Sunday, May 19, 2019

পল এলুয়ার-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

 

পল এলুয়ার-এর কবিতা ( ১৮৯৫ - ১৯৫২ )

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

অনুপস্হিতি

শহরগুলোর ওপর দিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলি
সমতলভূমির ওপর দিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলি
তোমার কানে আমার মুখ
দেয়ালের দুই দিক পরস্পরকে দ্যাখে
আমার কন্ঠস্বর তোমাকে স্বীকার করে ।
আমি তোমার সঙ্গে অনন্তকালের কথা বলি ।
হে শহরেরা শহরের স্মৃতিরা
আমাদের আকাঙ্খায় মোড়া শহরেরা
প্রথমদিকের শহর আর পরের দিকের
শক্তিমান শহর অন্তরঙ্গ শহর
তাদের প্রস্তুতকারকদের মুছে ফেলা হয়েছে
তাদের চিন্তাবিদদের তাদের মায়াপুরুষদের
পান্না রাজত্ব করতো চারভূমিতে
বাঁচে বেঁচে থাকে চিরকাল বাঁচে
আমাদের পৃথিবীতে আকাশের গমক্ষেত
আমার কন্ঠস্বরকে সুস্হ রাখে আমি স্বপ্ন দেখি আর কাঁদি
আমি শিখার মাঝে হাসি আর স্বপ্ন দেখি
রোদের জমায়েতের মাঝে
আর আমার দেহ ও তোমার দেহের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে
পরিষ্কার আয়নার পরত ।

সহজ
সহজ আর সুন্দর
তোমার চোখের পাতার তলায়
আনন্দের মিলনে
নাচে আর অন্যেরা
আমি জ্বরের কথা বললুম
আগুনের সবচেয়ে ভালো কারণ
যে তুমি হয়তো ফ্যাকাশে আর উজ্বল
হাজার ফলদায়ী অঙ্গভঙ্গী
হাজার বিধ্বস্ত আলিঙ্গন
তাদের মুছে ফেলার জন্য বারবার সরে যায়
তুমি অন্ধকার হয়ে যাও তুমি পোশাক খুলে ফ্যালো
একটা মুখোশ তুমি
নিয়ন্ত্রণ করো
আমি অবিকল তোমার মতন দেখতে
আর তুমি যেন কিছুই নয় বরং সুন্দরী নগ্নিকা
ছায়ায় নগ্ন আর ঝিকমিকে নগ্ন
বিদ্যুতের ঝলকে শিহরিত আকাশের মতন
তুমি তোমার কাছে মেলে ধরো
সবায়ের কাছে মেলে ধরার জন্য

ক্ষমতা ও প্রেম সম্পর্কে কথাবার্তা
আমার যন্ত্রণার মাঝে মৃত্যু ও নিজের মাঝে
আমার বিষাদের মাঝে আর বেঁচে থাকার যুক্তির মাঝে
রয়েছে অবিচার আর এই মানুষদের শয়তানি
আমি মেনে নিতে পারি না যে আমার ক্রোধ আছে
সেখানে রয়েছে স্পেনের রক্তরঙা যোদ্ধারা
সেখানে রয়েছে গ্রিসের আকাশরঙা যোদ্ধারা
রুটি রক্ত আকাশ আর আশার অধিকার
যে নিরীহরা শয়তানিকে ঘৃণা করে
আলো সব সময়ে মৃত্যুর কাছাকাছি
জীবন সব সময়ে মাটি হবার জন্য তৈরি
কিন্তু বস্তকাল আবার জন্মায় যা শেষ হয় না
অন্ধকার থেকে একটা কুঁড়ি ওঠে আর উষ্ণতা স্হিরতা পায়
আর উষ্ণতা পাবে একলষেঁড়ের অধিকার
তাদের ক্ষয়িষ্ণু সংবেদন প্রতিরোধ করবে না
আমি শুনতে পাই শীতলতা সম্পর্কে আগুন ঠাট্টা করছে
আমি শুনতে পাই একটা লোক যা জানে না সেই বিষয়ে কথা বলছে
তুমি যে ছিলে আমার মাংসের সুবেদী বিবেক
তুমি যাকে আমি চিরকাল ভালোবাসি আমায় গড়ে তুলেছো
তুমি শোষণ আর আঘাত মেনে নেবে না
তুমি পার্থিব আনন্দের স্বপ্নে গান গাইবে
তুমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখবে আর আমি তোমাকে চিরকাল ধরে রাখব

