Thursday, July 29, 2021

শার্ল বোদলেয়ার এর কাব্যগ্রন্হের সমালোচনা

  


লা ফিগারো পত্রিকায় ২৫ জুন ১৮৫৭ শার্ল বোদলেয়ার-এর ‘ফ্ল্যুর দ্যু মাল’ কাব্যগ্রন্হের সমালোচনা : “বিগত পনেরো বছর যাবত বোদলেয়ার নামে লোকটিকে কবি বলে চালাচ্ছে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, আর তাদের এতো স্পর্ধা যে বোদলেয়ারকে তারা উগো, ম্যুসে, কিংবা বেরাগেঁর চেয়ে বড় কবি বলে মনে করে । মসিয়ঁ বোদলেয়ার তাঁর বইটিতে যা লিখেচেন, তাতে তিনি প্রকৃতিস্হ মানুষ কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ জাগে ; আবার অনেক সময়ে সে সন্দেহটুকুও থাকে না । কবিতাগুলো একঘেয়ে শব্দ আর ধারণার অবিরাম বিকৃত পুনরুক্তি । এর আগে কখনও এত ক্ষুদ্র আয়তনে, মহিলাদের বুকে কামড়, স্তন চিবোনো, পাপাত্মাদের মিছিল দেখা যায়নি । পাঠ করার জন্য পাওয়া যায়নি এতো ভ্রূণ, রাক্ষস, বেড়াল, ছুঁচোর বিবমিষা উদ্রেককারী রচনা । সমগ্র বইটা মানব হৃদয়ের পচা গু-মুতে ঠাসা একটি ফোঁপরা মস্তিষ্কের পাগলা গারদ । বইটা যদি ওই সমস্ত অসুস্হতা সারাবার উদ্দেশ্যে হতো তাহলে মেনে নেয়া যেতো ; কিন্তু ও অসুখ কস্মিনকালে সারবার নয় । বহু কবিতার তো শিরোনাম পর্যন্ত ক্ষতিকর । কুড়ি বছর বয়সী কবি এরকম নোংরামি করলে বয়সের দোষ বলে চালানো যেতো । কিন্তু একজন মাঝবয়সী লোকের কবিতায় কোনো তর্কে তা বরদাস্ত করা উচিত নয়।


 

ইজরায়েলি ভাষার কবি এলি এলিয়াহুর কবিতা

 


ইজরায়েলের ইহুদি ভাষার কবি এলি এলিয়াহু’র কবিতা

অ্যালিবাই

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

যেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল আমরা কফির আড্ডায় বসেছিলুম।

আমরা দিব্বি দিয়ে পরস্পরের উপস্হিতির কথা বলতে পারি ।

পরে, আমরা বাড়ি ফেরার গতানুগতিক রাস্তা ধরলুম ।

যে প্রতিবেশীরা দৌঁড়ে এসেছিল তারা নিশ্চিত বলবে ।

তারপর রোজকার মতো টিভি দেখে বিছানায় সটান হলুম।

সারা রাত আমরা কেউ উঠিনি ।

একটু এপাশ-ওপাশ করেছিলুম বিছানায়, কিন্তু ভালোভাবেই ঘুমোলুম

( আমরা ভাবলুম, ভালোবাসা সব রকমের অপরাধ চাপা দিতে পারে )।

যদি কেউ জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়া ছেলেটার কথা জানতে চায়,

আমাদের কাছে তার যথাযথ অ্যালিবাই আছে।

আমাদের চোখ ঘটনাটা দেখেনি, 

আমাদের হাত সেই রক্তারক্তি ঘটায়নি ।

Tuesday, July 27, 2021

শার্ল বোদলেয়ার-এর 'বিষণ্ণ প্যারিস'

 

প্যারিস স্প্লিন [ বিষণ্ণ প্যারিস ; : শার্ল বোদলেয়ার

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

এক

সেই বিদেশি

“রহস্যময় পুরুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো ? তোমার বাবা, 

তোমার মা, তোমার বোন না তোমার ভাইকে ?”

“আমার বাবা নেই, মাও নেই, বোন নেই, ভাই নেই।”

“তোমার বন্ধুবান্ধব ?”

“এই যে তুমি একটা শব্দ ব্যবহার করলে তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি।”

“তোমার দেশ?”

“আমি জানি না কোন দ্রাঘিমায় তা অবস্হিত ।”

“সৌন্দর্য ?”

“আমি যেচে তাঁকে ভালোবাসবো, তিনি ঈশ্বরী ও অবিনশ্বর।”

“সোনা ?”

আমি তা ঘৃণা করি যেমন ঈশ্বরকে তুমি ঘৃণা করো ।”

“আচ্ছা, তাহলে কীই বা তুমি ভালোবাসো, বিস্ময়কর আগন্তুক ?

“আমি ভালোবাসি মেঘ...যে মেঘ ভেসে যাচ্ছে...ওপরে ওইখানে...ওপরে ওইখানে…

বর্ণনাতীত মেঘমালা !”


দুই

বুড়ির বিষাদ

ছোটোখাটো লোলচামড়া বুড়ি ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে আহ্লাদিত হলেন, যাকে নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত, যাকে সবাই খুশি করতে চাইছিল ; ওনার মতনই পলকা এই সুন্দর প্রাণী, ছোট্ট বুড়ি, আর --- তাঁরই মতন -- দাঁত আর চুলহীন ।

উনি বাচ্চাটার কাছে গেলেন, তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি আর হাসিখুশি মুখ দেখাতে চাইলেন ।

কিন্তু বাচ্চাটা জীর্ণ ভালো বুড়ির আদরে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো, আর সারা বাড়ি নিজের কাঁদুনি দিয়ে ছেয়ে ফেললো ।

তখন ভালো বুড়িটি ফিরে গেলেন নিজের শাশ্বত একাকিত্বে, এককোনে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন, নিজেকে শুনিয়ে বললেন :

“আহ, আমাদের মতন অবজ্ঞেয় বুড়িদের জন্য, নিষ্পাপদের আনন্দ দেবার যুগও চলে গেছে ; আর যে শিশুদের আমরা ভালোবাসতে চাই তাদের মনে আতঙ্ক জাগিয়ে তুলি !”


তিন

শিল্পীর পাপস্বীকার

ওহ, হেমন্তের শেষ দিনগুলো কতো কাঁটা ফোঁটায় -- এমন ফোটায় যে ব্যথার সীমায় পৌঁছে যায়! 

কেননা, তৃপ্তিকর সংবেদগুলোর মধ্যে এমন কয়েকটা আছে, যাদের অনির্দিষ্টতা প্রাচুর্যকে বাদ দিতে পারে না ; আর অনন্ত ছাড়া অন্য কোনও ক্ষুরধার বিন্দু নেই ।

সমুদ্র ও আকাশের বিশালতার দিকে নিজের চাউনিকে সাঁতরাতে দেয়া যে কি আনন্দময় ! নৈঃশব্দ, একাকীত্ব, ওই আশমানি রঙের অতুলনীয় কৌমার্য ! দিগন্তে কাঁপছে এক ছোটো পর্দা, আর, তার ক্ষুদ্রতা ও নিঃসঙ্গতায়, প্রতিবিধানের অসাধ্য আমার অস্তিত্বকে অনুকরণ করে, ঢেউদের একঘেয়ে সঙ্গীত -- এই সবকিছুই আমার মাধ্যমে চিন্তা করে, কিংবা তাদের মাধ্যমে আমি ( কেননা, এই ভাবাবেশের মহনীয়তায়, ওই “আমি” দ্রুত হারিয়ে যায় ) ; ওরা মনে করে, আমি বলতে চাই, কিন্তু তা গানে, ছবি আঁকায়, কোনোরকম তর্ক, ন্যায়সিদ্ধান্ত, ব্যবকলন ছাড়াই ।

কিন্তু এই চিন্তাগুলো, তা আমার মধ্যে থেকে আসুক বা বিভিন্ন বস্তু থেকে উৎসারিত হোক, দ্রুত ঐকান্তিক হয়ে ওঠে । যখন তেজোময়তা মেশে ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে, তা থেকে জন্মায় এক অসুস্হতা এবং এক উপকারক যন্ত্রণা । আমার অত্যধিক পীড়িত স্নায়ু কেবল কটু আর দুঃখময় কাঁপন জাগিয়ে তোলে । আর এখন আকাশের গভীরতা আমাকে বিক্ষুব্ধ করে, স্হবিরতা আমাকে উত্যক্ত করে । সমুদ্রের উদাসীনতা, দৃশ্যের অপরিবর্তনীয়তা আমাকে বিতৃষ্ণ করে...। ওহ, সারাজীবন কি কাউকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, নাকি সৌন্দর্য থেকে চিরকাল পালিয়ে বেড়াতে হবে ? প্রকৃতি, হে নির্দয় মোহিনী, তুমি সব সময়ে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী, আমাকে একা থাকতে দাও!

আমার আকাঙ্খা আর আমার গর্ববোধকে জাগিয়ে তুলো না ! সৌন্দর্যের পাঠ হলো এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ, যা শেষ হয় হেরে যাবার আগে শিল্পীর কান্নামাখা ত্রাসে ।


চার

একজন ভাঁড়

তখন ছিল নববর্ষের বিস্ফোরণ ; কাদা আর তুষারের বিশৃঙ্খলা, হাজার ঘোড়ার গাড়ির চাকায় মাড়ানো, খেলার জিনিশ আর মোমবাতিতে ঝিলমিলে, লোভী কামনা আর বিষাদে একাকার, এক মহান শহরের অনুমোদিত বিকার, সবচেয়ে দৃঢ় নিঃসঙ্গের মনকেও বিরক্ত করার জন্যে পরিকল্পিত ।

এই হইচই আর আওয়াজের মাঝে, চাবুকে হাতে এক গেঁয়ো লোকের ধাতানি খেয়ে, একটা গাধা টগবগিয়ে ভিড়ে ঢুকে গেলো  ।

গাধাটা যখন রাস্তার বাঁক নিতে চলেছে, একজন সাজগোজ করা ভদ্রলোক, হাতে সুন্দর দস্তানা, পালিশ খাওয়া চেহারায় আর চুলে তেল দিয়ে, নিষ্ঠুরভাবে নেকটাই বেঁধে আর নিজের নতুন পোশাকে বন্দী, নম্র প্রাণীটার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণত হলেন আর , নিজের হ্যাট নামিয়ে বললেন, “আমি আপনার সুস্বাস্হ্য এবং আনন্দ কামনা করি !” তারপর, বন্ধুবান্ধব যারা তাঁর পেছনে আসছিল তাদের দিকে বোকার মতন তাকালেন, যেন আত্মতৃপ্তির জন্য তাদের অনুমোদন চাইছেন ।

গাধাটা এই অসাধারণ ভাঁড়কে দেখতেই পেল না, আর যেদিকে তার কাজ সেই দিকে একান্তভাবে টগবগিয়ে যেতে লাগল ।

যদি আমার কথা ধরা হয়, আমি আচমকাই এই অসাধারণ মূর্খের প্রতি বাঁধভাঙা ক্রোধে আক্রান্ত হলুম, যাকে দেখে  আমার মনে হল সে ফরাসিদেশের আত্মা।


পাঁচ

যুগল ঘর

স্বপ্নের মতন এক ঘর, একটা ঘর যা সত্যই জগৎ-বহির্ভূত, যার স্হির আবহাওয়া ফিকে গোলাপি আর নীল ।

সেখানে আত্মা স্নান করে আলস্যে, সুগন্ধিত হয়ে আছে অনুশোচনা ও কামনায় । -- ব্যাপারটা সন্ধ্যাকালের, কিছুটা নীলাভ, গোলাপি ; গ্রহণের সময়কার এক ইন্দ্রিয়ময় স্বপ্ন ।

আসবাবের গড়ন লম্বাটে, শোয়ানো, দুর্বল । মনে হয় আসবাবগুলোও স্বপ্ন দেখছে ; তাদের জীবনে যেন রয়েছে ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলার ক্ষমতা, উদ্ভিদ আর খনিজের মতন । পর্দারা মৌনভাষায় কথা বলছে, ফুলের মতন, আকাশের মতন, সূর্যাস্তের মতন । দেয়ালে কোনো শৈল্পিক জঘন্যতা নেই । বিশুদ্ধ স্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করলে, অবিশ্লেষিত প্রভাবসহ, একটি নির্দিষ্ট এবং ইতিবাচক শিল্প হল ঈশ্বরনিন্দা । এখানে সবকিছুরই রয়েছে যথেষ্ট স্পষ্টতা, আর সেই সঙ্গে ঐকতানের রুচিকর দুর্বোধ্যতা ।

অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বেছে নেয়া পরিমেয়ভাবে ক্ষুদ্র এক সুগন্ধ, হালকা আর্দ্রতার সঙ্গে মেশানো, এই বাতাবরণের মাঝ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, যেখানে এক উষ্ণীকৃত ঘরের সংবেদনের মাঝে দোল খাচ্ছে ঘুমন্ত আত্মা । বিছানার সামনে আর জানালায় মসলিন পরম প্রাচুর্যে দুলে ওঠে ;  নিজেকে ছড়িয়ে দেয় তুষারপ্রপাতের মতন । এই বিছানায় শুয়ে আছেন এক প্রতিমা, স্বপ্নের রানি। কিন্তু কেনই বা তিনি এখানে ? কে তাঁকে এনেছে ? কোন ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা তাঁকে এই ভাবাচ্ছন্ন ও ইন্দ্রিয়সুখী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছে ?

কীই বা তাতে আসে-যায় : উনি তো রয়েছেন ! আমি ওনাকে চিনতে পারছি ।

হ্যাঁ, এই চোখদুটি  তাদের আগুন দিয়ে সন্ধ্যাকে ছিন্ন করে ; এই তনুকৃত ও ভয়ঙ্কর চোখদুটি, তাদের আতঙ্কজনক অশুভ কামনাকে আমি শনাক্ত করতে পারি । তারা আকর্ষণ করে, তারা বশে আনে, কারোর হঠকারী চাউনি যদি  তার প্রতি মনোযোগ দেয় তাহলে তাকে গিলে খেয়ে ফ্যালে । আমি অনেকসময়ে নিরীক্ষণ করেছি, কৌতূহল ও বিস্ময়ের দাবিদার এই দুটি কালো নক্ষত্রকে ।

কোন সেই দয়ালু দানব যার কাছে এরকম রহস্য, স্তব্ধতা, শান্তি আর সুগন্ধে আচ্ছাদিত থাকার জন্য আমি ঋণী ? হে স্বর্গসুখ ! যাকে আমরা সাধারণত বলি জীবন, এমনকি তার আনন্দময় প্রাচুর্যের সময়ে, আমি এখন যে পরম জীবনের কথা জানি, তার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই, আর আমি তা সেকেণ্ডের পর সেকেণ্ড, মিনিটের পর মিনিট উপলব্ধি করি !

না ! আর কোনও সেকেণ্ড নেই, কোনও মিনিট নেই ! সময় উধাও হয়ে গেছে ; এখন অনন্তের শাসন, অনন্তকালীন পরমানন্দ !

কিন্তু এক মৃদু, ত্রাসময় কড়া নাড়ার আওয়াজ দরোজায় শুনলুম এবং, যেমন নারকীয় স্বপ্নে  ঘটে থাকে, আমার মনে হল আমার পেটে কুঠারাঘাত করা হয়েছে । তারপর প্রবেশ করল এক অপচ্ছায়া । সে  বিচারকের প্রতিনিধি, আইনের নামে আমাকে নির্যাতন করতে এসেছে ; একজন নোংরা উপপত্নী “বিপর্যয়ের” কান্না কাঁদতে এসেছে আর নিজের জীবনের তুচ্ছতার সঙ্গে জুড়তে এসেছে আমার দুঃখ ; কিংবা হয়তো কোনো সংবাদপত্র সম্পাদকের স্যাঙাত পাণ্ডুলিপির বাকি অংশ চাইতে এসেছে।

স্বর্গীয় ঘরখানা, প্রতিমা, স্বপ্নের রানি, মহান রেনে শাতোব্রিয়োঁ যেমন বলেছেন ‘সিলফাইড’-এর কথা -- যাবতীয় ইন্দ্রজাল মিলিয়ে গেল অপচ্ছায়ার নির্দয় কড়া নাড়ার দরুন ।

আতঙ্কজনক ! এখন আমার মনে পড়েছে ! মনে পড়েছে ! হ্যাঁ ! এই জঘন্য বাসা, অনন্তকালীন একঘেয়েমির এই বাসা, আসলে আমারই । সেই একই বোকা আসবাবপত্র, ধুলোমাখা, বিধ্বস্ত; তাপ পোয়াবার আগুনহীন,  এমনকি স্ফূলিঙ্গও নেই এমন চিমনি, থুতু-গয়েরে নোংরা ; লজ্জাকর জানালা, যার ওপরে ধুলোয় দরানি এঁকেছে বৃষ্টি ; পাণ্ডুলিপি, মুছে-ফেলা বা অসম্পূর্ণ ; ক্যালেণ্ডার, যার ওপরে কাজ নিষ্পন্ন করার ভীতিকর  তারিখগুলোতে পেনসিল দাগানো!

আর সেই ভিনজগতের সুগন্ধ যা আমার অভিজাত সংবেদনকে আচ্ছন্ন করতো, হায়, তার জায়গা নিয়েছে তামাকের সঙ্গে মেশানো, ঈশ্বরই জানেন কোন বমি উদ্রেককারী ছত্রাকের পূতিগন্ধ। এখন, এখানে, তুমি নিঃশ্বাস নেবে কেবল নিঃসঙ্গতার বাসি জীর্ণতা ।

এই জগতে, এতো ঘিঞ্জি তা সত্বেও বিতৃষ্ণায় ঠাশা, কেবল একটি পরিচিত জিনিশই আমার দিকে তাকিয়ে হাসে : আফিমের শিশি , একজন পুরোনো আর ভয়ঙ্কর বন্ধু ; আর সব বন্ধুই যেমন হয়, হায়, আমাকে আদর করতে আর বিশ্বাসঘাতকতা করতে উদারচিত্ত ।

ওহ, হ্যাঁ ! সময় ফিরে এসেছে ; সময় এখন রাজার মতন সাম্রাজ্য চালায় ; আর বীভৎস বুড়োটার সঙ্গে আসে স্মৃতি, আফশোষ, আক্ষেপ, ভয়, উদ্বেগ, দুঃস্বপ্ন, ক্রোধ আর স্নায়বিক পীড়ার দানবেরা । 

আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি যে মিনিটগুলো এখন শক্তিমত্তায়, সমারোহে ঘনঘোর, এবং প্রতিটি, ঘড়ি থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, বলে : “আমিই জীবন, অসহ্য, অপ্রশম্য জীবন!”

মানবজীবনে একটিমাত্র মিনিট থাকে যার উদ্দেশ্য হল সুসংবাদ ঘোষণা করা, যে সুসংবাদ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক অনির্বচনীয় ভয়কে প্ররোচিত করে ।

হ্যাঁ ! সময় রাজত্ব করে ; সে তার নৃশংস স্বৈরাচারকে দৃঢ়ভাবে জাহির করেছে । আর সে আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়, তার দুদিকে ধারালো লাঙল টেনে-টেনে, যেন আমি একটা বলদ : “ চলে এসো, ওহে গাধা ! গায়ের জোর খাটাও, ক্রীতদাস ! বেঁচে থাকো, ঘৃণ্য কোথাকার !”


ছয়

যে যার অসার দানবের পাল্লায়

বিশাল অনুজ্বল  আকাশের নীচে, পথহীন ঘাসহীন কাঁটাগাছহীন বিছুটিহীন এক ধূলিধূসরিত বির্স্তীর্ণ সমতলভূমিতে, কয়েকটা লোককে দেখতে পেলুম যারা ঝুঁকে হাঁটছিল।

তারা প্রত্যেকে নিজের পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বিরাট দানব, এক বস্তা আটা কিংবা কয়লার মতন ভারি, কিংবা প্রাচীন রোমের পদাতিক সৈন্যের পিঠের বোঝার মতন । কিন্তু দানবিক জানোয়ারটা নিষ্ক্রিয়  ছিল না ; বরং বিপরীত, সে নিজের পেশির স্হিতিস্হাপকতা আর গায়ের জোরে লোকগুলোকে জড়িয়ে ধরে কষ্ট দিচ্ছিল ; নিজের দুটো বড়ো-বড়ো দাঁড়া দিয়ে বাহকের বুক আঁকড়ে ধরেছিল ; আর তার পৌরাণিক মাথা ছিল বাহকের মাথার ওপরে , সেই আগেকার দিনের ভারি হেলমেটের মতন যা প্রাচীন যোদ্ধারা পরে মনে করত যে সেটা শত্রুদের মনে ভয় জাগিয়ে তুলবে ।

তাদের মধ্যে থেকে একজন লোককে আমি জিগ্যেস করলুম, এই রকম অবস্হায় তারা কোথায় যাচ্ছে । সে বলল যে সে কিছুই জানে না, সেও জানে না অন্যেরাও জানে না ; কিন্তু তারা কোথাও যাচ্ছে, কেননা তারা হাঁটবার অপ্রতিরোধ্য প্রয়োজন-তাড়িত ।

চোখে পড়ার মতন কৌতুহলজনক : এই পর্যটকদের কাউকে দেখেই মনে হচ্ছিল না যে এক ভয়ঙ্কর জানোয়ার তার গলা জড়িয়ে রয়েছে আর পিঠের ওপরে ঝুলে আছে বলে তার অসুবিধা হচ্ছে ; যেন প্রত্যেকে মনে করছে সেটা তার দেহের অংশ ।

এই সমস্ত পরিশ্রান্ত, গম্ভীর মুখগুলো কোনও বিষাদ ব্যক্ত করছে না ; আকাশের বিষণ্ণ গম্বুজের তলায়, আকশের মতোই নিরানন্দ ধূলিধূসর মাটিতে পা পুঁতে, তারা পরাজিত মুখে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে গেল সেই সব লোকের মতন যারা চিরকালীন আশায় দণ্ডপ্রাপ্ত ।

পুরো দলটা আমার পাশ দিয়ে চলে গেল, তাড়াতাড়ি মিলিয়ে গেল আবছা দিগন্তে, সেই দিকে যেখানে গ্রহের গোলাকার পাটাতন মানুষের কৌতূহলময় দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যায়।

এবং কয়েক মিনিটের জন্য আমি জেদের সঙ্গে  রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করলুম ; কিন্তু তখনই এক অপ্রতিরোধ্য উদাসীনতা আমার ওপর ভেঙে পড়ল, আর ওই লোকগুলো যে অলীক দানবের ভারি ওজনে নুয়ে পড়েছিল তার চেয়েও ভারি বোঝার ভার আমার ওপর চেপে বসল।


সাত

মূর্খ এবং প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী

কি সুন্দর দিনটা ! সূর্যের জ্বলন্ত চোখের তলায় বিশাল বাগানটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, যেমনটা যৌবনে ঘটে প্রেমের প্রভূত্ববিস্তারে ।

বস্তুজগতের সর্বব্যাপী আহ্লাদ কোনও শব্দের দ্বারা অভিব্যক্ত হচ্ছিল না ; মনে হচ্ছিল জলরাশিও  নিজেরা ঘুমিয়ে পড়েছে । মানুষের উৎসবাদির থেকে একেবারে আলাদা, এখানে মহোৎসব ছিল নৈঃশব্দের ।

যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া আলো, বস্তুদের আরও বেশি ঝিলমিলে করে তুলছিল ; যেন উত্তেজিত ফুলগুলো, আকাশের নীলাভের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, স্বকীয় রঙের তেজপূঞ্জ দিয়ে নিজের আকাঙ্খায় পুড়ছিল, আর যেন উত্তাপ  সুগন্ধকে করে তুলছিল দৃষ্টিগোচর, বাষ্পের মতন নক্ষত্রদের দিকে উড়ে যাবার কারণ হয়ে উঠছিল ।

যাইহোক, এই সর্বজনীন আমোদপ্রমোদের মাঝে, আমার চোখে পড়ল এক দুর্দশাগ্রস্ত প্রাণী।

প্রেমের অতিকায় অধিষ্ঠাত্রীদেবীর  পায়ের কাছে, রাজাকে আনন্দ দেবার কাজে আত্মনিয়োজিত ভাঁড়েদের মধ্যে সেই সব কৃত্রিম মুর্খদের একজন, যখন কিনা আত্মগ্লানি কিংবা বিষাদ তাদের মুক্ত করতে পারত, রঙচঙে, হাস্যকর পোশাক পরার ফাঁদে পড়ে, মাথায়  শিঙ আর ঘণ্টা, বেদিতে হেলান দিয়ে অশ্রুভরা চোখ মেলে ধরল অবিনশ্বর ঈশ্বরীর দিকে।

আর তার চোখ বলল : “আমি মানবসমাজে ক্ষুদ্রতম এবং অত্যন্ত একা, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব থেকে বঞ্চিত, আর তাই ত্রুটিপূর্ণ পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট। কিন্তু তবু আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আমিও, যাতে অবিনশ্বর সৌন্দর্যকে উপলব্ধি ও অনুভব করতে পারি ! আহ, ঈশ্বরী ! আমার দুঃখ ও উন্মাদনার প্রতি দয়া করো !”

কিন্তু অপ্রশম্য অধিষ্ঠাত্রীদেবী শ্বেতপাথরের চোখ মেলে কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমি জানি না কিসের দিকে, দূরে । 


আট

কুকুর আর শিশি

“আমার চমৎকার কুকুর, আমার ভালো কুকুর, আমার ছোট্ট কুকুর, এখানে এসো আর গন্ধ শোঁকো অত্যুৎকৃষ্ট সৌরভের, শহরের শ্রেষ্ঠ সৌরভ প্রস্তুতকারকের কাছে কেনা।”

 কুকুরটা ল্যাজ নাড়ালো, যে ইঙ্গিত, আমি মনে করি, নগণ্য প্রাণীদের মধ্যে থাকে, যারা জোরে বা মৃদু হাসি পাবার যোগ্য, এগিয়ে এলো, কৌতূহলের সঙ্গে ভিজে নাক খোলা শিশিতে ঠেকালো -- আর তক্ষুনি, ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে, আমাকে উদ্দেশ্য করে ঘেউঘেউ করল, যেন ভর্ৎসনা করছে।

“আহ, তুই বোকা কুকুর, তোকে যদি আমি এক প্যাকেট গু দিতুম, তুই আনন্দে তার গন্ধ শুঁকতিস আর হয়তো খেয়েও নিতিস । এই প্রসঙ্গে আমি তোকে শ্রদ্ধা করি, আমার যন্ত্রণাময় জীবনের অযোগ্য সহচর, জনসাধারণের মতনই তুই, যাদের চটিয়ে দেবে এমন  মিহি সৌরভ কখনও উপহার দেয়া যায় না, তার বদলে তাদের দাও গোবর, ভালোভাবে বাছাই করে।”


নয়

জানালায় কাচ বসাবার খারাপ কর্মী

এমন অনেক বিশেষ চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব আছে, কাজের একেবারে অযোগ্য, যারা তা সত্বেও অনেকসময়ে, কোনো রহস্যময়, অজানা প্রেরণার বশীভূত হয়ে, এমন দ্রুতির সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে যে  তারা নিজেরাই বিশ্বাস করবে না অমন ক্ষমতার তারা যোগ্য। 

এই ধরনের লোক যে, দারোয়ান তাকে কোনো হয়রানির খবর দেবে, ভেতরে ঢোকার সাহস যোগাতে না পেরে ঘণ্টাখানেক যাবত নিজের দরোজার বাইরে ভীতুর মতন উঁকিঝুঁকি মারে;

সেই ধরণের লোক যে একটা চিঠিকে দুই সপ্তাহ যাবত খোলে না, কিংবা কোনো নির্ণয় নিতে ছয় মাস নেয় যখন কিনা কাজটা পুরো করতে এক বছর লাগবে -- তারপর সে নিজেকে আচমকা আবিষ্কার করে যে কোনো বিবেচনাহীন কাজ তড়িঘড়ি করতে চলেছে, ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীরের মতন । নীতিবাদী এবং চিকিৎসক, যাঁরা সবজান্তার ভান করেন, এই আচমকা উন্মাদ কর্মশক্তির উৎসের ব্যাখ্যা দিতে পারেন না, যা জেগে ওঠে অলস, সংবেদনময় চরিত্রে, আর কেমন করে, অত্যন্ত সরল ও জরুরি কাজ করার অযোগ্যতা সত্বেও, তারা কোনও মুহূর্তে অসম্ভব এমনকি বিপজ্জনক কাজ করার ঝুঁকি নিয়ে ফ্যালে ।

আমার বন্ধুদের একজন,  অতিনিরীহ স্বপ্নদ্রষ্টা, একবার জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল যাতে ও দেখতে পায়, ও বলেছিল, যে লোকজন যেমন বলে থাকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সে কথা সত্যি কিনা তা পরখ করতে চায় । পরপর দশবার,  তা ঘটেনি ; কিন্তু এগারোবারের সময়ে তা ভালোভাবে ঘটেছিল ।

আরেকজন বারুদের বাক্সের পাশে বসে সিগার জ্বালাতো, কেবল দেখার জন্য, যাতে ও জানতে পারে, অদৃষ্টকে লোভ দেখাবার জন্য, নিজের কাছে প্রমাণ করার জন্য, যে একজন জুয়াড়ির উদ্দীপনা তো ওর আছে, যা থেকে ও উদ্বেগের আনন্দ নিতে পারে, কিংবা অকারণেই, খেয়ালখুশিতে, অন্য কোনো কাজ হাতে নেই বলে ।

এই ধরণের কর্মক্ষমতা একঘেয়েমি আর দিবাস্বপ্ন থেকে উৎসারিত হয় ; আর যাদের জীবনে তা অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা দেয় তারা সাধারণত, যেমন আগেই বলেছি, সবচেয়ে শ্রমবিমুখ আর অলীক-কল্পনা করার প্রাণী । আরেকজন, অন্যেরা তার দিকে তাকালে চোখ নামিয়ে নেয় এমন ভীরু, মনের সমস্ত জোর খাটিয়ে কফিহাউসে ঢোকে কিংবা নাট্যমঞ্চকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যেখানে ওর মনে হয় যে টকিট বিক্রেতারা গ্রিক পুরাণের মিনোস, এজিনার রাজা ইকস, আর মৃতদের বিচারক রাদামানথুসের মতন ডাঁটে বসে থাকে,  হঠাৎ ঝাঁপিয়ে রাস্তায় ওর পাশ দিয়ে যেতে থাকা একজন বৃদ্ধের গলা আঁকড়ে ধরবে, আর অবাক পথচারীদের সামনে অতিউৎসাহে তাকে আলিঙ্গন করবে । কেন ? কারণ...কেননা সেই বিশেষ চেহারা তার কাছে দুর্নিবার আকর্ষক মনে হয়েছিল বলে ? হয়তো ; কিন্তু এ কথা অনুমান করা বেশি ন্যায়সঙ্গত যে সে নিজেই তার কারণ জানত না ।

আমি এক বারের বেশি এই ধরণের সঙ্কট এবং উত্তেজনার শিকার হয়েছি, যা আমাদের বিশ্বাস করায় যে আমাদের মধ্যে অশুভ দানবেরা চুপিচুপি ঢুকে পড়ে, আমাদের তেমন কাজকর্ম করতে বাধ্য করে, যা আমাদের অজানা, তাদের বিদকুটে ইচ্ছেগুলোকে পুরণ করার জন্য ।

একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠলুম, খারাপ মেজাজে, হতোদ্যম, আমার আলস্যে বিরক্ত, আর তাড়িত, আমার মনে হল, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু করি, কোনও সুন্দর কাজ ; আর, হায়, জানালা খুললুম !

( অনুরোধ করছি, আপনি লক্ষ করুন, লোকজনের সঙ্গে মজা করার উৎসাহ ভাবনাচিন্তার কিংবা সচেতন পরিকল্পনা নয় বরং আকস্মিক প্রেরণা, আর তার সঙ্গে লাগোয়া, উৎসাহবাহিত আকুলতা, যে ঠাট্টা-ইয়ার্কিকে চিকিৎসকরা বলেন বায়ুরোগ আর যাঁরা চিকিৎসকদের তুলনায় আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন তাঁরা বলেন শয়তানি, যা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, প্রতিরোধহীন,  অসংখ্য জঘন্য কাজ করতে ।) জানলা খুলে রাস্তায় প্রথম যে লোকটাকে দেখলুম সে ছিল একজন কাচের শার্শি বদলকারী, যার বেসুরো চিল চিৎকার প্যারিসের ঘন, দুর্গন্ধিত বাতাস ভেদ করে উঠে এলো আমার কাছে । বলা একেবারে অসম্ভব যে ওই বেচারা লোকটাকে দেখে আমার মন ঘৃণায় ভরে গেল, যা ছিল আকস্মিক আর সেই সঙ্গে হুকুমকারীর মতন । “ওহে ! ওহে !” আমি ওকে ওপরে আসতে বললুম । সেই ফাঁকে ভাবলুম, বেশ মজা করা যাবে, আমার ঘরটা সাত তলায় আর সিঁড়িটা বেশ অপ্রশস্ত হওয়ায়, ওপরে উঠে আসতে লোকটার বেশ খাটুনি হবে, আর ওঠার পথে ওর ঠুনকো জিনিশপত্র নানা জায়গায় ধাক্কা খাবে ।

শেষ পর্যন্ত লোকটা এলো : আমি খুঁটিয়ে ওর শার্শিগুলো দেখলুম, আর ওকে বললুম, “কী ? তোমার কাছে রঙিন কাচ নেই ? গোলাপি কাচ নেই, লাল নেই, নীল নেই, ঐন্দ্রজালিক শার্শি নেই, স্বর্গের শার্শি নেই ? বেহায়া মূর্খ কোথাকার ! তুমি গরিবদের পাড়ায়-পাড়ায় ফিরি করে বেড়াচ্ছ অথচ জীবনকে সুন্দর করে তোলে এমন শার্শি নেই !”  আমি ওকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দিলুম, যেখানে ও থমকে দাঁড়িয়ে ঘোঁতঘোঁত করল ।

আমি বারান্দায় ফিরে গিয়ে ফুলের একটা ছোট গামলা তুলে নিলুম, আর লোকটাকে যখন নীচে সিঁড়ির বাইরে বেরোতে দেখলুম, আমি আমার যুদ্ধাস্ত্র সোজা নীচে ফেলে দিলুম ওর পিঠের বস্তার ওপর ; ধাক্কায় ও পেছনে হেলে পড়ে গেল, আর তার ফলে ভেঙে ফেলল, নিজের পিঠের চাপে, ওর সমস্ত মর্মন্তুদ ভ্রাম্যমান ঐশ্বর্য, স্ফটিকের তৈরি প্রাসাদে বিদ্যুৎ পড়ার মতন জাঁকালো আওয়াজ করে ।

আর নিজের উন্মাদনায় মাতাল, আমি লোকটার উদ্দেশে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলুম, “জীবনকে সুন্দর করে তোলো ! জীবনকে সুন্দর করে তোলো !”

এই ধরণের বাজে ঠাট্টা বিপদহীন নয়, আর প্রায়ই তার জন্য বড়ো খেসারত দিতে হয় । কিন্তু যে মানুষ একটা ক্ষণের মধ্যে আনন্দের অনন্তকাল আবিষ্কার করেছে, তার কাছে অভিশপ্ত অবিনশ্বরতা কি কোনো ব্যাপার হতে পারে ?


