Saturday, July 20, 2019

ইয়াজিদি ( Yezidi ) কবিদের কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

ইয়াজিদি ( Yezidi ) কবিদের কবিতা

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

আমি ইয়েজিদি

আজি মেরশাউই
আমি ৭৪টা গণহত্যার যন্ত্রণা বইছি
আর কোটি বছরের ফোঁপানি ।
আমার পার্থক্যের চিহ্ণগুলো হলো
এক বন্ধ মুখ আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ইচ্ছাশক্তি ।
সৃষ্টিকর্তা আমার কথা জানে না
আর কোনো পথ-মানচিত্র আমাকে ধারণ করতে পারে না ।
সবচেয়ে দয়ালু দেবদূতরা আমাকে ঘৃণায় পরিহার করে ।
অনুকূল কেউই আমার সমর্থনে কথা বলবে না
আর কুরআনের আয়াত আমার দেয়ালকে সুরক্ষিত করবে না ।
আমি অন্যের স্বর্গোদ্যানে যাবার মসৃণ পথ ।
যারা আমাকে খুন করেছে তাদের সবায়ের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি
যদি তারা শেষ পর্যন্ত স্বর্গে গিয়ে না পৌঁছে থাকে ।
যদি পৌঁছে থাকে, আমি আশা করব কৃতজ্ঞতা ।
মৃত্যুযন্ত্রণা আমার জিনকোষে সহজাত ।
যন্ত্রণা নিজের শিকড় বিছিয়ে রেখেছে আমার রক্তস্রোতে।
আমার দেহের কোষগুলোয় বিষাদ বাসা বেঁধে আছে ।
বেঁচে থাকার জন্য আমি নিয়তি নির্দেশিত
কেবল অন্যেরা যেমনভাবে চাইবে ;
মরার জন্য আমি নিয়তি নির্দেশিত
কেবল যখন অন্যেরা তার হুকুম দ্যায়---
ঈশ্বরের স্মৃতির ধ্বংসাবশেষে ক্রুশকাঠে ঝোলানো
জীবনের প্রাণবন্ত এলাকা থেকে একঘরে,
যন্ত্রণাদায়ক ফাঁসির দড়ির মতন ছুঁড়ে ফেলে দেয়া
বিস্মৃতির ধারালো ক্ষুরের ওপরে ।
আমার একমাত্র স্বদেশ রয়েছে আমার অশ্রুর চাকচিক্যে ।
আমার একমাত্র শোকজ্ঞাপন হলো আমার দুঃখের শঙ্খধ্বনি ।
আমার অন্তরে, কারারুদ্ধ, মানবিক ফোড়ার পুঁজের বন্যা ।
কোনো মধ্যস্হতা আমাকে ওই ভুলে যাওয়া
ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না
আর তার বদমেজাজি হুকুম থেকে
আমার পালাবার কোনো পথ নেই ।
আমি ভয়ের হিমে বন্দি,
নিরাশার আটার তালে আমি চটকানো
ফোঁপানিতে মিশে, তিক্ততায়--
হাহাকারের ঝোপজঙ্গলে
আমার গলার আওয়াজ এক কন্ঠরুদ্ধ গোঙানি।
ব্রহ্মাণ্ডের কানে খড় ঢোকানো আছে
আর প্রভু নিজেকে অন্যান্য অভিরুচিতে ব্যস্ত রেখেছেন ।

যুদ্ধের রঙ
দুন্যা মিখাইল
দেয়ালে ডিজিটাল মানচিত্র ঝোলানো
মার্কিন যুদ্ধ দেখাচ্ছে
নানা রঙে :
ইরাক বেগুনি
সিরিয়া হলুদ
কুয়েত নীল
আফগানিস্তান লাল
ভিয়েতনাম সবুজ।
যুদ্ধ
মানচিত্রে
সুন্দর দেখায়
রসবোধপূর্ণ
আর রঙিন ।

