Sunday, July 7, 2019

চিলে-র কবি পাবলো নেরুদা-র কবিতা ( ১৯০৪ - ১৯৭৩ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

চিলে-র কবি পাবলো নেরুদার কবিতা ( ১৯০৪ - ১৯৭৩ ) । 
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী


কেবল মৃত্যু
চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নীরব কবর
শব্দহীন হাড়ে-ঠাশা অজস্র গোরস্তান
সুড়ঙ্গ বোনায় ব্যস্ত হৃদয়,
এক অন্ধকার, অন্ধকার ভূগর্ভপথ :
ভাঙা জাহাজের মতন আমরা প্রাণকেন্দ্রের অতল পর্যন্ত মারা যাই,
যেন হৃদয়-বরাবর ডুবে চলেছের
অথবা ত্বক থেকে আত্মার দিকে ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছে

রয়েছে শবদেহের কাতার
পায়ের পরিবর্তে চটচটে পাথরফলক,
হাড়ের ভেতরে আছে মৃত্যু
বিশুদ্ধ এক শব্দের মতন,
কুকুরহীন কুকুরডাকের মতো
কোনো ঘণ্টাধ্বনি থেকে মুক্ত, বিশেষ কবরগুলো
বৃষ্টির আর্তনাদের মতন এই আর্দ্রতায় ফেঁপে উঠছে।

অনেক সময়ে যখন একা থাকি, আমি দেখতে পাই,
পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে কফিনগুলো
বেরিয়ে পড়েছে ফ্যাকাশে মৃতদের নিয়ে,  বিনুনিবাঁধা মৃত নারীরা,
দেবদূতের মতন শাদা পাঁউরুটিঅলা,
দলিল-প্রমাণকের সঙ্গে বিবাহিত দুই মেয়ে,
মৃতদের আকাশমুখো নদী বেয়ে উঠে যাচ্ছে কফিনগুলো,
নিজের উৎসমুখের দিকে মদ-কালো নদী,
মৃত্যুর সঙ্গে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তাদের পাল,
মৃত্যুর শব্দহীন আওয়াজে ভরা ।

শব্দের দিকে আকৃষ্ট হয় মৃত্যু
পা-হীন চটিজোড়ার মতন, মানুষহীন পোশাকের মতন,
দরাজায় রুনুঝুনু টোকা দেয়, আঙুলহীন আর রত্নহীন
চলে আসে হাঁ-মুখহীন চিৎকার তুলতে, জিভ নেই, গলা নেই।
তবু তার পদধ্বনি তো শুনতে পাওয়া যায়
আর তার পোশাক প্রতিধবনি তোলে, ঠিক যেন গাছের ফিসফিস ।

আমি কিছুই জানি না, আমি অবিদিত, দেখতে পাচ্ছি না কিছু
কিন্তু আমার মনে হয় তার গানের রঙ ভিজে ভায়োলেট ফুলের মতো,
মাটি-পৃথিবীর সাথে সুপরিচিত ভায়োলেট ফুল,
কেননা মৃত্যুর মুখের রঙ সবুজ
কেননা মৃত্যুর দৃষ্টির রঙ সবুজ
ভায়োলেট পাতার গায়ে এচিং-করা আর্দ্রতা
আর যন্ত্রণায় কাহিল শীতের বর্ণে রাঙানো তার কবর ।

কিন্তু মৃত্যু তো সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, ঝাড়ুগাছায় চেপে
মাটিপৃথিবীকে চেটে বেড়ায় শবদেহের খোঁজে---
ওই ঝাড়ুখানাতেই আছে মৃত্যু,
মৃতের খোঁজে তা যেন মৃত্যুর জিভ,
মৃত্যু-ছুঁচ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সুতো।
মৃত্যু আমাদের পালঙ্কে শুয়ে আছে :
অলস তোষকের ওপরে, কালো রঙের কম্বল,
পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে আর হঠাৎই উড়তে শুরু করে,
চাদরগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে অজানা আওয়াজে
বেশ কিছু বিছানা বন্দরের দিকেও উড়ে যায়
যেখানে নৌ-সেনাপতির পোশাকে অপেক্ষা করছে মৃত্যু।

চিলের আবিষ্কারক
দক্ষিণ আলমগারে থেকে সে নিয়ে এলো তার আগুনের গুঁড়ো ।
আর সমগ্র এলাকা জুড়ে, বিস্ফোরণ আর সূর্যাস্তের মাঝে,
ও ঝুঁকে রইল, দিনভর আর রাতভর, যেন রেখাচিত্র দেখছে
কাঁটাঝোপের ছায়া, ক্যাকটাস ও মোমের ছায়া,
স্প্যানিশ লোকটা নিজেরই শুকনো চেহারার সঙ্গে দেখা করছে,
নজর রাখছে এলাকার অন্ধকার দখল-কৌশলের দিকে ।
নিশাকাল, তুষার, আর বালিতে গড়ে উঠেছে
আমার রুগ্ণদেশের নকশা,
দীর্ঘ তীরের কিনারায় পড়ে রয়েছে নৈঃশব্দ,
তার সামুদ্রিক দাড়ি থেকে ফেনা ঝরে পড়ে
রহস্যময় চুমু দিয়ে ঢাকা থাকে ওর কয়লার বিশাল ।
তার আঙুলে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতন জ্বলজ্বলে সোনা
আর সবুজ চাঁদের মতন ঝলমলে তার রুপো।
গোমড়ামুখ উপগ্রহের পুরু ছায়ায় ঢাকা । 
স্প্যানিশ লোকটা একদিন গোলাপের পাশে,
অলিভ অয়েলের পাশে, মদের পাশে, প্রাচীন আকাশের তলায় বসে,
এই খিটখিটে পাথরখণ্ডের কথা ভেবে দেখলো না
যেটি সমুদ্র-ঈগলের গুয়ের তলা থেকে জন্মাচ্ছিল ।