দশ

দুপর একটার সময়ে

শেষ পর্যন্ত, একা ! যা শোনা যাচ্ছে তা কেবল কয়েকটা পুরোনো, ক্লান্ত ঘোড়ার গাড়ির চাকার আওয়াজ । কয়েক ঘণ্টার জন্য, আমাদের থাকবে, আরাম না হলেও, নিস্তব্ধতা । শেষ পর্যন্ত ! আমাকে এখন ছায়ায় স্নান করার ঢিলেমি দেয়া হয়েছে ! কিন্তু প্রথমে, ঘড়িতে দুই বার চাবি দিতে হবে : আমার মনে হয় এই বাড়তি চাবি ঘোরানো আমার একাকীত্বকে বল দেবে আর জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পাঁচিলকে পোক্ত করবে ।

ভয়ঙ্কর জীবন ! ভয়ঙ্কর শহর ! সারা দিনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক : কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হল, তাদের একজন আমাকে জিগ্যেস করলে যে স্হলপথে কি রাশিয়ায় যাওয়া যায় ( স্বাভাবিক যে ও রাশিয়াকে একটা দ্বীপ বলে মনে করেছে ) ; এক পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে অনেকক্ষণ তর্ক হল, যিনি প্রতিটি আপত্তির একটাই জবাব দিচ্ছিলেন, “এই যে, আমরা শোভনতার পক্ষে,” যার মানে দাঁড়ায় যে অন্য সব পত্রিকা চালায় বজ্জাতের দল ; প্রায় কুড়িজন লোককে শুভেচ্ছার অভিবাদন করলুম, যাদের পনেরোজনকে আমি একেবারে চিনি না ; ততোজনের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলুম, আর গ্লোভস কেনার পূর্বাহ্ণিক সতর্কতা না নিয়ে ; বৃষ্টির ঝর্ণা বাঁচিয়ে সময় কাটাবার জন্য, একজন ফালতু নর্তকীর কাছে গেলুম, যে আমার কাছে অনুনয় করল যে “ভিস-নিস” অভিনয় করার জন্য তার পোশাকটার নকশা যেন আমি তৈরি করে দিই ; একজন নাটক-পরিচালকের কাছে হাজিরা দিলুম যে বলল, আমাকে বাতিল করে, “তুমি অমুকের সঙ্গে পরিচয় করলে ভালো করবে ; ও সবচেয়ে ভোঁদা, বোকা, আর লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত, ফলে তার কাছে তুমি হয়তো কিঞ্চিদধিক গুরুত্ব পেতে পারো। ওর সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, আর তারপর দেখা যাবে”; বেশ কয়েকটা নীচ কাজ যা আগে করিনি সে সম্পর্কে গর্ববোধ ( কেন ? ) করলুম, আর ভীতুর মতন আমার অনেক দুষ্কর্মকে অস্বীকার করলুম যেগুলো বেশ আনন্দের সঙ্গেই আমি করেছিলুম -- দম্ভোক্তি করার আহ্লাদ, মানবিক শোভনতার বিরুদ্ধে অপরাধ ; এক বন্ধুকে অনায়াস সাহায্য করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান, আর একজন পাক্কা বোকার সুপারিশ করে লিখলুম চিঠি -- উফ ! ফিরিস্তি শেষ হল ?

সবকিছু সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, নিজের সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, আমি সত্যিই প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, রাতের নৈঃশব্দ ও একাকীত্বে  এক চিলতে গর্ববোধ । যাদের অন্তরাত্মাকে ভালোবেসেছি, যাদের অন্তরাত্মার গান গেয়েছি, আমাকে শক্তি দেয়, সমর্থন করে, জগতসংসারের মিথ্যা ও ভ্রষ্টাচারের বাষ্প থেকে আমাকে দূরে রাখে, আর তুমি, আমার দেবতাত্মা ঈশ্বর ! কয়েকটা সুন্দর পংক্তি সৃষ্টি করার কৃপা আমাকে দাও যাতে নিজের কাছে প্রমাণ করতে পারি যে মানুষের মাঝে আমি সবচেয়ে হীন নই,  আমি যাদের অবজ্ঞা করি তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট নই !


এগারো

অসভ্য নারী আর ছোট্টো রক্ষিতা

সত্যি, হে প্রিয়া, তুমি আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছ ; তোমার অভিযোগগুলো দয়ামায়াহীন, বেখাপ্পা । তোমার দীর্ঘশ্বাস শুনলে, যে কেউ ভাববে ষাট বছরের বুড়ি জঞ্জাল কুড়ানির চেয়ে কিংবা সেই বুড়ি ভিখারিনীরা যারা রেস্তরাঁর দরোজার বাইরে রুটির টুকরো কুড়োয়, তাদের চেয়ে তুমি বেশি দুঃখযন্ত্রণায় ভুগছ ।

“যদি তোমার দীর্ঘশ্বাস অন্তত অনুশোচনা প্রকাশ করত, তা তোমাকে সন্মান দিত ; কিন্তু তা কেবল ফাঁস করে দেয় যে তুমি ভালোভাবে জীবনযাপনে  পরিতৃপ্ত, আর তুমি অতিরিক্ত বিশ্রাম করে হাঁপিয়ে পড়েছ । আর তারপর, তোমার বকবকানির স্রোত থামে না : ‘আমাকে বেশি করে ভালোবাসো ! আমি তা ভীষণভাবে চাই ! আমাকে এইভাবে সান্ত্বনা দাও, সেইভাবে আদর করো।’ দ্যাখো, আমি চেষ্টা করছি তোমার সুস্বাস্হ ফিরে আসুক ; আর হতে পারে যে আমরা তার উপায় বের করে ফেলব,  কাছাকাছি কোনো মেলায় গিয়ে দুটাকা খরচ করে। 

“দয়া করে, বিবেচনা করো, যে লোহার শক্তপোক্ত খাঁচার ভেতরে বসে, পতিতের মতন খ্যাঁকখ্যাঁক করে, নির্বাসনে পাগল ওরাঙওটাঙের মতন  খাঁচার গরাদ নাড়িয়ে, বাঘের পাক খাওয়ার নিখুঁত অনুকরণ করে, আর এখন শ্বেতভাল্লুকের মতন মূর্খ জবুথবু হাঁটাচলা করে, মনে হয় লোমশ দানবীর চেঁচামেচি আনেকটা তোমারই মতন  ।

“এই দানবী সেইসব জানোয়ারের অন্যতম, যাকে কেউ সাধারণভাবে ‘আমার দেবকন্যা’ বলে ডাকে! -- মানে, একজন নারী । তার সঙ্গে যে আরেকটা দানব, যার হাতে ছড়ি রয়েছে, গলার জোর খাটিয়ে চেঁচাচ্ছে,  একজন স্বামী । নিজের আইনসঙ্গত স্ত্রীকে জানোয়ারের মতন শেকল বেঁধে রেখেছে, আর মেলার দিনগুলোয় শহরতলিতে তাকে প্রদর্শন করে বেড়ায় -- স্বাভাবিকভাবে, অফিসারদের অনুমতি নিয়ে ।

“সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করো ! দ্যাখো কেমন গোগ্রাসে ( হয়তো লোকদেখানো নয় ! ) রক্ষকের ছুঁড়ে দেয়া জ্যান্ত খরগোশগুলোকে আর গ্যাঁকগ্যাঁকে  মুর্গিগুলোকে মেয়েটা ছিঁড়ছে । ‘রোসো’, লোকটা ওকে বলে, ‘তোমাকে সব খাবার এক বারে খেয়ে ফেলতে হবে না,’ আর এই উপদেশ দিয়ে লোকটা সতর্ক হয়ে মেয়েটার কাছ থেকে তার শিকার কেড়ে নেয়, ভয়ঙ্কর জানোয়ারটার দাঁত থেকে কিছু নাড়িভূঁড়ির টুকরো ঝুলতে থাকে -- মানে, আমি ওই নারীর কথা বলছি।

“দ্যাখো ! মেয়েটাকে শান্ত করার জন্য ছড়ির এক সুন্দর খোঁচা ! --- কেননা মেয়েটা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে, কেড়ে নেয়া খাবারের জন্য, লালসায় ক্ষেপে গিয়ে । হায় ঈশ্বর ! ছড়িটা মঞ্চে মজা দেখাবার জন্যে নয় ;  মেয়েটার মাংসে যে সপাং আওয়াজ হল তা শুনলে তো, জটপড়া নকল চুল সত্বেও ? আর মেয়েটার চোখ যেন ওর মুণ্ডু থেকে বেরিয়ে আসছে, ও এবার স্বাভাবিকভাবে চেঁচাচ্ছে । রাগের চোটে, মনে হয় ওর সারা শরীর কাঁপছে, লোহাকে পিটলে যেমন হয় ।

“অ্যাডাম আর ইভের উত্তরসূরীদের এরকমই দাম্পত্যজীবন, তোমার আয়ত্বে এই সমস্ত কাজ, হায় ভগবান ! এই নারী সত্যিই যৎপরোনাস্তি দুঃখযন্ত্রণায় রয়েছে, যদিও, হয়তো, খ্যাতির সুড়সুড়ির আনন্দ ওর অজানা নয় । এর চেয়েও খারাপ দূরপনেয় যন্ত্রণা আছে, এবং তা ক্ষতিপূরণহীন । কিন্তু যে জগতে ওকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, ওর মনে হয়নি যে একজন নারীর এর চেয়ে আলাদা অদৃষ্ট হতে পারে ।

“আর এবার, নিজেদের কথায় ফেরা যাক, আমার দামি প্রাণীটির দিকে ! এই জগতের লোকজন যে নরকে থাকে, তোমার বিশেষ সুন্দর নরক সম্পর্কে আমার কাছে কী আশা করো, তুমি, যে  কখনও নিজের খসখসে ত্বকের তুলনায় অন্য কোনো জিনিশে হেলান দাওনি, আর যে কেবল অনুগত চাকরের রাঁধা মাংস খাও প্রতিটি গ্রাসে ?

“আর কেমনভাবেই বা আমি এই ছোট দীর্ঘশ্বাসগুলোকে মেনে নেব যা তোমার সুগন্ধিত স্তনকে ফুলিয়ে তোলে, আমার পোক্ত ছোট্ট ছিনাল ? আর বই পড়ে জড়ো করা এই সমস্ত কৃত্রিম আচরণ, আর এই ক্লান্তিহীন বিষাদ, দর্শকের মনে দয়ার বদলে অন্য একরকমের ভাবপ্রবণতা জাগাবার চেষ্টা ? সত্যিই, আমি অনেকসময়ে ভাবি তোমাকে শিখিয়ে দিই কাকে প্রকৃত দুঃখযন্ত্রণা বলে ।

“ আমার তুলতুলে সুন্দরী, তোমার পা কাদায় আর তোমার চোখ গাগনিকভাবে আকাশের দিকে, যেন তোমাকে একজন মহারাজা এনে উপহার দেয়া হবে, যে কেউ তোমাকে মনে করবে একটা কচি ব্যাঙ, সেই আশা পূর্ণ করার প্রয়াস করছ । যদি তুমি বর্তমান রাজাকে অবজ্ঞা করো ( যা বর্তমানে আমি, তা তুমি ভালো করেই জানো ), পরের বার যে আসবে তার সম্পর্কে সাবধান হও, সে তোমাকে চিবোবে, গিলে ফেলবে, আর নিজের ইচ্ছেমতো কোতল করবে !

“হতে পারে আমি একজন কবি, কিন্তু তুমি যেমন ভাবছ আমাকে তেমন ঠকাতে পারবে না, আর যদি তুমি তোমার মূল্যবান কাঁদুনি গেয়ে আমাকে প্রায়ই ক্লান্ত করো, আমি তোমার সঙ্গে অসভ্য মেয়েমানুষের সঙ্গে যেমন করা উচিত তেমন ব্যবহার করব, কিংবা খালি বোতলের মতন জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেবো ।”


বারো

ভিড়

টবে স্নান করার মতন করে জনতার ভেতরে  সবাই নিজেকে চোবাতে পারে না ; ভিড়ের মজা নেয়া হলো  শিল্প ; আর কেবল সেই লোকগুলো মানবজাতির শৌর্যকে উৎসবে পরিণত করতে পারে যাদের, তাদের শৈশবের দোলনায়, একজন পরী এসে  ছদ্মবেশে আর মুখোশ পরে এসে, বাড়ির প্রতি ঘৃণার, আর ভ্রমণের নেশার শ্বাস ফেলেছিল ।

জনতা, একাকীত্ব : এই অভিধাগুলোর মর্মার্থ সক্রিয় ও বহুপ্রসূ কবির কাছে একই এবং সমভাবে বিনিমেয় । যে লোক জানে না যে তার একাকীত্বকে কেমন করে জনতা দিয়ে ভরে তুলতে হয়, সে জানতে পারবে না ব্যস্ত ভিড়ে কেমন করে একা থাকা যায় । এই অতুলনীয় সুবিধা উপভোগ করেন একজন কবি, তিনি হয়ে উঠতে পারবেন, যেভাবে তিনি চান, হয় নিজে স্বয়ং কিংবা আরেকজন । যে ভবঘুরে আত্মারা দেহের খোঁজে বেরিয়েছে, তাদের মতন, তিনি প্রবেশ করেন, যখনই তিনি চান, সকলের চরিত্রে । শুধুমাত্র তাঁর কাছে, সবকিছুই ফাঁকা,  তা এইজন্যে যে তাঁর দৃষ্টিতে সেখানে যাওয়ার পরিশ্রম করার কোনো মানে হয় না যেখানে যাওয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ ।

একা, চিন্তামগ্ন পথচারী এই সর্বজনীন অংশীদারিত্বে খুঁজে পান একক মাদকতা । যে মানুষ ভিড়কে বিয়ে করেন, তিনি অতিব্যাকুল মহানন্দ উপভোগ করেন, যা থেকে অহংকারীরা বঞ্চিত, যারা সিন্দুকের মতন তালা দেয়া, আর অলসদের ভাগ্যেও তা জোটে না, যারা ঝিনুকের মতন নিজেতেই আবদ্ধ । তিনি তাঁর কাছে ঘটণাচক্রে উপস্হাপিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে, সমস্ত রকমের আনন্দ আর সমস্ত দুঃখযন্ত্রণাকে নিজের করে তোলেন ।

লোকেরা যাকে প্রেম বলে মনে করে তা এতো ক্ষুদ্র, এতো সীমাবদ্ধ, এতো দুর্বল, সেই অনির্বচনীয় মহোল্লাসের তুলনায়, আত্মার পবিত্র বেশ্যাবৃত্তি যা সম্পূর্ণ নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তার যাবতীয় কবিতা ও পরার্থবাদিতা, অভাবনীয়দের কাছে, অচেনাদের কাছে, যেমন যেমন তারা দেখা দেয় তাদের কাছে বিলিয়ে দেয় ।

যারা এই জগতের সৌভাগ্যবান তাদের শিক্ষিত করে তোলা অনেক সময়ে ভালো, যদি তাতে তাদের মূর্খ গর্বকে ক্ষণিকের জন্য দমিয়ে দেয়া যায়, অর্থাৎ তারা যা জানে তার চেয়ে আরেক উচ্চতর আনন্দ আছে, বিশাল ও অধিকতর সংস্কৃতিসম্পন্ন ।  বসতের প্রতিষ্ঠাতারা, জনগণের চালকরা, জগতের সীমায় নির্বাসিত মিশনারি যাযকরা, সন্দেহ নেই যে তাঁরা এই রহস্যময় মাদকতা সম্পর্কে যৎসামান্য জানেন ; আর তাঁদের প্রতিভা থেকে তাঁদের হৃদয়ে যে বিশাল পরিবারের জন্ম হয়েছে, তাঁরা অনেক সময়ে সেই লোকগুলোকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন যারা তাদের কষ্টপূর্ণ ভাগ্য আর পবিত্র জীবন নিয়ে হাহুতাশ করে ।


তেরো

বিধবারা

অভিজাত ভভেনার্গুস বলেছেন যে জনগণের বাগানে এমন সমস্ত হাঁটাপথ আছে যার ওপর  নিরাশ উচ্চাকাঙ্খী, অভাগা আবিষ্কারক, ব্যর্থ সাফল্যের লোক, ভাঙা হৃদয়, ভুত চরে বেড়ায়, সেই সব বন্ধ আত্মার দল যাদের মধ্যে ঝড়ের শেষ দীর্ঘশ্বাস এখনও গুরুগুরু আওয়াজ তোলে, আর যারা হাসিখুশি ও অলস লোকেদের দুর্বিনীত চাউনি দেখে নিজেদের গুটিয়ে নেয় । এই ধরণের ছায়াময় আশ্রয়গুলো হলো জীবনে মার খাওয়া  সেই সমস্ত মানুষের মিলনস্হল। তাছাড়া, কবি ও দার্শনিকরা নিজেদের প্রিয় অনুমানগুলো এই ধরণের জায়গায় যাচাই করতে চান। এখানে আছে এক বিশেষ ধরণের পুষ্টিসাধক খাবার । কেননা, যদি কোনও একটা জায়গা থাকে যেখানে তাঁরা প্রবেশ করতে ঘৃণা বোধ করেন, তা হল এইটি, যার কথা আমি বললুম, জায়গাটা হলো বৈভবের আনন্দ উপভোগ করার । এই ফাঁকা ঘনঘটায় তাঁদের আকর্ষণ করার কিছুই নেই। বরং বিপরীত, তাঁরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্যভাবে আকর্ষিত বোধ করেন তার প্রতি যা দুর্বল, ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুর্দশাগ্রস্ত, অনাথ ।

অভিজ্ঞ চোখ কখনও প্রবঞ্চনা করে না । এই সমস্ত অনমনীয় বা পেটানো বৈশিষ্ট্যে, এই সমস্ত শূন্য, ফ্যালফেলে চোখে, বা  ধ্বস্তাধস্তির শেষ আলোয় যা তখনও দীপ্যমান, এই সমস্ত গভীর ও অসংখ্য কুঞ্চনে, এই সমস্ত শ্লথ ও ভাঙাচোরা চলনভঙ্গীতে, ক্ষণিকের মধ্যে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হয় তাদের প্রতারিত প্রেমের, অব্যাখ্যাত আত্মোৎসর্গের, ব্যর্থ প্রয়াসের, ক্ষুধার এবং মুখ বুজে সহ্য করে নেয়া শীতের অসংখ্য কিংবদন্তিগুলোকে ।

তুমি কি কখনও লক্ষ্য করেছ ফাঁকা বেঞ্চে বসে থাকা গরিব বিধবাদের ? তারা শোকপালন না করলেও, সহজেই চেনা যায় । আর তাছাড়া, গরিবদের শোকপালনে সর্বদা কিছুর অভাব থাকে, সমন্বয়ের অনুপস্হিতি যা তাদের হৃদয়কে আরও ভেঙে ফ্যালে । তারা তাদের মর্মযন্ত্রণায় সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় । ধনীরা নিজেদের মর্মযন্ত্রণাকে সবাইকে দেখিয়ে বয়ে বেড়াতে পারে।

কে সেই সবচেয়ে দুঃখী ও অত্যন্ত মর্মন্তুদ বিধবা, যে একজন শিশুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে সে নিজের চিন্তাধারা ভাগাভাগি করতে পারে না, নাকি যে একেবারে একা ? আমি জানি না ...। একদিন এমন হয়েছিল যে আমি অনেকক্ষণ ধরে একজন বয়স্ক, ভারাক্রান্ত দেখতে বিধবাকে অনুসরণ করছিলুম ; সে ছিল ঋজু, সোজা পিঠ, পুরোনো ছেঁড়া শালে ঢাকা দেওয়া, তার সমস্ত অস্তিত্ব থেকে নির্বিকার গর্বের ছটা প্রকাশিত হচ্ছিল । দেখে সহজে বোঝা যাচ্ছিল যে বার্ধক্যের কৌমার্যের পরম একাকীত্বের অভ্যাসে সে দণ্ডপ্রাপ্ত, আর  পুরুষালী চলনভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছিল কঠোর আত্মসংযমের রহস্যময় কটূতা । আমি বলতে পারব না কোন বাজে রেস্তরাঁয় সে দুপুরের খাবার খেয়েছিল, কিংবা কেমন করে খেয়েছিল । আমি তাকে জনসাধরণের জন্য উন্মুক্ত পাঠাগার পর্যন্ত অনুসরণ করলুম ; আর যখন সে একদা কান্নায় পুড়ে যাওয়া সক্রিয় চোখ দিয়ে সংবাদপত্রে অনুসন্ধান করছিল, ব্যক্তিগত আগ্রহের কোনো জরুরি খবরের, তখন অনেকক্ষণ ধরে তার দিকে নজর রাখলুম।

শেষ পর্যন্ত, দুপুরবেলা, হেমন্তের মনোরম আকাশের তলায়, সেই ধরণের আকাশ যেখান থেকে ঝরে পড়ে অজস্র পশ্চাত্তাপ আর স্মৃতি, সে পার্কের এক কোনায় বসে, ভিড় থেকে দূরে, শোনার চেষ্টা করছিল, প্যারিসবাসীদের প্রিয় সেনাবাহিনীর কনসার্টের সঙ্গীত ।

সন্দেহ নেই যে এই নিষ্পাপ বুড়ির সাময়িক আমোদ ( অথবা এই বিশুদ্ধিপ্রাপ্ত বুড়ির ), বন্ধুহীন, কথাবার্তাহীন, সঙ্গীহীন,  দুর্বহ দিনগুলোয়, যা ঈশ্বর তাঁর ওপরে হয়তো বহু বছর যাবত চাপিয়ে দিয়েছেন, তা সুঅর্জিত সান্ত্বনা ! বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ।

আরেকজনের কথা :

ভিড়ের ফালতু লোকেরা, যারা বেড়া ঠেলে কোনো প্রকাশ্য কনসার্টে ঢুকে পড়তে চায়, তাদের দিকে কৌতূহলভরে না তাকিয়ে আমি থাকতে পারি না, তা সম্পূর্ণ সমবেদী না হলেও । রাতের আনন্দের গানে, আহ্লাদের বিজয়কেতনে, অর্কেস্ট্রা ছড়িয়ে পড়ে । পোশাক পেছনদিকে ঝোলে আর ঝলমল করে, চাউনির অদলবদল হয় ; যারা অলস, কোনো কাজকর্ম না করেও জীর্ণ, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গীত উপভোগ করার শ্রমবিমুখ ভান করে । এখানে ঐশ্বর্য ছাড়া আর কিছু নেই, আনন্দধারা ব্যতীত আর কিছু নেই ; বেঁচে থাকার জন্য যে শ্বাসপ্রশ্বাস বেপরোয়া আনন্দকে উৎসাহিত করে ; কিচ্ছু নয়, ওইখানে ভিড়ের দৃশ্য ছাড়া, যারা বাইরের বেড়ায় হেলান দিয়ে আছে, বিনা পয়সায় সঙ্গীতের সামান্য রেশ শুনতে পাচ্ছে, বাতাসকে ধন্যবাদ, তারা দেখতে পাচ্ছে তাঁবুর ভেতরের ঝকমকানি ।

গরিবের চোখে ঐশ্বর্যশালীদের  আনন্দের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া সব সময়েই বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক । কিন্তু সেই দিন, এই লোকগুলো, যারা  তাদের কাজকরার আঙরাখা পরে আছে, আর তাদের সুতির জামা, তাদের ছাপিয়ে আমার চোখে পড়ল এমন একজন অভিজাত মহিলার দিকে যিনি এই ঘিরে-থাকা গেঁয়োগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত । একজন ঢ্যাঙা, মর্যাদাপূর্ণ রমণী, এমন এক মহিমাময়ী চারিত্র্য যে আমি মনে করতে পারলুম না অতীতে অভিজাত সুন্দরীদের জমায়েতে এমন কাউকে দেখেছি । তাঁর উন্নত সততার সুগন্ধ উদ্ভাসিত হচ্ছিল তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব থেকে। তাঁর মুখশ্রী ছিল দুঃখী আর রোগা, শোকের যে আনুষ্ঠানিক পোশাক তিনি পরেছিলেন তার সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খাচ্ছিল । এবং তিনিও, সাধারণ নাগরিকদের মতন, যাদের মাঝে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন আর যাদের উপস্হিতি তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না, তিনি আলোকময় জগতকে গভীর আগ্রহে অবলোকন করছিলেন, শোনার সময়ে মৃদু মাথা দোলাচ্ছিলেন।

একটি একক দিব্যদৃশ্য ! “নিঃসন্দেহে”, আমি নিজেকে বললুম, “ওনার দারিদ্র্য, যদি তা দারিদ্র্য হয়, তার জন্য অর্থগৃধ্নুতার মিতব্যয়ীতার প্রয়োজন ছিল না ; ওই মহিমান্বিত মুখশ্রী তার প্রমাণ। কিন্তু কেনই বা উনি জেনেশুনে অমন পরিপার্শ্বের অংশ হতে চাইলেন, যার মাঝে তিনি উজ্বল বিবর্ণতার মতন দাঁড়িয়ে আছেন ?”

কিন্তু কৌতূহলবশত যখন ওনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলুম, কারণটা আমি আঁচ করতে পারলুম। দীঘাঙ্গী বিধবাটি একটি শিশুর হাত ধরেছিলেন, তাঁর মতনই কালো পোশাকে ; ঢোকার টিকিটের দাম যুক্তিযুক্ত ছিল, সেই টাকাটা হয়তো বাচ্চাটার কোনো প্রয়োজন মেটাতে লাগবে, কিংবা, আরও ভালো হয়তো, বিলাসদ্রব্য বা খেলনা কেনা যাবে।

আর উনি হেঁটে বাড়ি ফিরবেন, নিজের চিন্তা ও স্বপ্নে মগ্ন, একা, সর্বদা একা ; কেননা বাচ্চারা চেঁচামেচি করে, একলষেঁড়ে হয়, শান্তস্বভাব হয় না, ধৈর্যশীল হয় না ; আর একাকীত্বের দুঃখ লাঘবের জন্য বাচ্চাটা, সত্যিকার জানোয়ারের মতন, কুকুর বা বিড়ালের মতন, তাঁর অন্তরঙ্গ হতে পারে না ।


চোদ্দ

বুড়ো সঙ

ছুটির দিনের ভিড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল সর্বত্র, মৌজমস্তিতে ব্যস্ত । দিনটা সেই ধরণের উৎসবের ছিল যখন রাস্তার মাদারিরা, দড়াবাজিকররা, পশুর খেলা দেখিয়েরা, ভ্রাম্যমান ফেরিঅলারা, সারা বছরের দুরবস্হাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য চিরকাল এই দিনটির ওপর নির্ভর করেছে । এই রকম দিনে আমার মনে হয় লোকেরা সবকিছু ভুলে যায়, ভালো দিনকাল আর ব্যস্ত কাজকর্ম থেকে মুক্ত ; তারা হয়ে যায় বাচ্চাদের মতন । ছোটোদের জন্য এটা একদিনের ছুটি, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য স্কুলের আতঙ্ক থেকে মুক্তি ; বড়োদের জন্য, দিনটা জীবনের অপকারী ক্ষমতার সঙ্গে ঘোষিত বোঝাপড়ার, শেষহীন সংগ্রামের বিবাদ-বিতর্ক থেকে সাময়িক আরামের। এমনকি সমাজকর্মী আর আধ্যাত্মিক শ্রমে নিযুক্ত মানুষের পক্ষেও এই সর্বাত্মক  বিজয়ানন্দের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয় । অপেক্ষা না করেই, তাঁরা তাঁদের অংশের বেপরোয়া বাতাবরনে মিশে যান । আমার কথা বলতে গেলে, সত্যিকার একজন প্যারিসবাসীর মতন, আমি এই ধরণের সমারোহপূর্ণ সুযোগে পথের ধারের ঘুপচি-দোকানগুলোকে নিরীক্ষণ করতে ছাড়ি না ।

আর তারা নিজেদের মধ্যে হইচই করে প্রতিযোগীতা করে : তারা তারস্বরে চিৎকার করে, ষাঁড়ের মতন চেঁচায়, নেকড়ের মতন ডাক পাড়ে । তা ছিল সব রকম ধ্বনির মিশেল, বাসনের ঘ্যাঙঘ্যাঙ আর বাজি ফাটাবার আওয়াজ । লাল পোশাকে সারিবদ্ধ দড়াবাজিকর আর ডিগবাজি-খাওয়া ভাঁড়েরা তাদের রোদে-পোড়া , বাতাসে, বৃষ্টিতে আর সূর্যের তাপে ক্ষয়ে যাওয়া মুখে, ভেংচি কাটছিল । আত্মবিশ্বাসী অভিনেতারা  নিজেদের প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত, তারা চালাক-চতুর ঠাট্টার গল্প বলছিল, মলিয়েরের কমেডির মতন যা একঘেয়ে আর আগেই আঁচ করা যায় । পালোয়ানরা, তাদের বড়সড় অঙ্গ সম্পর্কে গর্বিত, ওরাঙওটাঙের মতন কপাল আর করোটি, আঁটোসাঁটো লোকদেখানো পোশাকে ডিগবাজি খেয়ে বেড়াচ্ছিল, আগেভাগে পোশাক কাচিয়ে নিয়েছিল । নর্তকীরা, পরী কিংবা রাজকন্যার মতন সুন্দরী, দুলছিল আর তিড়িংবিড়িং করছিল, লন্ঠনের আলোয় তাদের ঘাগরা ঝকমক করছিল । সবকিছুতেই ছিল দীপ্তি, ধুলো, চেঁচামেচি, আনন্দ, হই্হল্লা ; কিছু লোক টাকাকড়ি খরচ করল, যখন কিনা অন্যদের লাভ হলো, দুই পক্ষই সমানভাবে খুশি । বাচ্চারা মায়ের পোশাকের খুঁট ধরে লজেঞ্চুশ পাবার আশায় হাঁটছিল, কিংবা তাদের বাবার কাঁধে চেপে ম্যাজিকঅলার দেবতাসূলভ চমৎকারিত্ব দেখছিল । আর সর্বত্র, সব রকমের গন্ধ ছাপিয়ে, চর্বি ভাজার সুবাস ঘুরপাক খাচ্ছিল, যেন তা উৎসবের ধুপধুনো ।

সবার পেছনে, দুই ধারের দোকানসারির একেবারে শেষে, যেন এই সমস্ত ঘনঘটা থেকে নিজেকে লজ্জায় নির্বাসন দিয়েছে, আমি একজন বুড়ো সঙকে দেখতে পেলুম, ঝুঁকে পড়েছে, রুগ্ন, জরাজীর্ণ, একজন মানুষের ধ্বংসাবশেষ, তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে আছে ;  কোনো বুনো বর্বরের চেয়েও ছেঁড়াখোঁড়া তাঁবু, সেখানে দুটো ফুরিয়ে-আসা মোমবাতি, দপদপ করছিল আর ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁবুর দারিদ্র্য ।

সর্বত্র, উল্লাস আর মুনাফা আর অসংযম ; সর্বত্র কালকের খাবারের আশ্বাস ; সর্বত্র জীবনীশক্তির ব্যস্ত উচ্চরব । এখানে, চরম দুরবস্হা, পোশাক পরানো দুরবস্হা, যাতে আতঙ্ককে তীব্রতর করা যায়, হাস্যকর কাঁথায়, যে অবস্হায় শিল্পের তুলনায় প্রয়োজন তৈরি করেছে বৈপরীত্য । লোকটা, দীনদরিদ্র, হাসেনি ! লোকটা ফোঁপায়নি, লোকটা নাচেনি, লোকটা অঙ্গভঙ্গী করেনি, লোকটা চেঁচায়নি ; লোকটা কোনো গান গায়নি, তা সে মজার হোক বা দুঃখের ; লোকটা ভিক্ষা চায়নি । লোকটা ছিল চুপচাপ আর স্হির । লোকটা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, লোকটা অধিকার ত্যাগ করে দিয়েছিল । ওর নিয়তি ছিল নিশ্চিত । কিন্তু ভিড় আর আলোর স্পন্দিত জোয়ার ওর বীভৎস দারিদ্র্যের কয়েক পা দূরত্বে এসে থেমেছিল,   ওর চাউনি ছিল গভীর জ্ঞানপূর্ণ, ভোলা যায় না এমন ! আমি অনুভব করলুম আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে বায়ুরোগের ভয়ঙ্কর প্রকোপে, আর আমি অনুভব করলুম যে আমার নিজের দৃষ্টি দ্রোহের কান্নায় মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে যা থেকে অশ্রু ঝরবে না ।

তাহলে কীই বা করি ? ছেঁড়া পর্দার পেছনে, অভাগা লোকটাকে যদি জিগ্যেস করি যে এই ছায়ার আড়ালে আমাকে দেখাবার মতন কোন আশ্চর্য , কোন কৌতূহল-জাগানিয়া ব্যাপার আছে, তাতে কী উপকার হবে ? আর সত্যি বলতে, আমার সাহস হলো না ; আর যদিও আমার ভীতির কারণ শুনে তুমি হাসবে, আমি দিব্বি করে বলতে পারি যে আমার ভয় করছিল লোকটাকে অপমান করে ফেলব । শেষ পর্যন্ত, নিজেকে বুঝিয়ে, আমি ঠিক করলুম যে লোকটার পাটাতনের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে কিছু টাকা তার ওপর রেখে দেব, এই আশায় যে সে আমার অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করবে, অথচ সেই সময়েই কোনো অজানা উৎসাহের আকস্মিক ঢেউয়ে ভিড়ের ঠেলায় আমি ওর থেকে অনেকটা দূরে চলে এলুম ।

আর, বাসায় ফেরার পথে, এই দৃশ্যের আচ্ছন্নতায়, আমি আমার আকস্মিক দূঃখকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলুম, আর নিজেকে বললুম : আমি এক্ষুনি একজন বৃদ্ধ সাহিত্যিকের স্পষ্ট ছবি দেখলুম যে সেই প্রজন্মের চেয়ে অধিককাল বেঁচেছে যে প্রজন্মকে সে এক সময় মেধাবী আনন্দ দিয়েছিল ; বন্ধুহীন একজন বুড়ো কবি, পরিবারহীন, সন্তানহীন, দারিদ্র্যের আর জনগণের অকৃতজ্ঞতা দ্বারা বিধ্বস্ত, তাঁবুর আড়ালে যেখানে ভুলো জগৎ আর ঢুকতে চায় না ! 


