জাঁ জেনে’র কবিতা ( ১৯১০ - ১৯৮৬ ) ‘শবযাত্রার কুচকাওয়াজ’
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
১
এক কোনে আবদ্ধ, একটুখানি রাত রয়ে গেছে।
আমাদের ভিতু আকাশে নির্মম আঘাতে স্ফূলিঙ্গ উগরে
( নৈশব্দের গাছেরা কিছু দীর্ঘশ্বাস ঝুলিয়ে রেখেছে )
এই শূন্যতার শীর্ষে গরিমার এক গোলাপ জেগে।
ঘুম বড়োই বিশ্বাসঘাতক যেখানে জেলখানা আমায় নিয়ে এসেছে
যদিও আমার গোপন দালানে বেশ আস্পষ্টভাবে
ওই অহংকারী ছোঁড়া গভীরভাবে নিজের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে
নাবিকদের আলোয় ঝলমলিয়ে যারা শব-সুন্দরী গড়ে তোলে ।
২
ও আমাকে নিজের ভেতরে শেকল পরিয়ে রাখে
জেলখানার এই কুড়ি বছর বয়সী পরিদর্শক
আর ও আমায় চিরকালের জন্য শেকল পরিয়ে রাখে !
একটিমাত্র ইঙ্গিত, ওর চোখ, দাঁতে চুল চিবোয় :
আমার হৃদয় খুলে যায়, আর পরিদর্শক, উৎসবময় উল্লাসে
আমাকে নিজের অন্তরে জেলবন্দী করে ।
এই অসূ্য়াভরা দরোজা আবার বন্ধ হবার সুযোগ পায় না
অনেক বেশি দয়ায়
আর তুমি তো ইতোমধ্যেই ফিরেছো । তোমার পরিপূর্ণতা আমাকে আতঙ্কিত করে
আর আমি আজকে শুনতে পাই আমাদের ভালোবাসা বর্ণিত হচ্ছে
তোমার মুখে যা গান গায় ।
এই ছোরামারা ট্যাঙ্গো যা জেলখুপরি শুনতে পায়
বিদায়বেলার এই ট্যাঙ্গোনাচ ।
তাহলে কি তুমি, হে প্রভূ, এই উজ্বল বাতাসে ?
তোমার আত্মা গোপন পথে এগিয়েছে
দেবতাদের থেকে পার পাবার জন্য ।
৩
যখন তুমি ঘুমোও রাতের আস্তাবল ভেঙে ঘোড়ারা
তোমার চ্যাটালো বুকে নামে, আর জানোয়ারগুলোর টগবগ
অন্ধকারকে ছত্রভঙ্গ করে তোলা যেখানে ঘুম নিজের
ক্ষমতার যন্ত্র চালায়, আমার মগজ থেকে ছিঁড়ে
একটুও শব্দ না করেই ।
ঘুম অনেক শাখা তৈরি করে
তোমার পা থেকে ফুল
তাদের কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে আমি ভয় পাই ।
তোমার মোলায়ের পাছার বাঁকের ওপরে, মিলিয়ে যাবার আগে
তোমার শাদা ত্বকে তা নীলাভ।
কিন্তু একজন জেল পরিদর্শক কি তোমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, আমার কচি চোর
যখন তুমি তোমার হাত ধুয়ে নাও ( ওই পাখিগুলো তোমার দস্তানায়
ডানা ঝাপটায়, একশো দুঃখের ভারে )
তারপর তুমি নির্দয়ভাবে নক্ষত্রদের আলোকরশ্মিকে ছারখার করে দাও
তোমার কাঁদতে-থাকা মুখের ওপরে ।
তোমার শোকেভরা অবশিষ্টাংশে
মহিমাময় অঙ্গভঙ্গী ধরে রাখা হয়
তোমার হাত যেটা একে ছুঁড়ে দিয়েছিল, রশ্মি দিয়ে বীজ পুঁতেছিল।
তোমার গেঞ্জি, তোমার শার্ট, আর তোমার কালো বেল্ট
