Friday, June 28, 2019

আরনেসতো কারদেনাল-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

আরনেস্তো কারদেনাল-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

মেরিলিন মনরোর জন্য প্রার্থনা
প্রভু :
পৃথিবীতে মারিলিন মনরো নামে পরিচিত এই বালিকাটিকে গ্রহণ করুন
যদিও তা ওর প্রকৃত নাম নয়
( কিন্তু আপনি মেয়েটির প্রকৃত নাম জানেন : অনাথ মেয়ে ৯ বছর বয়সে ধর্ষিত 
দোকানের কর্মচারী মেয়ে যে ১৬ বছর বয়সে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল )
যে এখন আপনার সামনে নিজেকে তুলে ধরছে কোনো সাজগোজ না করে
কোনো কাগজের দালাল সঙ্গে নেই
কোনো ফোটোগ্রাফার নেই অটোগ্রাফ সইয়ের ব্যাপার নেই,
নভোচরের মতন একা রাত্রির মুখোমুখি যার নাম মহাকাশ ।
বালিকা হিসাবে, মেয়েটি গির্জায় নগ্ন থাকার স্বপ্ন দেখেছিল (  টাইম ম্যাগাজিন যেমন বলে )
সাষ্টাঙ্গ জনগণের সামনে, মেঝেতে মাথা পেতে,
আর ওকে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল যাতে তাদের মাথায় না পা রাখতে হয়।
মনোবিদদের চেয়ে ভালো আপনি এই স্বপ্নগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন ।
গির্জা, বাসা, গুহা হলো মায়ের বুকের মতন সুরক্ষিত
কিন্তু তার চেয়েও বেশি…
মাথাগুলো মেয়েটির ভক্ত, তা পরিষ্কার
( আলোর এক স্রোতের তলায় অন্ধকারে মাথার জমঘট )।
কিন্তু মন্দিরটা তো টোয়ান্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স স্টুডিও নয় ।
মন্দির -- শ্বেতপাথর আর সোনায় -- মেয়েটির দেহের মন্দির
যেখানে মানবপুত্র, চাবুক হাতে,
টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স ব্যাবসাদারদের তাড়ায় ।
যারা আপনার প্রার্থনার বাড়িকে চোরেদের গুহায় বদলে দিয়েছে।

প্রভু :
এই জগত কি পাপ আর বিকিরণে দূষিত,
আপনি দোকানের কর্মচারী মেয়েটিকে কেবল দোষ দিতে পারেন না
যে, আর সমস্ত দোকানের কর্মচারী মেয়েদের মতন, তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল।
আর ওর স্বপ্ন ছিল বাস্তব ( কিন্তু যেমন টেকনিকালারও বাস্তব )।
মেয়েটি কেবল আমাদের দেয়া স্ক্রিপ্ট অভিনয় করেছিল,
যা আমাদের নিজেদের জীবন, এক অদ্ভুত স্ক্রিপ্ট ।
মেয়েটিকে ক্ষমা করুন, প্রভু, আর আমাদের ক্ষমা করুন
আমাদের বিশ শতকের জন্য
বিশাল অতি-উৎপাদনের জন্য যাতে আমরা সবাই খেটেছি।
মেয়েটি ভালোবাসা পেতে চেয়েছিল আর আমরা দিয়েছি ঘুমের ওষুধ।
যে দুঃখের জন্য আমরা কেউই পবিত্র নই
মেয়েটিকে মনোবিদ দেখাবার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
মনে করুন প্রভু ক্যামেরা সম্পর্কে মেয়েটির বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আতঙ্ক
সাজগোজকে ঘৃণা, প্রতিটি দৃশ্যের জন্য তাকে নতুন করে তোলার জন্য দাবি
আর কেমন করে আতঙ্ক বেড়ে যেতে লাগলো
আর স্টুডিওতে অনেক দেরিতে পৌঁছোনো ।
দোকানের কর্মচারী মেয়েদেরর মতন
মেয়েটি তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল ।
আর মেয়েতির জীবন ছিল অবাস্তব, স্বপ্ন যা মনোবিদ ব্যাখ্যা করে আর নথি করে রাখে।
মেয়েটির রোমান্স ছিল দুই চোখ বন্ধ করে চুমু খাওয়া
কিন্তু তারপর চোখ খুলে যায়
আর আবিষ্কার করে প্রচুর আলো ওর দিকে মুখ করা
তারপর আলোগুলো অন্ধকার হয়ে যায় !
আর লোকেরা ঘরের দুটো দেয়াল ভেঙে ফ্যালে ( তা ছিল ফিল্মের সেট )
পরিচালক নিজের নোটবই নিয়ে চলে যান
কেননা দৃশ্যটা তোলা হয়ে গেছে ।
কিংবা প্রমোদভ্রমণের পোতে, সিঙ্গাপুরে একটা চুমু, রিওতে নাচ
উইন্ডসর প্রাসাদে ডিউক ও ডাচেসের অভ্যর্থনা
এক মর্মন্তুদ ফ্ল্যাটের ছোটো বৈঠকখানায় দেখা ।
শেষ চুমু ছাড়াই ফিল্মটি শেষ হয় ।
ওরা মেয়েটিকে তার বিচানায় মৃত পেলো, হাতে ফোন ।
আর গোয়েন্দারা জানতে পারেনি কাকে মেয়েটি ডাকছিল ।
তা ছিল
সেইরকম যে বন্ধু কন্ঠস্বরকে চেনে তাকে ফোন করতে চাইছিল
কেবল রেকর্ড করা কন্ঠস্বর শোনার জন্য যা বলবে : রং নাম্বার
কিংবা কারোর মতন, যে, ডাকাতদের দ্বারা ঘায়েল
তার ছেঁড়া ফোনের দিকে হাত বাড়ায় ।
প্রভু :
কাকে ডাকার চেষ্টা মেয়েটি করেছিল তাতে কিছুই আসে-যায় না
কিন্তু পারেনি ( আর হবতো তা কেউ ছিল না
কিংবা কেউ যার নাম্বার লস অ্যাঞ্জেলেস ফোনের বইতে নেই ।