পনেরো

কেক

আমি পর্যটনে বেরিয়েছিলুম । যে ভূদৃশ্যে আমি নিজেকে পেলুম তা ছিল চমৎকারিত্ব ও মহনীয়তায় অপ্রতিরোধ্য । এর কিয়দংশ নিঃসন্দেহে আমার অস্তিত্বে প্রবেশ করেছিল । 

আবহের সমান সহজতায় আমার চিন্তাধারা উড়াল পেলো ; গেঁয়ো আবেগ, যেমন ঘৃণা ও নিষিদ্ধ প্রেম, মনে হতে লাগল আমার পায়ের নীচে বহুদূরের মেঘদলের মতন ভেসে  

গেছে গভীর অতলে ; আমার ওপরে ঘিরে থাকা আকাশের গম্বুজের মতন বিশাল আর বিশুদ্ধ অনুভব করছিল আমার আত্মা ; বহুদূরের, পাহাড়ের ঢালে আরেক পর্বতমালায় অদৃশ্য চারণভূমির গরুদের ঘণ্টাধ্বনির মতন আমার স্মৃতির পার্থিব ব্যাপার হৃদয়ে এসে দুর্বল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল । স্হির ছোটো জলাশয়ে, তার অতল গভীরতার কারণে কালো, মেঘের ছায়ারা বয়ে যাচ্ছিল, যেন আকাশে ডানাঅলা উড়ন্ত দৈত্যের আলখাল্লার  ছায়া । আর আমার মনে পড়ছে সেই সমারোহপূর্ণ, বিরল সংবেদন, ব্যপ্ত নিখুঁত স্তব্ধ সঞ্চরণের দ্বারা উদ্ভূত, আমার অন্তরে সৃষ্টি করেছিল মহোল্লাস ও ভয়ের মিশ্রণ । সংক্ষেপে, আমি অনুভব করছিলুম, আমার চতুর্দিকের উদ্দীপনাময় সৌন্দর্যকে ধন্যবাদ, নিজের ও ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে পরম শান্ত এক সম্পর্ক ; আমি বিশ্বাস করি, আমার পূর্ণ সুখে, আর পৃথিবীর যাবতীয় শয়তানিকে ভুলে যাওয়ায়, আমার এমনকি মনে হতে লাগল  সংবাদপত্ররা যে দাবি করে যে মানুষ সৎ হয়ে জন্মায় তা তেমন হাস্যকর নয় । --- কিন্তু যখন জাগতিক প্রয়োজনীয়তা তার চাহিদা মেটাতে চাইলো, আমার মনে হল এতো উঁচুতে চড়ার দরুণ যে ক্লান্তি আর ক্ষুধা দেখা দিয়েছে তা মেটানো দরকার । পকেট থেকে একটা বড়ো রুটির টুকরো, চামড়ার কাপ, আর তখনকার দিনে ডাক্তাররা পর্যটকদের যে ধরণের টনিক দিতেন আর তাতে গলিত তুষার মেশানো যেতো, তার ফ্লাস্ক বের করলুম। রুটিটা চুপচাপ কাটতে লাগলুম, তখনই একটা মৃদু শব্দ আমাকে ওপরে তাকাতে বাধ্য করল । আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক ছোট প্রাণী, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে আর অবিন্যস্ত, যার ফাঁকা চোখের কোটর, আরণ্যক,  আর যেন মিনতি করছে, রুটিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। আর আমি তার নিচুস্বর, কর্কশ কন্ঠের দীর্ঘশ্বাস মেশানো, “কেক” উচ্চারণ শুনতে পেলুম ! আমার মামুলি রুটিকে ওই শব্দে সন্মান করার দরুণ না হেসে থাকতে পারলুম না, আর আমি একটা বড়ো টুকরো কেটে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলুম । ও ধীরে এগিয়ে এলো , ঈর্ষার বস্তুটি থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই ; তারপর হঠাৎই, রুটির টুকরোটা হাত দিয়ে কেড়ে নিয়ে, তাড়াতাড়ি পেছিয়ে গেলো, যেন ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে আমার উপহার হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিংবা বলে ফেলে আমি পশ্চাত্তাপ করছি। 

কিন্তু সেই মুহূর্তে  আরেকজন বুনো কে জানে কোথা থেকে এসে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর দুজনকে এমন একইরকম দেখতে যে মনে হচ্ছিল ওরা যমজ ভাই । দুজনে ধুলোয় গড়াগড়ি খেলো, দামি শিকারের লোভে, মনে হচ্ছিল দুজনেই নিজের ভাইকে অংশ দিতে চায় না । প্রথম জন, হতাশায়, দ্বিতীয়জনের চুলের মুঠি ধরল । দ্বিতীয়জন প্রথমজনের কান দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল, আর অমার্জিত শব্দে গালাগাল দিয়ে  রক্তমাখা থুতু ফেলল । কেকের বৈধ দাবিদার চেষ্টা করল দখলদারের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে ; পরবর্তীজন তার হাত দিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা টিপে ধরতে চাইল, আর অন্য হাত দিয়ে জিতে নেয়া পুরস্কার পকেটে পুরে ফেলতে চাইলো । কিন্তু হতাশায় চাগিয়ে উঠে, পরাজিতজন গায়ের পুরো শক্তি খাটিয়ে বিজয়ীর পেটে মাথার ধাক্কা মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো । কিন্তু একটা নোংরা লড়াই, যা তাদের বালকসূলভ চেহারার তুলনায় বেশিক্ষণ বজায় ছিল, তা বর্ণনা করে কীই বা হবে ? মুহূর্তে-মুহূর্তে কেকটার হাতবদল আর পকেটবদল হতে থাকলো ; কিন্তু, হায়, তার পরিমাণেও পরিবর্তন ঘটতে থাকলো ; আর সব শেষে, ক্লান্ত হয়ে, শ্বাসের জন্যে হাঁপিয়ে, রক্তাক্ত, তারা থামলো, কেননা আর লড়াই করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে, লড়াই করার জন্যে বাঁচেনি কিছুই ; রুটির টুকরোটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল গুঁড়ো হয়ে, বালুকণায় মিশে গিয়ে আর পার্থক্য করা যাচ্ছিল না ।

ঘটনাটার দরুণ ভূদৃশ্য ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল আমার সামনে, আর এই দুই ক্ষুদে মানুষ আসার আগে আমার আত্মা যে শান্তি উপভোগ করছিল তা সম্পূর্ণ উবে গিয়েছিল; কিছুক্ষণের জন্যে আমার মন বেশ ভারাক্রান্ত ছিল, আমি নিজেকে বলছিলুম : “আচ্ছা, তাহলে, একটা চমৎকার দেশ যেখানে রুটিকে বলা হয় কেক, এক বিরল উপাদেয় যা ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট !”


ষোলো

ঘড়ি

বিড়ালের চোখ দেখে চীনারা সময় বলে দিতে পারে ।

একদিন একজন যাযক, নানকিঙের শহরতলির পথ দিয়ে যাবার সময়ে, তাঁর মনে পড়ল যে ঘড়ি পরে আসতে ভুলে গেছেন, আর একটি ছোটো ছেলেকে জিগ্যেস করলেন এখন কয়টা বেজেছে।

চীন সাম্রাজ্যের লোচ্চা ছোঁড়া প্রথমে ইতস্তত করল ; তারপর ভেবে নিয়ে বলল, “আমি গিয়ে তোমার জন্য জেনে আসছি”। কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে এলো, একটা মোটা বিড়ালকে সঙ্গে নিয়ে, আর বিড়ালের চোখ দেখে, তার শাদা অংশের দিকে তাকিয়ে, লোকে যেমন বলে থাকে, কোনো দ্বিধা ছাড়াই ঘোষণা করল : “এখনও দুপুর হয়নি।” কথাটা সত্যি ।

আমার কথা যদি বলি, যখন আমি আমার সুন্দর ফিলিনের দিকে ঝুঁকি, বেশ ভালো নাম, যে তার যৌনতার জন্য সন্মানিত, আমার হৃদয়ের গর্ব, আর আমার আত্মার সুগন্ধ -- তা সে রাত হোক বা দিন, ঝলমলে আলোয় কিংবা আবছা ছায়ায় -- তার আদরযোগ্য চোখের গভীরতায় আমি নিখুঁত সময় দেখতে পাই, সর্বদা একই সময়, বিশাল একটি সময়, সৌন্দর্যমণ্ডিত, এবং শূন্যতার মতন শৌর্যময়, মিনিট ও সেকেণ্ডের বিভাজন ছাড়াই -- স্হির একটা সময় যা ঘড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট নয়, কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের মতন হালকা, চোখের পাতা ফেলার মতন দ্রুত ।

আর যখন আমি সুন্দর ঘড়িমুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি সেই সময়ে কেউ এসে যদি আমাকে বিরক্ত করে, যদি কোনো অসৎ ও অসহ্য জিনপরী, খারাপ সময়ের কোনো দানব এসে বলে, “এতো মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ ? এই প্রাণীর চোখে তুমি কী খুঁজছ ? তুমি কি সময় দেখছ, ওহে অলস, অপচয়ী নশ্বর ?”-- কোনো দ্বিধা না করেই আমি জবাব দেবো : “হ্যাঁ, আমি সময়কে দেখছি ; তা হলো অনন্তকাল !”


সতেরো

মেয়েটির কেশদামের গোলার্ধ

আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।

আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে -- যাকিছু আমি অনুভব করি -- তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে ।

তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।

তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে। 

তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।

আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই  অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি । 

আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি। 


আঠারো

সমুদ্রভ্রমণের নিমন্ত্রণ

এক দারুণ দেশ আছে, কোকেইন নামের দেশ, লোকে বলে, সেখানে আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে যাবার স্বপ্ন দেখি । তুলনাহীন দেশ, উত্তরের কুয়াশায় ডোবা, যাকে বলা যায় পাশ্চাত্যের প্রাচ্য, ইউরোপের চীন, তেমন অবাধ নিয়ন্ত্রণ তপ্ত, খেয়ালি কল্পনার উৎসার ঘটায় না, আর তাই ধৈর্য ধরে ও জেদে তার গূঢ় ও অপলকা বনানীর  স্বপ্নবিলাস এঁকে রাখেনি।

সত্যকার এক কোকেইন দেশ, যেখানে সমস্তকিছু সুন্দর, বৈভবপূর্ণ, শান্তিময়, নিখুঁত ; যেখানে শৃঙ্খলার সঙ্গে বিলাস নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে উদ্বাহু ; যেখানে জীবন শ্বাস নেবার জন্য মোহময় ও মিষ্টি ; সেখান থেকে বিশৃঙ্খলা, উথালপাথাল, এবং যা অচিন্তিতপূর্ব তা নির্বাসিত ; সেখানে নৈঃশব্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আনন্দের ; সেখানে রান্না করার ব্যাপার একই সঙ্গে কাব্যিক, মূল্যবান ও উৎসাহবর্ধক ; সেখানে, হে প্রিয় দিব্যতা, সব কিছু তোমার সদৃশ ।

তুমি তো জানো আমাদের শীতল দুঃখযন্ত্রণার দিনগুলোতে যে জ্বরময় অসুখ ঘিরে ধরে, সেই অজানা দেশের জন্য মনকেমন, কৌতূহলপ্রসূত উদ্বেগ ? একটা দেশ আছে যা তোমার সদৃশ, সুন্দর, বৈভবপূর্ণ, শান্তিময়, এবং নিখুঁত, যেখানে কল্পনা সৃষ্টি করেছে আর সাজিয়েছে এক পাশ্চাত্য চীনদেশ, যেখানে শ্বাস নেবার জন্য জীবন বেশ মিষ্টি, যেখানে আনন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নৈঃশব্দের । সেখানেই আমাদের সকলের যাওয়া উচিত, আমাদের উচিত সেখানে গিয়ে মারা যাওয়া !

হ্যাঁ, শ্বাস নেবার জন্য, স্বপ্ন দেখার জন্য, এবং সময়কে সংবেদনের অনন্তকালীনতা দেবার জন্য, আমাদের যাওয়া উচিত । একজন সঙ্গীতকার ওয়াল্টজ নৃত্যে নিমন্ত্রণ নামে সুর বেঁধেছিলেন ; কোথায় সেই লোক যিনি সমুদ্রভ্রমণের নিমন্ত্রণ-এর সুর বাঁধবেন, যা প্রিয়তমাকে উপহার দেয়া যায়, নির্বাচিত বোনকে  দেয়া যায় ?

হ্যাঁ, সেই আবহাওয়াতে বেঁচে থাকা হয়ে উঠবে শ্রেয় -- সেই দূরদেশে, যেখানে স্তিমিত সময়ে বহু চিন্তা একত্রিত হয়, যেখানে ঘড়িগুলো গভীর, অর্থময় শান্তিতে আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি করে । জানালার ঝিকমিকে শার্শিতে, কিংবা গিল্টি-করা দামি কালো চামড়ার ওপরে, চুপচাপ বাস করে আশীর্বাদময়, শব্দহীন, গূঢ় পেইনটিঙ, যেন তা সেই চিত্রকরদের আত্মা যাঁরা সেগুলো সৃষ্টি করেছেন । অস্তগামী সূর্য, যা অভ্যর্থনাঘরের খাবার জায়গায় এমন রঙ এনেছে, সুন্দর পর্দার কাপড়ে সাজানো কিংবা দীর্ঘ জানালায় সীসার পাতলা পটি দিয়ে বাঁধানো একাধিক শার্শি ।

কাঠের আসবাবগুলো বিশাল, কৌতূহলময়, অদ্ভুত, এবং সূক্ষ্ম আত্মার মতন তালা ও গোপনতা দিয়ে বন্ধ । আয়নাগুলো, বাসনকোসন, আচ্ছাদন, সোনার থালা, আর মাটির জিনিসপত্র চাউনির জন্য বাজায় এক মৃদু, রহস্যময় সঙ্গীত ; আর সবকিছু থেকে, কোনাগুলো থেকে, দেরাজের ফাঁকগুলো থেকে, পর্দার ভাঁজ থেকে, এক একক সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, সুমাত্রার এক স্মৃতিচিহ্ণ, গৃহের আত্মার মতন এক সুবাস ।

সত্যকার এক কোকেইন দেশ, আমি বলি, যেখানে সকলে ধনী, পরিচ্ছন্ন, এবং সুস্হ বিবেকের মতন উজ্বল, রান্নার বাসনকোসনের মতন চমৎকার, যেন পেটা সোনার মতন, বহুরঙা অলঙ্কারের মতন অসাধারণ ! জগতের তাবৎ ঐশ্বর্য সেখানে একত্রিত হয়, যেন কোনো এক শ্রমিকের বাসা যে সারা পৃথিবীর ধন্যবাদ অর্জন করেছে । একটি অনুপম দেশ, সবার চেয়ে উন্নত, যেমন প্রকৃতির তুলনায় শিল্প, যেখানে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকৃতিকে নতুন করে গড়া যায়, যেখানে তা পরিশুদ্ধ, সাজানো, পুনর্নির্মিত । ওদের খুঁজতে দাও, ওরা খুঁজতে থাকুক, নিজেদের আনন্দের সীমাকে ওরা অপরিসীম বাড়িয়ে তুলুক, উদ্যানপালনবিদ্যার সেই রাসায়নিকরা ! 

তাদের উচ্চাকাঙ্খী সমস্যার সমাধানের জন্য তারা ষাট কিংবা শতহাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করুক । আমার কথা যদি বলি, আমি আমার কালো টিউলিপ আর নীল ডালিয়া খুঁজে পেয়েছি !

তুলনাহীন ফুল, পুনরাবিষ্কৃত টিউলিপ, আলঙ্করিক ডালিয়া, সেখানে আছে, নয় কি, সেই সুন্দর দেশে যা শান্তিময় আর স্বপ্নালু, যেখানে আমাদের গিয়ে প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠা উচিত ? তুমি কি তোমার নিজের তৈরি উপমা দিয়ে উদ্ভাসিত হতে চাইবে না, এবং তুমি কি সেখানে প্রতিফলিত হতে চাইবে না -- অতিন্দ্রীয়বাদীরা যেমন বলে থাকেন -- তোমার নিজের প্রতিষঙ্গে ?

স্বপ্ন, সব সময়ে স্বপ্ন ! আর আত্মা যতো উচ্চাকাঙ্খী আর সূক্ষ্ম, সম্ভাব্য থেকে স্বপ্নেরা ততো দূরে সরে যায়। প্রতিটি মানুষ নিজের অন্তরে প্রাকৃতিক আফিমের খোরাক বয়ে বেড়ায়, অশেষভাবে লুকিয়ে রাখা আর অশেষভাবে  নবায়িত, এবং জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে, প্রকৃত আনন্দের কতোটা সময় আমরা গুণতে পারি, সুচিন্তিত ও সফল কর্মকাণ্ডে ? আমরা কি কখনও বেঁচে থাকব, আমরা কি কখনও আত্মার রাঙানো নাট্যদৃশ্যে প্রবেশ করব, সেই নাট্যদৃশ্য যা তোমার সদৃশ? 

এই ঐশ্বর্য, এই আসবাবপত্র, এই বিলাসদ্রব্য, এই শৃঙ্খলা, এই সুগন্ধরাজি, এই অলৌকিক ফল, তারা সকলেই তুমি । আর তারা সকলেই তুমি, এই বিশাল স্রোত আর এই স্বচ্ছ খাল । জলবাহিত এই বিশাল নৌপোতগুলো, সবই ধনরত্নে ভরা, জাহাজের দড়িদড়া থেকে মন্ত্রের মতন জেগে ওঠা গান, তারা আমার চিন্তাধারা যেমন জাগ্রট করে,  তারা তোমার বুকে ঘুমোয় আর পরিবাহিত হয় ।

তুমি ধীরে তাদের সাগরে নিয়ে যাও যা অনন্তকালীন, তখন তুমি তোমার আত্মার সুন্দর স্পষ্টতায় আকাশের গভীরতাকে প্রতিফলিত করো --- আর তখন তারা ঢেউয়ের উথ্থানে ক্লান্ত হয়ে যায়, আর প্রাচ্যের ফলমূলে ভারি হয়ে ওঠে, আর নিজের দেশের বন্দরে ফিরে যায়, তারা তখনও থাকবে আমার চিন্তাধারা হয়ে, ঐশ্বর্যময়, আর তোমার নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে আসবে ।


উনিশ

গরিবের খেলনা

আমি একটা নিরীহ ভিন্নমুখের ইঙ্গিত দিচ্ছি । কিছু বিনোদনে অপরাধবোধ নেই!

তুমি যখন সকালে বাইরে বেরোও, মনঃস্হির করে নিয়ে যে কেবল রাজপথে ঘুরে বেড়াবে, পকেটে কয়েকটা ছোটো গ্যাজেট পুরে নাও যাদের দাম এক টাকাও নয় -- যেন একটা সুতোয় বাঁধা চ্যাপ্টা নাচ-পুতুল, কামার নেহাইয়ের ওপরে পিটছে, ঘোড়া আর তার সওয়ার, লেজ যেন হুইসিলের কাজ করছে -- আর রেস্তরাঁর সামনে, কিংবা গাছতলায়, যে গরিব বাচ্চাদের সঙ্গে তোমার দেখা হয় তাদের উপহার দিয়ে দাও । প্রথমে তাদের নেবার সাহস হবে না ; তারা তাদের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করবে না । কিন্তু তারপর তাদের ব্যগ্র হাত কেড়ে নেবে উপহার, আর নিয়ে পালাবে, যেমন বিড়ালদের তুমি যখন খাওয়াও তারা সেটা খাবার জন্য বেশ দূরে চলে যায়, মানুষকে অবিশ্বাস করার অভিজ্ঞতার দরুণ ।

পথে এগিয়ে, বিশাল এক বাগানের গেট অতিক্রম করে, যার পেছনে দেখা যাচ্ছিল সূর্যের আলোয় ঝলকে-ওঠা সুন্দর এক বাগানবাড়ির ঔজ্বল্য, দাঁড়িয়ে ছিল এক সংস্কৃতিমান ও তরতাজা বালক,  গ্রামীণ পোশাকে যা বেশ নম্র আর আকর্ষক ।

বিলাস, দুশ্চিন্তার অনুপস্হিতি, এবং বৈভবের অভ্যাসগত প্রদর্শনী এই বালকদের এমন শোভন করে তোলে যে মনে হবে সাধারণ ও দারিদ্র্যের ছাঁচে গড়া বালকদের চেয়ে এদের গড়ার ছাঁচ আলাদা।

তার পাশে ঘাসের ওপরে পড়ে আছে এক চমৎকার খেলনা, তার মালিকের মতনই টাটকা, চকচকে আর সোনালী, বেগুনি পোশাক পরানো, ছোটো-ছোটো পালক আর কাচের পুতি দিয়ে সাজানো । কিন্তু ছেলেটি তার প্রিয় খেলনা নিয়ে খেলছিল না ; পরিবর্তে, সে তাকিয়ে ছিল এই দৃশ্যের দিকে :

গেটের অন্য দিকে, রাস্তার ওপর, শেয়ালকাঁটা আর জংলিঝোপের মাঝে ছিল আরেকজন বালক, অপরিচ্ছন্ন, পুঁচকে, তেলচিটে, সেই ধরণের এক অস্পৃশ্য প্রাণী যার অন্তরে,  নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কেউ দেখলে খুঁজে পাবে, যেমনভাবে একজন বিশেষজ্ঞ আদর্শ পেইনটিঙের ভার্নিশের আবরণের তলায় প্রকৃত শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করেন, তেমন করে দারিদ্র্যের বিকর্ষক চাদর ধুয়ে ফেলে তাকে দেখতে পাবে ।

এই প্রতীকি পাঁচিল যা দুটি জগতকে আলাদা করে রেখেছে, রাজপথের আর বাগানবাড়ির, গরিব বালকটি ধনী বালকটিকে নিজের খেলনা দেখাচ্ছিল, যে বেশ উৎসাহ নিয়ে সেটা পরখ করছিল যেন তা কোনো বিরল ও অজানা বস্তু । এখন, নোংরা ছেলেটি যে খেলনা দেখিয়ে প্ররোচিত করছিল, খাঁচার ভেতরে ঝাঁকাচ্ছিল আর দোলাচ্ছিল -- তা ছিল এক জ্যান্ত ইঁদুর ! ওর বাবা-মা, নিঃসন্দেহে ব্যয়সঙ্কোচের কারণে, জীবনযাপন থেকেই সরাসরি খেলনা যোগাড় করে ফেলেছিলেন।

আর বালক দুজন ভাতৃত্ববোধে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছিল, সমান ঔজ্বল্যের সাদা দাঁত মেলে ।


কুড়ি

পরীদের উপহার

সেদিন ছিল পরীদের বিশাল জমায়েত, বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় যারা জন্মেছে তাদের উপহার দেবার ব্যবস্হা করার জন্য ।

নিয়তির এই সুপ্রাচীন আর খেয়ালি বোনেরা, আনন্দ আর দুঃখের এই অদ্ভুত মায়েরা,  একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা : কাউকে মনে হচ্ছিল গম্ভীর আর বদমেজাজি ; আবার কেউ  চঞ্চল আর দুষ্টু ; কেউ যুবতী, যারা চিরকালের জন্য যুবতী ; অন্যেরা বয়স্কা, যারা চিরকালই বয়স্কা রয়েছে ।

যে বাবারা পরীর অস্তিত্ব বিশ্বাস করে তারা হাজির হয়েছে, প্রত্যেকের কোলে সদ্যজাত।

উপহারগুলো, সামর্থ্যগুলো, সৌভাগ্যগুলো, অজেয় পরিস্হিতিগুলো জড়ো করা হয়েছে এক সালিশিসভার পাশে, যেমনভাবে সান্মানিক স্নাতক উৎসবে পুরস্কারগুলো একটা টেবিলের ওপরে রাখা থাকে । পার্থক্য হলো যে উপহারগুলো প্রয়াসের পরিশোধ হিসাবে নয় ; বরং বিপরীত, তারা ছিল এমন মানুষদের মর্যাদা দেবার উপলক্ষ যারা তখনও পর্যন্ত জীবনযাপন করেনি, এমন মর্যাদা যা  দুঃখযন্ত্রণা অথবা, তেমনই সহজভাবে, আনন্দের খাতিরে ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে ।

বেচারা পরীরা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, কেননা দরখাস্তকারিদের সারি ছিল দীর্ঘ, আর মাঝামাঝি জগত, মানবসমাজ ও ভগবানের মাঝে, আমাদের মতনই সময়ের ভয়ঙ্কর আইন  আর তার অগুন্তি সন্তানসন্ততি, দিন, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ডকে মানতে তারা মনে হচ্ছিল বাধ্য। 

সত্যি বলতে, তারা সবাই যাযকদের অধিবেশনের দিনের মতন বিক্ষুব্ধ ছিল, কিংবা  মঁ-দ্য-পিয়েতের তেজারতি কারবারিদের মতন যখন রাষ্ট্রিয় উৎসবের দিন বিনামূল্যে উত্তরণপ্রাপ্তি ঘোষণা করা হয়, তেমন । আমার সন্দেহ হলো যে সময়ে-সময়ে ওনারা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাচ্ছিলেন ঠিক যেমন মানুষ-বিচারকরা করেন যাঁরা, সকাল থেকে ঠায় চেয়ারে বসে, রাতের ভোজের , পরিবারের কথা, আর তাঁদের প্রিয় চটির ব্যাপারে দিবাস্বপ্ন দেখেন । সেকারণে যদি অতিবাস্তব বিচারের জন্য একটু ব্যস্ততা আর এলোমেলোভাব ঘটে, তাহলে অবাক হওয়া উচিত নয় যে একই ব্যাপার ঘটে থাকে মানুষের বিচারব্যবস্হাতেও । আমরা যদি অবাক হই তাহলে আমরা নিজেরাই অন্যায্য বিচারক হয়ে যাবো ।

সুতরাং, সেদিন কয়েকটা সাঙ্ঘাতিক ভুল হয়েছিল যা মনে হতে পারে অদ্ভুত, যদি খামখেয়াল নয়, বিচক্ষণতা হয় পরীদের নির্দিষ্ট, শাশ্বত চারিত্র্য ।

আর তাই চুম্বকের মতন বৈভব আকর্ষণের ক্ষমতা পুরস্কার হিসাবে দেয়া হলো একটি ঐশ্বর্যশালী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে, যার না ছিল পরার্থবাদীতার বোধ বা না ছিল দেখিয়ে বেড়াবার জিনিসপত্র সম্পর্কে আগ্রহ, যার ফলে  কোটি কোটি অর্থের ভারে অস্বাভাবিকভাবে বিব্রত তারা শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ঘটিয়েছিল নিজেদের ।

আর তাই সৌন্দর্য্য এবং কাব্যিক ক্ষমতার প্রতি প্রেম দেয়া হয়েছিল কৌতূকরসবোধহীন এক বুড়ো ইতর দুর্বৃত্ত, পাথরভাঙা মজুরের ছেলেকে, যে নিজের কারিগরি শেখাতে পারেনি ছেলেকে, বা তার নিন্দনীয় সন্তানের সমস্যা লাঘব করতে পারেনি ।

বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে এই পবিত্র দিনগুলোয় বিতরণের প্রক্রিয়া পুনর্বিচারযোগ্য নয়, আর কোনও উপহার প্রত্যাখ্যান করা যায় না ।

পরীরা সকলে উঠে দাঁড়ালো, এই মনে করে যে তাদের উঞ্ছবৃত্তি শেষ হয়েছে ; কেননা কোনো উপহার আর বাঁচেনি, দেবার মতন আর খুদকুঁড়ো ছিল না যা মানুষের ভিড়ে ছুঁড়ে দেয়া যায়, তখন একজন সাহসী লোক -- একজন ছোটোখাটো গরিব ব্যবসাদার, দেখে তাই মনে হলো--- উঠে দাঁড়ালো আর নিজের কাছের পরীর বহুরঙা বাষ্পময় পোশাক আঁকড়ে, চেঁচিয়ে উঠলো:

“ওহ, ঠাকরুন ! আপনারা আমাদের ভুলে যাচ্ছেন ! আমার ছেলেও রয়েছে ! কিচ্ছু পাবো না বলে আমি এতোদূর আসিনি !”

পরীটি হয়তো সত্যিই বিব্রত হয়ে থাকবে, কেননা আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু তখনই পরীটির একটা সর্বজনবদিত নিয়মের কথা মনে পড়লো যা সচরাচর প্রয়োগ করা হয়না অতিবাস্তব জগতে বসবাসকারী অননুভবনীয় প্রতিমাদের দ্বারা, মানবসমাজের বন্ধু এবং মানুষের আবেগের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য যাদের অনেক সময়ে বাধ্য করা হয়, যেমন পরীরা, যক্ষ-যক্ষিনী, উভচর প্রাণীরা, তন্বীদেবীরা, কৃশকায়াদেবীরা, জলের ভুতেরা, সন্তানবতী মানবাত্মারা আর বনকুমারীরা -- আমি বলতে চাইছি সেই আইনের কথা যা পরীদের, এইরকম ক্ষেত্রে, এমন ঘটনায়, যখন উপহারসামগ্রী ফুরিয়ে গেছে, দেবার মতো ক্ষমতা আর নেই, সম্পূরক হোক বা ব্যতিক্রম, পরীটির যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল যে তৎক্ষণাত কিছু তৈরি করে ফেলতে পারে ।

অতএব, ভালো পরীটি বলল, তার পদমর্যাদার আত্মনিয়ন্ত্রণ খেয়াল রেখে : “আমি তোমার ছেলেকে দিচ্ছি...আমি তাকে দিচ্ছি...খুশি করার ক্ষমতা !” কিন্তু ছোটোখাটো দোকানদার, যে সাধারণের মতন চিন্তাকারীদের একজন, নিজের মনকে অসম্ভাব্যতার যুক্তিতে উন্নীত করার প্রতিভা যার নেই,  এঁড়ে জেদ করে জানতে চাইলো, “কিন্তু কেমন করে খুশি করবে ? খুশি…? কেনই বা খুশি ?”

“কেননা ! কেননা !’ বলল ক্রুদ্ধ পরীটি, লোকটির দিকে পেছন ফিরে ; আর নিজের সহকর্মীদের মিছিলে আবার যোগ দিয়ে, পরীটি সঙ্গীদের বলল, “এই আত্মাভিমানী ছোট্ট ফরাসি লোকটার সম্পর্কে কী ভাবো তোমরা, যে সবকিছু বুঝে ফেলতে চায়, আর যে, নিজের ছেলের জন্যে সবচেয়ে ভালো ভাগ্য উপহার পেয়েছে, যা জিগ্যেস করা যায় না তাইই জিগ্যেস করার সাহস দেখাচ্ছে, আর যা নিয়ে তর্ক করা যায় না তাই নিয়ে তর্ক করছে ?”


একুশ

প্রলুব্ধিগুলো : অথবা যৌনতা, ঐশ্বর্য, এবং খ্যাতি

দুজন জাঁকজমকপূর্ণ শয়তান আর প্রেতিনী, কম অসাধারণ নয়, গত রাতে সেই রহস্যময় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল যে পথে নরক ঘুমন্ত দুর্বল মানুষকে আক্রমণ করে, আর তার সঙ্গে গোপন বার্তালাপ করে । আর তারা আমার সামনে এসে দ্যূতিসহ জাহির দাঁড়ালো, মঞ্চের অভিনেতাদের মতন ঋজু । আর যখন তারা রাতের অস্পষ্ট গভীরতা থেকে নিজেদের আলাদা করে এগিয়ে এলো, এই তিন ব্যক্তিত্ব থেকে গন্ধকের অত্যুজ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছিল । তাদের দেখে এতো গর্বোদ্ধত আর এতো বেশি কর্তৃত্বময় লাগছিল যে প্রথমে আমি ভেবেছিলুম তারা সত্যকার দেবতা।

প্রথম শয়তানের মুখ ছিল দ্ব্যর্থক, আর তার দেহের কোমল রেখা আর চেহারা মনে হচ্ছিল প্রাচীনকালের গ্রিকদের আসবদেবতার মতন । তার সুন্দর, ধীরুজ চোখ, ছায়াময়, অবর্ণনীয় রঙসহ, যেন ঝড়ের দেয়া অশ্রুফোঁটায় ভেজা ভায়োলেট ফুল, আর তার দু-ফাঁক করা ঠোঁট যেন তপ্ত ধুনুচির মতন, আতর বিক্রির দোকান থেকে সুগন্ধের শ্বাস ফেলছে ; আর যখনই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, তার অগ্নিময় নিঃশ্বাস থেকে যেন কস্তুরী-সুবাসের কীটেরা উদ্ভাসিত হচ্ছে আর স্পন্দিত হচ্ছে । 

তার বেগুনি রঙের জামায় এক উজ্বল সাপ বেল্টের মতন করে জড়ানো ছিল, আর মাথা তুলে তার দিকে অগ্নিময় অলস চোখে তাকিয়ে ছিল । এই জীবন্ত বেল্ট থেকে ঝুলছিল, ভয়ানক শিশির ফাঁকে ফাঁকে, চকচকে ছুরি আর শল্যচিকিৎসার অস্ত্রপাতি । তার ডানহাতে সে ধরেছিল আরেকটা শিশি যাতে ছিল লাল উজ্বল বস্তু, লেবেলে এই উদ্ভট কথা লেখা : “পান করো, এ হলো আমার রক্ত, উৎকৃষ্ট বলদায়ক” ; বাঁ হাতে ছিল একটা বেহালা যা স্পষ্টত তাকে সাহায্য করছিল নিজের আনন্দের আর নিজের দুঃখের গান গাইতে, আর কর্মবিরতির জন্য শাস্ত্রনির্দিষ্ট রাতে উন্মাদনার ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে দিতে ।

তার কমনীয় গোড়ালিতে পরা ছিল সোনার ভাঙা শেকল, আর তার দরুণ যে অস্বাচ্ছন্দ্য তাকে বাধ্য করছিল মাটির দিকে চোখ নামাতে, সে আত্মশ্লাঘায় মুগ্ধ হয়ে নিজের বুড়ো আঙুলের নখ দেখছিল , তা ছিল পালিশ করা মণিরত্নের মতন, 

তার সান্ত্বনাতীত বেদনাময় চোখ, প্রতারণাপূর্ণ  মাদকতায় চুর, সে মেলে ধরল আমার দিকে, আর সে আমাকে সঙ্গীতময় কন্ঠে বলল, “তুমি যদি চাও, তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আত্মাদের প্রভূ করে দেবো, আর তুমি জীবন্ত বস্তুর শিক্ষক হয়ে উঠবে, কাদার ভাস্করের চেয়ে বড়ো ; আর তুমি সুখানুভবের সঙ্গে পরিচিত হবে, যা শেষহীণভাবে নবায়িত হবে, তুমি নিজের কাছ থেকে মুক্তি পাবে আর অন্যদের মাঝে নিজেকে ভুলে যাবে, আর অন্যদের তাদের আত্মা থেকে টেনে বের করতে পারবে, এমন এক অবস্হায় থাকবে যেখানে তুমি তাদের থেকে নিজেকে আলাদা মনে করতে পারবে না।”

আর আমি জবাবে বললুম, “অনেক ধন্যবাদ !  অন্যের জঞ্জাল নিয়ে আমার কিছুই করার নেই, যাদের হয়তো, আমার চেয়ে বেশি মূল্য নেই । আর যখন কিনা আমার রয়েছে বহু লজ্জাজনক স্মৃতি, আমি কিছুই ভুলতে চাই না ; আর আমি যদি আগে থাকতে তোমাকে নাও চিনতুম, পুরোনো দানব কোথাকার, তোমার রহস্যময় ছুরি-চামচ, তোমার সন্দেহজনক শিশিগুলো, যে শেকল তোমার পা বেঁধে রেখেছে সেগুলো সবই এমন প্রতীক যা স্পষ্টভাবে তোমার বন্ধু হওয়ার বিড়ম্বনা ব্যাখ্যা করে । তোমার উপহার তোমার নিজের কাছেই রাখো।”

দ্বিতীয় শয়তানের তেমন বিয়োগান্তক হাসিমুখের হাবভাব ছিল না, তেমন সূক্ষ্ম, পরোক্ষ ইঙ্গিতপূর্ণ  আচরণও নয়, তেমন মোলায়েম আর সুগন্ধিত সৌন্দর্যও ছিল না । লোকটা ছিল পেল্লাই, চোখহীন মস্তবড়ো মুখ, ফোলা ভুঁড়ি ঝুলে পড়েছে উরু পর্যন্ত, আর তার গায়ের চামড়া ছিল সোনালী ও ছবি আঁকা, যেন উলকি দেগে দেয়া হয়েছে, তাতে প্রতিনিধিত্ব করছিল দুঃখদুর্দশার সর্বাত্মক আঙ্গিকে খুদে-খুদে বিচরণশীল প্রাণী । সেখানে ছিল ছোট্ট রোগা মানুষ যারা স্বেচ্ছায় পেরেক থেকে ঝুলছে ; ছিল ছোট্ট, টিঙটিঙে , বিকলাঙ্গ পাতালপ্রেত যাদের মিনতিভরা চোখ তাদের কাঁপতে-থাকা হাতের তুলনায় সার্থকভাবে ভিক্ষা চাইছিল ; আর তারপর তাতে ছিল বুড়ি মায়ের দল যারা নিজেদের চোপসানো বুকে আঁকড়ে রেখেছিল রুগ্ন শিশুদের । আর ছিল অনেক কিছু।

মোটা শয়তান নিজের পেল্লাই ভুঁড়িতে ঘুষি ঠুকলো, যার ফলে শোনা গেল দীর্ঘক্ষণ, ঠুঙঠাঙ, ধাতব আওয়াজ, যা শেষ হলো বহু মানুষের কন্ঠে অস্পষ্ট গোঙানিতে । আর ও হেসে উঠলো, অশ্লীল কায়দায় নিজের ভাঙা দাঁত দেখিয়ে, সে এক চওড়া জড়বুদ্ধি হাসি,  যেমন বহু দেশে দেখা যায়, বেশি খাবার-দাবার খেয়ে কিছু লোক অমন করে থাকে ।

আর ও আমাকে বলল, “আমি তোমাকে এমনকিছু দিতে পারি যার দরুণ তুমি সবকিছু পাবে, যা সবকিছুর দাম মেটাবে, যা প্রতিটি জিনিসকে বদলে দিতে পারবে !” আর সে নিজের দানবিক পেটে ঘুষি ঠুকলো, যার নাকিসুর  প্রতিধ্বনি তার কর্কশ কথাগুলো সম্পর্কে মন্তব্যের মতন শোনালো ।

আমি বিরক্তিতে পেছন ফিরলুম, আর জবাবে বললুম : “আমার আনন্দের জন্যে, আমি অন্যের দুঃখদুর্দশা, চাই না ; আর ওয়ালপেপারের মতন তোমার চামড়ায় আঁকা পাপগুলো, নোংরা মাখানো কোনো ঐশ্বর্য, চাই না ।”

যদি প্রেতিনীর কথা বলি, অস্বীকার করা মিথ্যা হবে, যদি বলি যে তার মধ্যে প্রথমে  অদ্ভুত একটা মনোহারিত্ব আমি পাইনি । এই মনোহারিত্বকে যে একটি মাত্র কথায় বলতে পারি তা হলো সেই সব সুন্দরী রমণীরা, যাদের সৌন্দর্য ঝরে গেছে, কিন্তু তবু যারা বুড়ি হয়নি, যাদের সৌন্দর্য ধ্বংসের তীব্র কৌতূহলের ইন্দ্রজাল ধরে রাখে । প্রেতিনী ছিল একই সঙ্গে উদ্ধত এবং জবুথবু, আর তার চোখদুটো, মেলে-মেলে ক্লান্ত,  তা সত্তেও মোহিনীশক্তি বজায় রেখেছিল । 

যা আমার সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় মনে হলো তা হলো প্রেতিনীর কন্ঠস্বরের রহস্য, যাতে আমি পেলুম স্তিমিত সুরের মাধুর্যের প্রতিধ্বনি, সেই সঙ্গে বহুক্ষণ ব্র্যাণ্ডি পান করার ফলে গলায় যে খসখসে ভাব থাকে, তাই ।

“তুমি তোমার ক্ষমতা জানতে চাও ?” মেকি ঈশ্বরী বলল তার মনোমুগ্ধকর, স্ববিরোধী কন্ঠস্বরে।

“শোনো ।”

আর প্রেতিনী তার ঠোঁটে একটা বিরাট আড়বাঁশি ঠেকালো, যা থেকে ঝুলছিল একাধিক ফিতে, খেলনার বাঁশির মতন, যার ওপরে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সংবাদপত্রের নাম লেখা ছিল, আর নিজের আড়বাঁশি বাজিয়ে প্রেতিনী আমার নাম ঘোষণা করল, যা শতহাজার বজ্রধ্বনির ক্ষমতায় ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পরিসরে, আর সবচেয়ে দূর থেকে আসা উপগ্রহের প্রতিধবনির মতন  ফিরে এলো আমার কাছে ।

“প্রেতিনী !” আমি বললুম, অর্ধেক পরাভূত, “জিনিসটা দামি বটে !”