আমার জেলখুপরিকে অবাক করে আর আমাকে হতবুদ্ধি করে তোলে
তোমার সুন্দর হস্তিদন্তের সামনে ।
৪
সারাদিনের সুন্দর রাতগুলো
পিলর-এর অন্ধকার
তোমার কালো পাকের ভেতরে
আমার ছুরি জাল করা হয় ।
ঈশ্বর, এখানে আমি উলঙ্গ
আমার ভয়ঙ্কর লুভরেতে ।
কেউ চিনতে পারে না
তোমার বন্ধ মুঠো আমায় খুলে দ্যায় ।
আমি ভালোবাসা ছাড়া কিছু নই
আমার সমস্ত শাখা জ্বলে
যদি আমি দিনটাকে অন্ধকার করে দিই
তারপর আমার ভেতরের ছায়া নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।
বিশুদ্ধ হাওয়ায় এটা সম্ভব
আমার শুকনো দেহ গুঁড়িয়ে ধুলোয় মেশার জন্য
দেয়ালে পিঠ দিয়ে
আমি বিদ্যুতের চমকের দখল নিই ।
হৃদয় আমার সূর্য
মোরগের ডাকে চৌচির হয়ে যায়
ঘুম কখনও সাহস দেখায় না
এখানে তার স্বপ্নগুলোকে উথলে দিতে।
আমার আকাঙ্খায় শুকিয়ে যাওয়া
আমি স্তব্ধতাকে মেরামত করে দিই
পাখিদের আগুন দিয়ে
যা আমার গাছ থেকে জেগেছে ।
৫
নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনে হয় এমন মহিলাদের থেকে
তাদের খবরিয়ারা গয়না পরে থাকে ।
গলির এই ছিঁচকে চোরগুলো রাতের বেলায় জেগে ওঠে
আর তাদের ইশারা পেয়ে তুমি সাহসে বেরিয়ে পড়ো।
অমন এক কচিখোকা, নিজের মায়াময় পোশাকে কাঁপে
ও ছিল আমার কাছে পাঠানো দেবদূত, যার আলোময় দিশা
আমি অনুসরণ করি বিভ্রান্ত হয়ে, যাত্রায় পাগল হয়ে
এই জেলখুপরি পর্যন্ত যেখানে তার প্রত্যাখ্যান ছিল জ্যোতির্ময়।
৬
যখন আমি অন্য সুরে গাইতে চাইলুম
আমার পালক আলোকরশ্মিতে জড়িয়ে পড়লো
এক ঝিমধরা শব্দে, মাথা নিচু করে
আমি বোকার মতন পড়ে গেলুম, এই ভুলের মাশুল হিসেবে
এই খাদের তলায় ।
৭
আর কিছুই গোলমাল
বাধাবে না অনন্তকালীন ঋতুতে
যেখানে আমি নিজেকে আটক আবিষ্কার করছি ।
একাকীত্বের স্হির জলাশয়
আমাকে পাহারা দেয় আর জেলখানা ভরে রাখে ।
আমি চিরকালের জন্য কুড়ি বছর বয়সী
তোমাদের নিরীক্ষণ সত্বেও ।
তোমাদের মন রাখতে, ওহ বধির সৌন্দর্যের অনাথ
মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি পোশাক পরে থাকবো
আর তোমার আত্মা তোমার মুণ্ডকাটা ধড়কে ছেড়ে গিয়ে
আমার ভেতরে খুঁজে পাবে এক শাদা আশ্রয় ।
ওহ একথা জানতে পারা যে তুমি আমার মামুলি ছাদের তলায় শোও!
তুমি আমার মুখ দিয়ে কথা বলো
আমার চোখ দিয়ে দ্যাখো
এই ঘর তোমার আর আমার কবিতা তোমার।
যা ভালো লাগে তার জন্য আরেকবার বেঁচে নাও
আমি নজর রাখছি ।
৮
হয়তো তুমিই ছিলে সেই দানব যে কেঁদেছিল
আমার উঁচু দেয়ালের পেছনে ?