আপনিই ফোনের জবাব দিন !

দক্ষিণের সমুদ্র
রাফায়েল হেলিওদোরো ভালে-র জন্য
তেইশে মার্চ আমি আকাপুলকো বন্দর থেকে যাত্রা করেছিলুম
আর শনিবার পর্যন্ত যাত্রাপথ নিয়ত রেখেছিলুম, চৌঠা এপ্রিল, যখন
ভোর হবার আধ ঘণ্টা আগে, আমরা চাঁদের আলোব দেখলুম
পাশাপাশি একটা জাহাজ এসেছে
যার পাল আর সামনে দিক রুপোর তৈরি ।
আমাদের কাণ্ডারী ওদের দিকে চেঁচিয়ে বলল দূরে থাকতে
কিন্তু কেউই উত্তর দিল না, যেন ওরা সবাই ঘুমোচ্ছিল ।
আবার আমরা হাঁক পাড়লুম : “কোথা থেকে তোদের জাহাজ আসছে ?”
আর ওরা বলল : পেরু !
তারপর আমরা ভেরীধ্বনি শুনলুম, আর বন্দুক চালাবার শব্দ,
আর ওরা আমাকে নির্দেশ দিলো ওদের জাহাজে যেতে
যেখানে ওদের ক্যাপ্টেন ছিল সেখানে ।
আমি দেখলুম উনি ডেকে পায়চারি করছেন,
ওনার কাছে গিয়ে, হাতে চুমু খেলুম আর উনি জিগ্যেস করলেন:
“ওই জাহাজে কতো রুপো আর সোনা আছে ?”
আমি বললুম, “কিছুই নেই,
কিচুই নেই, স্যার, কেবল আমার ডিশগুলো আর পেয়ালাগুলো।”
তখন উনি জিগ্যেস করলেন আমি ভাইসরয়কে চিনি কিনা ।
আমি বললুম, চিনি । আর ক্যাপ্টেনকে জিগ্যেস করলুম,
“উনি কি ক্যাপ্টেন ড্রেক নিজেই অন্য কেউ নন তো ?”
ক্যাপ্টেন জবাবে বললেন
“উনিই ক্যাপ্টেন ড্রেক যার বিষয়ে আমি বলছি।”
আমার অনেকক্ষণ কথা বললুম, রাতের ভোজনের সময় পর্যন্ত,
আর উনি নির্দেশ দিলেন আমি যেন ওনার পাশে বসি।
ওনার থালাগুলো রুপোর আর তারা কিনারায় সোনা
তাতে ওনার চিহ্ণ ।
স্ফটিকের শিশিতে ওনার রয়েছে বহু গন্ধদ্রব্য আর সুগন্ধী জল
যা, উনি বললেন, রানি ওনাকে দিয়েছেন ।
উনি সন্ধ্যা আর রাত্রির ভোজন সর্বদা বেহালার সঙ্গীতের সাথে সম্পন্ন করেন
আর নিজের সঙ্গে সর্বত্র চিত্রকরদের  নিয়ে যান যাঁরা আঁকতে থাকেন
তাঁর জন্য সমুদ্রতীরগুলো ।
উনি চব্বিশ বছর বয়সী, ছোটোখাটো, লাল দাড়ি ।
উনি হুয়ান অ্যাকুইনা, বিখ্যাত জলদস্যুর ভাগ্নে ।
আর উনি সমুদ্রের ওপরে যতো খ্যাতনামা নাবিক আছেন তার অন্যতম ।
পরের দিন, যা ছিল রবিবার, উনি অসাধারণ পোশাকে নিজেকে সুসজ্জিত করলেন 
আর ওদের দিয়ে পতাকা উত্তোলন করালেন
মাস্তুলের মাথায় ডুবুরি রঙের ছোটো পতাকা উড়িয়ে,
পেতলের আংটি, আর শেকল আর রেলিঙ আর
আলকাজারের আলো সোনার মতন জ্বলজ্বল করছিল ।
ওনার জাহাজ ছিল যেন শুশুকদের মাঝে সোনার ড্র্যাগন ।
আর উনি চলে এলেন, ওনার কাগজ নিয়ে, আমার অর্থ-ভাঁড়ার দেখতে ।
রাত্রির আগে পর্যন্ত সারা দিন আমার কি আছে তা দেখলেন
আমার থেকে যা নিলেন তা বিশেষ কিছু নয়,
আমার নিজের কিছু ছোটোখাটো জিনিস,
আর আমাকে দিলেন একটা ছোরা আর ওদের জন্য একটা রুপোর হাতল
আমায় অনুরোধ করলেন ওনাকে ক্ষমা করে দিতে
কেননা ওগুলো উনি ওনার মহিলার জন্য নিয়েছিলেন :
উনি আমাকে যেতে দেবেন, উনি বললেন, পরের দিন সকালে, বাতাস আরম্ভ হতেই ;
তার জন্য আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানালুম, আর ওনার হাতে চুমু খেলুম।
উনি নিয়ে যাচ্ছেন, ওনার জাহাজে, তিন হাজার রুপোর বাট
তিনটে ভাঁড়ার সোনায় ভরা
বারোটা ভাঁড়ার আটটা করে ভাগ করা :
আর উনি বললেন উনি চীনের উদ্দেশে যাত্রা করছেন
সামুদ্রিক মানচিত্র অনুসরণ করে একজন চীনা চালকের পরিচালনায় যাকে উনি বন্দী করেছেন…