স্বভূমি
আমেল হসকান
কল্পনা করো কেবল কল্পনা, আমি সতেরো বছরের মেয়ে । পরিবারের সঙ্গে আনন্দে সিঞ্জার নামে একটা জায়গায় থাকি, যেখানের পর্বতমালা রাজকীয় আর ক্ষেতগুলো সবুজ, যেখানে এক সময়ে ছিল ভালোবাসা আর শান্তি ।
আমার মা প্রতঃরাশ তৈরি করছে, বাবা কাজের জন্য তৈরি হচ্ছে, ছাদে ঘুমোচ্ছে ভাই, আমার বোন ফুলের বাগানে প্রজাপতিদের সঙ্গে নাচছে, প্রতিবেশিদের বাচ্চারা পাড়ায় খেলছে, আর তাদের হাসি পৌঁছোচ্ছে আকাশে ।
ন ইরবতা, শান্তি, সুরক্ষা, ভালোবাসা, হাসি, সৌন্দর্য ।
তখন আমি ভাবতুম আমি স্বর্গের অংশ, তা ছিল পৃথিবীর স্বর্গ ।
দাঁড়াও, শব্দ আসছে কোথা থেকে, কিসের !! মাকে ডাকলুম, মা আওয়াজ কিসের ? বাগানে গেলুম, আকাশ ধোঁয়ায় কালো হয়ে গিয়েছিল, ফুলগুলো মুর্ছিত, আমি সর্বত্র রক্তের গন্ধ পেতে লাগলুম ।
মাকে ডাকলুম, মা তুমি কোথায় ? বোন এখানে আছে তো, সে কোথায়? তুমি কোথায় ?
তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন, তুমি কোথায় ?
ওহ, আমার ভাই ছাদে ঘুমোচ্ছে, ও বলতে পারবে। আমি ভাইয়ের কাছে গেলুম ।
ভাই, উঠে পড় ; এই আওয়াজে তুই কেমন করে ঘুমোচ্ছিস, উঠে পড়, ভাই,ভাই ।
গন্ধটা ছিল আমার ভাইয়ের রক্তের, আমার ভাই বিছানায় খুন হয়েছে, আমার ভাইকে বিছানায় খুন করা হয়েছে । কেউ দয়া করে বলুক, এটা কি দুঃস্বপ্ন, বলুক এটা কি দুঃস্বপ্ন তাহলে জেগে যাবো।
আমি কি করি ? আমি কি করব ?
আমি পাহাড়ে যাবো । আমি শারফেদেন মন্দিরে যাবো, দুঃস্বপ্ন সেখানে শেষ হবে ।
বেরোবার জন্য দরোজা খুললুম, দেখলুম কারোর ধড় থেকে মাথা কাটা । না, না, না,না, উনি তো আমার বাবা, ওটা আমার বাবার মাথা, না, না । এমন দুঃস্বপ্ন শেষ হচ্ছে না কেন?
আমি যন্ত্রণা আর কান্না নিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়োলুম ।
দাঁড়াও, ওই কালো পতাকাগুলো রাস্তায় কেন দেখা যাচ্ছে ? এরা কারা কুৎসিত বিদেশি নোংরা দাড়ি ঝুলিয়ে ? দৌড়োই, ওরা আমাকে দেখতে পাবে না ।
দৌড়োচ্ছিলুম, পাথরে হোঁচোট খেয়ে তার ওপরে পড়লুম, দেখলুম তার তলায় একটা শিশু পাশে খালি বোতল, না খেয়ে মারা গেছে ।
শিশুটাকে দেখার অভিঘাতে আমি যখন বিস্মিত, ওরা আমাকে দেখতে পেলো, আমার সামনে দাঁড়ালো, হায় দেবতা, ওরা তো কাছে আসছে । আমি চিৎকার করতে লাগলুম, বাঁচাও, বাঁচাও, কেউ আমার কথা শুনতে পেলো না, কেউ সাহায্য করতে এলো না । আমাকে ছেড়ে দাও, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে । আমাকে ছেড়ে দাও...আমি কোথায় ? এতো অন্ধকার জায়গা কেন ? মা, তুমি এখানে রয়েছ, মা কথা বলছ না কেন ? মা !
মা শুধু একটা কথা বারবার বলতে লাগল : তিনটে রাক্ষস তোর বোনকে আমার চোখের সামনে ধর্ষণ করেছে ।
তিনটে রাক্ষস তোর বোনকে আমার চোখের সামনে ধর্ষণ করেছে, তোর বোনকে ধর্ষণ করেছে, তোর বোনকে ।
মা ওরা আসছে, মা ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের বাজারে, ওরা আমাকে দশ ডলারে বেচে দেবে মা । মা ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে…
ওটা কি? তরুণীভরা জেল, এই মেয়েটা কে, পরীর মতন ছোট্ট । জিগ্যেস করলুম, তোমার খাবার খাওনি কেন । জবাব দিল, আমি খেতে চাই না, যদি খাই তাহলে বড়ো হয়ে যাও আর ওরা আমাকে নিয়ে গিয়ে বেচে দেবে ।
তোমরা আমার মা কে ধরে এনেছো
আমাকে মেরে ফ্যালো, এই মেয়েগুলোকে মেরে ফ্যালো ।
কিন্তু তোমরা আমার ধর্ম বদলাতে পারবে না, তা আছে আমার হৃদয়ে । তোমরা আমার স্বদেশকে লুকোতে পারবে না, আমরা এমন রাষ্ট্র যারা পরাজয় কাকে বলে জানে না, আমাদের শ্লোগান হলো শান্তি । আমরা ৭৪টা গণহত্যা দেখেছি। আমরা মরিনি, মরব না ।
আমাকে খুন করো, এই মেয়েগুলোকে খুন করো, কিন্তু আমার স্বদেশকে লুকোতে পারবে না ।
আমরা শিঞ্জার পাহাড়ে থাকবো শারফেনদেন মন্দিরে ।
মেয়েটি বুঝতে পারলো সে দুঃস্বপ্ন দেখছে না । তার সামনে রূঢ় বাস্তব ।
আমরা বেঁচে থাকবো, এই কথা বলে মেয়েটি ধর্ষিত হবার আগে আত্মহত্যা করে নিলো ।

