ইরানের নারীবাদী কবি ফোরো ফারোখজাদ-এর কবিতা ( ১৯৩৪ - ১৯৬৭ )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
হাতে অস্ত্র তুলে নাও
কেবল তোমরা, হে ইরানের নারীরা, রয়ে গেছো
হীনাবস্হা, দুর্ভাগ্য আর নিষ্ঠুরতার বাঁধনে ;
তোমরা যদি এই বন্ধনগুলো ভাঙতে চাও,
একগুঁয়েমির পোশাককে আঁকড়ে ধরো
মিষ্টি প্রতিশ্রুতিতে কোমল হয়ে পোড়ো না,
স্বৈরাচারের কাছে কখনও আত্মসমর্পণ কোরো না ;
ক্রোধ, ঘৃণা আর যন্ত্রণার বানভাসি হয়ে ওঠো,
নিষ্ঠুরতার ভারি পাথরটাকে টুকরো করে ফেলে দাও।
তোমাদের উষ্ণ বুকের আলিঙ্গন
গর্বিত আর আত্মম্ভরী পুরুষদের প্রতিপালন করে ;
তোমাদের হাসিমুখই তো যোগায়
পুরুষের হৃদয়ে উদ্দীপনা আর বলিষ্ঠতা ।
যে লোকটাকে তোমরা সৃষ্টি করেছো,
তার অগ্রাধিকার ও শ্রেষ্ঠতা উপভোগ করা লজ্জাজনক ;
নারী, হস্তক্ষেপ করো কেননা এই জগত
অপেক্ষা করছে আর তোমার সুরে সুর মিলিয়েছে ।
অন্ধকার কবরে শোয়া তোমাদের আনন্দের ব্যাপার মনে হয়
এই শোচনীয় চাকরানিগিরি আর দুর্দশার তুলনায় ;
কোথায় সেই বীর্যবান পুরুষ…? তাকে বলো
তোমার চৌকাঠে যেন এবার থেকে মাথা নিচু করে ।
কোথায় সেই গর্বের কেশর ? তাকে বলো উঠে দাঁড়াতে
কেননা এখানে একজন নারী জেগে উঠেছে তার সঙ্গে লড়বে বলে ;
তার কথাগুলো হল সত্য, যে উদ্দেশ্যপূরণের জন্য
নারী কখনও দুর্বলতার অশ্রূ ঝরাবে না ।
বন্দি
তোমাকে চাই, তবু আমি জানি যে কখনও
আমি তোমাকে হৃদয়ের তৃপ্তির জন্য জড়িয়ে ধরতে পারব না ।
তুমি ওই পরিষ্কার আর উজ্বল আকাশ।
আমি, খাঁচার এই কোনে, এক বন্দি পাখি ।
শীতল আর কালো শিকের পেছন থেকে
আমার বিস্ময়ের ক্রুদ্ধ চাউনি তোমার দিকে লক্ষ্য করে,
আমি ভাবছি যে হয়তো একটা হাত আসবে
আর আমি সহসা তোমার উদ্দেশ্যে ডানা মেলতে পারবো ।
আমি ভাবছি কোনো এক অবহেলার মুহূর্তে
আমি এই নির্বাক কারাগার ছেড়ে উড়ে যেতে পারবো,
আমার কারারক্ষীর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারবো
আর তোমার পাশে নতুন জীবন আরম্ভ করতে পারবো ।
আমি এই ব্যাপারগুলো ভাবছি, তবু আমি জানি
আমি পারব না, এই কারাগার ছেড়ে পালাতে পারবো না ।
এমনকি কারারক্ষী চাইলেও পারব না,
আমর উড়ালের জন্য শ্বাস আর বাতাস আর নেই ।
শিকগুলোর পেছন থেকে, প্রতিটি উজ্বল সকালে
আমার দিকে তাকিয়ে এক শিশুর হাসি ভেসে ওঠে ;
যখন আমি আনন্দের গান গাওয়া আরম্ভ করি,
তার ঠোঁট আমার দিকে চুমুর জন্য এগিয়ে আসে ।
হে আকাশ, একদিন যদি আমি চাই
এই নিঃশব্দ কারাগার থেকে উড়ে যেতে
শিশুটির ফোঁপানো চোখেদের আমি কি বলব :
বলব কি, আমার কথা ভুলে যাও, আমি একটি বন্দি পাখি ?