প্রিয়তমা
যুবতীটি আমার চোখের পাতায় দাঁড়িয়ে আছে
আর ওর চুল জড়িয়ে আছে আমার চুলে,
ওর আঙ্গিক আমার হাতের মতন
ওর গায়ের রঙ আমার চোখের মতন
আমার ছায়া ওকে গিলে ফ্যালে
আকাশে ছোঁড়া পাথরের মতন ।
ওর চোখ সবসময়ে খোলা
আর আমাকে ঘুমোতে দেয় না ।
প্রকাশয় দিনের বেলায় ওর স্বপ্নেরা
সূর্যকে বাষ্পে পরিণত করে
আমাকে হাসায়, কাঁদায় আর হাসায়,
কিছু বলার না থাকলেও কথা বলে ।

ম্যাক্স অ্যার্ন
এক কোণে তৎপর ব্যভিচার
ছোট্ট পোশাকের কুমারীত্ব ঘুরিয়ে দ্যাখে
এক কোণে আকাশকে ছেড়ে দ্যায়
ঝড়ের শিরদাঁড়ায় শাদা বল ছেড়ে দ্যায় ।
এক কোণে চোখেদের ঔজ্বল্য
বিষাদের মাছের জন্য কেউ অপেক্ষা করে ।
এক কোণে গ্রীষ্মের সবুজের তৈরি মোটরগাড়ি
চিরকালের জন্য গৌরবে গতিহীন ।
যৌবনের আলোকচ্ছটায়
বড়ো দেরিতে বাতি জ্বালানো হয়েছে
প্রথম যুবতী স্তন দেখায় যা লাল পোকাদের মেরে ফ্যালে ।

অনুবর্তিতা
বাতাসে আনন্দময় দিনের দীপ্তিশীলতার জন্য
সহজে রঙের স্বাদ নেবার খাতিরে বেঁচে থাকা
ভালোবাসা উপভোগের খাতিরে হাসাহাসি
চরম মুহূর্তে চোখ মেলে ধরা
যুবতীটি সব কিছুতেই রাজি

আচ্ছন্নতা
বহু বছরের জ্ঞানের পর
যখন পৃথিবী ছুঁচের মতন স্বচ্ছ ছিল
তা কি অন্য কিছুর জন্য শীতল হয়ে উঠছিল ?
ফেরত-দেয়া অনুগ্রহ অপচয়িত ঈশ্বর্য নিয়ে কাড়াকাড়ির পর
লাল ঠোঁটের চেয়েও লাল ঠোঁট
আর শাদা পায়ের চেয়েও শাদা পায়ের পাতা
তাহলে আমরা কি ভাবি যে কোথায় আমরা আছি ?

আমাদের কাছেই
উদ্ধারপ্রাপ্তির উদ্দেশে দৌড়োন দৌড়োতে থাকুন
খুঁজুন আর যা পান জড়ো করুন
উদ্ধারপ্রাপ্তি আর সোনাদানা
এতো দ্রুত দৌড়োন যাতে সুতো ছিঁড়ে যায়
এক বিশাল পাখি যে শব্দে ডাকে তাই দিয়ে
একটা পতাকা সদাসর্বদা নাগালের বাইরে উড়তে থাকে

খোলা দরোজা
জীবন সত্যিই দয়ালু
আমার কাছে এসো, আমি যদি তোমার কাছে যাই তা হবে খেলা,
ফুলের তোড়ার দেবদূতরা ফুলেদের রঙ বদলাবার উপহার দেয় ।

তাৎক্ষণিক জীবন
তোমার কি হয়েছে কেন এই শাদা চুল আর গোলপি
কেন এরকম কপাল এই চোখ দু-আধখানা হৃদয়বিদারক
মৌলিক তেজষ্ক্রিয়ের বিয়ের বিশাল ভুলবোঝাবুঝি
বদ্ধমূল শত্রুতা নিয়ে নিঃসঙ্গতা আমাকে তাড়া করে ।

