Saturday, June 29, 2019

ওসিপ ম্যানডেলস্টাম-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

ওসিপ ম্যানডেলস্টাম-এর কবিতা ( ১৮৯১ - ১৯৩৮ )
( স্তালিন এনাকে জেলে পুরেছিলেন )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

কেবল বাচ্চাদের বই পড়তে হবে।
কেবল বাচ্চাদের বই পড়তে হবে,
কেবল শিশুদের জিনিস ভালোবাসতে হবে,
বড়োদের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে
দুঃখি চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়াবার পর ।
জীবন নিয়ে আমি অবসাদে মরে যাচ্ছি
এতে এমন কিছু নেই যা আমি চাই,
আর কোনো সুললিত জগত নেই ।
কাঠের এক মামুলি দোলনা ;
অন্ধকার, উঁচু দেবদারু গাছের,
অনেক দূরের বাগানে, দুলছে ;
যা মনে রেখেছে জ্বরে আক্রান্ত রক্ত ।

ফিকে নীল কলাই-করার ওপরে
ফিকে নীল কলাই-করার ওপরে, 
যা এপ্রিল মাস আনতে পারে,
ভূর্য্য-শাখার অদৃশ্য 
দুলুনি, সন্ধ্যার দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে ।
সূক্ষ্ম খোদাই করা রেখার জালে,
রয়েছে নকশার সম্পূর্ণ স্হিতি,
মনোযোগ দিয়ে আঁকা অভিলাষ,
যেমন ওই চীনামাটির থালায়,
চিন্তাশীল শিল্পী বসিয়েছেন,
মাতাল মহাকাশে,
বিষণ্ণ মৃত্যুর কাছে যা স্মৃতিহীন,
শক্তির ক্ষণস্হায়ীত্ব জেনে নিয়ে।

এই শরীর নিয়ে কী করব যা ওরা আমাকে দিয়েছে
এই শরীর নিয়ে কী করব যা ওরা আমাকে দিয়েছে,
আমার নিজস্ব কতোটা, আমার সঙ্গে এতো অন্তরঙ্গ ?
বেঁচে থাকার জন্য, শান্তিময় শ্বাসের আনন্দের জন্য, 
আমাকে বলো, কাকে আমি আশীর্বাদ দেবো ?
আমিই ফুল, আর তারই সঙ্গে আমিই মালি,
আর আমি একা নই, পৃথিবীর এই কারাগারে।
আমার জীবন্ত উষ্ণতা, নিঃশ্বাসে, তুমি দেখতে পাচ্ছ,
অনন্তকালের স্বচ্ছ কাচে ।
এক নকশা আঁকা হয়েছে,
এখনও পর্যন্ত, অজানা ।
প্রমাণ না রেখে শ্বাস বাষ্পীভূত হয়
কিন্তু আঙ্গিককে কেই ভাঙচুর করতে পারে না ।

এক নির্বাক বিষণ্ণতা
এক নির্বাক বিষণ্ণতা
দুটি বড়ো-বড়ো চোখ মেলে ধরল ।
জেগে উঠল ফুলের ফুলদানি :
স্ফটিকের বিস্ময় ছিটিয়ে ।
সমস্ত ঘর ভরে উঠল
স্নিগ্ধতায় -- মিষ্টি মিশ্রণে !
অমন ক্ষুদ্র এক রাজ্য
ঘুমের সমুদ্র পান করে নেয় ।
মদের ফিকে রক্তবর্ণ,
মে মাসের ফিকে রোদ--
আঙুলগুলো, অনুদেহী, আর শাদা,
ভাঙছে বিস্কুটের টুকরোগুলো ।

শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই
শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই :
কোনও কিছু শোনা চলবে না ।
কতো দুঃখজনক, আর সুন্দর
এক পশুর অন্ধকার মন ।
শোনা যায় এমনকিছু সে করবে না :
তার কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই,
এক যুবক শুশুক, লাফায়, ঘুমোয়,
জগতের ধূসর গভীরতায় ।

নৈঃশব্দ্য
মেয়েটি এখনও জন্মায়নি :
মেয়েটি সঙ্গীত আর শব্দ,
আর তাই অ-ছিন্ন,
যা ঘাঁটানো হয় তার বুনন ।
নিঃশব্দ সমুদ্র শ্বাস নেয় ।
দিনের ঔজ্বল্য উন্মাদ ঘুরে বেড়ায়।
রুগ্ন বেগুনিফুলের সুগন্ধ ফেননিভ হয়,
ধূসর-নীল পাতার বাটিতে ।
আমার ঠোঁট মহড়া দিক
আদিম নৈঃশব্দ্যের,
স্ফটিকস্বচ্ছ সঙ্গীতস্বরের মতন
এমন শব্দ যা জন্ম থেকেই পবিত্র !
ফেননিভ আফ্রোদিতির মতন হও -- শিল্প --
আর ফিরে এসো, শব্দ, যেখানে সঙ্গীতের আরম্ভ :
আর জীবনের উৎসের সঙ্গে মিশে যাও,
হে হৃদয় লজ্জা পাও, হৃদয় হবার কারণে !