কিন্তু ফোসলানো বাঁশিটা খুঁটিয়ে লক্ষ করে, আমার একটা অস্পষ্ট অনুভব হলো যে আমি একে চিনি, আমার জানাশোনা কয়েকজন মূর্খের সাথে কোথাও একে মদ খেতে দেখেছি ; আর আমার কানে ওর কাঁসার কর্কশ আওয়াজ আবছাভাবে মনে করিয়ে দিল এক বারবনিতাসূলভ আড়বাঁশির ।

তাই আমি বললুম, অত্যন্ত তাচ্ছল্যে, “এখান থেকে কেটে পড়ো !  নাম বলতে চাই না এমন লোকেদের রক্ষিতাকে বিয়ে করার জন্যে আমি জন্মাইনি।”

নিঃসন্দেহে আমার সাহসী প্রত্যাখানের জন্যে আমার গর্ববোধ করার অধিকার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমি জেগে উঠলুম, আর আমার সমস্ত শক্তি আমায় ছেড়ে চলে গেলো। “সত্যি”, আমি নিজেকে বললুম, “এই ধরণের শুদ্ধ বিবেক প্রদর্শন করার সময়ে আমি নিশ্চয়ই গভীর নিদ্রায় ছিলুম । আহ, যখন জেগে ছিলুম তখন যদি ওরা আসতো, তাহলে আমি অতো ভদ্রতা করতুম না!”

আর আমি যতো জোরে পারা যায় চিৎকার করে ওদের বললুম, আমাকে ক্ষমা করে দিতে, তাদের অনুগ্রহ পাবার জন্যে আমি আত্মঅপমানিত হতে রাজি হলুম ; কিন্তু আমি তো ওদের বেশ অপমান করেছি, তাই ওরা আর কখনও ফেরেনি ।



বাইশ

গোধূলীসন্ধ্যা

দিন ফুরিয়ে আসে । সারা দিনের খাটুনির দরুণ ক্লান্ত আত্মাগুলোর অন্তরে এক বিশাল শান্তিময়তা সৃষ্টি হয় । আর এই সময়ে তাদের চিন্তায় ফুটে ওঠে গোধুলীর অভিমানী, অনিশ্চিত রঙ।

কিন্তু পাহাড়ের চূড়া থেকে, এক অত্যুচ্চ আর্তনাদ আমার বারান্দায় পৌঁছোয়, রাতের উঁচু পাতলা মেঘের ভেতর দিয়ে, দূরত্বের সঙ্গে মিশ-খাওয়া বিসদৃশ কান্নায় তালগোল-পাকানো বিষণ্ণ ঐকতান, ঠিক যেমন ফুঁসে-ওঠা জোয়ার কিংবা জেগে-ওঠা ঝড়ে ঘটে ।

সেই অভাগারা কারা যারা সন্ধ্যার দ্বারা শান্ত হয় না আর যারা, পেঁচার মতন, এসে-পড়া রাতকে মনে করে অপবিত্র ডাইনির শাস্ত্রসন্মত ছুটির সংকেত ? এই অমঙ্গলের লক্ষণপূর্ণ উলুধ্বনি আমাদের কাছে আসছে পাহাড়ের ওপরের কালো আতুরাশ্রম থেকে ; আর সন্ধ্যাবেলা -- নেশা ফোঁকার সময়ে বিশাল নীরব সমতলভূমির কথা গভীরভাবে বিবেচনা করি, যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক বাড়ি যার প্রতিটি জানালায় লেখা, “এখন এখানে শান্তি বিরাজ করছে ; এখানে এখন পারিবারিক আনন্দ !” -- যখন ওখান থেকে বাতাস বয়ে আসে, আমি আমার চমকে-ওঠা চিন্তাগুলো নরকের ঐকতানের ওই অনুকরণের মাঝে খেলাতে পারি । গোধুলী পাগলদের উত্তেজিত করে। --  মনে পড়ছে আমার দুজন বন্ধু ছিল যারা গোধুলীর কারণে অসুস্হ হয়ে পড়েছিল । একজন, সেই সময়ে, প্রথমে যে তার কাছে পৌঁছোত, বন্ধুত্বের আচরণ আর বিনয়কে ভুল বুঝে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করত । আমি ওকে দেখেছিলুম প্রধান সেবকের দিকে ভালোভাবে রাঁধা মুর্গির মাংস ছুঁড়ে দিতে, ও মনে করেছিল তাতে বুঝি কে জানে কোন অপমানজনক সংকেতলিপিতে লেখা বার্তা আছে । সন্ধ্যায়, সবচেয়ে স্বাদু খানাপিনার প্রথম পাত হেয় করার পর, ওর জন্য নষ্ট হয়ে যেত যাবতীয় রসালো খাদ্যবস্তুগুলো ।

আরেকজন, নিজের উচ্চাকাঙ্খায় আহত, সূর্যাস্ত আরম্ভ হতেই ক্রমশ আরও তিক্ত, আরও বিষণ্ণ, আরও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতো । দিনের বেলায় প্রশ্রয়দানকারী আর বন্ধু, সন্ধ্যায় হয়ে উঠতো নির্দয়, আর তা কেবল অন্যদের ক্ষেত্রেই নয়, গোধূলীর পাগলামি সে নিজের ওপরেও বাঁধনছাড়া ক্রোধে প্রয়োগ করত ।

প্রথমজন পাগল হয়ে মারা গেল, নিজের স্ত্রী আর বাচ্চাকেও চিনতে পারত না ; দ্বিতীয়জন নিজের অন্তরে অবিরাম অসুস্হতার উদ্বেগ বয়ে বেড়ায়, আর আমি বিশ্বাস করি যে রাষ্ট্র আর রাজপুত্ররা তাকে সন্মান জানিয়ে সন্তুষ্ট করতে চাইলেও, গোধুলী তার ভেতরে তবুও কাল্পনিক স্বাতন্ত্রের লোভের আগুন জ্বালিয়ে দিতো । রাত্রি, যা তাদের আত্মায় অন্ধকার পুঁতে দেয়, আমার ক্ষেত্রে আলো আনে ; আর যদিও একই ব্যাপারের দুটি ভিন্ন পরিণতি বিরল নয়, তবু ব্যাপারটা আমাকে একই সঙ্গে বিহ্বল ও সতর্ক করেছে ।

হে রাত্রি, হে তরতাজা করে তোলা ছায়াগণ ! আমার জন্যে তুমি অন্তরের পবিত্র দিনের সংকেত, তুমি মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তিদানকারী ! সমতলভূমির একাকীত্বে, গলিঘুঁজির পাথুরে রাজধানী শহরগুলোয়, তুমি, ঝিলমিলে নক্ষত্রের আর রাস্তার লন্ঠনের ঝরে পড়া আলোয়, স্বাধীনতা-দেবীর আতশবাজি !

গোধূলী, তুমি কতো মিষ্টি আর কোমল ! দিগন্তে এখনও ছড়িয়ে পড়তে থাকা গোলাপি রশ্মি, রাতের বিজয়ী অত্যাচারের চাপে দিনের মৃত্যু-সংঘর্ষের মতন, সূর্যাস্তের শেষ গৌরবের ওপারে ঘন লাল দাগ তৈরি করে দেয় ঝাড়বাতির উজ্বল আলো, পূর্বদিকের নিগূঢ়তা জুড়ে এক অদৃশ্য হাত টাঙিয়ে দেয় ঠাসবুনান কাপড়ের ঝালর --- জীবনের ম্লান সময়ে একজন মানুষের হৃদয়ে যুদ্ধরত এগুলো হলো জটিল অনুভূতির অনুকরণ ।

কিংবা, পূনর্বার, নর্তকীরা যেমন অদ্ভুত পোশাক পরেন, যার মলিন স্বচ্ছ কাপড়ের তলায় দেখা যায় একদা বিস্ময়কর স্কার্টের ফিকে হয়ে আসা সৌন্দর্য, তেমনভাবেই বর্তমানের কালোকে  স্বাদু অতীত ভেদ করে ; আর দোদুল্যমান, ছড়িয়ে-পড়া সোনা-রুপোর নক্ষত্ররা কল্পনার সেই শিখাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যা কেবল রাতের গভীর শোকে সুস্পষ্টভাবে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে । 


তেইশ

একাকীত্ব

এক উদার-হৃদয় সাংবাদিক আমাকে বলল যে মানুষের জন্য একাকীত্ব খুব খারাপ ; আর নিজের গবেষণার সমর্থনে ও উদাহরণ দিল, অবিশ্বাসীরা যেমন সদাসর্বদা দিয়ে থাকে, গির্জার যাযকদের উপদেশগুলোও তাই ।

আমি জানি শয়তান সব সময় জনবসতিহীন অঞ্চল পছন্দ করে, আর হত্যা করার উৎসা্হ ও লালসা আশ্চর্যভাবে নিঃসঙ্গ স্হানে প্রতিপালিত হয় । কিন্তু হতে পারে যে এই নিঃসঙ্গ জায়গাগুলো কেবল অলস, নিরানন্দ লোকেদের জন্যই বিপজ্জনক, যারা জায়গাটাকে নিজের আবেগ আর ছায়ামূর্তি দিয়ে ভরে রাখে ।

এটা নিশ্চিত যে একজন বারফট্টাই-হাঁকিয়ে, যার মহানন্দ হলো একটা বেদি বা বেঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের মতামতকে অভ্রান্ত ঘোষণা করা, তার পাগল হয়ে গিয়ে চীৎকার চেঁচামেচির ভয়ঙ্কর বিপদ রয়েছে যদি সে রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপে থাকে । আমি সাংবাদিককে রবিনসন ক্রুসোর সাহসী সততার কথা জিগ্যেস করিনি, কিন্তু আমি ওকে অনুরোধ করেছিলুম যেন সেইসব লোকেদের বিরুদ্ধে নালিশ না করে যারা একাকীত্ব আর রহস্য ভালোবাসে।

আমাদের বকবককারী জাতিতে কিছু লোক আছে, যদি তাদের ফাঁসির মঞ্চের উচ্চতায়  দাঁড়িয়ে শব্দবহুল বাগাড়ম্বরের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে তারা ফরাসি বিপ্লবের  গিলোটিনের সময়ে বক্তৃতা থামাবার জন্য বাজানো দামামাকে পরোয়া না করেই, মৃত্যুদণ্ডকেও সামান্য অনিচ্ছাভরে মেনে নেবে ।

তাদের সম্পর্কে আমার নালিশ নেই, কেননা আমি বুঝতে পারি যে অন্যেরা যেমন নিজেদের নৈঃশব্দ আর ধ্যানে আনন্দ পান, তারাও তেমনি তাদের বক্তৃতার নির্গমন থেকে আনন্দ পায় ; কিন্তু আমি তাদের ঘৃণা করি ।

তাছাড়া, আমি চাইবো যে আমার অভিশপ্ত সাংবাদিক আমাকে আমার মতো করে খেয়ালখুশিতে থাকতে দেবে । “তাহলে, তুমি অনুভব করো না,” ও আমাকে জিগ্যেস করেছিল, যাযকীয় নাকিসুরে, “যে তোমার আনন্দ অন্যের সঙ্গে বাঁটোয়ারা করার প্রয়োজন আছে ?” দ্যাখো এই কৌশলী হিংসুটেকে ! ও জানে যে ওর সুখভোগের ধরণকে আমি অবজ্ঞা করি, তাই ও বিদকুটে রসভঙ্গ করার জন্য আমার মতামত সম্পর্কে ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করছে !

“একা না থাকতে পারার এই অতিঅমঙ্গল হলো…” লা ব্রুয়েরে কোথাও লিখেছেন, নিজেকে ভুলে থাকার জন্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকে  লোকগুলোকে অপমান করার জন্য দৌড়ে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করা, এই ভয়ে যে সে একা থাকলে নিজেকে সহ্য করতে পারবে না । 

“আমাদের প্রায় সমস্ত অমঙ্গলের উৎসসূত্র হল নিজের ঘরে না থাকতে পারা,” বলেছেন আরেকজন জ্ঞানী, পাসকাল, আমার বিশ্বাস, এইভাবে নিজের অন্তরজগতের ধ্যানশীলতার কুঠুরীতে সেই সমস্ত উন্মাদ মানুষদের ডাক দেয়ার চেষ্টা করেন যাঁরা নিজেদের আনন্দ এমন কাজকর্মে আর এমন প্রাণীর বেশ্যাবৃত্তিতে খোঁজেন যাকে আমি বলব ভ্রাতৃবৎ, যদি আমার শতকের সুন্দর ভাষায় তা বলতে হয় ।


চব্বিশ

পরিকল্পনা

ও নিজেকে বলল, একা একটা বাগানে বেড়াবার সময়ে : “রাজ দরবারের জটিল সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পোশাকে মেয়েটিকে কতো সুন্দর দেখাবে, সুন্দর সান্ধ্য বাতাসে, রাজবাড়ির শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বিশাল বাগান আর ঝিলগুলোর দিকে যদি ও তাকায় ! কেননা ওর তো রাজকন্যা হবার স্বাভাবিক আভিজাত্য রয়েছে।”

পরে রাস্তায় হাঁটার সময়ে, ও একটা ছাপার দোকানের সামনে দাঁড়ালো, আর একটা দেয়ালে ক্রান্তিবৃত্তের দেশের উপত্যকার ছবি দেখে, নিজেকে বলল : “নাহ ! রাজপ্রাসাদ তেমন জায়গা নয় যেখানে আমি ওর মিষ্টি জীবনকে অধিগ্রহণ করব ! সেখানে আমরা ঘর বাঁধতে পারব না । আর সোনার ছিটে দেয়া দেয়ালগুলোতে ওর ছবি ঝোলাবার মতন জায়গা থাকবে না ; জাঁকালো দরদালানগুলোতে নিরালা অন্তরঙ্গতার নিভৃতি থাকে না । নিঃসন্দেহে, এইটিই সেই জায়গা যেখানে আমার জীবনের স্বপ্নের চর্চা করতে হবে ।”

আর, ছাপা ছবিটি খুঁটিয়ে বিস্তারিত দেখার সময়ে, ও নিজেকে আবার বলল, “সমুদ্রের ধারে, এক সুন্দর কাঠের ঘরে, অদ্ভুত আলোকময় গাছে ঘেরা, যাদের নাম আমি ভুলে গেছি....হাওয়ায়, সেই মাদক, ব্যাখ্যাহীন সুবাস...ঘরের ভেতরে, এক তীব্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে, কস্তুরীর...আরও দূরে, আমাদের ছোট্ট এলাকার পেছনে, সাগরের ঢেউয়ে দুলতে-থাকা মাস্তুলের শীর্ষ...আমাদের চারিদিকে, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গোলাপি আলোয় আলোকিত আমাদের ঘর ছাড়িয়ে, বোনা শীতল চাটাই আর সংবেদনী ফুলে সাজানো, ঘন কালো বিরল পোর্তুগিজ রোকোকো চেয়ার ( যার ওপরে ও এলিয়ে বসবে, হাওয়ায়, আফিমদেয়া তামাকের ধোঁয়া উড়িয়ে ), আর তার ওইদিকে, বারান্দায়, রাতের আলোয় মাতাল পাখিদের কুজন, আর ছোটোখাটো আফরিকি মেয়েদের গল্পগুজব...আর রাতের বেলায়, আমার স্বপ্নকে সঙ্গদানের জন্য, সঙ্গীতময় গাছেদের সবিলাপ গান, সবিষাদ ক্যাসুরিনা গাছ । হ্যাঁ, সত্যি, এই ধরনের দৃশ্যপটই আমি চেয়েছি । কেনই বা আমি রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে মাথা ঘামাবো ?”

আর পরে, তরুশ্রেণীর মাঝখানের পথ দিয়ে যখন সে হাঁটছিল, সে একটা ছোটো পরিষ্কার রেস্তরাঁ দেখতে পেলো, সুতির পর্দায় আলোকিত জানালার ভেতরে, দুটি হাসিমুখ দেখতে পেলো। আর সহসা : “আমার মন”, ও নিজেকে বলল, “নিশ্চয়ই একটা সত্যিকার ভবঘুরে যে অনেক দূরে যা খুঁজতে যায় তা এতো কাছে রয়েছে ।  যে প্রথম রেস্তরাঁ আমার চোখে পড়ল, তাতেই রয়েছে আহ্লাদ আর খুশি, ভাগ্যক্রমের রেস্তরাঁ, উপভোগের জিনিসে ঠাশা । তাপ পোয়াবার আগুন, রঙিন থালা, চালু রাত্রিভোজন, আমুদে মদ, আর বড়ো বিছানা তার সঙ্গে কম্বল যদিও লোমশ কিন্তু পরিচ্ছন্ন : এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ?”

আর একা বাসায় ফেরার সময়ে, যখন পর্যন্ত বাইরের জীবনের জাঁকজমকে জ্ঞানের বার্তা দূরে মিলিয়ে যায়নি, ও নিজেকে বলল : “আজকে আমি কল্পনায় তিনটে বাড়ি পেয়েছিলুম, যার সবকটাতেই পেয়েছি সমান আনন্দ । কেনই বা আমার শরীরকে জায়গা বদলে বাধ্য করব, যখন আমার আত্মা অমন কর্মতৎপরতায় ভ্রমণে বেরোতে পারে ? আর কেনই বা আমার পরিকল্পনাকে রূপ দেবার জন্য মাথা ঘামাবো, যখন কিনা পরিকল্পনাটা নিজেই যথেষ্ট আনন্দের ?”


পঁচিশ

সুন্দরী ডরোথি

সূর্য তার তপ্ত, উল্লম্ব রোদে শহরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ; বালি ঝকমক করছে আর সমুদ্রের ঢেউ কেঁপে উঠছে । হতচেতন জগত দুর্বল আত্মসমর্পণ করে  দুপুরঘুম আরম্ভ করেছে, এক ধরণের প্রিয় মৃত্যুর মতন এমন দুপুরঘুম যে নিদ্রায় ঘুমন্ত মানুষ, অর্ধেক জেগে, নিজের বিলয়নের পরমানন্দ উপভোগ করে ।

কিন্তু ডরোথি, সূর্যের মতনই তেজি আর গর্বিত, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ছড়িয়ে-পড়া নীলিমার বিস্তারের তলায় এই সময়ে একমাত্র জীবন্ত প্রাণী, রোদের আলোয় কালো ছায়া ফেলে হাঁটছে ।

মেয়েটা হালকা চালে এগোয়, চওড়া পাছার ওপরে তার একহারা চেহারা দুলতে থাকে । তার ফিকে গোলাপি রেশমের পোশাক তাকে জড়িয়ে ধরে থাকে, তার কালো ত্বকের রূঢ় বৈশাদৃশ্য হিসাবে, তার দীর্ঘ চেহারাকে নিখুঁতভাবে মুড়ে, তার পলকা পিঠ, তার বুক দুটো ছুঁচালো।

রোদ্দুরকে ছেঁকে নিচ্ছে তার লালরঙের ছোট্ট ছাতা, রক্তবর্ণ রুজের প্রলেপ দিচ্ছে তার কৃষ্ণকায় ত্বকে ।

তার প্রচুর চুলের ওজন, প্রায় নীল, তার সুন্দর মাথাকে পেছনদিকে হেলিয়ে রেখেছে, যা তাকে দিয়েছে বিজয়িনীর শ্রমবিমুখ ঔদ্ধত্য । তার ভারি কানের দুল চুপিচুপি  কানে-কানে প্রশংসা করছে।

থেকে-থেকে সাগরের বাতাস তার ভাসমান পোশাকের একটা কোন তুলে ধরছে, দেখা যাচ্ছে তার মসৃণ, অসাধারণ পা দুটি ; আর তার পায়ের পাতা, ইউরোপ মর্মপাথরের তৈরি যে ধরণের ঐশী দেবীদের জাদুঘরে বন্ধ করে রাখে, মিহি বালুকণার ওপরে অনুগত ছাপ ফেলছে । কারণ ডরোথি এমনই অস্বাভাবিক ছিনাল যে তার মুগ্ধ-প্রশংসার আনন্দকে অতিক্রম করে চলে যায় মুক্তি পাওবার গর্বের দিকে, আর সে স্বাধীন হলেও, পায়ে জুতো না পরেই হাঁটে ।

তাই মেয়েটি এগিয়ে যায়, সমন্বয়ে ডগমগ, বেঁচে থাকার আনন্দে, মুখের ঝকঝকে হাসি, যেন সে বহু দূরের কোনো আয়নায় তার চালচলন ও সৌন্দর্য প্রতিফলিত হতে দেখছে ।

এই সময়ে, যখন কুকুররাও রোদ্দুরের কামড়ের নীচে দুঃখে ঘেউঘেউ করে, কোন সে কর্মদ্যোগী উৎসাহ যা শ্রমবিমুখ ডরোথিকে এইভাবে পরিচালিত করছে, ব্রোঞ্জের মতন সুন্দর ও শীতল তরুণী ?

মেয়েটি কেন তার ছোট্ট ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, যত্ন করে সাজানো, যেখানে অত্যন্ত কম খরচে গোছাগোছা ফুল আর মাদুর গড়ে দিয়েছে নিখুঁত এক খাসকামরা ; সেখানে চুল আঁচড়ে, সিগার টেনে, পাখার বাতাস খেয়ে কিংবা পালকের পাখা-আয়নায় নিজেকে দেখে সে আনন্দিত হয়, যখন সমুদ্র, একশো পা দূরে তীরভূমিতে আছড়ে পড়ে, মেয়েটির অস্পষ্ট কল্পনার সঙ্গে সশব্দ তাল মিলিয়ে, আর যখন লোহার পাত্র, যাতে মেয়েটি কাঁকড়া, ভাত, আর জাফরান ভাপে সেদ্ধ করেছে, দালানের পেছন থেকে উদ্দীপক সুবাস ভাসিয়ে দেয় ?

হয়তো মেয়েটি কোনো যুবক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাতের পরিকল্পনা করেছে, যে, বহু দূরের সমুদ্রতীরে, তার বন্ধুদের থেকে শুনেছে ডরোথির প্রসিদ্ধি । অবশ্যই, মেয়েটি যুবকটিকে মিনতি করবে, বেচারা, অপেরার নাচের বর্ণনা করতে, আর মেয়েটি তাকে জিগ্যেস করবে সেখানে কেউ খালি পায়ে যেতে পারে কিনা, যেমন রবিবারের নাচগুলোয় বুড়ি কাফ্রিরাও মাতাল হয়ে নিজের আনন্দে নাচতে পারে ; আর তারপর, জিগ্যেস করবে প্যারিসের সুন্দরীরা তার চেয়েও সুন্দরী কিনা ।

ডরোথিকে সকলেই প্রশংসা আর স্নেহ করে, আর সে খুবই আনন্দ পাবে যদি তাকে তার এগারো বছরের বোনকে, যে এখনই গায়েগতরে তৈরি আর সুন্দরী, তাকে ফেরত কিনে নেবার জন্য প্রতিটি পয়সা বাঁচাতে না হয় ! ও নিঃসন্দেহে সফল হবে, সুকন্যা ডরোথি ; বোনের মালিকটা এতো লোভী, এতো বেশি লোভী যে টাকাকড়ি বোঝে কিন্তু সৌন্দর্য বোঝে না !


ছাব্বিশ

গরিবের চোখ

আহ, তুমি জানতে চাও কেন আজ আমি তোমায় অপছন্দ করছি। আমার ব্যাখ্যা করার তুলনায়, নিঃসন্দেহে, তোমার পক্ষে তা বোঝা কঠিন হবে ; পৃথিবীর মাটিতে নারীর অভেদ্যতার সুন্দরতম উদাহরণে আমি বিশ্বাস করি । 

আমরা দুজনে সারাটা দিন একসঙ্গে কাটিয়েছি, যা আমার বেশ ছোটোই মনে হয়েছে। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে পরস্পরের ভাবনাচিন্তাকে সেদিন বিনিময় করব, আর আমাদের দুটি আত্মা এক হয়ে যাবে -- এমন স্বপ্ন যাতে কোনো মৌলিকতা ছিল না, যাই হোক, কথা হলো যে সবাই এই স্বপ্ন দেখে থাকলেও, কেউই এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি ।

সেই সন্ধ্যায়, যৎসামান্য ক্লান্ত, নতুন তরুবীথির সদ্য প্রতিষ্ঠিত রেস্তরাঁর সামনে তুমি বসতে চেয়েছিলে, তখনও পর্যন্ত ভাঙাচোরা ইঁটপাথরের মাঝে, কিন্তু বেশ জাঁকজমক করে তাদের অসমাপ্ত জিনিসগুলো তারা সাজিয়েছে । রেস্তরাঁটা ছিল আলো ঝলমলে । গ্যাসবাতিটা নিজেই যেন প্রথম দিনের উত্তেজনাকে অনুভব করছিল, আর নিজের সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে দেয়ালগুলোকে চোখধাঁধানো আলোয় শ্বেতশুভ্র করে তুলেছিল, ঝকমকে আয়নার সারি, সোনালি কার্নিস আর সাজানো কারুকৃতি, বকলেস বাঁধা কুকুরেরা টান মারছে গালফোলা ছোকরা-বেয়ারাদের, হাতের ওপরে বাজপাখি রেখে হাসছেন মহিলারা, পরীরা আর দেবীপ্রতিমারা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে ফলের টুকরি, মাংসপোরা রুটি আর খাবার পাখি, গ্রিক চাকরানি হিবসের দল  আর চাকর গ্যানিমিডের দল নিজেদের হাতে ধরে আছে ফেনিল মুসেকেক কিংবা বহুরঙা লম্বাটে আইসক্রিম: যাবতীয় ইতিহাস আর যাবতীয় পুরাণকাহিনি নামিয়ে আনা হয়েছে কোটনাগিরি আর খানাপিনার স্তরে।

আমাদের ঠিক সামনে পথের কিনারায়, যেন সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে, চল্লিশ বছর বয়সী এক সজ্জন দাঁড়িয়েছিলেন, মুখময় ক্লান্তি আর শাদা দাড়ি, এক হাতে একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে আর অন্য হাতে কোলে ধরা আরেকটা বাচ্চা, তখন পর্যন্ত যার হাঁটার বয়স হয়নি । লোকটা আয়ার ভূমিকা পালন করছিল, আর নিজের বাচ্চাদের সান্ধ্যভ্রমণ করাতে নিয়ে বেরিয়েছিল । সকলেই ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে । তিনটে মুখই ছিল অত্যন্ত গম্ভীর, আর ছয়টা চোখ সমানভাবে অবাক হয়ে দেখছিল নতুন রেস্তরাঁর শৌর্য, কিন্তু বয়স অনুযায়ী তারতম্য ছিল । বাবার চোখ দুটো বলছিল, “কতো সুন্দর ! কতো সুন্দর ! ঠিক যেন গরিব পৃথিবীর সমস্ত সোনা জড়ো করে এই দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছে।” ছোটো ছেলেটার চোখ দুটো : “কতো সুন্দর ! কতো সুন্দর ! কিন্তু এই জায়গাটা এমন যে আমাদের মতন লোকেদের ঢুকতে দেবে না ।” আর সবচেয়ে ছোটো বাচ্চার চোখ দুটো, তারা জাঁকজমকের জৌলুসে এতোই মুগ্ধ যে নির্বাক এবং গভীর আনন্দ ছাড়া আর কিছু ব্যক্ত করতে পারছিল না ।

গানলেখকরা বলেন যে আনন্দ আত্মাকে উন্নীত করে আর হৃদয়কে করে নম্র । সেই সন্ধ্যায় গানগুলো সঠিক ছিল, আমার ক্ষেত্রে । আমি যে কেবল  এই পরিবারের চোখের দ্বারা বিচলিত হয়েছিলুম তাইই নয়, আমাদের তৃষ্ণার চেয়ে বড়ো গেলাস আর মদ্যপানের পাত্র সম্পর্কে একটু লজ্জা বোধ করেছিলুম । প্রিয়তমা, আমি তোমার চোখে চাউনি মেললুম, যাতে সেখানে আমার চিন্তাভাবনাকে পাঠ করতে পারি : আমি গভীরভাবে নেমে গেলুম তোমার দৃষ্টিতে, কতো সুন্দর আর কতো অদ্ভুতভাবে মোলায়েম, তোমার সবুজ চোখের ভেতরে, ওই চোখে বসবাস করে খামখেয়াল, আর চাঁদের প্রেরণা পেয়ে, তুমি আমাকে বললে, “ওইখানে যে লোকগুলো রয়েছে তাদের সহ্য করা যায় না, ওদের চোখগুলো খোলা সিংদরোজার মতন ! তুমি তো প্রধান বেয়ারাকে বলতে পারো ওদের তাড়িয়ে দিতে ?”

কতো কঠিন পরস্পরকে বুঝতে পারা, আমার প্রিয় পরীরানি, এমনকি যে দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে,  আমাদের চিন্তা একে আরেকজনকে জানানো অসম্ভব ! 