মনোরম আর জীবনের মতন
দিনের শেষে এক মুখাবয়ব
দিনের শুকনো পাতার মাঝে এক দোলনা
নগ্ন বৃষ্টির ফুলের তোড়া
সূর্যের প্রতিটি রশ্মি লুকোনো
জলের গভীরতায় প্রতিটি ঝর্ণার ভেতর ঝর্ণা
আয়নার প্রতিটি আয়না ভাঙা
স্তব্ধতার তুলাদণ্ডে একটি মুখ
অন্য পাথরগুলোর মাঝে একটা পাথর
পাতাগুলোর জন্য দিনের  শেষ আলো
ভুলে যাওয়া মুখগুলোর মতন একটি মুখ

ভালোবাসাদের ঋতু
পথগুলোর রাস্তায়
ব্যহত ঘুমের তিনচতুর্থাংশ ছায়ায়
আমি তোমার কাছে আসি দুই-হয়ে অজস্র হয়ে
যেমন তোমার মতন যেমন ত্রিকোণাকারের যুগ ।
তোমার মাথা আমার মতনই ক্ষুদে
কাছের সমুদ্র বসন্তঋতুর সঙ্গে রাজত্ব করে
তোমার অপলকা কাঠামোর ওপরের গ্রীষ্মে
আর এখানে লোকে তাড়াবেঁধে বেঁজিদের পোড়ায় ।
ভবঘুরে স্বচ্ছতায়
তোমার বৈভবী মুখশ্রীর
এই ভাসমান জানিয়ারগুলো বিস্ময়কর
আমি ওদের সারল্য ওদের অনভিজ্ঞতাকে ঈর্ষা করি
জলের বিছানায় তোমার অনভিজ্ঞতা
নত না হয়েও ভালোবাসার পথ খুঁজে পায়
পথগুলোর রাস্তায়
আর রক্ষাকবচ ছাড়াই যা ফাঁস করে দ্যায়
নারীদের ভিড়ে তোমার হাসি
আর কেউই তোমার চোখের জল চায় না ।

আমার দেহের ইন্দ্রিয়গুলোয় আমার চোখ যতোটা দেখতে পারে

যাবতীয় গাছপালা তাদের সমস্ত শাখা তাদের সব কয়টা পাতা
পাথরের গোড়ায় ঘাস আর সারিবদ্ধ বাড়িগুলো
বহু দূরে সমুদ্র যাকে তোমার চোখ স্নান করায়
দিনের পর দিন এইসব চিত্রকল্প
খুঁত আর সততা এতো ত্রুটিপূর্ণ
হঠাৎই তাদের পাশ দিয়ে যাওয়া লোকেদের স্বচ্ছতা
আর তোমার মার্জিত একগুয়েঁমির শ্বাস-প্রসূত নারীদের চলে যাওয়া
কুমারী ঠোঁটে তোমার সীসা হৃদয়ের আচ্ছন্নতা
খুঁত আর সততা এতো ত্রুটিপূর্ণ
তোমার চোখ দিয়ে জেতা দৃষ্টির মতন অনুমতি
দেহের ক্লান্তির কামনার বিভ্রম
শব্দ ঢঙ ধারণার নকল
খুঁত আর সততা এতো ত্রুটিপূর্ণ
ভালোবাসা হলো মানুষ অসম্পূর্ণ

সবেমাত্র বিকৃত
বিদায় ত্রিসতেসে
হ্যালো ত্রিসতেসে
বিদায় দুঃখ
হ্যালো দুঃখ
ছাদের পংক্তিতে তোমরা লিখিত
যে চোখ আমি ভালোবাসি তাতে তোমরা লিখিত
তুমি দারিদ্র্য নও মোটেই
কেননা সবচেয়ে গরিব ঠোঁটেরা তোমাকে বর্জন করেছে
আহ মৃদু হাসি হেসে
হ্যালো ত্রিসতেসে
দয়ালু দেহের প্রেম
ভালোবাসার ক্ষমতা
যা থেকে দয়ার জন্ম হয়
দেহহীন রাক্ষসের মতন
লটকানো মাথা
দুঃখ সুন্দর মুখশ্রী ।

এক নতুন রাতে
যা নারীদের সঙ্গে বসবাস করেছি
যে নারীর সঙ্গে বসবাস করি
যে নারীর সঙ্গে বসবাস করব
সব সময় একই
তোমার একটা লাল আলখাল্লা দরকার
লাল দস্তানা একটা লাল মুখোশ
আর উরু পর্যন্ত কালো মোজা
কারণগুলো প্রমাণগুলো
তোমাকে নগ্ন দেখা
নগ্নতা বিশুদ্ধ ও তৈরি সূক্ষমতা
আমার হৃদয়ের দুই স্তন

