছাঁচে গড়লে 
( আমাদের ছাঁচে রাখার জন্য )
আর যে ছাঁচে তারা আমাদের রাখল তা বেশির ভাগই পাইন-বাক্সে 
আর অনুভূমিক । এখানে যুবক হওয়া
অপরাধ ছিল, আর তোমরা রোজ মনে করিয়ে দিতে
সেই অপরাধের কথা
কতোজনের দ্বারা, আর কতো দিন অন্তর করা হয় ।
কিন্তু আমরা ভেলে যেতুম, আমরা লড়তুম আর তোমাদের চিরন্তন বন্ধুর
প্রতিরক্ষামূলক পাহারার নিচে থেকে বেরিয়ে আসতুম। 
আমরা লড়তুম আর জিততুম, আমরা কবর দিতুম
আমাদের বোনেদের আর ভাইদের ( কেউ কেউ ছিল ফর্সা
বা তোমাদের ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞার সঙ্গে খাপ খেতো )
আর আমাদের দীর্ঘ ব্যথা আরম্ভ হতো, নিঃশব্দ আনন্দ, অসম্ভবকে
আমাদের ইতিহাসের চোখ আর হাত দিয়ে সম্ভব করে তোলা ।
আমরা জানি আমরা তোমাদের ১৯৮২-এর মাপকাঠির সঙ্গে
খাপ খাই না যা তোমরা নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্যে তৈরি করেছ ।
তোমরা চাও কেবল আমাদের খুন করতে । আমরা কেবল চাই বেঁচে থাকতে ।
---মানাগুয়া, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২
                                                 Ernesto Cardenal and Margaret Randall

     
     


Saturday, June 29, 2019

ওসিপ ম্যানডেলস্টাম-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

ওসিপ ম্যানডেলস্টাম-এর কবিতা ( ১৮৯১ - ১৯৩৮ )
( স্তালিন এনাকে জেলে পুরেছিলেন )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

কেবল বাচ্চাদের বই পড়তে হবে।
কেবল বাচ্চাদের বই পড়তে হবে,
কেবল শিশুদের জিনিস ভালোবাসতে হবে,
বড়োদের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে
দুঃখি চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়াবার পর ।
জীবন নিয়ে আমি অবসাদে মরে যাচ্ছি
এতে এমন কিছু নেই যা আমি চাই,
আর কোনো সুললিত জগত নেই ।
কাঠের এক মামুলি দোলনা ;
অন্ধকার, উঁচু দেবদারু গাছের,
অনেক দূরের বাগানে, দুলছে ;
যা মনে রেখেছে জ্বরে আক্রান্ত রক্ত ।

ফিকে নীল কলাই-করার ওপরে
ফিকে নীল কলাই-করার ওপরে, 
যা এপ্রিল মাস আনতে পারে,
ভূর্য্য-শাখার অদৃশ্য 
দুলুনি, সন্ধ্যার দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে ।
সূক্ষ্ম খোদাই করা রেখার জালে,
রয়েছে নকশার সম্পূর্ণ স্হিতি,
মনোযোগ দিয়ে আঁকা অভিলাষ,
যেমন ওই চীনামাটির থালায়,
চিন্তাশীল শিল্পী বসিয়েছেন,
মাতাল মহাকাশে,
বিষণ্ণ মৃত্যুর কাছে যা স্মৃতিহীন,
শক্তির ক্ষণস্হায়ীত্ব জেনে নিয়ে।

এই শরীর নিয়ে কী করব যা ওরা আমাকে দিয়েছে
এই শরীর নিয়ে কী করব যা ওরা আমাকে দিয়েছে,
আমার নিজস্ব কতোটা, আমার সঙ্গে এতো অন্তরঙ্গ ?
বেঁচে থাকার জন্য, শান্তিময় শ্বাসের আনন্দের জন্য, 
আমাকে বলো, কাকে আমি আশীর্বাদ দেবো ?
আমিই ফুল, আর তারই সঙ্গে আমিই মালি,
আর আমি একা নই, পৃথিবীর এই কারাগারে।
আমার জীবন্ত উষ্ণতা, নিঃশ্বাসে, তুমি দেখতে পাচ্ছ,
অনন্তকালের স্বচ্ছ কাচে ।
এক নকশা আঁকা হয়েছে,
এখনও পর্যন্ত, অজানা ।
প্রমাণ না রেখে শ্বাস বাষ্পীভূত হয়
কিন্তু আঙ্গিককে কেই ভাঙচুর করতে পারে না ।