ইয়াজিদি বোনেদের
আইল্লা রুৎ
আমি বই আর কবিতা লিখি
দুর্দশা-আক্রান্ত নারীদের জীবন নিয়ে
আর আমি নামকরা কবি
আমার কলম আর কবিতার কারণে
আমার একটা ওয়েবসাইট আছে
যেখানে আমার কবিতা পড়া হয় আবৃত্তি হয়
আমি পুরস্কার আর সম্বর্ধনা সংগ্রহ করি।

তবু ওরা এখনও যন্ত্রণাভোগ করছে
আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে
আমাদের মেয়েদের শেকলে বেঁধে রাখা হচ্ছে
আমাদের মেয়েরা তাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছে
আমাদের মেয়েদের বোরখায় চাপা দেয়া হয়েছে
আমাদের মেয়েদের বিক্রি করা হয়
চিনাবাদামের দামে ।

কে তাদের মুক্ত করবে ?
মায়েরা আর বাবারা কাঁদেন
যতক্ষণ না অশ্রু ফুরিয়ে যাচ্ছে
তাদের আর অশ্রূবিন্দু নেই
কে শোনে কন্ঠরুদ্ধ চিৎকার ?
ওই সুন্দর কালো চোখে 
কে দেখতে পায় সন্ত্রাসের ভয় ?

একটি মেয়ের অসহায়তা
যে শুধু নিজের জীবন কাটাতে চেয়েছে
তার পরিবারের সঙ্গে
তার বাড়িতে
তার জনগণের মধ্যে
আর তার দেশে

কে তাদের উদ্ধার করবে ?
স্বাধীন জগতের রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র
তাদের বাঁচাবার জন্য
অমন দানবতা থেকে
তবু পাষাণ নৈঃশব্দ
জগতের ঠোঁটে

ছায়ায়
পেশমেগরা নারীরা
তাদের জমিজমা অন্ধকার থেকে
আলোয় আনতে চাইছে

ছায়ায় 
অনামা কর্মীরা
ভালোবাসায় ভরা হৃদয়ে
হাত আর শব্দ দিয়ে
মুক্ত করতে চাইছে

তারা কখনও  সংবাদ হয় না
কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়
অনেক সময়ে তারা মারা যায়
শহিদের মৃত্যু
যাদের সন্মানিত করে মরুভূমি
কিংবা কোনো অলিভ গাছ ।