সাতাশ

নায়কোচিত মৃত্যু

ফাঁসিউলে ছিল একজন প্রশংসনীয় জোকার, বস্তুত রাজপুত্রের বন্ধু । কিন্তু সেই সমস্ত লোকেদের ক্ষেত্রে,  যাদের কর্মজীবন হাসিঠাট্টায় বাঁধা, গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় তাদের বিপজ্জনকভাবে আকর্ষণ করে ; আর একজন জোকারের মস্তিষ্কে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা যদি স্বেচ্ছাচারীর মতন দখল করে তাহলে তাকে বিটকেল মনে হতে পারে, আর ফাঁসিউলে একদিন কয়েকজন অসন্তুষ্ট অভিজাতদের ষড়যন্ত্রে শামিল হয়ে গেল । সব জায়গাতেই ভালো মানুষেরা থাকে যারা ক্ষমতাসীন কর্তৃত্বের কাছে দুঃখী ধরনের লোকেদের উৎসর্গ করতে চায় যাতে রাজপুত্রদের বেদখল করে পটের পরিবর্তন করে সমাজে পরিবর্তন আনা যায়, আর তা বিচার-বিবেচনা না করেই। অভিজাতের দল তো গ্রেপ্তার হলোই, সেই সঙ্গে ফাঁসিউলেও, পেল নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড ।

আমি বিশ্বাস করতে পারি যে তাঁর প্রিয় অভিনেতাকে বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখে রাজপুত্র কিছুটা বিপর্যস্ত বোধ করেছিলেন । অন্যদের মতন রাজপুত্র যেমন ভালো ছিলেন না তেমন খারাপও ছিলেন না ; কিন্তু অত্যধিক সংবেদনে চালিত হয়ে, অনেক ক্ষেত্রে, তিনি তাঁর অভিভাবকদের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আর বেশি উৎপীড়ক হয়ে যেতেন । সুকুমার শিল্পের অনুরাগী, এবং বিচক্ষণ বোদ্ধা, উপভোগের ক্ষেত্রে তাঁকে তৃপ্ত করা যেতো না । মানুষ আর নৈতিকিতার ক্ষেত্রে ছিলেন যথেষ্ট উদাসীন, এবং নিজেও একজন প্রকৃত শিল্পী, যে একমাত্র ভয়ঙ্কর শত্রুর কথা তিনি জানতেন তা হলো একঘেয়েমির ক্লান্তি, এবং সেই অবস্হা থেকে মুক্তির ও তাকে দাবিয়ে রাখার জন্য তিনি এমন উদ্ভট কাজকারবার করতেন যে কোনো কঠোর ইতিহাস লেখক তাঁকে “দানব” খেতাব দিতো, যদি তাঁর রাজত্বে অমনকিছু লেখার অনুমতি দেয়া হতো, যা  আদপে আনন্দ বা অনুভূতিতে অসহ্য আঘাত দেয় না, আর অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হলো আনন্দের সবচেয়ে সূক্ষ্ম আঙ্গিক । এই রাজপুত্রের দুর্ভাগ্য যে তার প্রতিভার সমকক্ষ কোনো বড়ো নাট্যমঞ্চ ছিল না । পৃথিবীতে যুবক নিরোরা আছে যাদের গণ্ডীবাঁধা অবস্হায় দম বন্ধ হয়ে যায়, আর ভবিষ্যতের শতকগুলোয় তাদের নাম আর সদিচ্ছা অজানা থেকে যায় । অসতর্ক ভাগ্যবিধাতা এই রাজপুত্রকে জমিজমার তুলনায় সামর্থ্য বেশি দিয়েছিলেন । হঠাৎই গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে শাসক ষড়যন্ত্রকারীদের মাফ করে দেবেন ; আর এই গুজবের উৎস ছিল এক বড়োসড় নাট্যাভিনয়ের ঘোষণা, যে নাটকে ফাঁসিউলে ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, অতিপরিচিত ভূমিকায় অভিনয় করবে, আর যাতে অভিযুক্ত অভিজাতবৃন্দও অংশ নেবে, লোকে বলে বেড়াচ্ছিল ; যাদের মগজ ফাঁকা, তারা বলে বেড়াতে লাগল যে অপমানিত রাজপুত্রের দয়ালু চরিত্রের এটা সুস্পষ্ট প্রমাণ।

একজন মানুষের পক্ষে, যে স্বাভাবিকভাবে আর জেনেশুনে খামখেয়ালি, তার পক্ষে সবকিছু করাই সম্ভব, এমনকি সততা, এমনকি ক্ষমাশীলতা, আর বিশেষ করে যদি সে তাতে কোনো অজানা আনন্দ আবিষ্কার করে । কিন্তু সেই সমস্ত মানুষের পক্ষে, যেমন আমার ক্ষেত্রে, যে ওই অদ্ভুত অসুস্হ আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে, এটা আরও বেশি বিশ্বাযোগ্য যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মানুষের নাট্যপ্রতিভা দেখতে রাজপুত্র বেশি কৌতূহলী ছিলেন । উপলক্ষটাকে কেন্দ্র করে উনি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার ইতিবাচক প্রকোপ নিয়ে শারীরবৃত্তীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইছেন, আর অনুসন্ধান করতে চাইছেন একজন শিল্পীর অভ্যাসগত সামর্থ্য অসাধারণ অবস্হায় পড়লে কতোটা পালটে যেতে পারে ; এই তর্ক বাদ দিয়ে ওনার চরিত্রে কি সুনির্দিষ্ট ক্ষমাশীলতা ছিল নাকি ? এই তর্কের নিষ্পত্তি কখনও হয়নি ।

শেষ পর্যন্ত সেই দিন এলো, আর ছোটো দরবারকে সাজিয়ে তোলা হলো আত্মম্ভরী আড়ম্বরে, আর কল্পনা করা কঠিন, যদি তুমি না দেখে থাকো, কতোটা জাঁকজমক একটা ছোটো রাজ্যের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেনি, সীমাবদ্ধ সঙ্গতি নিয়ে, একটা দুঃখজনক উপলক্ষে তুলে ধরতে পারে। আর এটা তো ছিল দ্বিগুণ দুঃখদায়ক, প্রথমত বিস্ময়কর বিলাসদ্রব্যের প্রদর্শন, আর দ্বিতীয়ত এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নৈতিক ও রহস্যময় আগ্রহ  ।

ফাঁসিউলে তো নির্বাক ভূমিকায় কিংবা যাতে সংলাপ অল্প ছিল, সেই ধরণের ভূমিকা যা ঐন্দ্রজালিক নাটকে প্রতীকিস্তরে জীবনের রহস্যের প্রতিনিধিত্ব করে,  তাতে উৎকৃষ্ট অভিনয় করল । ও মঞ্চে প্রবেশ করেছিল হালকা চালে আর নিখুঁত আত্মসংবরণ করে, যা দেখে জনসাধারণের বিশ্বাস হলো যে ক্ষমা আর দয়া পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ওর আছে ।

যখন কেউ একজন অভিনেতা সম্পর্কে বলে, “এই লোকটা একজন ভালো অভিনেতা”, তখন সে একটা ফরমুলা প্রয়োগ করে, তা হলো এই যে চরিত্রটির মধ্যে অভিনেতাকে পাওয়া যায় -- তার শিল্প, তার প্রয়াস, তার ইচ্ছাশক্তি । এইবার, কোনও অভিনেতাকে যদি হয়ে উঠতে হয়, যে চরিত্র সে উপস্হাপন করতে চলেছে তাই, তাহলে প্রাচীনকালের সুন্দর মূর্তিগুলোর কী ঘটবে যদি তারা অলৌকিকভাবে প্রাণশক্তি পায়, বেঁচে ওঠে, চলাফেরা করে, দ্যাখে,  সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ও বিভ্রান্ত ধারণা -- তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি একক ও নতুন ব্যাপার । সেই রাতে ফাঁসিউলে ছিল একটি আদর্শের নিখুঁত নিদর্শন, এমনই, যাকে কেউ জীবন্ত নয়, অসম্ভব নয়, বাস্তব নয়, বলতে পারত না । তার মাথা ঘিরে ধ্বংসাতীত জ্যোতি নিয়ে জোকার প্রবেশ করল আর চলে গেল, হাসল আর কাঁদল আর নিজের অঙ্গকে আক্ষিপ্ত করল, সেই জ্যোতি এমনই ছিল যা অন্যেরা দেখতে না পেলেও আমি দেখতে পাচ্ছিলুম, এমনই জ্যোতি যা ছিল শিল্পের রশ্মি আর শহিদের গৌরবের অভাবিত মিশ্রণ । ফাঁসিউলে, কে জানে কোন বিশেষ প্রসংসনীয় গুণে, উপস্হাপন করল, অমিত ভাঁড়ামির মধ্যেও ঐশ্বরিকতা ও অলৌকিকতা । আর ভুলতে পারা অসম্ভব এক সন্ধ্যার বর্ণনা করতে বসে আমার কলম কাঁপছে, আর পোঁছা যায় না এমন অশ্রুর আবেগ জমে ওঠছে আমার চোখে । ফাঁসিউলে আমাকে মানতে বাধ্য করল, অকাট্যভাবে, যে অতলে তলিয়ে যাবার সন্ত্রাসবোধকে ঢেকে ফেলার জন্য শিল্পের মাদকতা অনেক বেশি ক্ষমতাদক্ষ ; কবরের ধারে দাঁড়িয়ে প্রতিভাবানরা পরমানন্দে এমন ঠাট্টাইয়ার্কি করতে পারে যা কবরটাকে আড়াল করে দেয়, এমন এক স্বর্গোদ্যানে হারিয়ে যায় যেখানে তাদের কবরের আর ধ্বংসের কোনো ধারণা নেই ।

দর্শকদের মধ্যে সকলেই, আমোদ-ক্লান্ত আর ছেবলা, শিল্পীর ক্ষমতাশীল প্রভাবের কাছে দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল । মৃত্যুর কথা কেউই আর ভাবছিল না, কিংবা শোকের, কিংবা চরম শাস্তির । সবাই আহ্লাদের ঘনঘটায় এমনভাবে মজে গিয়েছিল যা কেবল শৈল্পিক শ্রেষ্ঠ অবদানই দিতে পারে । আনন্দ আর সমাদরের বিস্ফোরণে, বজ্রবিদ্যুতের তেজোময়তায়,  নাট্যগৃহের খিলানগুলো অনেক বার কেঁপে উঠছিল । রাজপুত্র নিজেই, উদ্বেলিত, দরবারের সকলরব সমর্থনে যোগ দিলেন ।

তা সত্তেও, তীক্ষ্ণ চোখ তাঁর উদ্বেলতায় অন্য কিছুর মিশেলও দেখতে পাচ্ছিল । উনি কি নিজের স্বৈরাচারী ক্ষমতার কাছে পরাজিত ? জনগণের হৃদয়ে সন্ত্রাসী আঘাত  ও শীতল হতবুদ্ধি সৃষ্টি করার উদ্দেশে নিজের শিল্পের দ্বারা অপমানিত ? নিজের অনুমানের দ্বারা হতাশাক্রান্ত এবং নিজের পরিকল্পনার ফলাফলে বোকা বনে গেছেন ? অমন ভাবনাচিন্তা -- যদিও সর্বাংশে ন্যায্য নয়, কিন্তু একেবারে অন্যায্যও নয় -- রাজপুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, তাঁর মুখের পরিচিত বিবর্ণতার ওপর অনবরত নতুন বিবর্ণতার প্রলেপ পড়ছিল, যেমন তুষারের ওপর তুষার জমতে থাকে । উনি বারবার ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন, আর ওনার চোখে জ্বলছিল ঈর্ষা আর তিক্ততার মতন আগুন, যদিও উনি নিজের পুরোনো বন্ধু আর অদ্ভুত জোকারের প্রতিভাকে লোকদেখানো প্রশংসা করছিলেন, যে মৃত্যুতেও ভালোভাবে ইয়ার্কি করতে পেরেছিল । একটুক্ষণ পরে, আমি দেখলুম সিংহাসন অধিকারী তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রাজভৃত্যর দিকে ঝুঁকে কানে-কানে কিছু বললেন । সৌম্যকান্তি ছেলেটির দুষ্টু মুখ হাসিতে আলোকিত হয়ে উঠল ; তারপর সে রাজপুত্রের দরবার ছেড়ে চলে গেল যেন কোনো জরুরি কাজ করতে যাচ্ছে।

কয়েক মিনিট পরে, এক তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ হিসহিস-ধ্বনি ফাঁসিউলেকে ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মুহূর্তে বিঘ্ন ঘটালো, একই সঙ্গে হৃৎপিণ্ড আর কান ভেদ করে । আর যেখান থেকে এই অপ্রত্যাশিত অননুমোদন ঘোষিত হয়েছিল, সেই বেদি থেকে একজন বালক দৌড়ে দরবারে এসে চাপা হাসি হাসতে আরম্ভ করল ।

ফাঁসিউলে, আঘাতপ্রাপ্ত, স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল, প্রথমে চোখ বন্ধ করল, তারপর অস্বাভাবিক ভাবে বড়োবড়ো করে মেলে ধরল, মুখ খুলল যেন শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে, হেলেদুলে একটু এগিয়ে, কিছুটা পেছিয়ে, তারপর মঞ্চের ওপর মরে পড়ে গেল ।

সেই হিসহিসধ্বনি, তারোয়ালের আঘাতের মতন দ্রুত, সত্যিই কি ঘাতককে হতাশ করেছিল ? রাজপুত্র কি নিজেই পূর্বাহ্ণে এই ছলনার স্বশ্রেনিঘাতী কার্যকরতা আঁচ করেছিলেন ? এটা সন্দেহ করা অনুমোদিত । উনি কি ওনার প্রিয় এবং শত্রুভাবাপন্ন ফাঁসিউলের অভাব বোধ করেছিলেন? একথা বিশ্বাস করা মধুর ও আইনসঙ্গত । অপরাধী অভিজাতবৃন্দ শেষ বারের মতন মজার প্রদর্শনী দেখেছিলেন । সেই রাতেই জীবন থেকে তাঁদের মুছে ফেলা হয় । সেই সময় থেকে, বহু মূক নাট্যাভিনেতারা, অন্য দেশে সঠিক সমাদৃত হলেও, “অমুকের” দরবারে অভিনয় করতে এলেও, তাদের একজনও ফাঁসিউলের সমকক্ষ প্রতিভার প্রদর্শন কখনও করতে পারেনি, আর তাদের কেউই একই আনুকূল্যের উচ্চতায় উঠতে পারেনি ।



আঠাশ

নকল টাকাকড়ি

তামাকের দোকান থেকে বেরোনোর পর, আমার বন্ধু টাকা-পয়সাগুলো আলাদা করে গুছিয়ে নিলো : তার কোটের বাঁ দিকের পকেটে রাখলো সোনার ছোটো মুদ্রা ; ডান দিকে, চাঁদিরগুলো; প্যাণ্টের বাঁদিকের পকেটে, একমুঠো কাঁসার ; আর সব শেষে, ডান দিকে, রুপোর একটা দুই ফ্রাংক পয়সা যা ও বহুক্ষণ ধরে যাচাই করেছিল ।

“বেশ সূক্ষ্ম পৃথগীকরণ !” আমি নিজেকে বললুম ।

আমরা একজন গরিব ভিখিরির সামনে পৌঁছোলুম, সে কাঁপা হাতে টুপি এগিয়ে দিয়েছিল। ওই  মিনতিময় দুটো চোখের নিঃশব্দ বাগ্মীতার তুলনায় আর কোনো অপ্রতিভ ব্যাপারের সঙ্গে পরিচিত হইনি, একজন সংবেদী মানুষ জানে কেমন করে তা বুঝতে হয়, যে চোখে একই সঙ্গে রয়েছে অবমাননার গভীর বোধ আর ভর্ৎসনা । তাতে এমন কিছু ছিল যা কুকুরের চোখের জলে দেখা যায় যখন কুকুরটাকে কেউ চাবুক মারে । আমার বন্ধু আমার চেয়ে বেশি পয়সা দিয়েছিল, আর আমি ওকে বলেছিলুম, “তুমি সঠিক কাজই করেছো ; নিজে অবাক হবার আনন্দের চেয়ে আরও বেশি আনন্দ হলো অন্য কাউকে অবাক করে দেয়া।” 

“ওটা নকল পয়সা ছিল”, ও শান্তভাবে বলল, যেন নিজের বৈভবকে যুক্তিপূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে । কিন্তু আমার দুস্হ মস্তিষ্কে, যা সব সময়ে অনভ কিছু দেখতে ব্যস্ত থাকে যা সাদা চোখে দেখা যায় না ( আমার এই ক্লান্তিকর প্রতিভা প্রকৃতি আমাকে দিয়েছে ), একটা ধারণা তৈরি হল যে আমার বন্ধুবরের অমন কাজ তখনই মাফ করা যায় যদি ও ভেবে থাকে বেচারা গরিবটার জীবনে কোনো আকস্মিকতা  সৃষ্টি করবে, আর হয়তো দেখতে চাইছিল কতোরকম প্রতিফল, ভয়ঙ্কর অথবা অন্যরকম বিপদ, একটা নকল পয়সা একজন ভিখারির হাতে দিলে ঘটতে পারে । তা কি ভালো পয়সায় বৃদ্ধি ঘটাবে না ? তা কি ওকে কারাগারে পাঠাবে না ? সরাইখানার মালিক কিংবা কসাই, ধরা যাক, নকল পয়সার জন্য ওকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারে । আর নকল পয়সাটা সহজেই হয়ে উঠতে পারে কোনো ছোটোখাটো বেচারা সাট্টাবাজের বহুদিনের রোজগারের উৎস । আর এই ভাবেই আমার চিন্তাধারা নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, আমার বন্ধু যা ভাবছিল তাতে হয়তো ডানা যোগালো, কতো রকমের সম্ভাবনার কতো রকমের প্রতিফল । কিন্তু ও হঠাৎই আমার ভাবনাস্রোতে বাধা দিয়ে আমারই কথাগুলো পুনর্বার বলল : “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষকে তার আশার চেয়ে বেশি দিয়ে অবাক করার তুলনায় আর মধুর আনন্দ হয় না ।”

আমি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকালুম, আর সেই চোখে প্রশ্নাতীত অকপটতার ঔজ্বল্য দেখে আতঙ্কিত বোধ করলুম । আমি এখন স্পষ্ট দেখলুম যে ও যা করতে চাইছিল তা হলো দানকর্ম, আর সেইসঙ্গে এক ধরণের দরাদরি ; চল্লিশ পয়সা জেতা আর তার সঙ্গে ঈশ্বরের হৃদয়কেও জেতা ; যাতে মিতব্যয়ের মাধ্যমে স্বর্গে যেতে পারে ; আর শেষে, মাঙনায়, দানশীল মানুষের পদমর্যাদা পেতে পারে ।  আমি ওর অপরাধী আনন্দকে ক্ষমা করে দিতে পারতুম, আমি এখনই অনুমান করতে পারছি যে ওর পক্ষে একাজ করা সম্ভব ; গরিব মানুষকে ঠকিয়ে ও মজা নিচ্ছে, তা হয়তো আমার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করত আর তাকে ভাবতুম বিদকুটে ; কিন্তু ওর অবান্তর হিসেবিপনাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না । বজ্জাত হওয়াটা কখনই মার্জনাযোগ্য নয়, কিন্তু একজন যে অমন তা জানতে পারাটা অর্জন ; আর সবচেয়ে ক্ষমাহীন দোষ হল বোকার শয়তানি ।


উনত্রিশ

বদান্য জুয়াড়ি

কালকে একটা ভিড়েভরা উদ্যানপথে আমি অনুভব করলুম এক রহস্যময় অস্তিত্ব আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেল,  যার সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছি, আর যাকে তক্ষুনি চিনতে পারলুম, যদিও তাকে আমি সত্যিই আগে দেখিনি । সেও আমার সম্পর্কে একই রকম অনুভব করল, কেননা পাশ দিয়ে যাবার সময়ে অর্থপূর্ণ চোখ মারলো, যা আমি দ্রুত স্বীকৃতি দিলুম । আমি ওকে  অনুসরণ করলুম, আর ওর পেছন-পেছন মাটির তলায় একটা ঘরে নামলুম, ঝকমকে জায়গা, বিলাসিতায় এমনই আলোকিত যা প্যারিসের উঁচু স্তরের বাড়িতেও পাওয়া যাবে না । অদ্ভুত মনে হলো যে এই প্রতিপত্তিপূর্ণ আড্ডাঘরের সামনে দিয়ে কতোবার গেছি অথচ প্রবেশপথ নজরে পড়েনি । এক সজ্জাবিলাসী, এমনকি মত্ততাদায়ক বাতাবরণ সেখানে ছেয়ে ছিল, যা তোমাকে প্রায় তৎক্ষণাৎ জীবনের একঘেয়ে গণ্ডোগোলের কথা ভুলিয়ে দেবে ; সেখানে, তুমি শ্বাস নেবে এক বিষণ্ণ স্বর্গসুখে, যেমন পদ্মফুলখোরদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যখন তারা, সূর্যের আলোয় আলোকিত শাশ্বত দুপুরে মায়াবী দ্বীপে নেমেছিল, তারা নিজের অন্তরে অনুভব করেছিল, সঙ্গীতময় ঝর্ণার মোহক শব্দে, যেন বাড়ির দেবীদেবতাদের, স্ত্রীদের, ছেলেমেয়েদের আর না দেখতে হয়, আর সমুদ্রের উঁচু ঢেউয়ে চেপে পাড়ি দিতে না হয় ।

সেখানে ছিল অদ্ভুত চেহারার পুরুষরা আর নারীরা, মারণ সৌন্দর্যে চিহ্ণিত, যা আমার মনে হলো,  এমন সময়ে আর দেশে এর আগে দেখেছি, যা ঠিক এক্ষুনি মনে পড়ছে না, আর যা আমাকে, সচরাচর অচেনা আগুন্তুক দেখে যে অজানা ভীতি হয়, তার বদলে  দিলো ভাতৃত্বের সহমর্মিতা। ওদের চাউনির অদ্ভুত অভিব্যক্তিকে যদি বর্ণনা করতে হয়, তাহলে আমি বলব এর আগে আমি কখনও এমন দৃষ্টি দেখিনি যা ক্লান্তির যন্ত্রণায় আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেতে প্রবল সক্রিয়তায়  পুড়ছে।

আমার নিমন্ত্রণকর্তা আর আমি যতক্ষণে বসলুম, আমরা ততোক্ষণে আমরা দুজনে পুরোনো, সহযোগী বন্ধু হয়ে গিয়েছিলুম । আমরা খেলুম, আমরা অনেক ধরণের মদ বেপরোয়াভাবে পান করলুম আর, সবচেয়ে মজার, কয়েক ঘণ্টা পরেও আমার মনে হচ্ছিল যে ও যতোটা মাতাল হয়েছে আমি ততোটা হইনি । কিন্তু জুয়া, সেই অতিমানবিক আহ্লাদ, মাঝে মাঝে আমাদের মদ খাওয়ায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, আর আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি বাজি ধরলুম, আর যে-জিতবে-সে-সবকিছু নেবে খেলায় আমার আত্মাকে নায়কোচিত উদ্বেগহীনতায় আর হালকাচিত্তে হারালুম । আত্মা এমনই এক স্পর্শাতীত জিনিস, বেশির ভাগ সময়ে অকেজো আর অনেক সময়ে এতো বিরক্তিকর, যে তা হারিয়ে ফেলার দরুন আমার কোনো আবেগ হলো না, অনেকটা বেড়াতে বেরিয়ে ভিজিটিঙ কার্ড হারিয়ে ফেলার মতন ।

আমরা আয়েস করে চুরুট ফুঁকলুম যার অতুলনীয় সুস্বাদ আর সুগন্ধ আমাদের আত্মায় এনে দিলো অজানা দেশ আর আনন্দের মনকেমন, আর এই মাতোয়ারায় মাতাল,  সুপরিচিতির তরঙ্গ ওকে অসন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হলো না, আমি সাহস করে চেঁচিয়ে বললুম, কানায় কানায় ভরে গেলাসে চুমুক দিয়ে, “প্রিয় নিক ! তোমার চিরন্তন স্বাস্হ্যের প্রতি ।” আমরা জগতসাংসার সম্পর্কে আলোচনা করলুম, অর্থাৎ প্রগতি আর নিখুঁত হয়ে ওঠার বিষয়ে বিশ্বাস সম্পর্কে, আর সাধারণভাবে মানুষের নানা মোহাচ্ছন্নতা নিয়ে আলোচনা করলুম । এই বিষয়ে মান্যবর চতুর এবং অকাট্য ঠাট্টাইয়ার্কিতে কম যায় না, নিজের মতামত ভদ্র বাক্যবিন্যাসে আর স্বচ্ছ রসিকতায় সাজিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করছিল যা এর আগে মানবসমাজের নামকরা বাগ্মীদের মুখেও শুনিনি । ও আমাকে বিভিন্ন দর্শনের অসম্ভাব্যতা ব্যাখ্যা করে বোঝালো, যে দর্শন এ-পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক দখল করে আছে, এমনকি আমাকে মৌলিক তত্বগুলোর কয়েকটায় শিক্ষিত করে তুলতে চাইলো, যদিও তত্বের জ্ঞান আর লাভ সম্পর্কে আমি যে কোনো কারোর সঙ্গে আলোচনা করি না । দুনিয়া জুড়ে নিজের কুখ্যাতির বদনাম নিয়ে একেবারেই নালিশ করল না, কুসংস্কার দূর করায় ওর সর্বাধিক আগ্রহ নিয়ে বিশ্বাস জাগালো, আর শপথ করে জানালো যে কেবল একবারই ও নিজের ক্ষমতাকে ভয় পেয়েছিল, যেদিন একজন যাযককে বলতে শুনেছিল, সহযাযকদের চেয়ে বার্তাবহ, বেদির ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিল, “আমার প্রিয় ভাতৃবৃন্দ, কখনও ভুলবেন না, যখন আপনি আলোকপ্রাপ্তির প্রগতি নিয়ে গর্ব করেন, বলেন যে,  শয়তানের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ছলনা হলো আপনাদের প্রত্যয় জন্মানো যে তার কোনো অস্তিত্ব নেই !”

সেই নামকরা বাগ্মীর স্মৃতি স্বাভাবিকভাবে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আমাদের আলোচনাকে নিয়ে গেলো, আর আমার অদ্ভুত নিমন্ত্রণকারী জোর গলায় বলল যে, লেখার কলমকে, বক্তৃতা দেয়াকে, পাতিপণ্ডিতদের ভাবনাচিন্তাকে উৎসাহিত করা ওর মর্যাদার তুলনায় নিম্নস্তরের, আর ও ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ে বিদ্যায়তনিক সভায় উপস্হিত থেকেছে, যদিও অদৃশ্য হয়ে । এই সব দয়ালু কথাবার্তায় প্ররোচিত হয়ে, আমি ওকে ঈশ্বরের কথা আর সাম্প্রতিক কালে ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা জিগ্যেস করলুম । উদাসীন কন্ঠে ও বলল, তাতে একটু দুঃখ মেশানো, “আমাদের যখনই সাক্ষাৎ হয় আমরা পরস্পরকে হ্যালো সম্ভাষণ করি, কিন্তু তা দুজন বৃদ্ধ ভদ্রসন্তানের দেখাসাক্ষাতের মতন হয়, যারা, তাদের জন্মসূত্রে পাওয়া আভিজাত্য সত্ত্বেও, পুরোনো ঝগড়ার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি ।”

একজন মামুলি নশ্বরকে মান্যবর এতক্ষণ সময় নিয়ে দর্শন দেননি বলেই মনে হয়, আর বিশ্বাসভঙ্গ যাতে না করে ফেলি সে ভয় আমার ছিল । শেষ পর্যন্ত, জানালায় যখন ভোরের প্রথম আলো দেখা গেল, এই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব,  না জেনেই যার গুণগান করেছেন বহু কবি আর যার শৌর্যকে সেবা করেছেন দার্শনিকরা, আমাকে বলল, “আমি চাই আমার সম্পর্কে তোমার স্মৃতি আনন্দময় হোক, আর তা আমি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব, আমার সম্পর্কে তো কতো খারাপ কথা লোকে বলে বেড়ায়, আমি অনেক সময়ে একজন ‘শুভ শয়তান’ হয়ে যাই , যেমন তোমাদের একটা জনপ্রিয় প্রবাদ আছে । তাই, তোমার আত্মার যে অপূরণীয়  ক্ষয়ক্ষতি তুমি ভোগ করলে, ভাগ্য তোমার সহায় হলে তুমি যে দাঁওগুলো জিততে --অর্থাৎ, তোমার সম্পূর্ণ জীবনে , ক্লান্তির বিটকেল অসুস্হতার সম্ভাবনাকে প্রশমিত ও পরাভূত করার জন্যে, যা তোমার অসুখ আর এগিয়ে যাবার দুঃখময় কারণ, আমি খেসারত দিয়ে তা পুষিয়ে দেবো । এমন কোনো ইচ্ছে তোমার হবে না যা পেতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না ; ফালতু সহযোগীদের ওপর তুমি কর্তৃত্ব করবে ; তুমি পাবে স্তাবকদল এমনকি সমাদর ; চাঁদি, সোনা, হীরে, পরীরা  তোমায় খুঁজে বের করে তাদের গ্রহণ করার জন্য অনুনয়-বিনয় করবে, তার জন্য তোমাকে কোনো প্রয়াস করতে হবে না ; তুমি যখনই চাইবে নিজের দেশ আর জাতীয়তা বদলে ফেলতে পারবে ; আহ্লাদে মাতাল হবে, কখনও তাতে ক্লান্তি আসবে না, সেই সব দেশে যা সর্বদা উষ্ণ আর যেখানে নারীদের গায়ে ফুলের মতন সুগন্ধ --- ইত্যাদি, ইত্যাদি….” ও উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকল , বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে বিদায় নিলো ।

এরকম জনগণের আড্ডায় নিজেকে অবমানিত করার ভয় যদি না থাকতো, আমি স্বেচ্ছায় এই বদান্য জুয়াড়ির পায়ে পড়ে তার অশ্রুতপূর্ব দানশীলতার জন্যে ধন্যবাদ জানাতুম । কিন্তু ও যাবার পরে, একটু-একটু করে, চিকিৎসার অসাধ্য আমার সন্দেহের অভ্যাস বুকের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলো ; অমন বৈভবপূর্ণ আনন্দে বিশ্বাস করার সাহস হলো না, আর যখন বিছানায় গিয়ে শুলুম, নীচ অভ্যাসের দরুণ প্রার্থনা করার সময়ে, আধোঘুমে বললুম : “হায় ভগবান ! ওহ আমার দেবতা, আমার ভগবান ! আমাকে দেয়া কথাগুলো শয়তানটা যাতে রাখে তা দেখো !”



ত্রিশ

দড়ি

এদুয়ার মানে’র জন্য

“মায়া”, বন্ধু আমাকে বলল, “যতোরকমের মানব সম্পর্ক হতে পারে ততো অসংখ্য, কিংবা যেমন বস্তু আর জনগণের সম্পর্ক, তেমন । আর মায়া যখন বিলুপ্ত হয়, অর্থাৎ, যখন  প্রাণীটি অথবা ঘটনাটি আমাদের বাইরে অবস্হিত, আমাদের একটা অদ্ভুত, জটিল অনুভব হয়, উবে যাওয়া মায়াপুরুষের জন্য অর্ধেক মনখারাপ, আর বাকি অর্ধেক এই অনন্যতায় অবাক হওয়া, এই বাস্তব ঘটনার জন্য অবাক হওয়া।

এখন, কোনও ব্যাপার যদি নিখুঁতভাবে স্বাভাবিক আর সাধারণ মনে হয়, সব সময়ে একই, যা আমাদের কখনও বোকা বানাতে পারে না, তা হলো মায়ের ভালোবাসা ।  মায়ের মাতৃত্বহীন ভালোবাসা কল্পনা করা যেমন কঠিন, যেমন তাপহীন আলো ; তাই , মায়ের সব কাজ আর কথাবার্তা, নিজের সন্তান সম্পর্কে, মায়ের ভালোবাসার সঠিক বৈধ কারণ নয়কি ? আর তবু, এই গল্পটার কথা শুনুন, যার দরুন আমি পুরোপুরি প্রাকৃতিক মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলুম।

“চিত্রকর হিসাবে আমার পেশা অন্যের মুখ খুঁটিয়ে দেখতে আমাকে বাধ্য করে, চলার পথে যে চেহারাগুলো আমি প্রত্যক্ষ করি, আর তুমি জানো এই দক্ষতা থেকে আমরা কেমন আনন্দ উপভোগ করি, অন্য লোকেদের দৃষ্টির তুলনায় আমাদের চোখে যা প্রতিভাত হয়, জীবনকে আরও প্রাণবন্ত এবং অর্থবহ করে তোলে । দূরের যে পাড়ায় আমি থাকি, যেখানে বাড়িগুলোকে পরস্পরের থেকে আলাদা করে রেখেছে তৃণভূমি, আমি প্রায়ই একটা বাচ্চাকে দেখতুম যার উষ্ণ, দুষ্টু মুখভাব অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আমাকে তৎক্ষণাৎ আকর্ষণ করতো । আমার জন্যে ও অনেকবার পোজ দিয়েছে, আর আমি কখনও ওকে ছোট্ট জিপসি এঁকেছি, কখনও দেবদূত, কখনওবা পূরাণের কামদেব । আমি ওকে ভবঘুরের বেহালা হাতে এঁকেছি, কাঁটার মুকুট আর খৃস্টের শেষযাত্রার আবেগসহ, আর যৌনতার দেবতার আলোকবর্তিকা হাতে । শেষে,  ওর মজা করার ব্যাপারে এমন আনন্দ পেতুম যে একদিন আমি ওর বাবা-মাকে, যারা বেশ গরিব, বললুম যে ছেলেটিকে আমায় দিতে, আমি ভালো পোশাক পরিয়ে রাখবো, যৎসামান্য টাকাকড়ি দেবো, আমার বুরুশ পরিষ্কার আর এদিক-ওদিকের কাজ ছাড়া দায়িত্বপূর্ণ কোনো কাজ দেবো না । বাচ্চাটা, আমি ওকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলার পর, বেশ সুশ্রী হয়ে উঠল, আর আমার সঙ্গে যে ধরণের জীবন কাটাতে লাগলো তা ওর বাবা-মায়ের জঘন্য বাসার তুলনায় মনে হয় স্বর্গ । তবে এখানে আমি একটা কথা বলব যে ছোটো ভদ্রলোকটি অনেক সময়ে তার অসাধারণ, অকালপক্ক মর্মযন্ত্রণার আকস্মিক প্রকোপ প্রদর্শন করে আমায় অবাক করে দিতো, আর দ্রুত ও চিনি এবং লিকোয়ার খানিক বেশি করে স্বাদ করার ঝোঁক দেখালো ; এমনই যে একদিন যখন ধরে ফেললুম যে ও এই রকম চুরি আবার করেছে, আমি ওকে বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠাবার ভয় দেখালুম । তারপর কাজে বেরোলুম আর আমার কাজকর্ম আমাকে বাড়ি থেকে কিছু সময়ের জন্যে বাইরে রাখলো ।

“তুমি চিন্তা করতে পারবে না কীরকম আতঙ্ক আর আকস্মিকতায় বাড়ি ফিরে আক্রান্ত হলুম, যখন সবচেয়ে প্রথমে আমার চোখে পড়ল, ছোটো ভদ্রলোকমশায়, আমার জীবনের দুষ্টু সঙ্গী, কড়িকাঠের হুক থেকে ঝুলছে ! ওর পা প্রায় মাটি ছুঁয়ে রয়েছে ; একটা চেয়ার যা দৃশ্যত লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ; এক কাঁধে ঝুলছে ওর আক্ষিপ্ত মাথা ; মুখ ফুলে উঠেছে আর ওর চোখ, ভয়ার্ত চাউনি মেলে খোলা, প্রথমে দেখে আমার ভ্রম হয়েছিল ও এখনও বেঁচে আছে। তুমি যেমন ভাবছো, ওকে নামানো সহজ কাজ ছিল না । ওর দেহ ইতোমধ্যে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, আর আবর্ণনীয় আতঙ্কে আমার মনে হচ্ছিল ও মেঝেয় পড়ে যেতে পারে । আমি এক হাতে ওকে তুলে ধরলুম আর অন্য হাত দিয়ে দড়িটা কাটলুম । কিন্তু তখনও পর্যন্ত সব পুরো হয়নি ; ছোটো জানোয়ারটা একটা সরু শক্ত দড়ি ব্যবহার করেছিল যা ওর গলার মাংসকে গভীরভাবে কেটে চেপে বসে গিয়েছিল, তখন, একটা ছোটো কাঁচি নিয়ে, ওর ফুলে ওঠা মাংস আর দড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে কেটে ফেলতে হলো, যাতে ওর গলাকে মুক্ত করা যায় ।

“বলতে ভুলে গেছি যে আমি চেঁচিয়ে সাহায্য চাইছিলুম ; কিন্তু কোনো প্রতিবেশি আমাকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলো না, এই ব্যাপারে সভ্য মানুষেরা পরস্পরের আচরণের কাছে একনিষ্ঠ, যারা কখনও, আমি জানি না কেন, গলায় দড়ি দেয়া মানুষের ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না। শেষে ডাক্তার এসে জানালেন যে বাচ্চাটা বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে । আর তারপর, যখন ওকে গোর দেবার জন্য ওর পোশাক খোলার প্রয়োজন হলো, শবদেহ এতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে আমরা ওর অঙ্গ নাড়াতে পারছিলুম না, আর পোশাক খোলার জন্য তা কেটে-ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল ।

“পুলিশকর্তা, যার কাছে ঘটনার বয়ান  দেবার ছিল, অবশ্যই, চোখের কোন দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, ‘এতে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার আছে’ -- বলাবাহুল্য, প্রত্যেকের মনে ভয় জাগাবার ওনার জেদি অভ্যাসবশত, তা সে নিষ্পাপ হোক বা অপরাধী, কথাগুলো বললেন ।

“একটা বড়ো কাজ রয়ে গেছে”, যা মাথায় আসা মাত্র নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হলুম। আমার কাজ হলো ওর বাবা-মাকে জানানো । সেখানে  যেতে আমার পা দুটো রাজি হচ্ছিল না ।

শেষে সাহস সঞ্চয় করতে পারলুম । কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে, মা ছিলেন অবিচলিত, চোখে জলের একটা ফোঁটাও নেই । এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার কারণ  মনে হল ঘটনার আকস্মিকতায় উনি নির্বাক, আর আমার পুরোনো এক প্রবাদ মনে পড়ল : ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শোক প্রকাশিত হয় মৌনতায়।’ বাবা, নিজেকে স্তোক দিলেন, অর্ধেক বিধ্বস্ত, অর্ধেক বিষণ্ণ : ‘যাই হোক, এটা হয়তো ভালোর জন্যই ঘটেছে ; ও তো কোনো কালেই ভালো ছেলে হয়ে উঠতে পারতো না !’