ঝিনুক
রাত, হয়তো তুমি চাও না
আমাকে । পৃথিবীর ধরাছোঁয়া থেকে,
মুক্তোর বীজহীন এক ঝিনুক,
আমাকে তোমার তীরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ।
তুমি ঘুরে বেড়াও বিভিন্ন সমুদ্রে,
আর সব সময়ে গান গাও,
কিন্তু তবু তুমি আনন্দিত হও
অনাবশ্যক জিনিসের মাঝে ।
তুমি কাছেই সমুদ্রতীরে পড়ে থাকো,
তোমার আঙরাখায় জড়ানো,
আর ঢেউদ্রের বিশাল ঘণ্টাধ্বনির গর্জন 
তুমি ঝিনুকে বেঁধে রাখো ।
তোমার কলতানময় ফেনা চুমু খাবে
ঝিনুকের ভঙ্গুর দেয়ালকে
বাতাস আর বৃষ্টি আর কুয়াশা দিয়ে,
সেই হৃদয়ের মতন যেখানে কিছুই বাস করে না ।

কালো-হলুদ পাখিরা বনে থাকে আর থাকে স্বর-সম্বন্ধীয়  কবিতায়
কালো-হলুদ পাখিরা বনে থাকে আর থাকে স্বর সম্বন্ধীয় কবিতায়
স্বরবর্ণের ব্যাপ্তি কেবল একমাত্র পরিমাপ ।
বছরে একবার প্রকৃতি অতিরেকে আকর্ষিত হয়,
আর বইতে থাকে প্রাচুর্য, হোমারের ছন্দমাত্রার মতো ।
আজ হাই তোলে, যতির নিলম্বনের মতো :
ভোর থেকে স্তব্ধতা, আর কষ্টকর সময়হীনতা :
চাষের ক্ষেতে বলদ, আর সোনালি আলসেমি ;
খাগড়াবন থেকে, সম্পূর্ণ স্বরের বৈভব আনার জন্য ।

প্রকৃতি হলো রোম, আর সেখানেই প্রতিবিম্বিত
প্রকৃতি হলো রোম, আর সেখানেই প্রতিবিম্বিত ।
আমরা তার জাঁকজমক দেখি, নাগরিকদের প্রদর্শনী :
স্বচ্ছ বাতাসের এক আকাশ-নীল সার্কাস,
গড়ে তোলে বিচরমেলা, গাছের স্তম্ভশ্রেনি ।
প্রকৃতি হলো রোম, তাই,
মনে হয় এখন প্রার্থনা করা উদ্দেশ্যহীন :
পড়ে আছে বলিদানের অন্ত্র, যুদ্ধের ভবিষ্যবাণী করার জন্য ;
ক্রীতদাস, মুখ বন্ধ রাখার জন্য ; পাথর, বেছাবার জন্য !

নিদ্রাহীনতা । হোমার । আঁট করে বাঁধা ক্যানভাস ।
নিদ্রাহীনতা । হোমার । আঁট করে বাঁধা ক্যানভাস ।
জাহাজের পুস্তিকার অর্ধেক আমার :
সারসদের ওই উড়াল, দীর্ঘ সারি,
যা এক সময়ে এগিয়েছিল, হেলাস থেকে ।
এক বিদেশি দেশের উদ্দেশ্যে, সংঘবদ্ধ সারসদের মতন--
রাজাদের মাথার ওপরে ফেনিল দেবতারা--
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ জাহাজ ? ট্রয়ের জিনিসগুলো
তোমাদের কোন কাজে লাগবে, একিয়ানগণ, হেলেনকে ছাড়া ?
সমুদ্র, অথবা হোমার -- সকলে ভালোবাসার দীপ্তিতে মোহিত ।
আমি কোনটা শুনবো ? এখন তো হোমার নির্বাক,
আর কৃষ্ণসাগর তার বাগ্মীতায় গর্জাচ্ছে, করাল,
আর, ফুঁসছে, গর্জাচ্ছে আমার বালিশকে আক্রমণ করছে ।