নাদিয়া মুরাদ
কেন ?
আমাকে বলো, কেন ?
ইয়াজিদিদের এতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে ?
ইতিহাসের মাটিতে পড়েছে চোখের জল ।
অস্বীকারের দেয়াল-পরদার পেছনে
না-বলা প্রামাণিক সাক্ষপত্রগুলো উধাও হয়ে গেল, যতক্ষণ না…
নাদিয়া মুরাদ মুক্ত এলাকায় পালিয়ে এলেন,
আর নিজের গল্প বললেন ।
কালো বুটজুতো নেমে এলো
ইরাকে তাঁর কোচো গ্রামে।
পুরুষরা এলো ধর্ষণ আর হত্যা করতে-করতে ।
মেয়েটিকে করা হলো সাবাইয়া,
যৌন ক্রীতদাসি।
মেয়েটি বেঁচে রইলো,
যাতে সবাইকে বলতে পারে ।
ভুলে যেও না,
ভুলে যেও না ।
নাদিয়া মুইরাদ
হবে শেষতম তরুণী !
লড়বে আইসিসিসের বিরুদ্ধে ।
গণহত্যার বিরুদ্ধে।
অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নয়, 
কিন্তু শব্দ দিয়ে ।
ন্যায়বিচারের জন্য ।
আমরা সবাই বিশ্বনাগরিক ।
মেয়েটি কতো সাহসী, কতো দৃঢ় ।
ওর লড়াইকে বৃথা যেতে দিও না।
আবার সবায়েরর জন্য সকাল আসুক।
মেয়েটি আমাদের কন্ঠস্বর !

আত্মপরিচয়
হায়মান আলকারসাফি
ওদের বলো যে আমি মরব না,
ওরা লাঠি ভেঙে ফেললেও
যা আমাকে ইতিহাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । 
আমার শরীর শক্তি সঞ্চয় করে নেবে
একগুঁয়েমিকে জয় করার জন্য ।
সঞ্চয় করে নেবে দুর্দশা সহ্য করার ক্ষমতা,
আর শিশুদের স্বপ্নের কাচের ফলার ওপর দিয়ে
আমি আমার বাড়ি ফিরব ।
ওদের বলো, ওরা ইঁদুরের মতন আমার সঙ্গে লড়েছে,
কিংবা আমাকে কোতল করেছে,       
আমার আত্মপরিচয়কে তাদের চোয়ালের মাঝে আটক করে ।
এই পর্বতমালা প্রতিবেশির ছেলেকে জড়িয়ে নিয়েছে।   

ওদের বলো   
যে এগুলো কেবল ফিসফিস করে বলা কথা নয়
কিংবা নকল দেশপ্রেমিকের কান্না -- তা আসলে
আমার ব্যক্তিগত আত্মপরিচয়,
আমার ইয়েজিদি অহং,
আমার ভাষা,   
আমার সিঞ্জারি আত্মা---
আমি বিভ্রান্ত হবো না ।

আমি এখনও বেঁচে আছি
শিশুদের দেহে।
আমি অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবো,
আমার হাতে শান্তি আর বিজয়ের পতাকা নিয়ে ।