এক নির্বাক বিষণ্ণতা
এক নির্বাক বিষণ্ণতা
দুটি বড়ো-বড়ো চোখ মেলে ধরল ।
জেগে উঠল ফুলের ফুলদানি :
স্ফটিকের বিস্ময় ছিটিয়ে ।
সমস্ত ঘর ভরে উঠল
স্নিগ্ধতায় -- মিষ্টি মিশ্রণে !
অমন ক্ষুদ্র এক রাজ্য
ঘুমের সমুদ্র পান করে নেয় ।
মদের ফিকে রক্তবর্ণ,
মে মাসের ফিকে রোদ--
আঙুলগুলো, অনুদেহী, আর শাদা,
ভাঙছে বিস্কুটের টুকরোগুলো ।

শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই
শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই :
কোনও কিছু শোনা চলবে না ।
কতো দুঃখজনক, আর সুন্দর
এক পশুর অন্ধকার মন ।
শোনা যায় এমনকিছু সে করবে না :
তার কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই,
এক যুবক শুশুক, লাফায়, ঘুমোয়,
জগতের ধূসর গভীরতায় ।

নৈঃশব্দ্য
মেয়েটি এখনও জন্মায়নি :
মেয়েটি সঙ্গীত আর শব্দ,
আর তাই অ-ছিন্ন,
যা ঘাঁটানো হয় তার বুনন ।
নিঃশব্দ সমুদ্র শ্বাস নেয় ।
দিনের ঔজ্বল্য উন্মাদ ঘুরে বেড়ায়।
রুগ্ন বেগুনিফুলের সুগন্ধ ফেননিভ হয়,
ধূসর-নীল পাতার বাটিতে ।
আমার ঠোঁট মহড়া দিক
আদিম নৈঃশব্দ্যের,
স্ফটিকস্বচ্ছ সঙ্গীতস্বরের মতন
এমন শব্দ যা জন্ম থেকেই পবিত্র !
ফেননিভ আফ্রোদিতির মতন হও -- শিল্প --
আর ফিরে এসো, শব্দ, যেখানে সঙ্গীতের আরম্ভ :
আর জীবনের উৎসের সঙ্গে মিশে যাও,
হে হৃদয় লজ্জা পাও, হৃদয় হবার কারণে !

ঝিনুক
রাত, হয়তো তুমি চাও না
আমাকে । পৃথিবীর ধরাছোঁয়া থেকে,
মুক্তোর বীজহীন এক ঝিনুক,
আমাকে তোমার তীরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ।
তুমি ঘুরে বেড়াও বিভিন্ন সমুদ্রে,
আর সব সময়ে গান গাও,
কিন্তু তবু তুমি আনন্দিত হও
অনাবশ্যক জিনিসের মাঝে ।
তুমি কাছেই সমুদ্রতীরে পড়ে থাকো,
তোমার আঙরাখায় জড়ানো,
আর ঢেউদ্রের বিশাল ঘণ্টাধ্বনির গর্জন 
তুমি ঝিনুকে বেঁধে রাখো ।
তোমার কলতানময় ফেনা চুমু খাবে
ঝিনুকের ভঙ্গুর দেয়ালকে
বাতাস আর বৃষ্টি আর কুয়াশা দিয়ে,
সেই হৃদয়ের মতন যেখানে কিছুই বাস করে না ।