‘ইতোমধ্যে, দেহটা আমার ঘোড়ার গাড়িতে রাখা হয়েছিল আর চাকরের সাহায্য নিয়ে আমি অন্ত্যেষ্টির যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলুম, তখন ছেলেটির মা আমার স্টুডিওতে এলেন । উনি বললেন, উনি ওনার ছেলের শব দেখতে চান । আমি ওনার শোক প্রকাশের পরম ও শান্ত সন্তুষ্টির জন্য ওনাকে সত্যই বাধা দিতে পারতুম না । তারপর উনি আমাকে অনুরোধ করলেন  আমি যেন সেই জায়গাটা দেখাই যেখানে ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়েছিল । ‘আহ না, ম্যাডাম’, আমি বললুম, ‘তা আপনার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে !’ কিন্তু অজান্তে আমার দৃষ্টি কড়িকাঠের দিকে গেলো, আর আমি দেখলুম, বিরক্তি আর আতঙ্কের মিশেলে, যে খুঁটিটা তখনও সেখানে ছিল, তা থেকে ঝুলছিল একটা লম্বা দড়ি । আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দুঃখযন্ত্রণার শেষ প্রমাণ ছিঁড়ে সরিয়ে ফেলতে চাইলুম, আর যখন তা জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলতে যাবো, বেচারা মহিলাটি আমার বাহুঁ আঁকড়ে অপ্রতিরোধ্য স্বরে বললেন : ‘ওহ, স্যার ! ওটা আমাকে দিন ! আমি অনুরোধ করছি !’ স্বাভাবিকভাবে, ওনার ব্যথা, আমি ভাবলুম, ওনার মাথা এমন খারাপ করে দিয়েছে যে, যে জিনিসটা ওনার ছেলের মৃত্যুর কারণ, তা প্রত্নবস্তুর মতন যত্নে সামলে রাখতে চাইছেন বলে উনি কোমলতায় নুয়ে পড়েছেন ।  উনি খুঁটি আর দড়ি কেড়ে নিলেন ।

“শেষে, শেষে, সবকিছু সমাধা হলো । যা বাকি রইলো তা হলো আমার নিজের কাজে ফেরা, আগের থেকেও বেশি আগ্রহে, আমার মস্তিষ্কের ভাঁজে-ভাঁজে ঘাপটি মেরে থাকা ছোট্ট শবের সন্মোহন থেকে মুক্তির জন্য যা ছিল জরুরি, সেই মায়াবালক যে তার ছবি আর চাউনি দিয়ে আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল  তাকে আঁকা। কিন্তু পরের দিন আমি এক গোছা চিঠি পেলুম ; কয়েকটা আমার অট্টালিকার নিবাসীদের থেকে, কয়েকটা প্রতিবেশিদের থেকে ; একটা একতলা থেকে, আরেকটা দোতলা, আরেকটা তিনতলা, আর এইরকমই সব ; কয়েকটা ছিল অর্ধেক রসিকতাপূর্ণ, যেন হালকা চালে নিজেদের অনুরোধ লুকোতে চাইছে, কিছু একেবারে নির্লজ্জ আর ভুল বানানে ভরা, কিন্তু সবায়ের উদ্দেশ্য এক,  মৃত্যুময় এবং স্বর্গীয় দড়ির একটা টুকরো পাবার প্রয়াস। সাক্ষরকারীদের মধ্যে, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি ছিল, কিন্তু তারা সকলেই, আমি তোমাদের নিশ্চিন্ত করে বলছি, গেঁয়ো নিম্ন শ্রেনির ছিল না । চিঠিগুলো আমি সংগ্রহ করে রেখেছি ।

“তারপর হঠাৎই, আমি আঁচ করলুম, আর বুঝতে পারলুম ছেলেটির মা কেন দড়িটা কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর নিজের সন্তুষ্টির জন্য কেমনতর বাণিজ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন ।

“‘হায় ভগবান’, আমি আমার বন্ধুকে বললুম : ‘গলায় ফাঁসি দেয়া একজন মানুষের এক মিটার দড়ির দাম একশো ফ্রাঁ প্রতি ডেসিমিটার, যার যেমন ক্ষমতা সে তেমন অর্থ দিয়ে কিনবে, যার যোগফল দাঁড়ায় এক হাজার ফ্রাঁ, বেচারা গরিব মায়ের সত্যিকার সান্ত্বনা !”


একত্রিশ

কাজকারবার

এক সুন্দর বাগানে,  যেখানে হেমন্তের রোদ অলস আনন্দে ছড়িয়ে পড়েছিল, ইতোমধ্যে সবুজ আকাশের তলায়, ভেসে যাওয়া মহাদেশগুলোর মতন সোনালি মেঘেরা, চারটে সুন্দর বাচ্চা, চারজনেই ছেলে, খেলে-খেলে ক্লান্ত, নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল ।

একজন বলছিল : “কালকে ওরা আমাকে নাট্যগৃহে নিয়ে গিয়েছিল । সেখানের মঞ্চে বিরাট সব দুঃখি-দুঃখি প্রাসাদ ছিল, যার পেছনে সমুদ্র আর আকাশ দেখা যায়, পুরুষ আর মহিলারা, কেউ গম্ভীর কেউ মনখারাপ, কিন্তু চারপাশে যাদের দেখি তাদের চেয়ে সুন্দর আর দামি পোশাকে, আর তারা এমনভাবে কথা বলছিল যেন গান গাইছে । তারা একে অন্যকে ভয় দেখাচ্ছিল, অনুরোধ করছিল, মনখারাপ করছিল, আর কোমরে গোঁজা ছোরায় নিজেদের একটা হাত রেখে কথা বলছিল । ওহ, কী বলব কতো সুন্দর ! আমাদের বাড়িতে যে মহিলারা বেড়াতে আসেন তাঁদের চেয়ে সুন্দরী আর দীর্ঘাঙ্গী ওখানের মহিলারা, আর তাদের বড়ো দীঘল চোখ আর ফোলা গাল মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর, কিন্তু তাদের ভালো না বেসে তোমরা থাকতে পারবে না । কখনও তুমি ভয় পাবে, কখনও তোমার কাঁদতে ইচ্ছে করবে, অথচ তা সত্বেও হাসিখুশি থাকবে । তাছাড়া, আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তোমারও মনে হবে অমন পোশাক পরি, আর অমন কাজকারবারই করি, আর ওইরকম কন্ঠস্বরে কথা বলি…”

চারজন ছেলের মধ্যে একজন, যে তার বন্ধুর কথায় এতোক্ষণ কান দেয়নি, অবাক চোখে দূরের আকাশে কিছু দেখছিল, হঠাৎ বলল, “দ্যাখো, ওপরে তাকিয়ে দ্যাখো ! দেখতে পাচ্ছো ওনাকে ? উনি ছোট্ট আলাদা মেঘে বসে রয়েছেন, আগুনরঙা মেঘটা ধীরে ভেসে যাচ্ছে । উনিও, যেন  আমাদের ওপর লক্ষ রাখছেন।” 

“কে ? উনি কে ?” অন্যেরা জিগ্যেস করল ।

“ঈশ্বর!” ছেলেটা নিশ্চিন্ত গলায় বলল । “ওহ ! উনি তো এখনই অনেক দূরে ; কিছুক্ষণে ওনাকে আর দেখতে পাবে না । উনি বোধহয় বেড়াতে বেরিয়েছেন, অন্য দেশগুলোয় যাচ্ছেন । দাঁড়াও, 

দিগন্তের প্রায় কাছাকাছি গাছের সারির ওপারে চলে যাচ্ছেন...আর এবার উনি গির্জার চূড়ার পেছনে ডুবে যাচ্ছেন...আহ, আর তোমরা ওনাকে দেখতে পাবে না !” এবং ছেলেটা অনেকক্ষণ যাবত সেইদিকে তাকিয়ে রইলো, ওর চোখ আকাশ আর পৃথিবীর সংলগ্নরেখার দিকে,  ভাবাবেশ ও দুঃখের অনির্বচনীয় দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো ।

“এ  পাগলাটে, এই ব্যাটা, ওর মহান ঈশ্বরকে কেবল ওই দেখতে পাচ্ছে,” তৃতীয়জন বলল, যার সম্পূর্ণ ছোটো দেহ ছিল বিরল জীবনীশক্তি আর উদ্যমের  বহিঃপ্রকাশ । “আমি, আমি তোমাদের এমনকিছু বলতে যাচ্ছি যা আমার জীবনে ঘটেছে কিন্তু তোমাদের জীবনে ঘটেনি, আর যা তোমাদের নাটক এবং মেঘের চেয়ে বেশি কৌতূহল-উদ্দীপক ।--- দিনকয়েক আগে, আমার বাবা-মা আমাকে ওনাদের সঙ্গে  প্রমোদ-ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা যে হোটেলে ছিলুম তাতে আমাদের সকলের জন্যে বিছানা ছিল না বলে, নির্ণয় নেয়া হলো যে আমি কাজের মেয়ের সঙ্গে একই বিছানায় শোবো ।” ছেলেটি বন্ধুদের আরও কাছে আসতে ইশারা করে নিচু গলায় বলল । “ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল, বিছানায় একা না শুয়ে কাজের মেয়ের সঙ্গে শোয়া, তাও অন্ধকারে । আমার ঘুম আসছিল না, নিজের ভাবনা ভাবছিলুম কিন্তু মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল আর আমার হাত নিয়ে ওর নিজের বাহুতে, গলায়, কাঁধে বোলাতে লাগল । ওর বাহু আর কাঁধ অন্য মেয়েদের চেয়ে মাংসল, ত্বক বেশ নরম, এতো নরম, যেন লেখার কাগজ কিংবা সিল্কের কাগজ । আমার তাতে এতো আহ্লাদ হল যে যদি না ভয় করতো আমি অনেকক্ষণ অমনভাবে চালিয়ে যেতে পারতুম , ওর ঘুম ভাঙিয়ে ফেলার ভয়, আর তাছাড়া জানি না আর কি-কি । তারপর ওর পিঠে ছড়ানো ঘোড়ার লেজের মতন এলোচুলে আমি আমার মুখ গুঁজলুম, আর এতো ভালো গন্ধ পেলুম, তোমরা বিশ্বাস করবে না, এখন বাগানে ফুলগুলোর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছে তেমন । যদি সুযোগ পাও তাহলে চেষ্টা করে দেখো, তখন বুঝতে পারবে !”

এই অস্বাভাবিক উদ্ঘাটন বর্ণনার তরুণ লেখক, নিজের কাহিনি বলার সময়ে, চোখদুটোকে একধরনের হতচেতন চাউনিতে মেলে ধরেছিল যেন ও তখনও স্মৃতিকে অনুভব করছে, আর সূর্যাস্তের আলো ওর লালচে কোঁকড়ানো চুলের ঢেউকে  লালসার গন্ধকবর্ণ জ্যোতিতে আলোকিত করে দিয়েছে । বলা সহজ যে কেউই মেঘ থেকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্যে জীবন নষ্ট করবে না, আর তা পাবে অন্য কোথাও ।

শেষে চতুর্থজন বলল : “তোমরা তো জানো যে বাড়িতে আমি তেমন মজা পাই না ; আমাকে নাটক দেখতে নিয়ে যায় না ; আমার গৃহশিক্ষক বড়োই কড়া মেজাজের ; ঈশ্বর আমার আর আমার একঘেয়েমির সময় জুড়ে থাকেন না, আর আমার কোনো সুন্দরী কাজের মেয়ে নেই যে আদর করবে । আমি প্রায়ই ভাবি যে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবো যদি পালিয়ে যেতে পারি, কোথায় যাচ্ছি তা না জেনেই, আর কাউকে উদ্বিগ্ন না করে, আর সব সময় নতুন দেশ দেখে বেড়াবো । আমি যেখানেই থাকি না কেন সুখি থাকি না, আর সবসময় মনে হয় অন্য কোথাও গেলে ভালোভাবে থাকব । তাই ! পাশের গ্রামে গত মেলার সময়ে, আমি তিনজন লোককে দেখলুম যারা অমনভাবে থাকে, যেমনভাবে আমি থাকতে চাই । তোমরা তাদের দেখোনি, তোমরা সবাই । তারা ছিল বিশালদেহ, ময়লা চামড়া, প্রায় কালো, আর যদিও ছেঁড়া পোশাকে তবুও বেশ গর্বিত, মনে হচ্ছিল আর কোনো মানুষের প্রয়োজন ওদের নেই । যখনই বাজনা বাজাতো  ওদের বড়ো-বড়ো নম্র চোখ আলোকিত হয়ে উঠতো; এমন চমৎকার সঙ্গীত যে তোমাদের কখনও মনে হবে নাচি, কখনও মনে হবে কাঁদি, কিংবা দুটোই একই-সঙ্গে করি, আর বেশিক্ষণ শুনলে তোমরা যেন পাগল হয়ে যাবে । যে বেহালা বাজাচ্ছিল সে যেন কোনো দুঃখের বর্ণনা করছিল, আরেকজন, নিজের কাঁধে ঝোলানো ছোটো পিয়ানোর চাবিতে ঘা মেরে যেন অন্য লোকটার দুঃখকে ঠাট্টা করছিল, আর তৃতীয়জন মাঝে মাঝে তার খঞ্ঝনি বেশ জোরে বাজাচ্ছিল । তারা নিজেদের নিয়ে এতো হাসিখুশি ছিল যে বুনো সঙ্গীত বাজাতেই থাকলো, এমনকি জনগণ বিদায় নেবার পরেও । শেষে, ওদের দেয়া পয়সাকড়ি কুড়িয়ে, পিঠে নিজেদের বস্তা নিয়ে চলে গেলো । আমি, আমি জানতে চাইছিলুম ওরা কোথায় থাকে, আর জঙ্গলের প্রান্ত পর্যন্ত ওদের অনুসরণ করলুম, সেখানে গিয়ে জানতে পারলুম যে ওরা কোথাও থাকে না ।

“ওদের একজন বলল : ‘আমরা কি তাঁবুটা খাটাবো ?’

“‘না, মোটেই নয়,’ আরেকজন বলল, ‘এতো সুন্দর আজকের রাতটা !”

“তৃতীয়জন, দিনের রোজগার গুণে নিয়ে, বলল, ‘এই লোকগুলো সঙ্গীত বোঝেনা, আর ওদের মহিলারা ভাল্লুকের মতন নাচে । ভাগ্য ভালো যে এক মাসের মধ্যে আমরা অস্ট্রিয়ায় গিয়ে থাকবো, সেখানে পছন্দের লোকজন পাওয়া যাবে ।’

“আমরা স্পেনে গেলে ভালো হয়, কেননা ঋতু ক্রমশ পালটাচ্ছে ; বৃষ্টিকে এড়াতে হবে, আর এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে গলা ভেজানো যায়’, আরেকজন বলল ।

“দেখছো তো, আমার সবই মনে আছে । তারপর ওরা এক গ্লাস করে ব্র্যাণ্ডি খেয়ে ঘুমোতে গেল, সেখানে শুয়ে, নক্ষত্রদের দিকে মুখ করে । প্রথমে, আমি ভেবেছিলুম ওদের অনুরোধ করব আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে আর ওদের যন্ত্রসঙ্গীত শেখাতে ; কিন্তু আমার সাহস হলো না, তার কারণ বড়োসড়ো নির্ণয় নেয়া বেশ কঠিন, আর আরও কারণ হলো যে আমার ভয় করতে লাগল ফ্রান্স ছাড়ার আগেই আমি ধরা পড়ে যেতে পারি।”

বাকি তিন জন বন্ধুর অনাগ্রহ আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করল যে এই ছোটো ছেলেটিকে আগে থেকেই ভুল বোঝা হয় । আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখলুম ; ওর চোখেমুখে সেই অননুভবনীয়, 

বালপ্রৌঢ় সর্বনাশের রেশ দেখা যাচ্ছে যা সাধারণত সমবেদনাকে বেমানান করে দেয় কিন্তু যা, আমি ঠিক জানি না কেন, উত্তেজিত বোধ করলুম, সহসা অদ্ভুত ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে, যে, আমার হয়তো এক ভাই ছিল যার কথা কখনও শুনিনি ।

সূর্য অস্ত গেল । বিষণ্ণ রাত দখল নিলো । ছেলেগুলো যে যার পথে এগোলো, কিন্তু ওরা কেউই জানত না, নিজের-নিজের নিয়তিকে পরিস্হিতি আর ঘটনাক্রম অনুযায়ী কেমন করে হাসিল করতে হয়, বন্ধুকে বদনাম করতে হয়, আর শৌর্যকে ঘিরে পাক খেতে হয় , কিংবা অপমানের পথে যেতে হয়।


বত্রিশ

নাচের ফুলছড়ি ( থায়েরসাস )

ফ্রানৎস লিৎসের জন্য

নাচের ফুলছড়ি কি জিনিস ? নৈতিক আর কাব্যিক দৃষ্টিতে, তা পুরুষ-পুরোহিত ও নারী-পুরোহিতদের হাতে-ধরা দেবী-দেবতাদের উৎসব পালনের যাজকীয় নিশান, যাঁদের তারা ব্যাখ্যাকারী আর চাকর । কিন্তু বাস্তবে তা একটা ছড়ি, কেবল একটা ছড়ি, যেমন আঙুরলতাকে তোলার জন্য ব্যবহার হয়, শুকনো, অনমনীয়, আর ঋজু । ছড়িতে জড়ানো থাকে ডালপালা আর ফুল যা সাপের খেয়ালি ভঙ্গীতে খেলে, দোল খায়, কয়েকটা আঁকাবাঁকা আর আঁকড়ানো, কয়েকটা ঘণ্টার মতন ঝোলা কিংবা যেন ওলটানো কাপের মতন । এবং এক পরমোৎকৃষ্ট চমৎকারিত্ব গড়ে ওঠে রেখা ও রঙের এই জটিলতা থেকে, কখনও কোমল, কখনও সপ্রতিভ । 

মনে হয় না কি যে বেঁকা  আর জড়ানো রেখা সোজা রেখাটাকে সেলাম করছে, মূক সমাদরে তাকে ঘিরে নাচছে ?  মনে হয় না কি এই সমস্ত সূক্ষ্ম পরাগ, এই সমস্ত পাপড়ি, গন্ধে আর রঙে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, পৌরোহিত্যের ছড়িটার চারিধারে স্পেনীয়দের রহস্যময় ফানডানগো নাচছে?

এবং তবু, কোন সে ধৃষ্ট নশ্বর যে নির্ণয় নেবার সাহস দেখাবে যে ফুলগুলো আর লতাগুলো ছড়িটার জন্যই বানানো, কিংবা ফুলগুলো আর লতাগুলোর সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য ছড়িটা কেবল একটা ছুতো ? থায়েরসাস নামের ফুলছড়ি হলো দ্বৈততার আশ্চর্য প্রতিনিধি, ক্ষমতাবান এবং শ্রদ্ধেয় পরিচালক, রহস্যময় ও আবেগপ্রবণ সৌন্দর্যের প্রিয় মদ্যপ । অদৃশ্য মদ্যদেবতার দ্বারা উত্তেজিত কোনও সমুদ্রপরী নিজের উন্মাদ সঙ্গিনীদের মাথার ওপরে ফুলযষ্টি নাড়ায়নি, তোমার মতন কর্মশক্তি আর কামখেয়াল নিয়ে, যখন তুমি তোমার প্রতিভাকে তোমার ভ্রাতৃবৃন্দের হৃদয়কে প্রভাবিত করার কাজে লাগাও । --- ছড়িটা তোমার ইচ্ছাশক্তি, ঋজু, শক্ত আর অপ্রতিরোধ্য ; ফুলগুলো তোমার ইচ্ছাশক্তিকে ঘিরে ঘুরে বেড়ানো কল্পনা ; তারা পুরুষের চারিধারে এক পায়ে নৃত্যরতা ঝলমলে নারীউপাদান । সোজা রেখা, জালিদার রেখা, অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তি, ইচ্ছাশক্তির ন্যায়পরায়ণতা, শব্দের সর্পিলতা, বিভিন্ন উপায়ে একটি মাত্র লক্ষে পৌঁছানোর প্রয়াস, প্রতিভার সর্বশক্তিময় ও অদৃশ্য মিশ্রণ : কোন সে বিশ্লেষক যার ঘৃণ্য সাহস হবে তোমাকে খণ্ডন ও পৃথক করতে ?

প্রিয় লিৎস, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে, নদীদের ওই পারে, শহরের ওপরে পিয়ানোগুলো তোমার গৌরবের গান গায়, যেখানে ছাপার প্রেসগুলো তোমার জ্ঞানের অনুবাদ করে, যে দেশেই তুমি থাকো না কেন, অনন্তকালীন শহরের বৈভবে হোক কিংবা স্বপ্নময় দেশের কুয়াশায়,  তোমাকে সান্ত্বনা দেবেন বিয়ারের রাজা ক্যামব্রিনাস, তোমার মনোরম কিংবা দুঃখের গানকে নতুন সুরে বাঁধবে, কিংবা কাগজকে গোপনে জানাবে তোমার নিগূঢ় ধ্যানের কথা, শাশ্বত আনন্দ ও ক্ষোভের গায়ক, দার্শনিক, কবি, এবং শিল্পী, তোমার অমরত্বকে আমি সেলাম করি !



তেত্রিশ

নিজেকে মাতাল করে তোলো

তোমার উচিত সদাসর্বদা মাতাল থাকা । এটাই আসল তর্কবিন্দু, একমাত্র প্রশ্ন । সময়ের ভয়ঙ্কর চাপ যাতে তোমার কাঁধ ভেঙে তোমাকে মাটির দিকে নুইয়ে না দেয়, তাই তোমাকে অবিরাম মাতাল থাকতে হবে ।

কিন্তু কিসে মাতাল ? মদে, কবিতায়, সততায়, যা তোমার পছন্দ । কিন্তু তোমাকে মাতাল থাকতে হবে ।

আর কখনও কোনো সময়ে, কোনো প্রাসাদের সিঁড়িতে অথবা অবতলের সবুজ ঘাসে কিংবা তোমার ঘরের নিঃসঙ্গতায়, তুমি যদি জেগে উঠে বোঝো যে তোমার মাতলামি কমে এসেছে বা ফুরিয়ে গেছে, তাহলে বাতাসকে, ঢেউদের, নক্ষত্রদের, পাখিদের, ঘড়িকে, যা-কিছু বয়ে চলে যায় তাদের, যা-কিছু গোঙায়, যা-কিছু গড়িয়ে চলে যায়, যা-কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যা-কিছু কথা বলে, তাদের প্রশ্ন কোরো এখন কয়টা বাজে, আর জবাবে বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি বলবে : “এটা মাতাল হবার সময় ! তাই যদি তুমি সময়ের একজন  কেনা গোলাম শহিদ হতে না চাও, তাহলে নিজেকে মাতাল করে তোলো ; নিজেকে সদাসর্বদা মাতাল করে রেখো ! মদে, কবিতায়, কিংবা সততায়, যা তোমার পছন্দের ।”


চৌত্রিশ

ইতোমধ্যে !

ইতোমধ্যে একশোবার সূর্য লাফিয়ে উঠেছে, প্রখর বা অন্ধকারাচ্ছন্ন, সমুদ্রের বিরাট চৌবাচ্চা থেকে, যার পরিধি দেখা দুষ্কর ; একশোবার ফেরত ডুব মেরেছে, ঝলমলে বা মনমরা, নিজের সান্ধ্য স্নানে । অনেকদিন যাবত আমরা নভোমণ্ডলের অপর পারকে অনুমান করতে পেরেছি এবং উপজাতিদের গাগনিক অক্ষরমালার মর্মার্থ বের করতে পেরেছি । এবং প্রতিটি যাত্রী বিলাপ করেছে আর কাতরেছে । যেন ডাঙার কাছাকাছি পৌঁছোবার কারণে তাদের দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছে।

“কখন, কখন,” ওরা জানতে চেয়েছে, আমরা ঢেউদের উথালপাথালে পাওয়া ঘুম আর ঘুমোবো না, বাতাস এমন নাক ডাকছে যা আমাদের নাক ডাকার তুলনায় বেশি আওয়াজ করছে কেন ?

কখন আমরা মাংস খেতে পাবো যা আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে থাকা অভিশপ্ত পঞ্চভূতের দেয়া এতো নোনতা নয় ? কখন আমরা স্হির আরামদায়ক চেয়ারে বসে খাবার হজম করতে পারবো?”

তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিল যারা নিজের ভিটেমাটির কথা ভাবছিল, যাদের মনকেমন করছিল তাদের বিশ্বাসঘাতক, গোমড়া বউদের আর এঁড়ে বাচ্চাদের জন্যে । আর অনুপস্হিত ডাঙার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছিল যে, আমার বিশ্বাস, গবাদি পশুদের চেয়ে বেশি উৎসাহে ওরা ঘাস খেয়ে নিতো । শেষে, তীরভূমি দেখতে পাওয়া গেল ; আর আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছোলে, দেখতে পেলুম তা ছিল এক চমৎকার, চোখধাঁধানো দেশ । মনে হলো যেন জীবনের নানা রকম সঙ্গীত এক অস্পষ্ট মর্মরধ্বনিতে সেখানে উৎসারিত হচ্ছে, আর তার তীরভূমি, সব রকমের সবুজে ছত্রালাপ, ফুল এবং ফলের স্বাদু সুবাস চতুর্দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎই সবাই আনন্দিত হয়ে উঠলো, প্রত্যেকে নিজেকে তার বাজে মনস্হতি থেকে মুক্ত করল । ভুলে গেল ঝগড়াঝাঁটি, মাফ করে দিল পরস্পরের  দোষ ; যে দ্বন্দ্বযুদ্ধগুলো হবার ছিল সেগুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হলো, আর ধোঁয়ার মতন উবে গেল গোঁসা ।

আমি একা ছিলুম মনমরা, ধারণার অতীত মনখারাপ । একজন পুরোহিতের মতন, যার কাছে তার দেবতাকে কেড়ে নেয়া হয়েছে, হৃদয়বিদারক তিক্ততা ছাড়া,আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিলুম না, সমুদ্রের দানবিক আকর্ষণ থেকে, যে সমুদ্র তার ভয়ানক সারল্যে অসংখ্যপ্রকারে বিভিন্ন, যে সমুদ্রে, মনে হচ্ছিল নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে আর প্রতিনিধিত্ব করছে তার কৌশলের, লোভনীয়তার, ক্ষোভের, হাসির, মেজাজের, যন্ত্রণার এবং যতো রকমের আত্মা এতাবৎ বেঁচেছিল, বেঁচে আছে কিংবা বেঁচে থাকবে তার আহ্লাদময় সমুদ্র !

সেই তুলনাহীন সৌন্দর্যকে বিদায় জানিয়ে, আমার মনে হলো আমাকে আধমরা করে মেরে ফেলা হয়েছে ; আর সেই জন্যেই, যখন আমার সহযাত্রীদের প্রত্যেকে বলল, “যাক শেষ হলো!” আমি শুধু বলতে পারলুম, “ইতোমধ্যে !”

আর তবু, এইটেই তো পৃথিবী, ধ্বনিময়, আবেগময়, বস্তুময় এবং উৎসবময় এই পৃথিবী ; এ ছিল ঐশ্বর্যময় এবং চমৎকার পৃথিবী, প্রতিশ্রুতিপূর্ণ, আমদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে গোলাপের, কস্তুরীর এক রহস্যময় সুগন্ধ, তার সঙ্গে প্রণয়লীলার হর্ষধ্বনিতে গুঞ্জরিত জীবনের কতোরকম সঙ্গীত ।


পঁয়ত্রিশ

জানালাগুলো

একজন লোক দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে যতো রকমের ব্যাপার দেখতে পায়, তার চেয়ে বেশি ব্যাপার দেখতে পায় সেই মানুষ যে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে । মোমবাতিতে আলোকিত জানালার মতন আর কোনো বস্তুকে অতো বেশি প্রগাঢ়, অতো বেশি রহস্যময়, অতো বেশি ফলপ্রসূ, অতো বেশি ছায়াময়, অতো বেশি ঝলমলে দেখায় না । যা প্রকাশ্য দিনের আলোয় দেখা যায় তা জানালার পেছনের ঘটনার তুলনায় কম আগ্রহসঞ্চারী । ওই অন্ধকার অথবা আলোকিত গবাক্ষে, জীবন বেঁচে থাকে, জীবন স্বপ্ন দেখে, জীবন যন্ত্রণাভোগ করে।

ছাদের ঢেউগুলোর ওপর দিয়ে, আমি একজন সম্পূর্ণাঙ্গ নারীকে দেখতে পাই, যে এখনই লোলচর্ম, গরিব, সব সময়ে কিছুর দিকে ঝুঁকে আছে, কখনই বাইরে বেরোয় না -- আর তার মুখাবয়ব লক্ষ্য করে, পোশাকের মাধ্যমে, অঙ্গভঙ্গী দেখে, কোনো জিনিসপত্র ছাড়াই, আমি এই নারীর ইতিহাস নতুন করে গড়ে নিয়েছি, কিংবা তার কিংবদন্তিকে, আর অনেক সময়ে তা নিজেকে শোনাই, চোখে অশ্রুজল নিয়ে । যদি কোনো গরিব পুরুষ হতো তার ইতিহাসও আমি তাড়াতাড়ি গড়ে ফেলতে পারতুম ।

আমি বিছানায় শুতে যাই, গর্ব বোধ করি যে নিজেকে ছাড়া অন্য লোকেদের জীবনের যন্ত্রণাতে আমি বেঁচে থেকেছি ।

তুমি হয়তো জানতে চাইবে, “তুমি কি নিশ্চিত যে এই কিংবদন্তি সত্য ?” কিন্তু তাতে কীই বা এসে যায়, আমার বাইরে যে বাস্তবের অবস্হান, তা যদি আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করে আর আমি কে তা জানায় ?


ছত্রিশ

আঁকার ইচ্ছা

লোকটা হয়তো মানুষ হিসাবে দুর্দশাগ্রস্ত, কিন্তু সে আকাঙ্খায় বিদীর্ণ একজন সুখী শিল্পী !

আমি তাকে আঁকতে চাই যে আমাকে অনেক কম দেখা দিয়েছে, যে আমার কাছ থেকে দ্রুত পালিয়েছে, সেইরকম সুন্দর অনুতাপের জিনিসের মতন যা রাতের দ্বারা প্রভাবিত একজন পর্যটক, ফেলে চলে যায় । কতোকাল হলো সে উধাও হয়ে গেছে !  

সে সুন্দরী, সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি সুন্দরী : সে অবাক-করা । অন্ধকার তার মধ্যে উপচে পড়ে: আর যা-কিছুকে সে অনুপ্রাণিত করে তা নিশিময় ও গভীর । তার চোখ দুটি আশ্রয়নিবাস যার মধ্যে রহস্য আবছাভাবে জ্বলজ্বল করে, আর তার চাউনি বিদ্যুতের মতন ঝলকে ওঠে : যেন ছায়াদের বিস্ফোরণ । যদি কেউ আলো-ছড়ানো ও আনন্দময় কালো নক্ষত্রের কল্পনা করতে পারে, আমি তাকে কালো সূর্ষের সঙ্গে তুলনা করতে পারি । কিন্তু ও সাবললীলতায় আমাকে চাঁদের কথা মনে পড়ায়, যা ওর ওপর নিশ্চয়ই প্রচণ্ড প্রভাব রেখে গেছে ; রাখালি কবিতার শ্বেত চাঁদ নয়, শীতল স্ত্রীর মতন নয়, বরং অমঙ্গলময় নেশাধরানো চাঁদ, ঝড়ের রাতের গভীরতায় নিলম্বিত, এমন এক রাত যে দ্রুতগামী মেঘেদের পরস্পরের রেশারেশি চলছে সেখানে ; শান্তিময়, গোপন চাঁদ নয় যে পবিত্র লোকেদের স্বপ্নে দর্শন দেয়, বরং আকাশ থেকে ছিঁড়ে নামানো চাঁদ, পরাভূত ও দ্রোহী, যাকে  আতঙ্কিত ঘাসের ওপরে নাচতে বাধ্য করেছিল থেসালিয়ার করালদর্শন ডাইনিরা ! তার সরু ভ্রুর তলায় বাস করে এক একগুঁয়ে ইচ্ছা আর শিকারের প্রতি ভালোবাসা । কিন্তু এই অশান্তিকর মুখাবয়বের তলার দিকে, সর্বদা স্ফূরিত নাসারন্ধ্রের অজানা ও অসম্ভব শ্বাসের কাঁপুনিতে, বিস্তৃত মুখগহ্বরের হাসি অবর্ণনীয় মাধুর্যে ঝলকায় , লাল এবং শ্বেত, এবং স্বাদু, যা দেখে যে কেউই আগ্নেয়গিরির ঢালে ফুটে থাকা অলৌকিক ফুলের স্বপ্ন দেখবে। এমন নারীরা আছেন যাঁরা তাঁদের জয় ও সঙ্গদান করার প্রেরণা যোগান ; কিন্তু এই নারী জাগিয়ে তোলেন মৃত্যুর আকাঙ্খা, ধীরে, তাঁর দৃষ্টির গভীরে ।



সাঁইত্রিশ

চাঁদের আনুকূল্য

তুমি যখন দোলনায় শুয়েছিলে তখন চাঁদ, খামখেয়ালের মূর্ত প্রতিমা, জানালা দিয়ে তোমাকে দেখেছিল, আর বলেছিল : “আমি এই বাচ্চাটাকে পছন্দ করি।”

এবং ভেড়ার সলোম চামড়ার মতন নরম, মেঘের সিঁড়ি বেয়ে তিনি নেমে এলেন, শব্দ না করে জানালা দিয়ে চলে গেলেন । তারপর মায়ের নমনীয় কোমলতায় তিনি তোমার ওপরে ছড়িয়ে পড়লেন, ওনার রঙগুলো রেখে গেলেন তোমার মুখাবয়বে । এই কারণেই তোমার চোখের তারা সবুজ, আর তোমার গালদুটো অত্যধিক ফ্যাকাশে । আর এই আগন্তুকের কথা মনে করে তোমার চোখদুটো অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে উঠলো ; আর এমন কোমলতায় তিনি তোমার গলা জড়িয়ে ধরলেন, যে তবে থেকে তোমার ফোঁপাতে ইচ্ছে করেছে । তবু, তাঁর ছড়িয়ে পড়া আনন্দে, চাঁদ সারা ঘরকে অনুপ্রভার বাতাবরণে ভরে তুললো, আলোকময় বিষের মতন ; আর এই জীবন্ত আলো ভাবলো, আর বললো : “তুমি চিরকাল আমার চুমুর প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। তোমার সৌন্দর্য হবে আমার । যা আমি ভালোবাসি তুমিও তাই ভালোবাসবে, আর যা-কিছু আমাকে ভালোবাসবে : জল, মেঘ, স্তব্ধতা, এবং রাত্রি ; বিশাল সবুজ সমুদ্র ; আঙ্গিকহীন ও বহুআঙ্গিকের জল ; যে জায়গায় তুমি নেই ; যে প্রেমিককে তুমি জানো না ; দানবিক ফুলদল ; বিভ্রম সৃষ্টিকারী সুগন্ধ ; পিয়ানোর ওপর শুয়ে থাকা বিড়ালের নারীসুলভ খসখসে গলায়, মিষ্টি সুরের কাতরানি, সমস্তকিছু !

