Thursday, June 27, 2019

হোর্হে লুই বোর্হেস-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

হোর্হে লুই বোর্হেস-এর কবিতা (১৮৯৯ - ১৯৮৬) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী


বাইরের প্রাঙ্গণ

সন্ধ্যাবেলায়
ওরা বিষণ্ণ হয়ে যায়, প্রাঙ্গণের দুই বা তিনটি রঙ ।
আজ রাতে, চাঁদ, উজ্বল বৃত্ত,
পরিসরের ওপরে খবরদারি করতে পারে না ।
বাইরের প্রাঙ্গণ, আকাশের খাল ।
বাইরের প্রাঙ্গণ ঢালু 
হয়ে যায় যেখান দিয়ে আকাশ ঘরে ঢোকে ।
নির্মল,
অনন্তকাল নক্ষত্রদের চৌমাথায় অপেক্ষা করে ।
বন্ধুত্বময় অন্ধকারে থাকতে ভালো লাগে
প্রবেশপথে, কুঞ্জবন আর জলাধার ।

সরলতা
খুলে যায়, বাগানে যাবার গেট
একটা কাগজের পাতার নিরীহতা নিয়ে
যার সন্নিহিত আনুগত্য প্রশ্ন তোলে
আর ভেতরে, আমার দৃষ্টির
কোনো প্রয়োজন নেই বিশেষ বস্তু দেখবার
যা আগেই আছে, হুবহু, আমার স্মৃতিতে ।
আমি রীতিগুলো আর আত্মাদের
আর উপভাষার ইঙ্গিতগুলোকে
যা মানুষদের প্রতিটি সমাবেশ বুনে চলে ।
আমার বলবার কোনো দরকার হয় না
মিথ্যে সুবিধার দাবি পেশ করবারও;
যারা এখানে আমাকে ঘিরে থাকে তারা আমাকে ভালোভাবে চেনে,
ভালো করে জানে আমার পরিতাপ আর দুর্বলতার কথা ।
এটা সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য,
যা হয়তো স্বর্গ আমাদের দিতে রাজি হবে :
সমাদর কিংবা বিজয়প্রাপ্তি নয়
কিন্তু সরলভাবে গ্রহণ করে নে্য়া
অনস্বীকার্য বাস্তবতার অংশ হিসাবে,
পাথরদের আর গাছেদের মতো ।

সীমানা
এই পথগুলো যারা সূর্যাস্তকে গভীর করে তোলে,
একটা নিশ্চয়ই আছে ( কিন্তু কোনটা ) যাতে আমি হেঁটেছি
আগেই একবার, উদাসীনভাবে
আর তা না জেনে, সমর্পণ করেছি
একজনের কাছে যিনি অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন আইনের সীমা বাঁধেন
আর এক গোপন আর এক অনমনীয় মাপকাঠি
ছায়াদের, স্বপ্নের, আর আঙ্গিকের জন্য
যা এই জীবনের টানা ও পড়েনের কাজগুলো করে।
যদি সবকিছুরই একটা সীমা আর মূল্য থাকে
শেষ বারের জন্য এক বিস্মৃতির বেশি কিছু নয়
কেই বা এই বাড়িতে বলতে পারে কাকে
অজান্তে, আমরা জানিয়ে দিয়েছি বিদায় ?
ইতোমধ্যে ধূসর কাচের ভেতর দিয়ে রাত কমে যেতে থাকে
আর বইয়ের গাদার মধ্যে যা ছুঁড়ে দেয়
অনালোকিত টেবিলের ওপরে এক ভাঙা ছায়া,
তার মধ্যে একটা নিশ্চয়ই আছে যা কখনও পড়ব না ।
দক্ষিণে একটার বেশি ক্ষয়ে যাওয়া গেট আছে
তার গাঁথুনির কলসি আর কণ্টকী নাশপাতি নিয়ে
যেখানে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ
কেননা তা রয়েছে এক লিথোগ্রাফে ।
এক দরোজা আছে যা তুমি চিরকালের জন্য বন্ধ করেছো,
আর এক আয়না যা তোমার জন্য বৃথাই অপেক্ষা করে ;
আড়াআড়ি পথ তোমার মনে হয় তোমার জন্য প্রশস্ত খোলা
আর সেখানে এক চার-মুখো তোরণ-দেবতা নজর রাখে ।
তোমার স্মৃতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, এমন এক
যা এখন অপুরণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে ;
ওই কুয়োর কাছে যেতে তোমাকে দেখা যাবে না
শাদা সূর্য আর হলুদ চাঁদের নিচে ।
তোমার কন্ঠস্বর পুনরুদ্ধার করতে পারে না যা সেই ইরানি
তার পাখি আর গোলাপের জিভ ব্যবহার করে গেয়েছিল,
যখন সূর্যাস্তে, আলো যেমন যেমন ছড়িয়ে পড়ে,
তোমার ইচ্ছে করে অবিনাশী বিষয়ের কথা বলো ।
আর অবিশ্রান্ত রোন নদী আর ঝিল,
গতকালকের  ওপরে আমি আজ ঝুঁকে থাকি ?
ওরা হারিয়ে যাবে সেই কার্থেজের মতো
রোমানরা যেমন আগুন ও লবণে মুছেছিল।
ভোরবেলা মনে হয় শুনতে পাই এক করাল
কলনাদ বহু মানুষের যা পালিয়ে যায় দূরে ;
সবাই যারা আমাকে ভালোবেসেছে আর ভুলে গেছে;
স্হান, কাল আর বোর্হেস এখন আমায় ছেড়ে যাচ্ছে।