বন্দি
মুরাদ সুলেইমান আল্লো
ভালোবাসার মরুযাত্রীদলে যোগ দাও আর আমার যাত্রীদলের চেয়ে এগিয়ে যাও,
নাওয়াফেল প্রার্থনায় একটা চিঠি দিয়ে দিও।
মৃত্যুর কালো মুখের সামনে সজোরে চিৎকার করো,   
আজকে পাপিয়াদের গান যথেষ্ট নয় ।
তুমি কোন প্রার্থনা পছন্দ করো, হে হ্যাজেল-চোখ নারী ?   
সিঞ্জারের শোকের কথা জানাও, প্রশ্ন কোরো না ।
সবসময় ময়ূরপঙ্খী দেবদূতকে বিশ্বাস করো, তিনি দেবদূতদের প্রধান,
তাঁর নামে, তাঁর ক্ষমতায় আমি তোমার শেকল আর বন্ধন ছিন্ন করব।
দয়েশদের বলো জিব্রিল দেবদূতকে নিজেদের সততার প্রশ্ন করতে ।
কবে থেকে নষ্ট অলসদের দেয়া হয়েছে খলিফাগিরি ?   
তোমরা আমার রক্ত যদি ঝরাও, তা কখনও শুকোবে না ।     
কবে থেকে মরুভূমির বালি ফুরিয়ে গেছে ?
তোমদের হত্যার ফরমান আমাদের ধ্বংস করতে সফল হবে না ।
ব্যাবিলনের সভ্যতাকে পুড়িয়ে তোমরা নষ্ট করতে পারোনো পারবেও না।
প্রতিবেশিদের আপসে লড়িয়ে দেবার মধ্যে গৌরব নেই
আর পোয়াতি নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো পুরস্কার নেই ।
তোমরা বলতে পারো যে তোমাদের আক্রমণ একটা ন্যায্য কাজ, 
যেমন একসঙ্গে ডাঁটিকে ঘিরে থাকে কাঁটারা।
তোমরা অজ্ঞ মূঢ়, তোমাদের পোশাকের মতন হৃদয়ও কালো
মরুভূমির অপদার্থ বারবনিতাপুত্র তোমরা, জঞ্জালের প্রতিভূ ।
আমরা দায়ুদ, মির্জা আর বাশার গৌরবকে আবার প্রতিষ্ঠা করব ।






Friday, July 19, 2019

নাগাল্যাণ্ডের কবি টেমসুলা আও-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

নাগাল্যাণ্ডের কবি টেমসুলা আও-এর কবিতা

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
 
সেই বুড়ো গল্পকথক
আমি জীবন কাটিয়েছি এই ভেবে
গল্প বলা আমার গর্বের উত্তরাধিকার ।
যেগুলো আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি
আমার দাদুর কাছ থেকে তা হয়ে উঠল
আমার প্রথম ঐশ্বর্য
আর যেগুলো আমি অন্য কথকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি
তা যোগ হল জাতিগত ঐতিহ্যের সঙ্গে ।
যখন আমার সময় এলো আমি গল্প বলতুম
যেন সেগুলো আমার রক্তে বই্ছে
কেননা প্রতিবার বলার ফলে তা আমার
জীবনের তেজকে পুনরুজ্জীবিত করে দিতো
আর প্রতিটি গল্প চাঙ্গা করে তুলতো
আমার জাতিগত পূর্বস্মৃতি।
গল্পগুলো সেই মুহূর্তের কথা বলতো
যখন আমরা ফেটে বেরোলুম
ছয়টা পাথর থেকে আর
কেমন করে প্রথমপিতারা প্রতিষ্ঠা করলেন
আমাদের প্রাচীন গ্রামগুলো আর
প্রকৃতির শক্তিমত্তাকে পুজো করতে লাগলেন ।