ফলপ্রসূ দুই চোখ
ফলপ্রসূ দুই চোখ
আর কেউ আমাকে বেশি জানতে পারবে না
তুমি যা জানো তার চেয়ে বেশি
তোমার চোখ যার ভেতরে আমরা ঘুমোই
ওরা দুজন
আমার পুরুষ গোলকদের সন্মোহিত করেছে
জাগতিক রাতের চেয়ে বেশি
তোমার চোখ যার ভেতর আমি সমুদ্রযাত্রায় বেরোই
পথনির্দেশ দিয়েছে
পৃথিবী থেকে আলাদা-করা নির্দেশাবলী
তোমার দুই চোখে সেগুলো যা আমাদের দেখায়
আমাদের অনন্তকালীন নিঃসঙ্গতা
তারা যার উপস্হিতি ভাবে তার বেশি কিছু নয়
আর কেউ আমাকে বেশি জানতে পারে না
যতোটা তুমি জানো ।

আমি তোমাকে বলেছি
আমি তোমাকে এ-কথা মেঘের জন্য বলেছি
আমি তোমাকে এ-কথা সমুদ্রের গাছের জন্য বলেছি
প্রতিটি ঢেউয়ের জন্য পাতায় পাখিদের জন্য
শব্দের নুড়ির জন্য
পরিচিত হাতের জন্য
চোখের জন্য যা সমতলভূমি বা মুখ হয়ে যায়
আর ঘুম ফিরে আসে স্বর্গে তার রঙে
কেননা রাত যা পান করেছে
পথের জালের জন্য
খোলা জানালার জন্য ফাঁকা কপালের জন্য
আমি তোমাকে এ-কথা বলেছি তোমার চিন্তার জন্য তোমার শব্দের জন্য
প্রতিটি আদর প্রতিটি আস্হা টিকে থাকে ।

এটা পুরুষদের মিষ্টি নিয়ম

এটা পুরুষদের মিষ্টি নিয়ম
ওরা আঙুর থেকে মদ তৈরি করে
ওরা কয়লা থেকে আগুন তৈরি করে
ওরা চুমু থেকে পুরুষদের তৈরি করে
এটা পুরুষদের সত্যিকার নিয়ম
টিকিয়ে রাখা হয়েছে
দুর্দশা আর যুদ্ধ সত্বেও
মৃত্যুর বিপদ সত্বেও
এটা পুরুষদের উষ্ণ নিয়ম
জলকে আলোয় বদলে দেয়া
স্বপ্নকে বাস্তবে
শত্রুদের বন্ধুতে
পুরোনো আর নতুন এক নিয়ম
যা নিজেকে নিখুঁত করে তোলে
শিশুর হৃদয়ের গভীরতা থেকে
যুক্তির উচ্চতায় নিয়ে যায় ।

তোমার চোখেদের ডৌল
তোমার চোখেদের ডৌল আমার হৃদয়কে জড়িয়ে ধরে
মিষ্টতা আর নাচের বৃত্ত
সময়ের জ্যোতির্মণ্ডলী, নিশ্চিত নিশির দোলনা,
আর আমি যে সমস্তের মধ্যে বেঁচেছি তা যদি না জানি
তা এই জন্য যে তোমার চোখদুটো চিরকাল আমার ছিল না ।
দিনের পাতারা আর শিশিরের শ্যাওলা,
মৃদু বাতাসের বাঁশি, সুগন্ধিত হাসি,
ডানায় ঢাকা আলোর জগৎ,
আকাশ আর সমুদ্রে বোঝাই নৌকো,
শব্দের শিকারি আর রঙের উৎস
ভোরের তিতির ঝাঁকে ভরা সুগন্ধ
নক্ষত্রের মাদুরের ওপরে চিরকালের বিছানা,
দিন যেমন নিরীহের ওপর নির্ভর করে
সমগ্র পৃথিবী তোমার বিশুদ্ধ চোখের ওপর নির্ভর করে
আর তাদের দৃষ্টিতে বয়ে যায় আমার রক্ত ।