রেশমি ফিতের চেয়েও মোলায়েম তুমি ফিরে এসেছো
আমার দৈব দুর্বৃত্ত
এক নতুন মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়তি আবার তছনছ করে
আমাদের নিরানন্দ ভালোবাসাগুলো
কেননা তুমিই তো ছিলে আবার, পিলর, মিথ্যা বোলো না
এই চুরিকরা ছায়াগুলো !
৯
যে খোকাটাকে আমি খুঁজছিলুম
বাচ্চাদের মধ্যে খেলছে
নিজের বিছানায় মরে পড়ে আছে, একা
এক রাজকুমারের মতন ।
নিজের আলতো পায়ে ইতস্তত করে
এক মহিমা ওর পায়ে জুতো পরায়
আর দেহ ঢেকে দ্যায়
রাজকীয় পতাকায় ।
হাতে গোলাপ ধরে-থাকা মিষ্টি ভঙ্গীতে
শবগুলো কে যে হাত লুটপাট করছিল তা চিনতে পারলুম।
একজন সেনা অমন কাজ করবে না
যা তুমি, একা, করেছিলে
আর তুমি তাদের মধ্যে নেমে গেলে
ভয়ও পেলে না
পশ্চাত্তাপও নয় ।
তোমার দেহের মতন
একটা কালো গেঞ্জি তোমার আত্মাকে দস্তানায় ঢুকিয়ে রাখলো
আর যখন তুমি নির্দিষ্ট সমাধিকে অপবিত্র করলে
তুমি ছুরির ডগা দিয়ে খোদাই করে দিলে
শব্দ আন্দাজ করার ধাঁধা
বিদ্যুৎ দিয়ে নকশাকাটা ।
আমরা তোমার উথ্থান দেখেছি, উন্মাদনায় বয়ে যাওয়া
নিজের চুলে ঝুলছ
লোহার মুকুটে
মুক্ত-বসানো ফিতেয় আর বাসি গোলাপে
জীবন্ত ধরবার জন্যে মোচড়ানো হাত ।
তোমার মৃদু হাসি আমাদের দেখাবার জন্য সবেই ফিরেছ
তুমি দ্রুত উধাও হয়ে গেলে আমার মনে হয়
আমাদের কিছু না জানিয়ে, তোমার ঘুমন্ত গরিমা
আরেক মুখের সন্ধানে অন্যান্য আকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে।
পথচলতি এক বালককে লক্ষ করি
তোমার সুগঠিত দেহের ঝলক
আমি তার মাধ্যমে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি
কিন্তু তার এক সামান্য ইশারা
তার কাছ থেকে তোমাকে উধাও করে দিলো
আর তোমাকে আমার কবিতায় ছুঁড়ে ফেললো
যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে না ।
কোন দেবদূত তাহলে
তোমাকে পাশ দিয়ে যাবার অনুমতি দিলো
অকাতরে বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে
হাত দিয়ে বাতাসকে দুফাঁক করে
ক্ষেপণাস্ত্রের ডগার সূক্ষ্ম ঘূর্ণনের মতো
যা নিজের দামি পথ খুঁজে নিজেই তাকে নষ্ট করে ?