পোশাকের জন্য গাথাকবিতা
প্রতিদিন সকালে তুমি অপেক্ষা করো
পোশাক, চেয়ারের ওপরে,
আমার শ্লাঘা মেটাবার জন্য,
আমার ভালোবাসা,
আমার আশে, আমার শরীর
যাতে তোমায় পূর্ণ করে,
আমি ঘুমকে সবেমাত্র ছেড়েছি,
জলকে বলেছি এখন চলি তাহলে
আর প্রবেশ করেছি তোমার আস্তিনে,
আমার পা দুটো
তোমার ফাঁপা পায়ের খোঁজ করে,
আর তাই
তোমার অক্লান্ত আনুগত্যের আলিঙ্গনে
আমি খড়ের মাড়াই করতে বেরিয়ে পড়ি,
কবিতায় প্রবেশ করি,
জানালার বাইরে তাকাই,
জিনিসপত্রের দিকে,
পুরুষ, নারী,
ঘটনাপ্রবাহ ও সংঘর্ষ
আমি যা আমাকে সেরকমই গড়তে থাকে,
আমার বিরোধিতা করে,
চোখ খুলে দ্যায়,
স্বাদ এনে দ্যায় হাঁ-মুখে
আর এভাবে,
পোশাক,
তুমি যা আমি তোমাকে সেরকমই গড়ে তুলি,
তোমার কনুই হতে টান দিয়ে,
সেলাইয়ে জায়গায় আঁটোসাঁটো,
আর তাই তোমার জীবন স্ফীত হয়ে ওঠে
আমারই জীবনের মূর্তচেহারা ।
তুমি উত্তাল
এবং হাওয়ায় আলোড়ন তোলো
যেন তুমি আমার আত্মা,
ভালো লাগছে না এরকম সময়ে
তুমি আমার হাড়
আঁকড়ে থাকো
ফোঁপরা, রাতের বেলায়
অন্ধকার, ঘুম,
মানুষ তাদের মায়াপুরুষদের সঙ্গে
তোমার আর আমার ডানা হয়ে যায় ।
আমি প্রশ্ন করি
কোনও একদিন কি
একটা বুলেট
শত্রুপক্ষের দিক থেকে
তোমাকে আমার রক্ত দিয়ে ভেজাবে
আর তারপর
তুমি আমার সঙ্গে মারা যাবে
কিংবা হয়তো
না-ও হতে পারে
অমন নাটকীয়
বরং অতি সাধারণ,
তুমি ক্রমে অসুখে পড়বে,
পোশাক,
আমার সাথে-সাথে, আমার শরীরের সঙ্গে
একসাথে
আমরা প্রবেশ করব
পৃথিবীর মাটিতে ।
এই সমস্ত চিন্তায়
প্রতিদিন
আমি তোমায় অভিবাদন করি
শ্রদ্ধায়, আর তারপর
তুমি আমায় জড়িয়ে ধরো অথচ আমি তোমায় ভুলে যাই
কেননা আমরা একাত্ম
অবিরাম মুখোমুখি দুজনে
এক সাথে বাসতাসের, রাতের বেলায়,
পথে-পথে অথবা সংঘর্ষে,
একদেহ
হয়তো, হয়তো, একদিন নিথর ।

এই এপিটাফ এক আলোয় গড়া জানোয়ারের
এবং আজ হারিয়ে যাওয়া অরণ্যের গভীরে
সে শত্রুর আওয়াজ শুনতে পায় আর পালায়
অন্য কারোর কাছ থেকে
সেই অশেষ কথোপকথন থেকে
যে বৃন্দগান সবসময়ে আমাদের সঙ্গে থাকে তা থেকে
এবং জীবনের অর্থময়তা থেকে
কেননা এই একবার, কেননা কেবল একবার, কেননা
একটি শব্দমাত্রা অথবা একটি নৈঃশব্দের বিরামকাল
অথবা একটি ঢেউয়ের অবরোধহীন ধ্বনি
সত্যের মুখোমুখি আমাকে ছেড়ে চলে যায়
এবং তখন আর ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু বাকি নেই,
বলার মতো আর কিছু নেই : এইই সবকিছু ।
অরণ্যের দরোজাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । 
পাতাদের উন্মুক্ত করে সূর্য পাক খেয়ে চলে
চাঁদ ওঠে কোনো শাদা রঙের ফলের মতন
আর মানুষ তার নিয়তির কাছে মাথা নত করে।

No comments:

Post a Comment