ব্লেক
কোথায় আপনার হাতে  গোলাপফুল থাকে
যা অবাধে অর্পণ করে, অজান্তে, অন্তরঙ্গ উপহার ?
রঙে নয়, কেননা ফুল তো অন্ধ,
মিষ্টি অফুরান সুগন্ধেও নয়,
পাপড়ির ওজনেও নয় । ও-ব্যাপারগুলো
হলো বিরল ও দূরবর্তী সব প্রতিধ্বনি ।
প্রকৃত গোলাপ আরও অধরা ।
হয়তো কোনো স্তম্ভ বা লড়াই
বা দেবদূতদের গগনপট, কিংবা এক অসীম
জগত, গোপন ও দরকারি,
কিংবা এক দেবতার আনন্দ যা আমরা দেখতে পাবো না
অথবা আরেক আকাশে রুপোর এক গ্রহ
কিংবা এক ভয়ঙ্কর আদিরূপ
যার গোলাপের আঙ্গিক নেই।

একটি গোলাপ এবং মিলটন
গোলাপদের বহু প্রজন্ম থেকে
কালের অতলে যা হারিয়ে গিয়েছে
একটিকে আমি বিস্মৃতি থেকে রক্ষা করতে চাই,
এক নিখুঁত গোলাপ, সবকিছুর মাঝে
যা কখনো ছিল । ভাগ্য অনুমতি দিয়েছে আমাকে
একবারের জন্য বেছে নেবার ক্ষমতা
সেই নিঃশব্দ ফুল, শেষ গোলাপ
যা মিলটনের নিজের হাতে ছিল ধৃত,
অদেখা । তা টকটকে লাল, কিংবা হলুদ
অথবা শাদা গোলাপ কোনো নষ্ট বাগানের,
তোমার অতীত তবু জাদুবলে রয়ে গেছে
চিরকালের জন্য উজ্বল এই কবিতায়,
সোনা, রক্ত, হস্তিদন্ত অথবা ছায়া
যেন তাঁর হাতে, অদৃশ্য গোলাপ ।

পাঠকেরা
সেই বীরব্রতী যার ফ্যাকাশে, শুকনো
আর নায়কোচিত চেহারা, ওরা অনুমাম করে
যে, এই চললেন বুঝি অ্যাডভেঞ্চারে,
নিজের গ্রন্থাগারের বাইরে উনি কখনও নৌকো ভাসাননি ।
ওনার আগ্রহের সংক্ষিপ্ত সালতামামি
আর তার বিয়োগাত্মক বিপর্যয়গুলো
স্বপ্নে দেখেছিলেন উনি, সেরভানতেস নয়,
ব্যাপারটা স্বপ্নের সালতামামির চেয়েও বড়ো ।
আমার অদৃষ্টও তেমনই । আমি জানি কিছু একটা আছে
অবিনশ্বর আর জরুরি যা আমি কবর দিয়েছি
অতীতের কোনো গ্রন্থাগারের কোথাও
যেখানে আমি বীরব্রতীর ইতিহাস পড়েছিলুম।
ধীর পাতাগুলো এক শিশুর কথা মনে পড়ায় যে গম্ভীরভাবে
অস্পষ্ট জিনিসের স্বপ্ন দেখে যা সে বুঝতে পারে না ।