তোমার পালাবার সংকীর্ণতা আমাদের নিরানন্দ করেছিল ।
এক দ্যুতিময় পিছুটান তোমাকে আমাদের আলিঙ্গনে এনে দিয়েছিল।
তুমি আমাদের গলায় টোকা মেরে আমাদের মন ভরাতে চাইলে
আর তোমার হাত ছিল ক্ষমাময়
কামানো চুলের দরুণ ।
কিন্তু তুমি আর দেখা দাও না, ফর্সা খোকা যাকে আমি খুঁজি।
আমি কোনো শব্দে হুঁচোট খাই আর তোমাকে তার বিপরীতে দেখি।
তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাও, কবিতা আমাকে রক্ষা করে।
কান্নার কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে আমি বিপথগামী হই ।
তোমাকে ধরার জন্য আকাশ নানা ফাঁদ পেতেছিল
করাল আর নতুন, মৃত্যুর সঙ্গে ষড় করে
এক অদৃশ্য সিংহাসন থেকে নজর রাখছিল
সুতোগুলো আর গিঁটগুলো
সোনার ববিনে পরানো ।
আকাশ এমনকি মৌমাছিদের যাত্রাপথ ব্যবহার করেছিল
কতোরকমের রশ্মি আর কতোরকমের সুতোর পাক খুলে
যে সেষ পর্যন্ত ওকে গোলাপের সৌন্দর্য ধরে ফেললো :
ছবিতে দেখানো এক শিশুর মুখ ।
এই খেলা যদি নিষ্ঠুর হয় তাহলে আমি নালিশ করব না
তোমার সুন্দর চোখ খুলে ফেলার জন্য
দুঃখের এক গান তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল
অতো সন্ত্রাসকে আয়ত্ত করে
আর এই গান, হাজার বছরের জন্য
তোমার কফিনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।
দেবতাদের ফাঁদে আটক, তাদের রেশমিসুতোয় কন্ঠরুদ্ধ
কেন আর কেমন করে না জেনেই তুমি মারা গেলে ।
তুমি আমাকে ছাপিয়ে জিতে গেছ
কিন্তু সাপসিঁড়ি লুডোখেলায় হেরে গেছ
যেখানে আমি তোমাকে ধর্ষণ করার সাহস দেখাই
ওগো আমার পলাতক প্রেমিকা ।
কালো সেনারা তাদের বন্দুক নত করলেও
তুমি ওই বিছানা ছেড়ে পালাতে পারো না যেখানে লোহার মুখোশ
তোমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে -- কিন্তু হঠাৎ তুমি উঠে দাঁড়াও
নড়াচড়া না করেই পেছনে পড়ে যাও
আর নরকে ফেরো ।
১০
আমার ভালোবাসার কালকুঠুরি
তোমার স্পন্দিত ছায়ায়
আমার চোখ, আচমকা, এক গোপনকথা আবিষ্কার করেছে ।
আমি কতো রকম শোয়া শুয়েছি তা জগত জানে না
যেখানে সন্ত্রাস নিজেই গিঁট পাকায় ।
তোমার অন্ধকার হৃদয়ের দর-দালানগুলো আঁকাবাঁকা পথ
আর তাদের জড়োকরা স্বপ্নগুলো স্তব্ধতাকে সঙ্গঠিত করে
কবিতার সঙ্গে মিল আছে এমন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া
আর তার হুবহু তীব্রতা ।
আমার চোখ আর আমার কপাল থেকে
তোমার রাত কালির বন্যা বয়ে যেতে দ্যায়
এমন ঘন পালক যার ওপরে আমি এখানে শুই
নিয়ে আসবে কুসুমিত নক্ষত্রদের
যেমন কেউ গোলাগুলির বেড়াজালে দেখতে পায় ।
আমি তরল অন্ধকারের দিকে এগোই
যেখানে অবয়বহীন ষড়যন্ত্রেরা
ধীরে ধীরে আকার পাওয়া আরম্ভ করে ।
কেনই বা আমি সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করব ?
আমার সমস্ত অঙ্গবিক্ষেপ ভেঙে টুকরো হয়
আমার আমার কান্নাগুলো
খুবই সুন্দর ।
আমার চাপা দুর্দশা থেকে শুধু তুমিই জানতে পারবে
দিনের মেলে দেয়া অদ্ভুত সৌন্দর্যগুলো ।
ওদের হাজার রকমের ভেলকিবাজির পর
যে বজ্জাতদের কথা আমি শুনি
খোলা বাতাসে ভিড় জমায় ।
পৃথিবীতে তারা একজন কোমল প্রতিনিধি পাঠায়
এক শিশু যে কারোর পরোয়া করে না, আর নিজের যাত্রাপথ চিহ্ণিত করে
অনেকরকমের চামড়া ফাটিয়ে
আর ওর খোশমেজাজি বার্তা
এখানে পায় নিজের জাঁকজমক ।
কবিতাটা পযে তুমি লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাও
অপরাধী অঙ্গভঙ্গী দিয়ে একজন বয়ঃসন্ধির লেখা
কিন্তু তুমি কখনও জানতে পারবে না
মৌলিক গিঁটগুলোর কোনও ব্যাপার
যা আমার মলিন ক্রোধের ফসল
কেননা ওর রাতে যে গন্ধগুলো গড়াচ্ছে তা খুবই তীব্র।
ও সই করবে পিলর আর ওর মহিমান্বয়ন হবে
গোলাপ-স্রোতের উজ্বল ফাঁসিমঞ্চ
মৃত্যুর সুন্দর কর্মফল ।
১১
সম্ভাবনা -- সবচেয়ে মহার্ঘ সম্ভাবনা !