নীল উড়োজাহাজের জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্য
            এক গোল ছোটো জানালায়, সবই নীল,
জমি নীলাভ, নীল-সবুজ, নীল
                               ( আর আকাশ )
              সবই নীল
নীল ঝিল আর জলাশয়
                    নীল আগ্নেয়গিরি
            অনেক দূরের জমিগুলো আরও নীল দেখায়
         নীল দ্বীপ নীল ঝিলের মাঝে ।
এটা মুক্ত করা দেশের মুখ।
আর যেখানে সব জনগণ যুদ্ধ করেছিল, আমার মনে হয় :
                                           ভালোবাসার জন্য !
শোষণের ঘৃণা ছাড়া
                             বাঁচবার জন্য ।
এক সুন্দর দেশে একে আরেককে ভালোবাসার জন্য
এতো সুন্দর, কেবল নিজেই নয়
                        কিন্তু তার অধিবাসীদের জন্য,
সবার ওপরে তার অধিবাসীদের জন্য ।
ঈশ্বর সেই জন্যে এই সুন্দর দেশ আমাদের দিয়েছেন
তার অন্তর্গত সমাজের জন্য ।
আর যে নীল জায়গাগুলোয় তারা লড়েছিল, যন্ত্রণা ভোগ করেছিল
                  এক ভালোবাসার সমাজের জন্য
                          এখানে এই দেশে ।

একটা নীল টুকরো অনেক বেশি গাঢ় দেখায়…
আর আমি ভাবলুম আমি সেখানে সব কয়টা লড়াইয়ের জায়গা দেখতে পাচ্ছি,
আর সমস্ত মৃত্যুর,
ওই ছোটো গোল জানালার কাচের পেছনে
                                      নীল
                              যতো রকমের নীল হয় ।
                                   

                   

No comments:

Post a Comment