ম্যানুয়েল ফ্লোরেসের জন্য এক মিলোঙ্গা নাচ

মরতে চলেছে ম্যানুয়েল ফ্লোরেস,
তা ‘টাকার জন্য’ ;
মারা যাওয়া একটা অভ্যাস
তা অনেকেই জানেন ।
তবুও আমি দুঃখ পাই
জীবিত কাউকে বিদায় বলতে,
ব্যাপারটা এতো পরিচিত,
এতো মিষ্টি আর বজায় থাকে ।
ভোরবেলা আমি নিজের হাতের দিকে তাকাই,
আমার হাতে শিরাগুলো রয়েছে ;
আমি তাকাই কিন্তু বুঝতে পারি না
যেন ওগুলো সব অপরিচিত ।
কালকে চারটে বুলেট আসবে, 
জ্ঞানী মানুষ মেরলিন অমনই বলেছিলেন :
মারা যাওয়া মানে সে জন্মেছিল ।
রাস্তায় কতো কিছু রয়েছে
এই দুটো চোখ তা দেখেছে !
যখন যিশু আমার বিচার করেছেন
কে জানে ওরা কি দেখতে পাবে ।
ম্যানুয়েল ফ্লোরেস মরতে চলেছে
তা ‘টাকার জন্য’;
মারা যাওয়া একটা অভ্যাস
তা অনেকেই জানেন ।

নিউ ইংল্যাণ্ড ১৯৬৭
আমার স্বপ্নে আঙ্গিকগুলো বদলে গিয়েছে ;
এখন সেখানে পাশাপাশি লাল রঙের বাড়ি
আর পাতাগুলোর নরম পেতল
আর শুদ্ধ শীত আর পবিত্র বনানী ।
যেমন সপ্তম দিনে, জগতসংসার
ভালো থাকে । সেখানে গোধুলীতে বজায় থাকে
যার অস্তিত্ব প্রায় নেই, সাহস, দুঃখ,
বাইবেলের প্রাচীন এক কলনাদ, যুদ্ধ ।
শিগগিরি ( সবাই বলছে ) প্রথম তুষারপাত হবে
প্রতিটি রাস্তায় আমেরিকা আমার জন্য অপেক্ষা করে,
কিন্তু সন্ধ্যার অবসানে আমি অনুভব করি
আজকের দিনটা বড়ো দীর্ঘ, আর গতকাল ছিল ছোটো ।
বুয়েনস এয়ারিস, আমি বেড়াতে যাই
তোমার রাস্তায়, কোনো সময় আর যুক্তি ছাড়াই ।

আত্মহত্যা

একটা তারাও থাকবে না রাতের বেলায় ।
রাত নিজেই তো থাকবে না ।
আমি মারা যাবো আর আমার সঙ্গে 
সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অসহ্য সমষ্টি ।
আমি পিরামিডগুলো মুছে ফেলবো, পয়সাকড়িও,
উপমহাদেশগুলো আর সমস্ত মুখ ।
আমি মুছে ফেলবো একত্রিত অতীত ।
আমি ইতিহাসকে ধুলোয় পরিণত করব, ধুলোর ধুলো ।
এখন আমি শেষ সূর্যাস্তের দিকে তাকাই।
আমি শুনছি শেষ পাখিটাকে ।
আমি কাউকে শূন্যতা উপহার দিয়ে যাচ্ছি না ।