কালো-হলুদ পাখিরা বনে থাকে আর থাকে স্বর-সম্বন্ধীয়  কবিতায়
কালো-হলুদ পাখিরা বনে থাকে আর থাকে স্বর সম্বন্ধীয় কবিতায়
স্বরবর্ণের ব্যাপ্তি কেবল একমাত্র পরিমাপ ।
বছরে একবার প্রকৃতি অতিরেকে আকর্ষিত হয়,
আর বইতে থাকে প্রাচুর্য, হোমারের ছন্দমাত্রার মতো ।
আজ হাই তোলে, যতির নিলম্বনের মতো :
ভোর থেকে স্তব্ধতা, আর কষ্টকর সময়হীনতা :
চাষের ক্ষেতে বলদ, আর সোনালি আলসেমি ;
খাগড়াবন থেকে, সম্পূর্ণ স্বরের বৈভব আনার জন্য ।

প্রকৃতি হলো রোম, আর সেখানেই প্রতিবিম্বিত
প্রকৃতি হলো রোম, আর সেখানেই প্রতিবিম্বিত ।
আমরা তার জাঁকজমক দেখি, নাগরিকদের প্রদর্শনী :
স্বচ্ছ বাতাসের এক আকাশ-নীল সার্কাস,
গড়ে তোলে বিচরমেলা, গাছের স্তম্ভশ্রেনি ।
প্রকৃতি হলো রোম, তাই,
মনে হয় এখন প্রার্থনা করা উদ্দেশ্যহীন :
পড়ে আছে বলিদানের অন্ত্র, যুদ্ধের ভবিষ্যবাণী করার জন্য ;
ক্রীতদাস, মুখ বন্ধ রাখার জন্য ; পাথর, বেছাবার জন্য !

নিদ্রাহীনতা । হোমার । আঁট করে বাঁধা ক্যানভাস ।
নিদ্রাহীনতা । হোমার । আঁট করে বাঁধা ক্যানভাস ।
জাহাজের পুস্তিকার অর্ধেক আমার :
সারসদের ওই উড়াল, দীর্ঘ সারি,
যা এক সময়ে এগিয়েছিল, হেলাস থেকে ।
এক বিদেশি দেশের উদ্দেশ্যে, সংঘবদ্ধ সারসদের মতন--
রাজাদের মাথার ওপরে ফেনিল দেবতারা--
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ জাহাজ ? ট্রয়ের জিনিসগুলো
তোমাদের কোন কাজে লাগবে, একিয়ানগণ, হেলেনকে ছাড়া ?
সমুদ্র, অথবা হোমার -- সকলে ভালোবাসার দীপ্তিতে মোহিত ।
আমি কোনটা শুনবো ? এখন তো হোমার নির্বাক,
আর কৃষ্ণসাগর তার বাগ্মীতায় গর্জাচ্ছে, করাল,
আর, ফুঁসছে, গর্জাচ্ছে আমার বালিশকে আক্রমণ করছে ।

ঘোড়ার পাল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করছে আর চরছে
ঘোড়ার পাল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করছে আর চরছে
এই উপত্যকা বদলে যাবে, রোমের মতন, কলঙ্কে।
সময়ের স্বচ্ছ ধারা ধুয়ে দ্যায়
এক ধ্রুপদি বসন্তের শুকনো ঝলমলে ধুলো ।
হেমন্তের নিঃসঙ্গ অবসানে,
ওক পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে, আমার পথ চলে যায়,
সিজারের বিশুদ্ধ চেহারা মনে রেখে,
মেয়েলি আদল, ধূর্ত বেঁকা নাক ।
জুপিটারের মন্দির আর বিচারালয়, বেশ দূরে: প্রকৃতির পতন।
এখানে জগতের কিনারায় আমি শুনতে পাই
অগাস্টাসের যুগ, অক্ষিগোলকের মতন তার বল
গড়াচ্ছে, রাজকীয়ভাবে, পার্থিব এক বলয় ।
যখন বুড়ো হবে, আমার উন্মাদনাকে উজ্বল হতে দিও ।
রোম আমাকে জন্ম দিয়েছে : সে ফিরবে।
হেমন্তকাল, আমার মেয়ে-নেকড়ে, দয়া করে :
আমাকে, আগস্ট -- সিজারদের মাস -- পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।