মুক্তি
স্কুলের সময়ের আমার খাতার ওপর
আমার টেবিলের ওপর আর গাছেতে
বালির ওপরে তুষারে
আমি তোমার নাম লিখি
যতো পৃষ্ঠা পড়েছি তাতে
প্রতিটি শাদা কাগজে
পাথর রক্ত কাগজ বা ছাই
আমি তোমার নাম লিখি
সোনালি প্রতিমার ওপরে
সেনার অস্ত্রের ওপরে
রাজাদের মুকুটের ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
জঙ্গলে আর মরুভূমিতে
পাখির বাসায় আর ঝোপঝাড়ে
শৈশবের প্রতিধ্বনিতে
আমি তোমার নাম লিখি
রাতের বিস্ময়ের ওপরে
দিনের শাদা রুটিতে
প্রতিশ্রুত ঋতুতে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার সব কয়টা নীল কম্বলে
পুকুরে ছাতাপড়া সূর্যে
ঝিলে বসবাসের চাঁদে
আমি তোমার নাম লিখি
দিগন্তের মাঠের ওপরে
পাখিদের ডানায়
ছায়াদের হাওয়াকলে
আমি তোমার নাম লিখি
ভোরের প্রতিটি শ্বাসে
সমুদ্রে জাহাজে
অস্হিরচিত্ত পাহাড়ে
আমি তোমার নাম লিখি
মেঘেদের ফেনার ওপরে
ঝড়ের ঘামের ওপরে
কালো স্বাদহীন বৃষ্টির ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
ঝকমকে আঙ্গিকের ওপরে
রঙের ঘণ্টার ওপরে
ভৌতিক সত্যের ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
জাগিয়ে-তোলা পথের ওপরে
খুলে-দেয়া রাস্তায়
ছড়ানো জায়গায়
আমি তোমার নাম লিখি
যে লন্ঠন আলো দেয় তার ওপরে
যে লন্ঠন ডুবে গেছে তার ওপরে
আমার পুনর্মিলিত বাড়িতে
আমি তোমার নাম লিখি
অর্ধেক কাটা ফলের ওপরে
আমার আয়নায় আর ঘরে
আমার বিছানার ফাঁকা খোলোশে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার লোভী নরম কুকুরের ওপরে
তার শোনবার কানের ওপরে
তার অদ্ভুত থাবার ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার দরোজার চৌকাঠের পায়ায়
পরিচিত জিনিসের ওপরে
আগুনের পবিত্র স্রোতের ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
সুরে বাঁধা সমস্ত মাংসের ওপরে
আমার বন্ধুদের ভ্রূর ওপরে
প্রতিটি প্রসারিত হাতের ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
আশ্চর্য হবার গেলাসে
যে ঠোঁট মনোনিবেশ করে তার ওপরে
স্তব্ধতার শীর্ষে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার বিধ্বস্ত আশ্রয়ে
আমার ভেঙেপড়া লাইটহাউসের ওপরে
আমার অবসাদের দেয়ালে
আমি তোমার নাম লিখি
আবেগহীন অনুপস্হিতির ওপরে
নগ্ন নিঃসঙ্গতার ওপরে
মৃত্যুর কুচকাওয়াজের ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
ফিরে-পাওয়া স্বাস্হ্যের ওপরে
যে বিপদ কেটে গেছে তার ওপরে
স্মৃতিহীন আশার ওপরে
আমি তোমার নাম লিখি
শব্দের ক্ষমতাবলে
আমি জীবন ফিরে পাই
আমি জন্মেছিলুম তোমাকে জানার জন্য
আর তোমার নামকরণ করার জন্য
মুক্তি

শান্তির বৃত্ত

আমি উদাসীনতার দরোজা দিয়ে গেছি
আমার তিক্ততার দরোজা দিয়ে
ফিরে এসে তোমার ঠোঁটে চুমু খাবার জন্য
শহর কোনঠাসা হয়ে গেছে ঘরে
যেখানে শয়তানির অদ্ভুত জোয়ার
ছেড়ে যায় আশ্বস্ত করার ফেনা
শান্তির বৃত্ত আমার কেবল তুমি আছো
তুমি আমায় আবার শেখাও তা ঠিক কি
মানুষ হয়ে ওঠা যখন আমি দাবি ত্যাগ করি
একথা জানার জন্য যে সগোত্র-প্রাণীদের সঙ্গে আমি আছি তো