প্রায়ই আমার পালককে তৈরি করতে বাধ্য করেছে
আমার সমস্ত কবিতার হৃদয়কেন্দ্র
সেই গোলাপ যার ওপরে শাদা শব্দে লেখা মৃত্যু
বাহুর ফেট্টিতে নকশা করা
যে কালো যুদ্ধাদের আমি ভালোবাসি তাদের নাম।
আমার রাতের ভেতর দিয়ে কোন বাগানই বা ফুল ফোটাতে পারে
কোন যন্ত্রণাময় খেলা এখানে হয় যে
এই কেটে নেয়া গোলাপ থেকে পাপড়ি ছেঁড়া হয়
আর কে তাকে নিঃশব্দে ফাঁকা কাগজে নিয়ে যায়
যেখানে তোমার হাসি তাকে অভিবাদন করে ?
কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষকিছু আমি জানি না
মেয়েটির বিষয়ে এতো কথা বলার পরও
আর গুরুতর উপায়ে
তাহলে মেয়েটি আমার ভেতরেই বাস করে
যাতে সহজে জেগে উঠতে পারে
আমার আমার আবোলতাবোল থেকে বইতে পারে
অন্তত আমার শব্দগুলো ।
মেয়েটির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না
বলা হয় যে ওর সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল
অনন্তকালকে খেয়ে ফ্যালে
কিন্তু এই বিশুদ্ধ বিচরণ পরাজয়ে বিদীর্ণ হয়
আর এক বিয়োগান্তক বিশৃঙ্খলার গোপনীয়তাকে ফাঁস করে ।
অশ্রুবিন্দুর আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে ফ্যাকাশে
মেয়েটি খালি পায়ে আসে ফুৎকারে আত্মপ্রকাশিত হয়ে
আমার উপরিতলে যেখানে ফুলের এই তোড়াগুলো
আমাকে শেখায় মৃত্যুর
কন্ঠরোধী কোমলতা।
আমি নিজেকে তোমার আলিঙ্গনে ছেড়ে দেবো, হে বর্ণোজ্বল মৃত্যু
কেননা আমি জানি কেমন করে আবিষ্কার করতে হয়
আমার উন্মুক্ত শৈশবের চলমান চারণভূমি
যেখানে তুমি আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যাবে
অপরিচিত লোকটার ফুলেফুলে সাজানো লিঙ্গের কাছে ।
আর এই শক্তিতে বলবান, হে রানি, আমি হবো
তোমার ছায়াদের নাটকের গোপন মন্ত্রী ।
মিষ্টি মৃত্যু, আমাকে নাও, আমি তৈরি
এই যে আমি এখানে, আমি যাচ্ছি
তোমার নিরানন্দ শহরে ।
১২
একটা শব্দে আমার কন্ঠস্বর হুঁচোট খায়
আর অভিঘাত থেকে তুমি উৎসারিত হও
এই অলৌকিকতার জন্য ততোটা উৎসাহী
যতোটা তুমি তোমার অপরাধগুলোর জন্য !
কেই বা তাহলে অবাক হবে
যখন আমি আমার নথিগুলো খুলে ধরব
যাতে পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে অন্বেষণ করা যাব
শব্দের ঝোপঝাড়গুলো ?
