Saturday, June 1, 2019

মাহমুদ দারবিশ-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

মাহমুদ দারবিশ-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

কবিতা থেকে ঘোড়াটা পড়ে গেল
কবিতা থেকে ঘোড়াটা পড়ে গেল
প্রজাপতি আর শিশিরে
গ্যালিলিয় নারীরা ভিজে গেলেন,
ক্রিসানথিমামের ওপরে নাচতে-নাচতে

যারা দুজন অনুপস্হিত : তুমি আর আমি
তুমি আর আমি এই দুজন অনুপস্হিত

একজোড়া শাদা পায়রা
হোম-ওক গাছের ডালে বসে আলোচনা করছে

প্রেম নেই, কিন্তু আমি প্রাচীন
প্রেমের কবিতা ভালোবাসি যা আড়াল করে রাখে
ধোঁয়া থেকে অসুস্হ চাঁদকে

আমি আক্রমণ করি আর পিছোই, অন্ত্যমিল বেহালার সুরের মতো
যখন আমি জায়গাটার বিবরণের কাছে থাকি
আমার সময় থেকে বহু দূরে চলে যাই…

যা ভালোবাসি তা উদযাপনের জন্য
আধুনিক ভাষায় আর প্রান্ত অবশিষ্ট নেই,
কেননা আমরা যা হবো তা হয়ে গেছে...ছিল

ঘোড়া পড়ে গেল রক্তাক্ত
আমার কবিতা নিয়ে
আর আমি পড়ে গেলুম রক্তাক্ত
ঘোড়াটার রক্ত নিয়ে…

পরিত্যক্ত থিয়েটারে আমার একটা আসন আছে
পরিত্যক্ত থিয়েটারে আমার একটা আসন আছে
বেইরুটে । আমি ভুলে যেতে পারি, আর আমি মনে করতে পারছি
আকুল আকাঙ্খা ছাড়াই শেষ অঙ্ক...অন্যকিছুর জন্য নয়
কেবল এই কারণে যে নাটকটা লেখা হয়নি
দক্ষতায়…
বিশৃঙ্খলা
বিষণ্ণদের মতন যুদ্ধের দিনকালে, আর এক আত্মজীবনী
দর্শকদের আবেগের । অভেনিতারা তাদের স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে ফেলছিল
আর আমাদের মাঝে খুঁজছিল নাট্যকারকে, আমরা যারা সাক্ষী
আমাদের আসনে বসে
আমার পাশের আসনের শিল্পীকে বলি : আপনার অস্ত্র বের করবেন না,
আরও অপেক্ষা করুন, যদি না আপনিই নাট্যকার হন !
---না
তারপর উনি আমায় জিগ্যেস করেন : আর আপনিই কি নাট্যকার ?
---না
আমরা তাই ভয়ে বসে থাকি । আমি বলি : হয়ে উঠুন নিরপেক্ষ
নায়ক যাতে প্রতীয়মান অদৃষ্ট থেকে কেটে পড়া যায়
উনি বলেন : কোনো নায়কই মহিমায় মারা যায় না দ্বিতীয়
দৃশ্যে । আমি বাকিটুকুর জন্য অপেক্ষা করব । হয়তো আমি
কোনো অঙ্কের পুনর্লিখন করে দেবো । আর হয়তো আমি সংশোধন করব
লোহা যা আমার ভাইদের জীবনে ঘটিয়েছে
তাই আমি বলি : তাহলে আপনিই ?
উনি উত্তর দেন : আপনি আর আমি দুজন মুখোশ-পরা নাট্যকার আর দুজন মুখোশ-পরা
সাক্ষী
আমি বলে : তা আমার উদ্বেগের বিষয় হবে কেন ? আমি একজন দর্শক
উনি বলেন : কোনো দর্শকই গহ্বরের দরোজায় দাঁড়িয়ে নেই….আর তাই
একজন এখানে নিরপেক্ষ । আর আপনি বেছে নিতে বাধ্য
আপনার অন্তকালীন ভূমিকা
আমি তাই বলি : আমি আরম্ভটার অভাব বোধ করছি, কী যেন ছিল আরম্ভে?