আমি সেই মোমবাতি যা ধ্বংসাবশেষকে আলোকিত করে
তার নিজের হৃদয়কে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ।
যদি আমি নিঃশব্দ অন্ধকার বেছে নিই,
আমি একটি নীড়কে নষ্ট করে ফেলব ।
পাপ
আমি একটা পরমানন্দের পাপ করেছি,
এমন এক আলিঙ্গনে যা ছিল উষ্ণ আর আবেগভরা।
বাহুর ঘেরাটোপে আমি পাপ করলুম
তা ছিল তপ্ত আর শক্তিময় আর প্রতিকর্মের ফল ।
অন্ধকার আর নিঃশব্দ আড়ালে
আমি ওর নিগূঢ় চোখের দিকে তাকালুম ।
আমার বুকের মধ্যে হৃদয় অধৈর্যভাবে স্পন্দিত হল
ওর করণীয় চোখের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ।
ওই অন্ধকার আর নিঃশব্দ আড়ালে,
আমি আলুথালু ওর পাশে বসলুম ।
ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটে কামেচ্ছা উগরে দিলো,
আমি আমার উত্তেজিত হৃদয়ের দুঃখ কাটিয়ে উঠলুম।
আমি ওর কানে ভালোবাসার কাহিনি বললুম ফিসফিস করে :
আমি তোমাকে চাই, হে আমার জীবন,
আমি তোমাকে চাই, হে জীবনদায়ী আশ্লেষ
হে আমার উন্মাদ প্রেমিক, তুমি ।
চাহিদা ওর চোখ থেকে অনুরাগের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দিলো ;
পেয়ালায় নাচতে লাগলো লাল মদ ।
নরম বিছানায়, আমার শরীর
ওর বুকে মাতাল স্ফূরণ গড়ে ফেললো ।
আমি এক পরমানন্দের পাপ করেছি,
শিহরিত স্তম্ভিত আকারের নৈকট্যে
হে ঈশ্বর, কেই বা জানে আমি কি করেছি
ওই অন্ধকার আর নিঃশব্দ আড়ালে ।
বিয়ের বেড়ি
মেয়েটি হাসল আর বলল : এই সোনার
আঙটির রহস্য কি,
এই আঙটির রহস্য যা এমন এঁটে
বসে গেছে আমার আঙুলে,
এই আঙটির রহস্য
যা ঝিলমিল করছে আর এতো দ্যূতিময় ?
যুবক বেশ অবাক হল আর বলল :
এই আঙটি সৌভাগ্যের, জীবনের আঙটি ।
সবাই বলল : অভিনন্দন আর ভালো থেকো !
মেয়েটি বলল : হায়
আমার এখনও সন্দেহ আছে আঙটির এই মর্মার্থের ।
বহু বছর কেটে গেল, আর এক রাতে
এক হতোদ্যম মহিলা সোনার আঙটিটা দেখল
আর তার দ্যূতিময় নকশায় দেখতে পেল
স্বামীর বিশ্বস্ততার আশায় নষ্ট হওয়া দিনগুলো,
দিনের পর দিন একেবারে বরবাদ ।
মহিলাটি উত্তেজিত হয়ে কেঁদে বললেন :
হায়, এই আঙটি যা
এখনও ঝিলমিল করে আর দ্যূতিময় রয়েছে
তা ক্রীতদাসত্বের আর বাঁধনের বেড়ি ।
আমার বোনকে
বোন, তোমার স্বাধীনতার জন্য উঠে দাঁড়াও
এতো চুপচাপ কেন তুমি ?
উঠে দাঁড়াও কেননা এবার থেকে
স্বৈরাচারী পুরুষদের রক্তে নিজেকে ভেজাতে হবে ।
তোমার অধিকার দাবি করো, বোন,
যারা তোমাকে দুর্বল করে রেখেছে তাদের কাছ থেকে,
তাদের কাছ থেকে যারা অসংখ্য কৌশল আর ষড়যন্ত্রে
বাড়ির এক কোনে তোমাকে বসিয়ে রেখেছে।
আর কতোদিন আনন্দ দেবার জিনিস হয়ে থাকবে
পুরুষদের কামনার হারেমে ?
কতোদিন তোমার গর্বিত মাথা নত করবে তাদের পায়ে
তমসাকবলিত চাকরানির মতন ?
আর কতোদিন একগাল রুটির জন্য,
এক বুড়ো হাজির সাময়িক বউ হয়ে থাকবে,
দেখতে থাকবে দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী বউদের ।
শোষন আর নিষ্ঠুরতা, বোন আমার, আর কতো কাল ?
তোমার ক্রুদ্ধ গোঙানি
নিশ্চিত হয়ে উঠুক এক বিক্ষুব্ধ চিৎকার ।
এই শক্ত বাঁধন তোমাকে ছিঁড়তেই হবে
যাতে তোমার জীবন হয়ে ওঠে স্বাধীন ।
উঠে দাঁড়াও আর অত্যাচারকে মূল থেকে উপড়ে তোলো।
তোমার রক্তাক্ত হৃদয়কে আরাম দাও ।
তোমার স্বাধীনতার জন্য, সংগ্রাম করো
আইন বদলাবার জন্য, উঠে দাঁড়াও ।
No comments:
Post a Comment