যোদ্ধারা আর যারা ছিল বাঘ
গল্পের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠতেন
যেমন হয়ে উঠতো অন্য প্রাণীরা
যারা একসময়ে আমাদের ভাই ছিল
যতোদিন না আমরা মানুষের ভাষা আবিষ্কার করলুম
আর তাদের বদনাম দিলুম হিংস্র হিসেবে ।
দাদু অবিরাম সতর্ক করতেন
 যে গল্পগুলো ভুলে যাওয়া হবে
সবায়ের সর্বনাশ :
আমরা আমাদের ইতিহাস হারিয়ে ফেলবো,
এলাকা, আর নিশ্চিতভাবে
আমাদের অপরিহার্য আত্মপরিচয় ।
তাই আমি গল্প বলতুম
যা ছিল আমার জাতিগত দায়িত্ব
যাতে কমবয়সীদের মনে যোগাতে পারি
আবহমানকালের শিল্প
অস্তিত্বের ইতিহাস আর জরুরি ঐতিহ্য
পরের প্রজন্মে পৌঁছে দেবার জন্য।
কিন্তু এখন আরম্ভ হয়েছে নতুন যুগ ।
বুড়োদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কপটতার আশ্রয়ে ।
আমার নিজের নাতিরা বাতিল করে দ্যায়
আমাদের গল্পগুলোকে প্রাচীন বকবকানি হিসাবে
অন্ধকার যুগের, ফালতু হয়ে যাওয়া
এই বর্তমানকালে আর জিগ্যেস করে
কেই বা চায় এইসব অসংলগ্ন গল্পগাছা
যখন বই থেকে বেশি জানা যায় ?
আমার নিজেদের লোকেদের প্রত্যাখ্যান
উৎসার নষ্ট করে দিয়েছে
আর গল্পগুলোকে মনে হয় পশ্চাদগমন
এমন গর্তে যেখানে পৌঁছোনো যাবে না
যে মন একসময়ে গল্পে স্পন্দিত ছিল
এখন পর্যবসিত হয়েছে অকল্পনীয় স্হবিরতায় ।
তাই যখন আমার স্মৃতি হারিয়ে যায় আর কথায় গোলমাল হয়
আমি পশুসূলভ এক চাহিদার কাছে পরাস্ত বোধ করি
মনে হয় ছিঁড়ে বের করে আনি চুরিকরা নাড়িভুঁড়ি
সেই আদিম কুকুরটা থেকে
আমার আমার সব গল্প ঢুকিয়ে দিই
তার প্রাচীন অন্ত্রের মূল দলিলে ।
একটি একশিলা-মূর্তির প্রার্থনা   
আমি গ্রামের সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে থাকি
আমার আগের অবস্হার ইয়ার্কি হিসাবে ।            
এক সময়ে আমি গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকতুম
গর্বে আর সন্তুষ্ট
আমার টোলপড়া হাসিমুখ প্রেমিকা
দাঁড়িয়ে থাকতো আমার পাশে ।
তারপর একদিন কিছু বাইরের লোক
খোঁচা দিতে-দিতে আর উঁকিঝুঁকি মেরে
এখানের টিলাটায় ছোরা ঢোকালো
আরেক জায়গায় পাথর যাচাই করল ।
হঠাৎ ওদের বুড়ো লোকটা
আমাকে দেখতে পেলো আর চেঁচালো,
‘আহা, এইটাই চাই
এতেই কাজ হবে ।’
অন্যরা আমার প্রেমিকাকে দেখে
মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘কিন্তু এটা নয়
নোংরা ফাটলটা দ্যাখো।’
আমি প্রতিবাদ করলুম আর অনুরোধ করলুম,
‘দয়া করে ওকে ছেড়ে যাবেন না
ওটা গালের টোল
এক বিদ্যুৎ যাবার পথে দিয়ে গেছে।’
কিন্তু তারা আমার অনুরোধকে আমল দিলো না
আর নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করল ।
আমাকে বেদি থেকে উপড়ে তুললো
প্রেমিকার পাশ থেকে কেটে আলাদা করল
বাটালি দিয়ে চাঁছলো আমাকে
অন্যরকম চেহারা দিলো।
ওরা আমাকে গ্রামে টেনে নিওয়ে গেলো
একটা চলনসই ঠেলাগাড়িতে বেঁধে ফেলল
আর পুঁতে দিল পালটে-দেয়া আমায়
তাদের নতুন পাওয়া ট্রফি হিসাবে ।
দলটা যখন গ্রামে পৌঁছোলো
বাচ্চারা হইচই করে বেরিয়ে এলো,
উলু দিল রঙিন-পোশাক মহিলারা
আর মাতাল পুরুষরা নাচতে লাগল
আম,আর নতুন পোঁতা
দুর্দশা ঘিরে ।
এমনকি গ্রামের কুকুররা
দৌড়ে এসে নিজেদের ঠ্যাঙ তুলে ধরল
বাটালি-চাঁছা আমার চেহারায়
তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য
সার্বজনিক গর্বে 
আর আমি লজ্জায় দাঁড়িয়ে রইলুম
অন্য কারো খ্যাতির খাতিরে ।
এইভাবেই আমি গ্রামের সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে থাকি
আমার পুরোনো অবস্হার ইয়ার্কি হিসেবে।
হে প্রকৃতির শক্তি,
যখন তুমি জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবে
আর আমার প্রেমিকা জানতে চাইবে
তাকে বোলো
আমি আমার গরিমায় অবতীর্ণ হয়েছি
কিন্তু কখনও, দয়া করে, দয়া করে, বোলো না
আমার অবমাননার কাহিনি ।