আমার হাতে আরও দড়ি ধরিয়ে দেবার জন্য বন্ধুরা লক্ষ রাখে
জেলখানার ছড়ানো ঘাসে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো ।
তোমার জন্য, এমনকি তোমার বন্ধুত্বের জন্য
আমি পরোয়া করি না ।
আমি এই সৌভাগ্যকে আগলে রাখি
যা বিচারকরা আমাকে দেন ।
এটাকি তুমি, অন্য আমি, তোমার রুপোর চটি ছাড়াই
সালোম, যে আমাকে একটা গোলাপ কেটে এনে দ্যায় ?
এই রক্তাক্ত গোলাপ, শেষ পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ থেকে খোলা
তা কি মেয়েটির, নাকি এটা জাঁ জেনের মাথা ?
উত্তর দাও পিলর ! তোমার চোখের পাতাকে পিটপিট করতে দাও
আমার সঙ্গে তির্যক কথা বলো, তোমার গলায় গান গাও
তোমার চুলের কাছে কাটা আর গোলাপঝাড় থেকে পড়ে যাওয়া
হুবহু শব্দে, হে আমার গোলাপ
আমার প্রার্থনাকে মেনে নাও ।
১৩
হে আমার কারাগার যেখানে আমার বয়স না বাড়লেই আমি মারা পড়ি
আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
জীবন, মৃত্যু দিয়ে সাজানো, আমাকে শুষে নেয় ।
তাদের ধীর কঠিন ওয়ালৎজ উল্টোদিকে নাচা হয়
প্রত্যেকে নিজের মহিমান্বিত কার্যকারণের পাক খোলে
অন্যের বিরোধীতায় ।
তবু, আমার অনেকটা জায়গা আছে, এটা আমার সমাধি নয়
আমার জেলখুপরি বেশ বড়ো আর আমার জানালা অতিবিশুদ্ধ ।
আবার জন্ম নেবার জন্য অপেক্ষা করছি জন্মের আগের রাতে
আমি নিজেকে তেমনভাবে বাঁচার অনুমতি দিয়েছি যাতে আমাকে
মৃত্যু চিনতে পারে
উচ্চতর ইশারার মাধ্যমে ।
আকাশ ছাড়া আর সকলের জন্য আমি আমার দরোজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি
আর আমি কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ মুহূর্তের অনুমতি দিই
খোকা চোরগুলোকে যাদের ফিসফিসানিতে আমার কান গুপ্তচরগিরি করে
নিষ্ঠুর আশায়, আমার সাহায্যের ডাকের জন্য
তাদের সমাপ্ত গানের মাধ্যমে ।
যদি আমি ইতস্তত করি আমার গান নকল নয়
কেননা আমি আমার গভীর মাটির তলায় খোঁজ করি
আর আমি প্রতিবার একই ধ্বনন নিয়ে উঠে আসি
জীবন্ত কবর দেয়া ঐশ্বর্যের টুকরো-টাকরা
যা জগতের আরম্ভ থেকে ছিল ।
যদি তুমি দ্যাখো আমার টেবিলের ওপরে ঝুঁকে আছি
সাহিত্যে বরবাদ আমার মুখাবয়ব
তাহলে বুঝবে যে এটা আমাকেও পীড়িত করে
এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ
আবিষ্কার করার স্পর্ধা
সেই লুকোনো সোনার
এই প্রচুর
পচনের তলায় ।
এক আনন্দময় জ্যোতি আমার চোখে উদ্ভাসিত হয়
যেন উজ্বল ভোরবেলায় এক জাজিম
পাথরের ওপরে বেছানো
তোমার চলাফেরায় বাধা দেবার জন্য
গোলোকধাঁধা জুড়ে
কন্ঠরুদ্ধ দর-দালানগুলোতে
তোমার চৌকাঠ থেকে
ভোরের
সিংহদ্বার পর্যন্ত ।
( কবিতাটি মরিস পিলর [ Maurice Pilogre ] নামে একজন নামকরা অপরাধীকে উদ্দেশ্য করে। জেলে তার সঙ্গে জাঁ জেনের পরিচয় । ১৯৩৯ সালে গিলোটিনে তার মাথা কাটা হয়েছিল । মরিস পিলর হাসিমুখে গিলোটিনে মাথা দিয়েছিল ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমাভিক্ষা চায়নি । )
No comments:
Post a Comment