ঘোড়ার পাল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করছে আর চরছে
ঘোড়ার পাল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করছে আর চরছে
এই উপত্যকা বদলে যাবে, রোমের মতন, কলঙ্কে।
সময়ের স্বচ্ছ ধারা ধুয়ে দ্যায়
এক ধ্রুপদি বসন্তের শুকনো ঝলমলে ধুলো ।
হেমন্তের নিঃসঙ্গ অবসানে,
ওক পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে, আমার পথ চলে যায়,
সিজারের বিশুদ্ধ চেহারা মনে রেখে,
মেয়েলি আদল, ধূর্ত বেঁকা নাক ।
জুপিটারের মন্দির আর বিচারালয়, বেশ দূরে: প্রকৃতির পতন।
এখানে জগতের কিনারায় আমি শুনতে পাই
অগাস্টাসের যুগ, অক্ষিগোলকের মতন তার বল
গড়াচ্ছে, রাজকীয়ভাবে, পার্থিব এক বলয় ।
যখন বুড়ো হবে, আমার উন্মাদনাকে উজ্বল হতে দিও ।
রোম আমাকে জন্ম দিয়েছে : সে ফিরবে।
হেমন্তকাল, আমার মেয়ে-নেকড়ে, দয়া করে :
আমাকে, আগস্ট -- সিজারদের মাস -- পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।

স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড়
স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড় এখানে
 যেখানে আমরা  অধোলোকের দেবীর দ্বারা শাসিত ।
আমরা মৃত্যুর বাতাস পান করি, বাতাসের প্রতিটি গোঙানির শ্বাস,
আর প্রতিটি ঘণ্টা আমাদের মৃত্যু-ঘণ্টার জল্লাদের ।
সমুদ্রের দেবী, বজ্রময়ী এথেনা,
তোমার পাথরের বিশাল কচ্ছপখোল সরাও । 
স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড় :
এখানে অধোলোকের দেবী আমাদের জারিনা ।

ভাইরা, স্বাধীনতার গোধুলীকে গৌরবান্বিত করা যাক
ভাইরা, স্বাধীনতার গোধুলীকে গৌরবান্বিত করা যাক--
সেই মহান, অন্ধকার করে তোলা বছর ।
রাতের ফুটন্ত গরম জলে
জালের ভারি জঙ্গলগুলো নিশ্চিহ্ণ হয় ।
হে সূর্য, বিচারক, জনগণ, তোমাদের আলো
জেগে উঠছে অন্ধকারাচ্ছন্ন বছরগুলোয়
মারাত্মক চাপগুলোকে গৌরবান্বিত করা যাক
জনগণের নেতা যাকে কেঁদে গুরুত্ব দেন ।
ভাগ্যের অন্ধকার বোঝাকে গৌরবান্বিত করা যাক,
ক্ষমতার অসহ্য জোয়ালের ভয়কে গৌরবান্বিত করা যাক।
তোমার জাহাজ কেমন তলিয়ে যাচ্ছে, সরাসরি ।

এই রাত অনপনেয়
এই রাত অনপনেয় ।
যেখানে তুমি আছো, তা এখনও উজ্বল ।
জেরুজালেমের দরোজায়
এক কালো সূর্য আলোকময় ।
হলুদ সূর্য অসহ্য, 
ঘুমোও, খুকি, ঘুমোও ।
মন্দিরের আগুনে ইহুদিরা
আমার মাকে গভীরে কবর দিয়েছে ।
কোনো যাজক ছাড়াই, আশীর্বাদহীন,
তাঁর চিতাভস্মের ওপরে, ওপখানে
মন্দিরের আগুনে ইহুদিরা
প্রার্থনার মন্ত্রোচ্চারণ করেছিল।
এই মায়ের শরীরে
ইজরায়েলের কন্ঠস্বর গেয়েছিল।
আমি জেগে উঠেছিলুম ঝলমলে দোলনায়,
কালো সূর্যের আলোয় ।
তখন বৃষ তার খোঁয়াড়ে অলস জাবর চেবাচ্ছিল ।

মানুষের মাথার মর্যাদাক্রম অবক্ষয়িত : তারা বহু দূরে
মানুষের মাথার মর্যাদাক্রম অবক্ষয়িত : তারা বহু দূরে ।
আমি সেখানে লুপ্ত হই, আরেকটি বিস্মৃতজন ।
কিন্তু ভালোবাসার শব্দাবলীতে, শিশুদের খেলায়,
আমি আবার উদয় হবো, বলার জন্য -- সূর্য !

আমার রক্তে রয়েছে এক শিখা
আমার রক্তে রয়েছে এক শিখা
পুড়িয়ে দিচ্ছে আমার শুকনো জীবন, হাড় পর্যন্ত ।
আমি পাথরের গান গাই না
আর, আমি গাই বনানীর ।
তা হালকা আর কর্কশ :
একটিমাত্র মাস্তুলে গড়া,
ওক গাছের গভীর হৃদয়,
আর মাঝির লগি ।
তাদের গভীরে নিয়ে যাও, খুঁটিগুলো
হাতুড়ি মেরে শক্ত করো,
কাঠের স্বর্গোদ্যান ঘিরে
যেখানে সবকিছুই হালকা ।

No comments:

Post a Comment