স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড়
স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড় এখানে
 যেখানে আমরা  অধোলোকের দেবীর দ্বারা শাসিত ।
আমরা মৃত্যুর বাতাস পান করি, বাতাসের প্রতিটি গোঙানির শ্বাস,
আর প্রতিটি ঘণ্টা আমাদের মৃত্যু-ঘণ্টার জল্লাদের ।
সমুদ্রের দেবী, বজ্রময়ী এথেনা,
তোমার পাথরের বিশাল কচ্ছপখোল সরাও । 
স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড় :
এখানে অধোলোকের দেবী আমাদের জারিনা ।

ভাইরা, স্বাধীনতার গোধুলীকে গৌরবান্বিত করা যাক
ভাইরা, স্বাধীনতার গোধুলীকে গৌরবান্বিত করা যাক--
সেই মহান, অন্ধকার করে তোলা বছর ।
রাতের ফুটন্ত গরম জলে
জালের ভারি জঙ্গলগুলো নিশ্চিহ্ণ হয় ।
হে সূর্য, বিচারক, জনগণ, তোমাদের আলো
জেগে উঠছে অন্ধকারাচ্ছন্ন বছরগুলোয়
মারাত্মক চাপগুলোকে গৌরবান্বিত করা যাক
জনগণের নেতা যাকে কেঁদে গুরুত্ব দেন ।
ভাগ্যের অন্ধকার বোঝাকে গৌরবান্বিত করা যাক,
ক্ষমতার অসহ্য জোয়ালের ভয়কে গৌরবান্বিত করা যাক।
তোমার জাহাজ কেমন তলিয়ে যাচ্ছে, সরাসরি ।

এই রাত অনপনেয়
এই রাত অনপনেয় ।
যেখানে তুমি আছো, তা এখনও উজ্বল ।
জেরুজালেমের দরোজায়
এক কালো সূর্য আলোকময় ।
হলুদ সূর্য অসহ্য, 
ঘুমোও, খুকি, ঘুমোও ।
মন্দিরের আগুনে ইহুদিরা
আমার মাকে গভীরে কবর দিয়েছে ।
কোনো যাজক ছাড়াই, আশীর্বাদহীন,
তাঁর চিতাভস্মের ওপরে, ওপখানে
মন্দিরের আগুনে ইহুদিরা
প্রার্থনার মন্ত্রোচ্চারণ করেছিল।
এই মায়ের শরীরে
ইজরায়েলের কন্ঠস্বর গেয়েছিল।
আমি জেগে উঠেছিলুম ঝলমলে দোলনায়,
কালো সূর্যের আলোয় ।
তখন বৃষ তার খোঁয়াড়ে অলস জাবর চেবাচ্ছিল ।

মানুষের মাথার মর্যাদাক্রম অবক্ষয়িত : তারা বহু দূরে
মানুষের মাথার মর্যাদাক্রম অবক্ষয়িত : তারা বহু দূরে ।
আমি সেখানে লুপ্ত হই, আরেকটি বিস্মৃতজন ।
কিন্তু ভালোবাসার শব্দাবলীতে, শিশুদের খেলায়,
আমি আবার উদয় হবো, বলার জন্য -- সূর্য !

আমার রক্তে রয়েছে এক শিখা
আমার রক্তে রয়েছে এক শিখা
পুড়িয়ে দিচ্ছে আমার শুকনো জীবন, হাড় পর্যন্ত ।
আমি পাথরের গান গাই না
আর, আমি গাই বনানীর ।
তা হালকা আর কর্কশ :
একটিমাত্র মাস্তুলে গড়া,
ওক গাছের গভীর হৃদয়,
আর মাঝির লগি ।
তাদের গভীরে নিয়ে যাও, খুঁটিগুলো
হাতুড়ি মেরে শক্ত করো,
কাঠের স্বর্গোদ্যান ঘিরে
যেখানে সবকিছুই হালকা ।