ভাবাবেশ
আমি মেয়েলি জমির সামনে রয়েছি
যেন আগুনের সামনে একটা বাচ্চা
চোখে জল নিয়ে অস্পষ্টভাবে হাসছি
এই জমির সামনে যেখানে সবকিছু আমার মধ্যে নড়াচড়া করে
যেখানে আয়নায় কুয়াশা হয় যেখানে আয়না পরিষ্কার হয়
ঋতুর পর ঋতু দুটো উলঙ্গ দেহকে প্রতিবিম্বিত করে
নিজেকে হারিয়ে ফেলার কতো কারণ আমার রয়েছে
এই পথহীন পৃথিবীতে দিগন্তহীন আকাশের তলায়
কালকে আমি সুযুক্তিগুলোকে অস্বীকার করেছি
আর আমি কখনও ভুলব না
চাউনির ভালো চাবিগুলো নিজেদের মেয়েদের চাবি লাগায়
এই জমির সামনে যেখানে প্রকৃতি আমার নিজস্ব
আগুনের প্রথম আগুনের সামনে
ভালো রক্ষিতা যুক্তিযুক্ততা
চিহ্ণিত নক্ষত্র
আমার হৃদয়ের ভেতরে আর বাইরে আকাশের নীচে পৃথিবীতে
দ্বিতীয় কুঁড়ি প্রথম সবুজ পাতা
যাকে সমুদ্র পাল দিয়ে ঢেকে রাখে
আর শেষ পর্যন্ত সূর্য আমাদের কাছে আসছে
আমি এই মেয়েলি জমির সামনে রয়েছি
আগুনের ভেতরে শাখার মতন

আমাদের জীবন
আমরা এক এক করে লক্ষ্যে পৌঁছোবো না কিন্তু জুটিতে
আমরা জানি জুটিতে আমরা নিজেদের বিষয়ে সবকিছু জানবো
আমরা সবকিছু ভালোবাসবো আমাদের সন্তানরা হাসবে
অন্ধকার ইতিহাসে কিংবা একা শোকপালন করবে

অব্যাহত কবিতা
সমুদ্র থেকে উৎসে
পাহাড় থেকে সমতলভূমিতে
জীবনের মায়াপুরুষ ধাবিত হয়
মৃত্যুর ক্লেদাক্ত ছায়া
আমাদের মধ্যে
আকুল মাংসের এক ভোর জন্মায়
আর যথাযথ শুভ
যা পৃথিবীতে শৃঙ্খলা বজায় রাখে
আমরা শান্ত পায়ে এগোই
আর প্রকৃতি আমাদের সেলাম জানায়
দিক আমাদের রঙে রঙিন হয়
আমাদের চোখে আগুন সমুদ্র আমাদের মিলন
আর প্রতিটি জীবন্ত আমাদের মতন দেখতে
আর প্রতিটি জীবন্তকে আমরা ভালোবাসি
কাল্পনিক অন্যান্য
ভুল আর তাদের জন্মের দ্বারা সংজ্ঞায়িত
কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংঘর্ষ করতে হবে
ওরা ছোরার ঘা খেয়ে বেঁচে থাকে
ওরা ভাঙা চেয়ারের মতন কথা বলে
আনন্দে ওদের ঠোঁট কাঁপে
সীসার ঘণ্টার প্রতিধ্বনি শুনে
আর কালো সোনার মৌনতা
একাকী হৃদয় তো হৃদয় নয়
একাকী হৃদয় প্রতিটি হৃদয়
আর দেহগুলো প্রতিটি নক্ষত্র
নক্ষত্রভরা আকাশে
গতিশীল কাজকর্মে
আলোয় আর চাউনিতে
পৃথিবীতে আমাদের ওজন উজ্বল হয়ে ওঠে
আকাঙ্খার ঝিলমিল
মানবতীরের গান গাওয়া
তোমার জন্য যে বেঁচে আমি ভালোবাসি
আর সবায়ের জন্য যাদের আমরা ভালোবাসি
যাদের ভালোবাসা ছাড়া অন্য চাহিদা নেই
রাস্তাটা বন্ধ করে আমি সত্যিই শেষ করব
বাধ্যতামূলক স্বপ্নে ভাসমান
আমি নিজেকে আবিষ্কার করে সত্যিই শেষ করব
আমরা পৃথিবীর দখল নেবো

                                                                   

No comments:

Post a Comment