আমার আছে একজন দণ্ডিতের জ্ঞান
আমার আছে মৃত্যুর দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তের জ্ঞান
আমার অধিকারে কিছুই নেই তাই কিছুই আমাকে অধিকার করতে পারে না
আর আমার ইচ্ছাপত্র লিখেছি আমার নিজের রক্তে:
“হে আমার গানের নিবাসীরা : জলকে বিশ্বাস করো”
আর আমি আমার আগামীকালে বিদ্ধ হয়ে আর মুকুটে অভিষিক্ত হয়ে ঘুমোই…
আমি স্বপ্ন দেখলুম পৃথিবীর হৃদয়
তার মানচিত্রের চেয়ে বড়ো,
আয়নার চেয়ে আর আমার ফাঁসিকাঠের চেয়ে
বেশি পরিষ্কার ।
আমি একটা শাদা মেঘে হারিয়ে গিয়েছিলুম যা আমাকে ওপরে তুলে নিয়ে গিয়েচিল
যেন আমি এক ঝুঁটিওয়ালা পাখি
আর বাতাস নিজেই আমার ডানা ।
ভোরবেলা, আমার রাতের পাহারাদারের ডাক
আমাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুললো, আমার ভাষা থেকে :
তুমি আরেকটা মৃত্যু বেঁচে থাকবে,
তাই নিজের ইচ্ছাপত্র পুনর্লিখন করো,
ফাঁসির সময় আবার মুলতুবি রাখা হয়েছে ।
আমি জানতে চাই : কবে অব্দি ?
ও জবাবে বলে : আরও মরে নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো ।
আমি বলি : আমার অধিকারে কিছুই নেই তাই কিছুই আমাকে অধিকার করতে পারে না
আর আমার ইচ্ছাপত্র লিখেছি আমার নিজের রক্তে :
“হে আমার গানের নিবাসীরা : জলকে বিশ্বাস করো।”

যা করেছ তার জন্য কৈফিয়ত দিও না
যা করেছ তার জন্য কৈফিয়ত দিও না -- আমি একথা বলছি
গোপনে । আমি আমার ব্যক্তিগত অপরকে বলি :
এখানে তোমার যাবতীয় স্মৃতি দৃষ্টিগোচর :
এক বিড়ালের নিদ্রালুতায় মধ্যদিনের অবসাদ,
বিদূষক,
সন্ন্যাসীর গন্ধ,
মায়ের কফি,
মাদুরের সঙ্গে বালিশ,
তোমার ঘরে ঢোকার লোহার দরোজা,
সক্রেটিসকে ঘিরে মাছির ভনভনানি,
প্ল্যাটোর ওপরদিকের মেঘ,
দিওয়ান আল-হামজা
বাবার ফোটো,
মুজাম আল-বুলদান,
শেক্সপিয়ার,
তোমার তিন ভাই আর তিন বোন
তোমার বাল্যকালের বন্ধুরা --
আর অনধিকারচর্চাকারীদের গুলতানি :
“এই লোকটাই সে ?”
সাক্ষীরা ভিন্নমত :
“হতে পারে।”
“মনে হয় তেমনই ।”
আমি জানতে চাই :
“আর ও কে ?”
কোনো উত্তর পাই না ।
আমি আমার অপরকে ফিসফিস করে বলি :
“ও কি সে যা তুমি ছিলে...যা আমি ছিলুম?”
ও অন্য দিকে তাকায় ।
সাক্ষীরা আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে সত্যতা জানতে চায়
ও আসলে আমি আর
মা গাইবার জন্যে তৈরি হন
ওনার নিজস্ব গান :
“আমিই সে যে ওর জন্ম দিয়েছি
কিন্তু বাতাস ওর লালন-পালন করেছে।”
আর আমি আমার অপরকে বলি : “তোমার মাকে ছাড়া, আর কাউকে কৈফিয়ত দিও না।”

এরকম একটা দিনে
এরকম একটা দিনে, কোনো গোপন কোনায়
এক গির্জায়, এক সম্পূর্ণ মেয়েলি চমৎকারীত্বে,
এক অধিবর্ষে, যখন শাশ্বত সবুজ
নেভি-নীল সকালের সঙ্গে দেখা করে,
যখন আঙ্গিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে দেখা করে আর ইন্দ্রিয়চেতনার
দেখা হয় বোধাতীতের সঙ্গে,
পরিপূর্ণ চক্রনেমির তলায়
যেখানে এক চড়ুইপাখির ছায়া মুছে ফ্যালে
মর্মার্থের প্রতিমাকে -- এই আবেগের জায়গায়
আমি আমার শেষ আর আমার শুরুর মুখোমুখি হবো
আর বলব : মরগে যাও তোমরা দুজনে। নিজেদের রাস্তা দ্যাখো
যদি তাইই চাও -- আমাকে নাও আর এগিয়ে চলো,
হৃদয়ের সত্যকে তরতাজা রেখে যাও
শৈয়ালের ক্ষুধার্ত মেয়েদের জন্য ।
আমি বলি : আমি নাগরিক নই
কিংবা এক উদ্বাস্তু ।
আর আমি একটা জিনিস চাই : তার বেশি নয়,
একটা জিনিস : এক সরল, নিরব মৃতভু
এরকম একটা দিনে, এক গোপন হৃদয়ে
শ্বেতপদ্মের,
হতে পারে অনেকটা বা একটু ক্ষতিপূরণের জন্য,
মুহূর্ত ও প্রস্হানের মাঝে মাপা জীবনের জন্য ।
আমি এই বাগানে মৃত্যু চাই ।
বেশি নয়...কম নয় ।
       

No comments:

Post a Comment