“আর আমার প্রেমিকরা তোমাকে ভালোবাসবে, যারা আমার সঙ্গ দেয় তারা তোমায় সঙ্গ দেবে। তুমি হবে সবুজ-চোখ পুরুষদের রানি যাদের কন্ঠকে আমি নিশির আদরে জড়িয়ে ধরেছি ; যারা সমুদ্রকে ভালোবেসেছে, বিশাল, প্রাণবন্ত এবং সবুজ সমুদ্রকে, আঙ্গিকহীন ও বহুআঙ্গিকের জল, যে প্রাসাদ নেই, যে নারীদের তারা চেনে না, অজানা ধর্মের ধুপধুনোর মতন ভয়ানক ফুলদল, যে সুরভি ইচ্ছাশক্তিকে বিরক্ত করে, এবং আরণ্যক, কামনাময় পশুরা যারা উন্মাদনার প্রতিনিধি ।”

আর সেই কারণেই, অভিশপ্ত, প্রিয়, নষ্ট আমার শিশু, এখন আমি তোমার পায়ের কাছে শুয়ে আছি, তোমার প্রতিটি অঙ্গে ভয়াবহ ঐশ্বরিকতার প্রতিফলন চাইছি, মারাত্মক ধর্মমাতা, সমস্ত উন্মাদদের বিষাক্ত সেবিকা ।


আটত্রিশ

কোনটা আসল ?

আমি একজন বেনেডিক্টাকে জানতুম, যার থেকে আদর্শময়তার ছটা বিস্ফারিত হতো, যার চোখ মহৎ হবার সদিচ্ছার বীজ বপন করতো, সৌন্দর্ষের জন্য, খ্যাতির জন্য, আর সমস্তকিছু যা আমাদের অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস জন্মায় তার জন্য। কিন্তু এই ঐন্দ্রজালিক মেয়েটি বেশিদিন বাঁচার তুলনায় বড়ো বেশি সুন্দরী ছিল ; তার সঙ্গে আমার দেখা হবার কয়েকদিন পরেই সে মারা গেল, আর আমিই তাকে গোর দিয়েছিলুম, তা ছিল বসন্তকাল, গোরস্তানেও তার ধুপধুনো উড়িয়েছিল । আমিই তাকে গোর দিয়েছিলুম, সুগন্ধী ও নিষ্পাপ কাঠের কফিনে বন্ধ করে, ভারত থেকে আসা সিন্দুকের মতন ।

আর আমার ঐশ্বর্য বিদায় নিয়েছিল, যখন সেদিকে তাকিয়ে ছিলুম, আমি হঠাৎ দেখলুম একজন ছোটোখাটো তরুণী যাকে দেখতে হুবহু মৃতার মতন, আর যে, টাটকা মাটিকে পাগলের মতন অদ্ভুত হিংস্রতায় খুঁড়ছিল, হাসিতে ফেটে পড়ে বলে উঠলো : “আমিই, বাস্তবের বেনেডিক্টা! আমিই, একজন বিখ্যাত বারবণিতা ! আর তোমার পাগলামির আর তোমার অন্ধত্বের শাস্তি হিসাবে আমি যেমন তেমনই তুমি আমাকে ভালোবাসবে !”

কিন্তু আমি, ভয়ানক রেগে গিয়ে, জবাবে বললুম, “না ! না ! না !”  এবং আমার প্রত্যাখ্যানকে গুরুত্ব দেবার জন্য, মাটিতে আমার পা এতো জোরে ঠুকলুম যে নতুন কবরের ভেতরে আমার পা হাঁটু পর্যন্ত সেঁদিয়ে গেল, আর ফাঁদে পড়া নেকড়ের মতন, আমি টিকে আছি, বোধহয় চিরকালের জন্য, পরমাদর্শের কবরে বাঁধা অবস্হায় ।


উনচল্লিশ

বিশুদ্ধ বংশজাত

মেয়েটি নিঃসন্দেহে কুৎসিত । তা সত্বেও সে উপাদেয় !

সময় ও প্রেম তাদের নখ দিয়ে তার গায়ে আঁচড় দিয়েছে আর তাকে নিষ্ঠুরভাবে শিখিয়েছে যে প্রতিটি মিনিট ও প্রতিটি চুমু তার যৌবন আর তার নতুনত্বকে ফুরিয়ে দিয়েছে ।

মেয়েটি সত্যিই কুৎসিত ; পিঁপড়ের মতন, মাকড়সার মতন, এমনকি কঙ্কালের মতন, যদি তুমি ওকে চাও ; কিন্তু একই সঙ্গে মেয়েটি একরকম মলম, ইন্দ্রজাল, ডাকিনিবিদ্যা ! সংক্ষেপে, মেয়েটি নিখুঁত চমৎকারীত্বপূর্ণ । সময় ওর চলনভঙ্গীমার ঐকতান ভাঙতে পারেনি বা ওর দেহবল্লরীর অভঙ্গুর সৌষ্ঠব নষ্ট করতে পারেনি । প্রেম ওর শিশুসূলভ শ্বাসের মিষ্টতাকে নষ্ট করতে পারেনি ; এবং ওর কেশরের প্রাচুর্য হ্রাস করতে পারেনি সময়, যা এখনও নিঃশ্বাস ফেলে, কস্তুরি সুগন্ধে, দক্ষিণ ফ্রান্সের আরণ্যক প্রাণবন্ততা : নাইম, একস, আর্লে, অ্যাভিনিও, নাবোন, তুউল, সূর্যের আশীর্বাদপ্রাপ্ত  শহর, প্রণয়লীলার ও পুলকের !

সময় ও প্রেম মেয়েটির অস্তিত্বে তীব্র ক্ষয় ঘটাতে চেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ; ওর বালকসূলভ বুকের অস্পষ্ট ও শাশ্বত জাদুকে তারা একটুও কমাতে পারেনি ।

হয়তো জীর্ণতাপ্রাপ্ত কিন্তু অব্যবহার্য হয়নি, আর চিরকালের জন্য বীরাঙ্গনা, মেয়েটি তোমাকে সেইসব অভিজাত-বংশজাতদের কথা মনে পড়ায় যা প্রকৃত রসপণ্ডিতেরা সবসময় চিহ্ণিত করতে পারেন, এমনকি কোনো ভাড়াকরা ঘোড়ার গাড়িতে হোক বা ফালতু ঠেলায় সে বসে থাকুক।

আর তাছাড়া  মেয়েটি বেশ মিষ্ট প্রকৃতির আর কতো ঐকান্তিক ! লোকে যেমন হেমন্তকালকে ভালোবাসে মেয়েটি সেইভাবেই ভালোবাসা জানায় ; যেন আগত শীত তার হৃদয়ে নতুন আগুন জ্বেলেছে, আর তার কোমলতায় যে বশ্যতা তা কখনও ক্লান্তিকর নয় ।


চল্লিশ

আয়না

একজন  বীভৎস লোক ভেতরে ঢুকে এসে আয়নায় নিজের দিকে তাকালো ।

“তুমি কেনই বা নিজেকে আয়নায় দ্যাখো, যখন কিনা তুমি সম্ভবত নিজেকে অপছন্দ করা ছাড়া অন্য কিছু দেখবে না ?’

বীভৎস লোকটি জবাবে আমাকে বলল : “স্যার, ১৭৮৯ সালের অপরিবর্তনীয় আইন অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের আছে সমান অধিকার ; অতএব, আমারও অধিকার আছে আয়নার দিকে তাকানোর : তা পছন্দের হোক বা অপছন্দের তা অন্য কারোর মাথা ঘামাবার ব্যাপার নয়, কেবল আমার ব্যাপার।”

শুভবুদ্ধির তর্কে আমি নিশ্চয়ই ঠিক ছিলুম ; কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে, লোকটাও ভুল ছিল না।


একচল্লিশ

বন্দর

জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত আত্মার বিশ্রামের জন্যে একটা বন্দর খুবই ভালো জায়গা। আকাশের বিস্তার, মেঘেদের ভ্রাম্যমান স্হাপত্য, বদলাতে থাকা সমুদ্রের রঙ, লাইটহাউসগুলোর ঝিলমিলে আলো চোখদুটোকে ক্লান্তি না দিয়ে তাদের আনন্দ দেবার চমৎকার ত্রিপার্শ্বকাচ । জাহাজগুলোর এগিয়ে চলা আকার, তাদের জটিল দড়িদড়া-মাস্তুলসহ, যা সমুদ্রের ঐকান্তিক ঢেউগুলোর সন্ধান পায়, আত্মার সৌন্দর্য ও ছন্দের স্বাদ বজায় রাখতে সাহায্য করে । আর তাছাড়া, রয়েছে একধরনের রহস্যময়, অভিজাত আনন্দ, বিশেষ করে সেই লোকগুলোর জন্যে মনঃসংযোগ করার জন্য যাদের কৌতূহল বা উচ্চাকাঙ্খা নেই, আচ্ছাদিত জায়গায় শুয়ে কিংবা জেটির খুঁটিতে হেলান দিয়ে, যারা চলে যাচ্ছে আর যারা ফিরে আসছে তাদের চলাফেরা দেখা, যাদের এখনও যা ইচ্ছে চাইবার কর্মশক্তি বজায় আছে, পর্যটনে বেরোবার বা ধনী হবার আকাঙ্খা রয়েছে।


বিয়াল্লিশ

রক্ষিতাদের প্রতিকৃতি

খাসকামরার পুরুষ রূপান্তরণে -- অর্থাৎ, জমকালো এক জুয়াখানার লাগোয়া তামাক ফোঁকার ঘরে -- চারজন লোক বসে ফুঁকছিল আর কথা বলছিল । তারা ঠিক যুবক নয় আবার বুড়োও নয়, সৌম্যকান্তি নয় কুৎসিতও নয় ; কিন্তু যুবক হোক বা বুড়ো, তাদের চোখেমুখে ছিল মজায় জীবন কাটাবার ঝানুদের নির্ভুল ছাপ, সেই অবর্ণনীয় কিছু-একটা, সেই শীত আর ব্যঙ্গমাখা বিষাদ যা ব্যথায় ঘোষণা করে : “আমরা আশ মিটিয়ে বেঁচে নিয়েছি, আর এখন আমরা খুঁজছি এমনকিছু যা আমরা ভালোবাসতে আর সমাদর করতে পারি ।”

ওদের একজন আলোচনার বিষয়বস্তু নারীদের দিকে নিয়ে গেল । তাদের সম্পর্কে কথা না বলাই দার্শনিকভাবে ভালো ছিল ; কিন্তু কিছু চালাক মানুষ আছে যারা, যৎসামান্য মদ টানার পর, ফালতু আলোচনাকেও বাতিল করবে না । তেমন অবস্হায়, যে কথা বলছে তার দিকে কান দিতে হয়, যেমনভাবে লোকে নৃত্যসঙ্গীত শোনে ।

“প্রতিটি মানুষ”, সে বলছিল, “তার দেবদূতের মতন কালখণ্ড কখনও নিশ্চয়ই কাটিয়েছে ; তা হলো সেই সময় যখন, বনপরীর অভাবে, লোকে জেনেশুনে ওকগাছের গুঁড়িকে জড়িয়ে ধরে । এটা হলো প্রেমের প্রথম ধাপ । দ্বিতীয় ধাপে লোকে বাছবিচার করে । ধীর ও সতর্ক হওয়ার স্তরে ইতোমধ্যে সে সৃজনীশক্তিচ্যুত হয়ে গেছে । এইটাই হল সেই সময় যখন একজন মনঃস্হির করে নিয়ে সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে ব্যপৃত হয় । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, বন্ধুগণ, আমি গর্বিত যে শেষ পর্যন্ত যৌবনান্তকালীন পর্বে পৌঁছেচি, তৃতীয় ধাপে, যেখানে সৌন্দর্যই সবকিছু নয় যদি না তা সুগন্ধ, সুশ্রী পোশাক ইত্যাদির দ্বারা পরিপক্ক হয় । এবং আমি স্বীকার করছি যে অনেকসময়ে আমি চেয়েছি, অজানা আশীর্বাদের স্তরে, চতুর্থ ধাপে পৌঁছোতে, যা কিনা পরম শান্তির দ্বারা সংজ্ঞায়িত। কিন্তু আমার সমগ্র জীবনে, বনপরীদের পর্ব ছাড়া, আমি মেয়েদের বিরক্তিকর বোকামি আর অস্বস্তিকর মধ্যমেধা সম্পর্কে অন্য লোকেদের চেয়ে বেশি জানতুম । পশুদের যে ব্যাপারটা আমি বেশি পছন্দ করি তা হলো তাদের সারল্য । তাহলে ভেবে দ্যাখো, আমার শেষ রক্ষিতা আমাকে কতো কষ্ট দিয়েছে । “সে ছিল এক রাজপুত্রের জারজ মেয়ে । সুন্দরী, নিঃসন্দেহে; নয়তো কেনই বা তাকে আমি নিয়ে আসতুম ? কিন্তু মেয়েটা সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে ফেললো এক কুরুচিপূর্ণ এবং বিকৃত উচ্চাকাঙ্খার ফলে । সে ছিল এমন নারী যে সবসময় পুরুষের ভূমিকাটা নিতে চাইতো : ‘তুমি তো পুরুষ নও ! আহ, যদি আমি পুরুষ হতে পারতুম ! আমাদের দুজনের মধ্যে, আমিই পুরুষ!’ অমনধারা অসহ্য কথাবার্তা ওর গলা থেকে বেরোতো যে কন্ঠ থেকে আমি চেয়েছিলুম গানের উড়াল । এবং যদি আমার মুখ ফসকে কোনো বই, কবিতা, কিংবা অপেরার সমাদরের কথা বেরোতো, ও তক্ষুনি বলে উঠতো : তুমি কি সত্যিই মনে করো ওটা ভালো ? অবশ্য, তুমি কীই বা জানো কাকে ভালো বলে ?’ আর তারপর তর্কাতর্কি আরম্ভ করে দিতো ।

“একদিন, ও রসায়নের বিষয় আলোচনা করতে চাইলো : আর তারপর থেকে, ওর আর আমার ঠোটের মাঝে কাচের মুখোশ গড়ে উঠলো । তার সঙ্গে শালীনতার ভান । যদি আমি যখন তখন ওর প্রতি সামান্য প্রণয় প্রকাশ করার জন্যে এগোতুম, ও ছিঁড়ে নেয়া ফুলের মতন ঝিমিয়ে পড়তো….”

“ব্যাপারটা কেমন করে শেষ হলো ?” ওদের মধ্যে একজন জানতে চাইলো। “আমি তো তোমার ধৈর্যশীলতা কখনও দেখিনি ।”

“ঈশ্বর,” ও বলল, “রোগের সঙ্গে উপশমও পাঠান । একদিন আমি আমার মিনার্ভাকে দেখতে পেলুম, নিজের জোরালো আদর্শে বুভুক্ষু, আমার চাকরের সঙ্গে দৈহিকভাবে লিপ্ত, যে দৃশ্য দেখে আমি বাধিত হলুম চুপচাপ সরে যেতে যাতে তারা লজ্জায় না ভোগে । সেই সন্ধ্যায় আমি দুজনকেই বরখাস্ত করলুম, তাদের পাওনা টাকাকড়ি মিটিয়ে দিয়ে ।”

“যদি আমার কথা বলি,” যে লোকটা মাঝখানে কথা বলেছিল সে বলল, “আমার তো নিজেকে ছাড়া আর কারোর বিরুদ্ধে নালিশ ছিল না । আনন্দ আমার সঙ্গে বসবাস করতে এলো, অথচ আমি তা বুঝতে পারিনি । বেশিদিন আগের কথা নয়, ভাগ্য আমাকে এক নারীসঙ্গের আনন্দ দান করেছিল যে ছিল খুবই মধুর, অত্যন্ত বশ্য, আর একান্ত অনুরক্ত জীব, আর সবসময় তৈরি ! আর কোনো রকম উৎসাহ ছাড়াই! ‘তোমাকে আনন্দ দেয় বলে আমি একাজ করে খুশি ।’ তা ছিল ওর গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া । তুমি ওই দেয়ালে ঠেলে বা এই সোফায় ফেলে ঠুকতে পারো, আর আমার রক্ষিতার ঠোঁট থেকে যে দীর্ঘশ্বাস বেরোতো তার চেয়ে দেয়াল আর সোফা থেকে পাওয়া যেতো একই শ্বাস, এমনকি সঙ্গমের বুনো আস্ফালনের সময়েও । দুজনে এক বছর একসঙ্গে বসবাসের পর, ও স্বীকার করল যে কখনও আনন্দ পায়নি । আমি সেই একতরফা দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে পড়লুম, আর অতুলনীয় মেয়েটি বিয়ে করে ফেললো । পরে, ওকে আবার দেখার রোখ চেপে বসল, আর ও আমাকে ওর ছয়টা সুন্দর বাচ্চা দেখিয়ে বলল, ‘প্রিয় বন্ধু ! স্ত্রী সেরকমই অক্ষতযোনি হয় যেমনটি তোমার রক্ষিতা ছিল।’ ওর কোনো কিছুই বদলায়নি । অনেকসময় আমি আফশোষ করি ; আমার উচিত ছিল মেয়েটিকে বিয়ে করা ।”

অন্য সকলে হেসে উঠলো, আর তৃতীয়জন তার কথা বলা আরম্ভ করলো :

“বন্ধুগণ, আমি কিছু আনন্দ পেয়েছি যা তোমরা হয়তো অবহেলা করেছ । আমি প্রণয়লীলায় হাসিঠাট্টার কথা বলতে চাই, এমন হাসিঠাট্টা যা সমাদর করতে উৎসাহ জাগায় । আমি আমার শেষ রক্ষিতাকে সবচেয়ে বেশি সমাদর করতুম, মনে হয়, যতোটা তোমরা নিজেদের রক্ষিতাকে ঘৃণা করতে বা ভালোবাসতে পারতে । যখনই আমরা কোনো রেস্তরাঁয় ঢুকতুম, কিছুক্ষণ পরে সবাই খাওয়া-দাওয়া ভুলে কেবল ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতো । এমনকি বেয়ারারা আর কাউন্টারের মহিলারা ওর ছোঁয়াচে আহ্লাদে প্রভাবিত হতো আর নিজেদের কাজ অবহেলা করতো। সংক্ষেপে, কিছুদিনের জন্য আমি প্রকৃতির একজন জীবন্ত উদ্ভট সৃষ্টির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছি । মেয়েটি খেতো, চিবোতো, কামড়াতো, গোগ্রাসে গিলতো, আর হজম করতো, কিন্তু হালকাভাবে, জগতের সবচেয়ে বেপরোয়া চালে । ও আমাকে অনেককাল যাবত ভাবাবেশে উচ্ছ্বসিত রেখেছিল । ও বলত, মধুর, স্বপ্নালু, ইংরেজি, রোমান্টিক কন্ঠস্বরে ‘আমার খিদে পেয়েছে’ । আর পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দাঁত মেলে, কথাটা দিনের আর রাতের বেলা বারবার বলতো-- তোমরা একই সঙ্গে বিচলিত আর আনন্দিত হতে -- আমি ওকে মেলায় নিয়ে গিয়ে সর্বগ্রাসী দানবী হিসাবে প্রদর্শনী করে অনেক রোজগার করতে পারতুম । আমি খাইয়ে-দাইয়ে ভালোই রেখেছিলুম ; তবু ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল….”

“নির্ঘাৎ কোনো মুদিখানার মালিকের কাছে, নাকি ?”

“সেইরকমই একজন, সৈন্যবাহিনীর মাল সরবরাহকারী কেরানি, কোনো ঐন্দ্রজালিক ছড়ি প্রয়োগ করে লোকটা, বেচারী মেয়েটাকে কয়েকজন সেনার বরাদ্দ খাবারের ব্যবস্হা করে দিতো। আমার তো তাই মনে হয়।”

“আমার কথা যদি বলো”, চতুর্থজন বলল, নারীর অহঙ্কার বলতে সচরাচর যা বোঝায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপারের নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে । আমার মনে হয়, তোমরা বড্ডো ভুল করছ, তোমরা যারা অতিভাগ্যবান নশ্বর মানুষ, তোমাদের রক্ষিতাদের ত্রুটির বয়ান করে-করে !”

এই কথাগুলো বেশ গম্ভীরভাবে বলেছিল,  যে লোকটাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল শান্তস্বভাব এবং আত্মসংবরণশীল, হাবভাব কেরানিদের মতন, ওর মুখাবয়ব ধূসর চোখের পরিষ্কার উজ্বলতায় বলতে চাইছিল : “আমি এটা চাই !” কিংবা, “তোমার ওটা করা উচিত!” কিংবা এমনকি, “আমি কখনও ক্ষমা করি না !” 

“যদি, আমি তোমাকে যতোটা উত্তজক বলে জানি, জি, কিংবা ঢিলেঢালা আর দুর্বল তোমাদের দুজনের মতন, কে আর জে, তোমাদের যদি আমার পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে জুটি বেঁধে দেয়া হতো, হয় তোমরা পালিয়ে যেতে কিংবা মারা পড়তে । আমি, আমি টিকে গেলুম, দেখতেই পাচ্ছ। একজন মহিলার কথা ভেবে দ্যাখো যে অনুভব বা বিচারে ভুল করতে অসমর্ধ ; একজন মহিলা যার চরিত্র ভয়ঙ্কর রকম শান্ত, ঠাট্টাইয়ার্কি বা জাঁকজমক ছাড়াই আত্মসমর্পিত, দুর্বলতা ছাড়াই মধুর, উগ্রতা ছাড়াই তেজোময় । আমার প্রেমের কাহিনি আয়নার মতন পালিশকরা পবিত্র পৃষ্ঠতলের ওপর দিয়ে অন্তহীন যাত্রার মতন, মাথাখারাপ-করা একঘেয়েমির, যে আয়নায় আমার নিজের বিবেকের হাস্যকর স্পষ্টতায় প্রতিফলিত হতো আমার যাবতীয় অনুভব আর অঙ্গভঙ্গী, যাতে না আমি আমার অবিচ্ছেদ্য অপচ্ছায়ার তাৎক্ষণিক ভর্ৎসনার যোগ্য কোনো অযৌক্তিক আবেগ বা কাজে জড়িয়ে পড়ি । প্রেমকে মনে হতো শিক্ষার বৈঠক । কতো যে বোকামির কাজ থেকে ও আমাকে বিরত করেছে, যে কাজ না করার দরুন আফশোষ হয় ! আমি রাজি না হওয়া সত্বেও কতো যে ধারদেনা শোধ করিয়েছে ! আমার ব্যক্তিগত মূর্খতা থেকে যে লাভ আমি পেতুম তা থেকে বঞ্চিত করেছে । ভাঙা চলবে না এমন শীতল নিয়মকানুনে বেঁধে সে আমার সমস্ত খামখেয়াল রুদ্ধ করেছে । আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো যে ও কখনও চায়নি যে বিপদ কেটে যাবার পর ওকে ধন্যবাদ জানাই! কতোবার যে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি ওর গলা ধরে চেঁচিয়ে বলি : ‘ওগো দুর্দশাময় নারী, একটু ত্রুটিপূর্ণ হও ! যাতে অসুস্হ আর ক্রুদ্ধ অনুভব না করে তোমাকে ভালোবাসতে পারি !’ অনেক বছর যাবত আমি ওকে সমাদর করেছিলুম, আমার হৃদয়ে ঘৃণা নিয়ে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আমি সেই ব্যক্তি নই যে মারা পড়ল !”

“হায়”, সবাই বলল, “মেয়েটি মারা গেছে ?”

“হ্যাঁ ! আমি অমনভাবে চালিয়ে যেতে পারছিলুম না । প্রেম আমার কাছে সর্বভূক দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল । বিজয় অথবা মৃত্যু, রাজনীতিকরা যেমন বলে থাকেন, এইটিই ছিল বেছে নেবার পথ যা নিয়তি আমাকে দিয়েছিল । একদিন রাতে, ঝিলের পাশের জঙ্গলে….মনখারাপ করা পায়চারির পর, যে সময়ে ওর দুই চোখে স্বর্গের মাধুর্য প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর আমার স্নায়ু ছিঁড়ে যাবার অবস্হায়…”

“কী !”

“ কি বলতে চাইছ !”

“তোমার বক্তব্য কি ?

“ব্যাপারটা ছিল অবশ্যম্ভাবী । অমন ত্রুটিহীন সেবিকাকে পেটানো, অপমান করা, কিংবা ছাঁটাই করা আমার বিবেকের উর্ধ্বে ছিল । কিন্তু সেই বোধের সঙ্গে আমাকে ভারসাম্য রাখতে হলো আমার মধ্যে  প্রাণীটার দেয়া আতঙ্কের সঙ্গে ; অশ্রদ্ধা না করে প্রাণীটা থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার ছিল। তাছাড়া আমি আর কীই বা করতে পারতুম, যখন কিনা মেয়েটা ছিল নিখুঁত ?”

অস্পষ্ট হতচেতন চাউনি মেলে ওর তিন বন্ধু ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন না বোঝার ভান করছে এবং যেন অন্তর্নিহিত অর্থোদ্ধার করতে পারছে যে, তাদের কথা যদি বলা হয়, তারা অমন কঠোর কাজ করার যোগ্য নিজেদের মনে করে না, তা যতো বিশ্বাসযোগ্য কথায় ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকুক না কেন ।

তারপর ওরা আরেক প্রস্হ মদ আনতে বলল, সময় নষ্ট করার জন্য, যা জীবনকে নির্দয়ভাবে আঁকড়ে ধরে, আর একঘেয়েমিকে দ্রুতি দিতে পারে ।


তেতাল্লিশ

প্রণায়াভিলাষী লক্ষ্যবেধী

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা যাবার সময়ে, ও চালককে বলল গুলি-চালানো অভ্যাস করার মাঠের কাছে থামতে, বলল যে স্রেফ সময় কাটানোর জন্য কয়েক রাউণ্ড গুলি চালাবার সুযোগের আনন্দ নিতে পারবে । আর দানবটাকে মেরে ফেলা -- এটা কি প্রত্যেকের একেবারে মামুলি ও বৈধ পেশা নয় ? --- আর ও নিজের প্রণয়াভিলাষী হাত এগিয়ে দিলো ওর প্রিয়, সমধুর, এবং বিরক্তিকর নারীর দিকে, ওর রহস্যময় স্ত্রী যার প্রতি ওর বহু আনন্দদানের দেনা রয়েছে, বহু দুঃখ, এবং ওর প্রতিভার অনেকাংশ ।

লক্ষ্যবিন্দু থেকে দূরে-দূরে কয়েকটা গুলি গিয়ে বিঁধলো, একটা গুলি তো গিয়ে ছাদে আটকে গেলো; আর যখন সুন্দরী প্রাণীটি আপ্রাণ হাসতে আরম্ভ করলো, নিজের স্বামীর অক্ষমতাকে ঠাট্টা করে, লোকটা হঠাৎ নারীটির দিকে ফিরে বলল, “ওখানে ডানদিকে ওই পুতুলটাকে দ্যাখো, বাতাসে নাক উঁচু করে উদ্ধত গোমর দেখাচ্ছে । ওগো ! আমার প্রিয় প্রতিমা, আমি কল্পনা করছি যে ওটা তুমি।” লোকটা চোখ বন্ধ করে ট্রিগার টিপলো । পুতুলটার মাথা সুস্পষ্টভাবে ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল । তারপর নিজের প্রিয়, সমধুর, বিরক্তিকর স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে, যে ওর অপরিহার্য এবং নির্দয় অনুপ্রেরণা, হাতে আনত  চুমু খেয়ে বলল, “আহ, আমার প্রিয় প্রতিমা, আমার দক্ষতার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই !”


চুয়াল্লিশ

সুপ এবং মেঘ

আমার ছোটোখাটো প্রেয়সী ক্ষেপি আমার জন্যে রাতের খাবার রাঁধছিল, আর খাবার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলুম যে বাষ্প থেকে ঈশ্বর কেমন ভাসমান স্হাপত্য গড়ে তোলেন, স্পর্শাতীতের চমৎকার কারুকার্য । আর আমার ভাবনায়, আমি নিজেকে বলছিলুম : “এই সমস্ত মায়ামেঘ ঠিক আমার সুন্দরী প্রেয়সীর সুন্দর চোখের মতন, আমার ক্ষেপির দানবী সবুজ-চোখ যেন ।”

এবং হঠাৎ আমার পিঠে একটা সজোর ঘুষি অনুভব করলুম, আর শুনতে পেলুম এক খসখসে, চমৎকার কন্ঠস্বর, ব্র্যাণ্ডিটানার দরুন গলাভাঙা পাগলি কন্ঠস্বর, আমার ছোটোখাটো প্রেয়সীর কন্ঠস্বর, যে বলছিল, “তাহলে, তুমি তোমার সুপ খেতে চলেছ, মেঘের কারবারী কুত্তির বাচ্চা কোথাকার ?”


পঁয়তাল্লিশ

গুলি চালানো শেখার মাঠ আর গোরস্তান

“এক অসাধারণ সাইনবোর্ড” -- গোরস্তান দেখার হোটেল, আমাদের ফেরিঅলা নিজের মনে বলল, “কিন্তু যে কাউকে তৃষ্ণার্ত করে তোলার জন্যে ভালোভাবে তৈরি করা ! নিঃসন্দেহে, হোটেল মালিক হোরেস এবং এপিকিউরাসের কবিশিষ্যদের মর্ম উপলব্ধি করেন । হয়তো প্রাচীন মিশরীয়দের নিগূঢ় বিশোধনের সঙ্গে উনি পরিচিত, যাদের কাছে একটা কঙ্কালের উপস্হিতি ছাড়া কোনো ভোজসভা পূর্ণাঙ্গ হতো না, কিংবা জীবনের স্বল্পস্হায়িতার অন্য কোনো চিহ্ণ।”

আর লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল, কবরগুলোর দিকে মুখ করে এক গ্লাস বিয়ার খেলো, এবং ধীরেসুস্হে একটা চুরুট ফুঁকলো । হঠাৎ কোনো খামখেয়ালে আক্রান্ত হয়ে ও গোরস্তানে যাওয়া মনস্হ করল, ঘাসগুলো ছিল উঁচু আর্ আ্‌হ্বায়ক, আর এক ঝকমকে সূর্য সবার ওপর রাজত্ব করছিল ।

সত্যি বলতে কি, মনে হচ্ছিল তীব্র আলো আর তাপ মাতাল সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়ছে, যা চমৎকার ফুলগুলোর ওপরে, যে ফুলগুলোর স্বাস্হ তলাকার পচনের কারণে বেশ পুরুষ্টু, তাদের ওপরে আগাপাশতলা  জাজিম বিছিয়ে দিয়েছে । বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে জীবনের বিস্তৃত মর্মরধ্বনি -- সবচেয়ে ক্ষুদ্রের জীবন --- যা মাঝেমাঝে কাছাকাছি কোনো গুলিচালানো শেখার মাঠ থেকে রাইফেলের আওয়াজে বিঘ্নিত হচ্ছিল, শ্যাম্পেনের ছিপিখোলার মতন মৃদু নিচুস্বর ঐকতানের মাঝে ।

তারপর, সূর্যের তলায়,  যা ওর মস্তিষ্ককে পোড়াচ্ছিল, এবং মৃত্যুর উষ্ণ সুগন্ধের বাতাবরণে, যে গোরের ওপরে ও বসেছিল তা থেকে ফিসফিসে গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। আর কন্ঠস্বর বলল, “তোমার লক্ষ্যবস্তু আর গুলিগোলা অভিশপ্ত হোক, তোমরা অস্হির জীবন্ত প্রানী কোথাকার, মৃতের  আর তাদের বিশ্রামের পবিত্র জায়গা সম্পর্কে তোমাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই ! অভিশপ্ত হোক তোমাদের উচ্চাকাঙ্খা, তোমাদের পরিকল্পনা অভিশপ্ত হোক, তোমরা ধৈর্যহীন নশ্বর কোথাকার, মৃত্যুর নিভৃত আবাসের কাছে আসো হত্যার শিল্প শেখার জন্য !

হায়, যদি তোমরা জানতে এই পুরস্কার জয় করা কতো সহজ, এই লক্ষ্যবিন্দুকে ভেদ করা কতো সহজ, আর মৃত্যু ছাড়া সবকিছুই শূন্য, তোমরা নিজেদের ওভাবে ফুরিয়ে ফেলতে না, তোমরা শ্রমশীল জীবন্ত প্রাণী কোথাকার, আর যারা বহুকাল আগে লক্ষ্যভেদ করেছে, যা কিনা এই বিরক্তিকর জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যবস্তু,  তাদের ঘুমে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য তোমরা কম উৎপাত করতে !”


ছেচল্লিশ

মাথার পেছনের হারানো জ্যোতি 

“কী ? তুমি এখানে, আমার প্রিয় দোস্ত ? তুমি, এই রকম একটা নোংরা জায়গায় ! তুমি, যে সবচেয়ে অপরিহার্য পানীয় পান করো, দেবতাদের খাবার খাও ! সত্যি, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার ।”

“বন্ধুবর, তুমি ঘোড়া আর ঘোড়ারগাড়ি সম্পর্কে আমার আতঙ্কের কথা জানো। ঠিক এক্ষুনি, তাড়াতাড়ি বাগানের রাস্তা পার হবার সময়ে, কাদার ওপরে লাফ মেরে ওই ভ্রাম্যমান বিশৃঙ্খলায়, যেখানে মৃত্যু টগবগিয়ে তোমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফ্যালে, আমি আচমকা রূঢ়ভাবে হাঁটছিলুম আর আমার মাথা থেকে জ্যোতিটা খসে গেল, পড়ল গিয়ে রাস্তার কাদায় । ফিরে যাওয়ার ঝঞ্ঝাটের কোনো মানে হয় না । আমার মনে হলো নিজের হাড় ভাঙার চেয়ে নিজের তকমা হারানোটা কম অপ্রীতিকর । আর তারপর মনেমনে বললুম, প্রতিটি খারাপ ব্যাপারের একটা ভালো দিক থাকে । এখন আমি আত্মপরিচয় গোপন করে ঘুরে বেড়াতে পারি, বজ্জাতি করতে পারি, লাম্পট্যে নিজেকে সঁপে দিতে পারি, সাধারণ নশ্বর মানুষদের মতন । আর এখন এই আমি, অবিকল তোমার মতন, দেখতেই পাচ্ছ !”

“তোমার উচিত জ্যোতিটার জন্যে একটা বিজ্ঞাপন দেয়া, কিংবা পুলিশের সাহায্য নিয়ে ফিরে পাবার চেষ্টা করা ।”

“হায় ভগবান, না ! আমার এই ভাবেই ভালো লাগছে । কেবল একমাত্র তুমিই আমাকে চিনতে পেরেছ । আর তাছাড়া, মর্যাদা আমাকে বিরক্ত করে । আর আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে কোনো মূর্খ কবি ওটা তুলে নিয়ে নির্লজ্জের মতন নিজের মাথায় পরে নেবে । কাউকে খুশি করা --- কতো যে আনন্দের ! আর তার চেয়েও উৎকৃষ্ট, যদি সে এমন কেউ হয় যাকে দেখে তুমি হাসাহাসি করতে পারবে ! ভেবে দ্যাখো, এক্স-এর মাথায়, কিংবা জেড-এর ! ওহ কতো মজার হবে।


সাতচল্লিশ

কুমারী বিসতৌরি

শহরের শেষ প্রান্তে গ্যাসবাতির তলা দিয়ে হাঁটার সময়ে, অনুভব করলুম একটা হাত আস্তে আমার বাহু আঁকড়ে ধরল, আর আমার কানে একটা কন্ঠস্বর বলল, “আপনি একজন ডাক্তার, স্যার ?” আমি চেয়ে দেখলুম ; বেশ দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্হ্যবতী বড়ো-বড়ো চোখের যুবতী, মুখে যৎসামান্য সাজগোজ, শিরাবরণের ফিতের সঙ্গে বাতাসে তার চুল উড়ছে ।

“না, আমি ডাক্তার নই । হতে চাই ।”

“হ্যাঁ ! আপনি একজন ডাক্তার । আমি দেখে বলতে পারি । আমার বাসায় আসুন । আমার সঙ্গ আপনার ভালো লাগবে ; আসুন !!”