জিনিসপত্র
আমার হাঁটবার ছড়ি, পয়সাকড়ি, চাবির গোছা,
নিরীহ তালা আর বিলম্বিত লেখালিখি
যে কয়টা দিন বেঁচে আছে তা দেবে না
পড়ে ওঠার সময়, তাসগুলো, টেবিল.
একটা বই, তার পাতায়, চেপ্টে-যাওয়া
বেগুনি ফুল, দুপুরের অবশিষ্টাংশ
যা নিঃসন্দেহে ভোলবার নয়, ভুলে গেছি,
রক্তবর্ণ আয়না পশ্চিমের দিকে মুখ করে
যেখানে ভ্রমাত্মক ভোর জ্বলছে । অনেক জিনিস,
ফাইল, চৌকাঠ, মানচিত্র, মদের গেলাস, পেরেক,
যা আমাদের কাজে লাগে, মুখবোজা ক্রীতদাসের মতন,
কতো অন্ধ আর কতো রহস্যময়ভাবে গোপন !
আমাদের বিদায় নেবার পরও তারা বহুদিন থাকবে ;
আর জানবে না যে আমরা চলে গেছি ।
পাপিয়া পাখিকে
কোন গোপন রাতে ইংল্যাণ্ডে
কিংবা ধারণাতীত নিয়ত রাইন নদীর তীরে,
আমার রাতগুলোর সব রাতের মাঝে হারিয়ে যাওয়া,
আমার অজ্ঞ কানে পৌঁছে দিলো
তোমার কন্ঠস্বর, কিংবদন্তিতে ভারাক্রান্ত,
ভারজিলের পাপিয়া, নাকি পারস্যদের ?
বোধহয় আমি কখনও তোমায় শুনিনি, তবু আমার জীবন
আমি তোমার জীবনে বেঁধেছি, অঙ্গাঙ্গিভাবে ।
তোমার প্রতীক এক পর্যটনকারী আত্মা
হেঁয়ালির এক বইতে । এল মেরিনো
তোমার নাম দিয়েছিলেন বনানীর কুহকিনী
আর তুমি জুলিয়েটকে সারা রাত গান শোনাও
আর জটিল লাতিন পৃষ্ঠাগুলোয়
আর অপরের সেই পাইন-গাছ থেকে,
জার্মানি আর জুডিয়ার পাপিয়া পাখি,
হাইনে, ঠাট্টা করে, জ্বলেপুড়ে, শোকে ।
কিটস সবায়ের জন্য তোমায় শুনেছিলেন, সব জায়গায় ।
এমন একটিও উজ্বল নাম নেই যা 
পৃথিবীর লোক তোমাকে দেয়নি
তাতে তোমার সঙ্গীতের সমকক্ষ হবার আকুলতা নেই, 
ছায়াদের পাপিয়া । মুসলমান লোকটি
স্বপ্ন দেখেছিল তুমি ভাবাবেশে মাতাল
তার বুক কাঁটায় এফোঁড়-ওফোঁড়
গীত গোলাপের যাকে তুমি লাল করে তোলো
তোমার শেষ রক্ত দিয়ে । এভাবেই
গোধুলীর শূন্যতায় আমি এই পংক্তিগুলো লিখি,
সমুদ্রতীর আর সাগরের পাপিয়া পাখি,
যে উল্লাস, স্মৃতি আর উপকথায়
ভালোবাসায় পোড়ে আর সঙ্গীতময়তায় মারা যায় ।


চাঁদ

ওই সোনায় কতো নিঃসঙ্গতা আছে ।
এই রাতগুলোর চাঁদ সেই চাঁদ নয় যা 
প্রথম আদম দেখেছিল । বহু শতক যাবত
মানুষের দৃষ্টি মেয়েটিকে ভরে তুলেছে
পুরোনো এক বিলাপে । দ্যাখো । মেয়েটি তোমার আয়না ।

মনস্তাপ
আমি সবচেয়ে খারাপ পাপগুলো করেছি
যা একজন করতে পারে । আমি হতে পারনি
সুখি । বিস্মৃতির হিমবাহগুলো আমাকে
নিয়ে নিক আর গিলে ফেলুক, নির্দয়ভাবে ।
আমার মা-বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন
জীবনের বিপজ্জনক আর সুন্দর খেলার জন্য, 
পৃথিবী, জল, বাতাস আর আগুনের জন্য ।
আমি ওনাদের ইচ্ছে পুরো করিনি, আমি সুখি নই ।
আমার জন্য তাঁদের যৌবনের আশা পুরো হয়নি।
আমি আমার মনকে শিল্পের সুসামঞ্জস্যের
তর্কে প্রয়োগ করলুম, তার নগণ্য তন্তুজালে ।
তাঁরা চেয়েছিলেন আমি সাহসী হই । আমি সাহসী হইনি।
তা আমাকে কখনও ছেড়ে যায় না । সদাসর্বদা আমার পাশে
একজন বিষণ্ণ মানুষের ছায়া ।

No comments:

Post a Comment