“হতে পারে, আমি তোমার বাসায় যাবো, কিন্তু ডাক্তার হবার পরে, ধ্যাৎ !”

“আহা, আহা”, মেয়েটি বলল, আমার বাহু আঁকড়ে থেকে, আর হাসতে লাগলো, “আপনি একজন মজার ডাক্তার । আপনার মতন কয়েকজনকে আমি জানি ! আসুন দিকিনি ।”

আমি রহস্য বেশ পছন্দ করি, কারণ আমার সব সময়ে মনে হয় তার সমাধান করতে পারবো । তাই আমি এই নতুন সঙ্গিনীর টানের সঙ্গে চললুম, কিংবা বলা যায়, এই অপ্রত্যাশিত হেঁয়ালির সঙ্গে ।

আমি ওর বাসার বর্ণনা বাদ দিচ্ছি ; তা বহু নাম-করা পুরোনো কবিদের রচনায় পাওয়া যাবে । যাই হোক, যে বিস্তারিত বর্ণনা অঁরি দ্য রেনিউ দেননি, দেয়ালে দুই বা তিনজন বিখ্যাত ডাক্তারের ছবি ঝুলছিল ।

কতো যে প্রশ্রয় আমাকে দেয়া হলো ! জ্বলজ্বলে তাপ পোয়াবার আগুন, মশলা মেশানো মদ, চুরুট ; আর আমাকে এই জিনিসগুলো দেবার সময়ে এবং নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে, মজার মেয়েটি আমাকে বলল: আরাম করে বসুন, বন্ধুবর, আয়েশ করে বসুন । এটা আপনাকে হাসপাতালের  আর যৌবনের ভালো দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেবে -- আরে ! আপনার চুল অমন শাদা হয়ে গেছে কেমন করে ? সেসময়ে তো এরকম ছিল না, সেই কতোকাল আগে, যখন আপনি এল-এর শিক্ষানবীশ ছিলেন । আমার মনে আছে জটিল শল্যচিকিৎসায় আপনিই ওনাকে সাহায্য করতেন । তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি কাটাছেঁড়া করতে, কাঁচি চালাতে আর অংশ বাদ দিতে ভালোবাসতেন !

আপনি ওনার হাতে সরঞ্জাম তুলে দিতেন, ক্ষতস্হান সেলাইয়ের সুতো আর স্পঞ্জ দিতেন -- আর আমার মনে আছে কেমন করে, যখন শল্যচিকিৎসা শেষ হয়ে যেতো, তিনি নিজের ঘড়ি দেখতেন আর গর্বভরে ঘোষণা করতেন, ‘পাঁচ মিনিট, ভদ্রমহোদয়গণ !’ ---ওহ, আমি, মনে পড়ছে । আমি সেই ভদ্রমহোদয়দের ভালোভাবে চিনি ।”

কয়েক সেকেণ্ড পরে, এবার ঘরোয়া ঢঙে, মেয়েটি গল্পের সূত্র এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি একজন ডাক্তার, নয়কি, আমার প্রিয় বাঘ ?”

মেয়েটির এই পাগলামির ধুয়া আমাকে বাধ্য করল চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে ।

“না !” আমি চেঁচিয়ে বললুম ।

“তাহলে একজন শল্যচিকিৎসক ?”

“না, না ! যদি না আমি তোমার মাথা কেটে ফেলার জন্য শল্যচিকিৎসক হই ! পূতচরিত্র ম্যাকেরেল মাছ ঢোকানোর গর্ত কোথাকার !”

“দাঁড়ান, “ মেয়েটি বলল । “আপনি নিজেই জানতে পারবেন ।”

আর মেয়েটি আলমারি থেকে একতাড়া কাগজ বের করল, যেগুলো নামকরা ডাক্তারদের ছবির সংগ্রহ, মরাঁর লিথোগ্রাফ করা, যা কয়েক বছর কোয়ায় ভোলতেয়ারে প্রদর্শিত হয়েছিল ।

“দেখুন ! এনাকে চিনতে পারছেন ?

“হ্যাঁ ! ইনি এক্স । ছবির তলায় ওনার নাম ছাপা রয়েছে ; কিন্তু আমি ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ।”

“হ্যাঁ আপনি তো চিনবেনই ! এটা, দেখুন ইনি জেড, যে লোকটি এক বক্তৃতায় এক্স সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমন দানব যে নিজের আত্মার কালিমা মুখাবয়বে প্রকাশ করে !’ আর তা কেবল এই জন্যে যে বিশেষ এক রোগির ক্ষেত্রে দুজনের মতের মিল হয়নি ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই কতো হাসাহাসি করেছিল তখন, আপনার মনে আছে ? -- এবার এই যে, কে-এর দিকে দেখুন, যে খবর দিয়েছিল যে তার হাসাপাতালে বিপ্লবীদের সে চিকিৎসা করছে । তা ছিল দাঙ্গার সময়ে । অমন ভদ্রলোকের কেন  অতো কম সাহস ছিল?--- আর এই যে ডাবলিউ, বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার; উনি যখন প্যারিসে এসেছিলেন তখন ওনাকে পাকড়াও করেছিলুম । ওনাকে অনেকটা মেয়েদের মতন দেখতে, তাই না ?”

এবং যখন আমি টেবিলের ওপরে রাখা সুতো বাঁধা একটা তাড়ায় হাত দিলুম, মেয়েটি বলল, “একটু দাঁড়ান ; ওগুলো শিক্ষানবীশদের, আর এই তাড়াটা যারা আবাসিক ছিল না তাদের।”

তারপর মেয়েটি ফোটোগ্রাফের গোছা বের করল, সেগুলোতে মুখগুলো তরুণতরদের।

“আমাদের যখন আবার দেখা হবে, আপনি আপনার ছবি আমাকে দেবেন, বলুন, দেবেন তো, হে প্রিয় ?”

“কিন্তু”, আমি মেয়েটিকে বললুম, আমার ব্যক্তিগত আচ্ছন্নতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে অপারগ, “তুমি কেন মনে করো যে আমি একজন ডাক্তার ?”

“কারণ আপনি কতো ভালো,  নারীদের কতো সন্মান জানান !”

“অদ্ভুত যুক্তি !” মনে মনে বললুম ।

“ওহ, আমি তেমন ভুল করি না ; আমি ওনাদের অনেককে চিনি । আমি এই ভদ্রলোকদের এতো ভালোবাসি যে অসুস্হ না হলেও, আমি অনেকসময়ে তাঁদের কাছে যাই কেবল তাঁদের দেখবো বলে । ওনাদের কেউ কেউ শীতল কন্ঠে বলেন : ‘তুমি মোটেই অসুস্হ নও !’ কিন্তু কেউ কেউ আমাকে বুঝতে পারেন, যখন ওনারা দেখেন আমি কেমনভাবে তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসছি ।”

“আর যখন ওনারা তোমাকে বুঝতে পারেন না ?”

“হায় ভগবান ! আমি তো তাঁদের কোনোভাবে বিরক্ত করিনি, আমি দশ ফ্রাঁ তাকের ওপরে রেখে দিই ! --- ওনারা এতো ভালো আর এতো ভদ্র, ওই লোকজন ! ---আমি একজন ছোটো শিক্ষানবীশকে পিটি-তে খুঁজে পেয়েছিলুম, দেবদূতের মতন সৌম্যকান্তি আর কতো নম্র ! কতো পরিশ্রম করতো, বেচারা ! ওর বন্ধুরা আমায় বলেছিল ওর অবস্হা ভালো নয়, কারণ ওর বাবা-মা গরিব আর ওকে টাকাকড়ি পাঠাতে পারেন না । শুনে আত্মবিশ্বাস হলো । আমি তো দেখতে যথেষ্ট ভালো, যদিও ততো কম বয়স নয় । আমি ওকে বললুম : ‘এসো, আমার সঙ্গে দেখা করো, আমার সঙ্গে প্রায়ই তুমি দেখা করবে । আর আমাকে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না : আমার টাকাকড়ি চাই না !” কিন্তু আপনি বুঝবেন যে  সেসব কথা আমায় নানা উপায়ে বলতে হয়েছিল ; আমি অমার্জিত ঢঙে বলতে চাইনি । ওকে অপমান করে ফেলার ভয় ছিল আমার, আমার খোকাবাবু !”

“আচ্ছা ! তুমি কি বিশ্বাস করবে যে আমার এক ধরণের মজার উদ্দীপনা চাগিয়ে উঠেছিল যা ওকে বলার সাহস আমার হয়নি ?--- আমি চেয়েছিলুম ও আমাকে দেখতে আসুক ওর ডাক্তারি ব্যাগ আর শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি নিয়ে, এমনকি তাতে লেগে থাকা রক্তসুদ্দু আসুক !”

মেয়েটি এই কথাগুলো বেশ অকপটে বলল, যেমনভাবে সংসারি লোক তার অভিনেত্রী প্রেমিকাকে বলবে, “আমি তোমাকে তোমার বিখ্যাত ভূমিকায় পরা পোশাকে দেখতে চাই।”

আমি জেদাজেদি করে জিগ্যেস করলুম : “তুমি কি আমাকে বলতে পারো কোথায় তোমার এই অদ্ভুত চাহিদার সূত্রপাত ঘটেছিল ?”

আমার কথা বোঝানো বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সফল হলুম । কিন্তু মেয়েটি বড়ো দুঃখি কন্ঠে জবাব দিল, যতোদূর আমার মনে পড়ে, আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে : “আমি জানি না….আমার মনে নেই ।”

বিশাল একটা শহরে কতো অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যদি লোকে জানে যে কেমন করে চলাফেরা করতে হয় আর তাদের খুঁজতে হয় ! জীবনে ভেসে বেড়ায় নিষ্পাপ দানবেরা । --- হায় ভগবান, হে ঈশ্বর ! তুমি স্রষ্টা, তুমি মালিক ; তুমি আইন ও মুক্তি দুটিই গড়েছ ; তুমি সর্বভৌম যে অনুমতি দেয়, তুমি বিচারক যে ক্ষমা করে, তুমি  উদ্দেশ্য ও কারণে সম্পূর্ণ, আর যে সম্ভবত ভয়ঙ্করের স্বাদ আমার আত্মায় দিয়েছে আমার হৃদয়ে পরিবর্তন ঘটানোর জন্য, ছুরির ডগা থেকে যেমন সুশ্রূষা আসে ; ভগবান, দয়া করো, পাগল ও পাগলিনীদের দয়া করো ! হে সৃষ্টিকর্তা ! তোমার দৃষ্টিতে তাদের কি রাক্ষস বলে মনে হয় কেননা কেবল তুমিই জানো কেন তাদের অস্তিত্ব, কেমন করে তাদের তৈরি করা হয়েছে এবং কেমন করে তাদের অন্যরকম তৈরি করা যেতে পারতো ?



আটচল্লিশ

এই জগতের বাইরে যেখানে হোক

এই জীবন একটা হাসপাতাল যেখানে প্রতিটি রোগী বিছানা বদল করার জন্য হন্যে হয়ে থাকে। এই লোকটা আগুনের দিকে মুখ করে ভুগতে চায়, আর অন্যজন ভাবে জানালার পাশে থাকলে ভালো হয়ে উঠবে । আমার সব সময় মনে হয়েছে আমি যেখানে আছি তার চেয়ে অন্য যে-কোনো জায়গায় ভালো থাকবো, এবং এই অন্যত্র যাওয়ার প্রশ্ন আমি আমার আত্মার সঙ্গে অবিরাম আলোচনা করি ।

“আমাকে বলো, আমার আত্মা, আমার বেচারা শীতল আত্মা, লিসবনে গিয়ে থাকার বিষয়ে কী ভাবো ? সে-জায়গাটা নিশ্চয়ই উষ্ণ, আর তুমি গিরগিটির মতন উদ্দীপিত হয়ে উঠবে । শহরটা জলের কিনারায় ; লোকে বলে শ্বেতপাথরের তৈরি, আর সেখানকার জনগণের উদ্ভিদ সম্পর্কে এমন ঘৃণা যে সব গাছপালা কেটে ফ্যালে । ন তোমার পছন্দ মতো একটা দেশ  : আলো এবং আকরিক পদার্থে গড়া ভূদৃশ্য, আর তাদের প্রতিফলিত করার জন্য তরল !”

সাড়া দেয় না আমার আত্মা ।

“যেহেতু তুমি নীরবতা আর বহমানতার প্রদর্শনী  ভালোবাসো, তুমি কি হল্যাণ্ডে গিয়ে বসবাস করতে চাইবে, মোহময় দেশে ? হয়তো ওই দেশে তোমার চিত্তবিনোদন করা হবে যার ছবি তুমি প্রায়ই মিউজিয়ামগুলোয় দেখে  মুগ্ধ হয়েছ । তুমি রোটারডম সম্পর্কে কী ভাবো, তুমি তো জঙ্গল আর মাস্তুলশ্রেনি ভালোবাসো, আর বাড়ির বাইরে নোঙরবাঁধা নৌকো ?” 

আমার আত্মা বোবা হয়ে থাকে ।

“ব্লাটভিয়া কি তোমার মুখে বেশি হাসি ফোটাবে ? সেখানে আমরা ক্রান্তিমন্ডলের সৌন্দর্যের সঙ্গে ইউরোপীয় কর্মশক্তির মেলবন্ধন খুঁজে পাবো ।”

একটি শব্দ নয় -- আমার আত্মা কি মৃত ?

“তাহলে, তুমি কি এতোই অনড় যে নিজের রোগ থেকেই কেবল আনন্দ পেতে চাও ? যদি তাইই হয়, তাহলে চলো সেইসব দেশে পালাই যারা মৃত্যুর সদৃশ । --- আমি জানি তুমি কী চাও, বেচারা আত্মা !  আমরা তোর্নিও যাবার জন্য বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নেবো । আমরা আরও দূরে চলে যাবো, বালটিকের একেবারে শেষ পর্যন্ত ; এমনকি জীবন থেকে বহুদূরে, যদি তা সম্ভব হয় ; আমরা মেরুঅঞ্চলে বাসা বাঁধবো । সেখানে সূর্য পৃথিবীর কাছে তীর্যকভাবে আসে, এবং আলো ও রাত্রির ধীর পরিবর্তন বৈভিন্ন্যকে দমন করে  একঘেয়েমিকে প্রশ্রয় দেয়, তা আরেক ধরনের শূন্যতা । সেখানে আমরা বহুক্ষণ ছায়ায় স্নান করতে পারবো, কেবল সেই সময়ে, যখন, ক্ষণে-ক্ষণে, উত্তরের আলো তাদের গোলাপি পিচকারি দিয়ে আমাদের চিত্তবিনোদন করবে, তা দেখে নরকের আতশবাজির প্রতিফলন মনে হবে !”

শেষ পর্যন্ত আমার জ্ঞানী আত্মা কান্নায় ভেঙে পড়ে : “যেখানে হোক ! যেখানে হোক ! এই জগতের বাইরে যেখানে হোক !”


উনপঞ্চাশ

চলো গরিবদের ধরে পেটাই !

সপ্তাহ দুয়েক আমি ঘরবন্দি ছিলুম, আর সেই সময়ের ফ্যাশান অনুযায়ী আমি নিজের চতুর্দিক বই দিয়ে ঘিরে রেখেছিলুম ( ঘটনাটা ষোলো বা সতেরো বছর আগের ); মানে সেই ধরনের বই যা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জনগণকে সুখি, জ্ঞানী আর ধনী করে তোলার  শিল্প প্রতিপাদন করে।

ফলে আমি হজম করলুম -- কিংবা গিললুম, আমি বলতে চাই -- জনগণের আনন্দের সকল ঠিকাদারদের লেখা দীপালোকের গন্ধ-মাখানো যাবতীয় পণ্ডিতি রচনা --- তাঁরা যাঁরা উপদেশ দিলেন যে গরিবদের সবায়ের উচিত কেনা গোলাম হয়ে যাওয়া, আর তাদের যাঁরা  বোঝাতে লাগলেন যে তারা আসলে রাজপরিবারের সিংহাসনচ্যুত মানুষ । তাহলে অবাক হবার কথা নয় যে, আমি মূর্খতার কিনার বরাবর মাথা-ঝিমঝিমে অবস্হায় বিরাজ করছিলুম।

তবু আমার মনে হলো যে আমি টের পাচ্ছি, আমার বোধের গভীরে কোথাও চাপা পড়ে আছে, এমন একটা ধারণার অজ্ঞাত বীজানু, যা বুড়ি বউদের ফরমুলার  অভিধানের তুলনায়, যা এক্ষুনি পড়লুম, তার চেয়ে উচ্চতর । কিন্তু তা ছিল ধারণার অন্তর্গত ধারণা, এমনকিছু যা সীমাহীনভাবে অস্পষ্ট । আর আমি অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্হায় বাইরে বেরিয়ে পড়লুম । কেননা বাজে কিছু  পড়ার আবেগান্বিত রুচি সমান্তরালভাবে খোলা হাওয়া আর ঠাণ্ডা পানীয়ের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্রয় দেয় ।

আমি একটা মদের ঠেকে ঢুকতেই যাচ্ছিলুম, একজন ভিখারি তার টুপিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো, ভুলতে পারা যাবে না এমন এক চাউনি মেলে যা সিংহাসন ওলোটপালোট করে দিতে পারে --- মন যদি বস্তুকে সক্রিয় করে তুলতে পারে, কিংবা সন্মোহনকারীর দৃষ্টি যদি আঙুরফলে পাক ধরাতে পারে তেমন ।

একই সঙ্গে, আমার কানে একটা গলার আওয়াজের ফিসফিসানি শুনতে পেলুম, একটা কন্ঠস্বর যা আমি তক্ষুনি ভালোভাবে চিনতে পারলুম ; ওটা ছিল ভালো দেবদূতের কন্ঠস্বর, কিংবা ভালো দানবের, যে সদাসর্বদা আমার সঙ্গে থাকে । যেহেতু সক্রেটিসের ছিল ভালো দানব, আমার কেন ভালো দেবদূত থাকবে না, আর কেনই বা আমি, সক্রেটিসের মতন, আমার নিজের পাগলামির প্রমাণপত্র  পাবার গৌরবে অভিষিক্ত হবো না, কৌশলী লেলুট এবং বিচক্ষণ বেইলারজারের সই করা ?

সক্রেটিসের আর আমার রাক্ষসের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে : ওনারটা ওনাকে দেখা দিয়েছিল বারন করার জন্য, হুশিয়ার করার জন্য, প্রতিরোধ করার জন্য, যখন কিনা আমারটা অভীষ্টপূরণের জন্য এসেছিলেন উপদেশ দিতে, স্মরণ করাতে, যুক্তি-পরামর্শ দিতে । বেচারা সক্রেটিসের ছিল এক নেতিবাচক রাক্ষস ; আমার অত্যন্ত ইতিবাচক, কর্মশক্তি প্রয়োগের রাক্ষস, লড়ে যাবার রাক্ষস ।

এখন, আমার রাক্ষস কানে-কানে বলল : “অন্যের সমান সে-ই একমাত্র মানুষ যে তা প্রমাণ করতে পারে, আর একমাত্র সেই মানুষই মুক্তির হকদার যে জানে তা কেমন করে হাসিল করতে হবে ।” 

তক্ষুনি, আমি ভিখারিটার ওপরে ঝাঁপালুম । একটা ঘুষিতে ওর একটা চোখ কালো করে দিলুম, যা ক্ষণেকেই বলের মতন ফুলে উঠলো । ওর দুটো দাঁত ভাঙতে গিয়ে আমার একটা নখে চোট লাগল, এবং যেহেতু আমার কখনও মনে হয়নি যে গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, অত্যন্ত রুগ্ন জন্মের কারণে আর বক্সিঙের বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল না বলে, বুড়ো লোকটাকে তাড়াতাড়ি কাবু করার জন্যে আমি এক হাতে ওর কলার চেপে ধরলুম আর অন্য হাতে ওর গলা টিপে ধরলুম, আর জোরে-জোরে ওর মাথা দেয়ালে ঠুকতে আরম্ভ করলুম । আমি স্বীকার করছি যে এই সব করার আগে আমি চারিপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলুম, আর দেখে নিয়েছিলুম যে ফাঁকা শহরতলিতে যেখানে আমি রয়েছি তা পুলিশের থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিরাপদ জায়গায় ।

তারপর, ষাট বছরের দুর্বল বুড়োটাকে মাটিতে ফেলে, আমি ওর পেছনে একটা দ্রুত লাথি মারলুম, ওর শিরদাঁড়া ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট, কাছাকাছি গাছের যে ডাল ঝুলছিল তা হাতে নিয়ে, বিফস্টিক রাঁধুনি একগুঁয়ে মেজাজে যেমন মাংস নরম করে,  ওকে তেমন পেটালুম ।

হঠাৎই --- আরে, অলৌকিক ঘটনা ! আহা , তত্বের গুরুত্ব প্রমাণ করার কি আনন্দ দার্শনিকের !---আমি দেখলুম প্রাচীন লাশ নড়েচড়ে উঠল, আর আমাকে এতো জোরে আক্রমণ করল যে আমি ভাবতেই পারিনি ভেঙে-পড়া যন্ত্রে অমন ক্ষমতা আছে ; আর, ঘৃণার চাউনি মেলে, যা আমার মনে হলো ভবিষ্যৎসূচক লক্ষণ, জরাজীর্ণ বুড়ো বজ্জাতটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার দুটো চোখকেই কালো করে দিলো, ঘুষি মেরে আমার চারটে দাঁত উপড়ে ফেললো, আর সেই একই গাছের ডালটা নিয়ে আমাকে মার দিয়ে প্লাস্টারের চেয়ে চ্যাপ্টা করে দিলো । --- আমার ঝাঁঝালো ওষুধ পেয়ে, আমি ওকে ওর গর্ব আর জীবন ফেরত দিলুম।

তারপর, নানা ইশারার মাধ্যমে আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমাদের আলোচনা শেষ হয়েছে, আর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পোরটিকোর  কুতার্কিকদের পরিতৃপ্তিসহ, আমি ওকে বললুম : “স্যার, আপনি আমার সমকক্ষ ! আমার টাকাকড়ি আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করার সুযোগ দিন ; আর মনে রাখুন, আপনি যদি প্রকৃত লোকহিতৈষী হন, যখনই আপনার কোনো সহযোগী ভিক্ষা চাইবেন, আপনি তাদের ক্ষেত্রে একই তত্ব প্রয়োগ করবেন যা আমি আপনার ক্ষেত্রে পয়োগ করার জন্য এতো কষ্ট করলুম ।”

ও আমাকে আশ্বস্ত করল যে আমার তত্ব বুঝেছে, আর ও আমার উপদেশ মেনে চলবে ।


পঞ্চাশ

ভালো কুকুরেরা

জোসেফ স্টেভেন্সের জন্য

বুফোঁ ( যিনি পশুদের জীবন নিয়ে লিখেছেন ) সম্পর্কে আমার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে আমি কখনও কুন্ঠিত হইনি, এমনকি আমার শতকের তরুণ লেখকদের কাছেও ; কিন্তু বর্তমানে, প্রকৃতির তাবৎ সৌন্দর্যকে যে চিত্রকর উপস্হাপন করেন, আমাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর আত্মাকে আর জাগিয়ে তুলবো না । উহুঁ।

আমি বরং যেচে স্টার্নকে ডাক দেবো, আর তাঁকে বলব : “স্বর্গ থেকে নেমে আসুন, কিংবা এলিসিয় মাঠ থেকে আমার দিকে উঠে আসুন যাতে আমি ভালো কুকুরদের, খারাপ কুকুরদের, গুণগান করতে পারি, আপনার উপযোগী গান, হে ভাবপ্রবণ সিক, হে অতুলনীয় সঙ ! যে গাধাটা সব সময় আপনার সঙ্গে থাকে, ভবিষ্যতের স্মৃতির জন্য তার পিঠে চেপে ফিরে আসুন ; এবং সর্বোপরি, গাধাটাকে ভুলতে দেবেন না, তার ঠোঁটের মাঝে পরিচ্ছন্নভাবে ঝুলিয়ে আনতে, বাদামে তৈরি তার অমর বিস্কুট ! বিদ্যায়তনিক সৃষ্টিপ্রতিমার নাগালের বাইরে ! শালীনতার ভানকারী ওই বুড়ির আমার কোনো প্রয়োজন নেই । আমি পরিচিত সৃষ্টিপ্রতিমাকে আহ্বান জানাই, শহরের যুবতী, জীবন্ত, যাতে সে আমায় ভালো কুকুর, খারাপ কুকুর, বাজে গন্ধের কুকুর, গায়ে পোকাধরা ক্ষতিকর কুকুর যেগুলোকে সবাই হ্যাট-হ্যাট করে তাড়ায়, তাদের নিয়ে গান গাইতে সাহায্য করে, তারা গরিবদের সহচর, আর কবিরা তাদের ভাইয়ের দৃষ্টিতে সম্ভ্রম করে ।

ফুলবাবু কুকুরদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, চারপেয়ে জড়বুদ্ধিগুলো, গ্রেট ডেন, কিঙ চার্লস, খ্যাঁদানাকি, কিংবা স্প্যানিয়েল, নিজেকে এতোই ভালোবাসে যে কেউ বেড়াতে আসলে তার পায়ের মাঝে বা কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন তাকে নিশ্চয়ই আদর করা হবে, বাচ্চার মতন চেঁচামেচি করে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো লোকের মতন বোকা, চাকরের মতন বদমেজাজি আর উদ্ধত ! এবং চার-থাবার সাপগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, দুলুনিখোর ও অলস, যার নাম গ্রেহাউণ্ড, যার প্রলম্বিত চোয়ালে গন্ধ শোঁকার যৎসামান্যও বোধ নেই যে কোনো বন্ধুর গমনপথ অনুসরণ করবে, যার চ্যাপ্টা মাথায় ডমিনো খেলার মতন বুদ্ধিটুকুও নেই !

এই সমস্ত ক্লান্তিকর পরগাছা নিয়ে ফেরা যাক কুকুরের কাঠঘরে ! ফেরা যাক তাদের রেশমের গদি-বসানো কুকুরবাসায় !

আমি নোংরা কুকুরের গান গাই, দরিদ্র কুকুরের, গৃহহীন কুকুরের, অবাঞ্ছিত কুকুরের, ডিগবাজিখোর কুকুরের, যে কুকুরের সহজপ্রবৃত্তি, গরিবের মতন, জিপসির মতন, এবং অভিনেতার মতন, প্রয়োজনের দ্বারা চমৎকারভাবে তীক্ষ্ণ, সেই ভালো মা, বোধবুদ্ধির প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক নারী !

আমি অভাগা কুকুরদের গান গাই, তারা একা ঘুরে বেড়াক, বিশাল শহরের ঘুরপাক গর্তগুলোয়, কিংবা সেইগুলো যারা তাদের কানা আধ্যাত্মিক চোখে পরিত্যক্ত লোকেদের বলে : “আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো, এবং আমাদের দুজনের দুর্দশা থেকে আমরা একরকম আনন্দ সৃষ্টি করতে পারবো !”

“কুকুরগুলো কোথায় যায় ?” নেসতর রোকেপ্লাঁ একবার এক চিরস্হায়ী প্রবন্ধ লিখেছিলেন যে লেখাটা তিনি নিজেই হয়তো ভুলে গেছেন, আর যা কেবল আমি, এবং সম্ভবত স্যঁৎ বভ, আজ পর্যন্ত মনে রেখেছি ।

কুকুরগুলো কোথায় যায়, আপনি জিগ্যেস করুন, হে অনাগ্রহী লোকজন ? তারা নিজের কাজে যায় ।

কাজের সমাবেশ,  প্রণয়লীলার সমাবেশ । কুয়াশার ভেতর দিয়ে, তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে, কাদার ওপর দিয়ে, জ্বলন্ত কুকুরদিবসের রোদে, তুমুল বৃষ্টিতে তারা যায়, তারা আসে, তারা হাঁটে, তারা ঘোড়ারগাড়ির তলা দিয়ে বেরোয়, পোকা কিংবা আবেগে চালিত হয়ে, কর্তব্যকর্মের দিকে যায় । আমাদের মতোই তারা ভোরবেলা ওঠে আর রোজগারের চেষ্টা করে কিংবা নিজেদের আনন্দের পেছনে দৌড়োয় ।

অনেকে শহরতলির ভাঙাচোরা বাড়ির তলায় শোয় আর প্রতিদিন একই সময়ে র‌য়াল প্যালেসের 

রান্নাঘরের দরোজার সামনে টুকরো-টাকরা ভিক্ষা চায় ; অন্যেরা দলবেঁধে পাঁচ মাইল দৌড়োয় কোনো  অবিবাহিতা ষাট বছরের বুড়িদের রাঁধা দাতব্য খাবার ভাগাভাগির জন্য, যে বুড়িরা তাদের দাবিদারহীন হৃদয়কে পশুদের বিলিয়ে দেন কেননা মূর্খ লোকেরা আর তাঁদের চায় না ।

অন্যেরা, পলাতক কেনা-গোলামের মতন প্রেমে পাগল, নিজের এলাকা ছেড়ে নির্দিষ্ট দিনে শহরে এসে কোনো সুন্দরী কুকুরীর  চারিপাশে ঘণ্টাখানেকের জন্য ক্রীড়াচঞ্চল হয়ে ওঠে, যে কুকুরী নিজের চেহারাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, গর্বিত ও কৃতজ্ঞ  হয় ।

এবং তারা সকলেই বেশ আচারনিষ্ঠ ও সময়নিষ্ঠ, কোনোরকম রোজনামচা, খাতা বা পকেটবই ছাড়াই ।

আপনি কি শ্রমবিমুখ বেলজিয়ামে গেছেন, এবং  মুগ্ধ হয়েছেন, আমার মতন, কসাইয়ের গাড়ির পেছনে বাঁধা প্রাণবন্ত কুকুরগুলোকে দেখে, কিংবা গয়লানির গাড়ি, বা পাঁউরুটিঅলার ঠেলার পেছনে বাঁধা, যাদের জয়ধ্বনির  ঘেউঘেউ ঘোড়াদের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গর্ববোধ ও আনন্দ অনুভবের প্রমাণ ? যদি ইচ্ছা হয় তাহলে দুটি কুকুরের বিষয়ে ভেবে দেখুন যারা সভ্য সমাজস্তরের সদস্য । অনুমতি দিন আপনাকে একজন রাস্তার ক্রীড়া-প্রদর্শনকারীর ঘরটা দেখাই যে অনুপস্হিত । একটা রঙকরা কাঠের খাট, কোনও পর্দা নেই, ছারপোকাভর্তি কোঁচকানো চাদর, খড়ের গদিতে ঠেসান দেবার দুটো চেয়ার, একটা লোহার উনোন, একটা বা দুটো সঙ্গীতযন্ত্র । হায়, দুঃখি আসবাবপত্র ! কিন্তু চেয়ে দেখুন্, যদি দেখতে চান, ওই দুটি মেধাবী চরিত্র, মামুলি ও বিলাসী, সৈনিক বা প্রেমের গীতিকবিতা রচয়িতার মতন শোভন, উনোন থেকে আসা রহস্যময় পাঁচমিশালি রান্নার দিকে খেয়াল রেখেছে, যা থেকে উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে বড়োসড়ো হাতা, এমনভাবে রাখা যেন কোনো অট্টলিকার ছাদে বাঁশের মতু উঁচু যাতে সংকেত দেয়া যায় যে রাজমিস্ত্রির কাজ এখনও শেষ হয়নি ।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, নয় কি, যে অমন একান্ত অনুরত অভিনেতারা কাজে বেরোবার আগে পেটভরে কড়া, সারবান সুপ খেয়ে বেরোবেন না ? আর আপনার কি হিংসে হবে যদি এই বেচারা গরিবরা একটু আনন্দ করেন, কেননা তাঁদের তো প্রতিদিন জনগণের উদাসীনতা এবং ম্যানেজারের অসাধুতার মুখোমুখি হতে হয় --- যে লোকটা রোজগারের অধিকাংশ হাতিয়ে নেয়, যে চারজন অভিনেতার খাবার সুপ একাই খেয়ে নেয় ?

আমি অনেকসময়ে লক্ষ্য করেছি, তাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আর তাদের সমব্যথার অংশীদার হয়ে, ওই চারপেয়ে দার্শনিকরা, ওই অনুগত, বশ্য, আত্মসমর্পণকারী কেনা-গোলামেরা, যাদের প্রজাতান্ত্রিক অভিধান বেসরকারি কেনা-গোলাম বলে সংজ্ঞায়িত করবে, যদি সেই প্রজাতন্ত্র, মানুষের সুখ সম্পর্কে অত্যধিক উদ্বিগ্ন হতো, কুকুরদের প্রাপ্য সন্মান নিয়ে চিন্তা করার সময় থাকতো ।

এবং আমি অনেকসময়ে চিন্তা করেছি,  ( যদিও, কে-ই বা তা জানে ? ) অমন সাহসকে পুরস্কৃত করার জন্য, অমন ধৈর্য ও পরিশ্রম, ভালো কুকুরদের জন্যে, গরিব কুকুরদের জন্যে , দুর্গন্ধিত ও অত্যাচারিত কুকুরদের জন্য  একটা বিশেষ স্বর্গোদ্যান কোথাও তো হবে । কেননা সুইডেনবোর্গ তো জোর দিয়ে বলেছেন যে তুর্কিদের জন্য অমন বিশেষ জায়গা আছে, এবং আরেকটা আছে ওলন্দাজদের জন্যে ! 

ভার্জিল এবং থিওক্রিটাসের মেষপালকরা, গানের প্রতিযোগীতায়, পুরস্কারের আশা করেছিল, সুস্বাদু পনির, সবচেয়ে ভালো কারিগরের তৈরি একটা বাঁশি, কিংবা থনে দুধভরা একটা ছাগলি । যে কবি বেচারা কুকুরদের গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন গাঢ় আর ফ্যাকাশে রঙের ফতুয়াকোট, হেমন্তের সূর্যের স্মারকের মতন, স্বাস্হ্যবতী রমণীর সৌন্দর্যের মতন, এবং ভারতীয় গ্রীষ্মের মতন ।

যারা রু ভিলা হেরমোসা শুঁড়িখানায় উপস্হিত ছিল তারা কখনই ভুলবে না কতো উৎসাহে চিত্রকর তাঁর ফতুয়াকোট খুলে ফেলে কবিকে দিয়েছিলেন, কেননা তিনি ভালোভাবেই জানতেন বেচারা কুকুরদের গান গেয়ে শোনানো কতো ভালো এবং সৎ ।

তাই তো প্রাচীন কালে একজন চমৎকার ইতালীয় স্বৈরাচারী তাঁর মণিরত্নখচিত দৈব আরেতিনো ছোরা অথবা দরবারি পোশাক একটি অসাধারণ সনেট অথবা কৌতূহলোদ্দীপক বিদ্রূপাত্মক কবিতা রচয়িতার সঙ্গে অদল-বদল করে নিয়েছিলেন ।

এবং যখনই চিত্রকরের ফতুয়াকোট কবি পরে নেন, তিনি ভালো কুকুর, দার্শনিক কুকুর, ভারতীয় গ্রীষ্মকাল, আর যৌবনশেষের নারীদের সৌন্দর্যের কথা ভুলতে পারেন না ।

[ রচনাকাল : ১৮৫৫ - ১৮৬৭ ]

[ প্রকাশকাল : ১৮৬৯ ]

[ অনুবাদ : ২০১৯ ]