Tuesday, May 14, 2019

ত্রিস্তঁ করবিয়ে

ত্রিস্তঁ করবিয়ে-র কবিতা

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
অনিদ্রা
অনিদ্রা, স্পর্শাতীত জানোয়ার !
তোমার মগজে  তাকে ভালোবাসো ?
তোমার অবসন্নতা দেখতে আসার জন্য,
তোমার শয়তানি চোখের তলায়, মানুষের কামড়
ওর চাদর, আর অবসাদের মোচড় !...
তোমার চোখের নীচে কালো হীরকখণ্ড ।

বলো কেন, ঘুমহীন রাতে
বৃষ্টিময় রবিবারের মতন
কুকুরের মতন আমাদের চাটো :
তার আগে দুঃখপ্রকাশ কিংবা আশা ।
আমাদের উৎকর্ণ কানে
কথা বলতে চাও….আর কিছুই বলো না ?

কেন আমাদের গলা
তোমার ফাঁকা পেয়ালার অপেক্ষায় থাকে
আর আমাদের রেখে যায় গলা-বাড়ানো অবস্হায়
গ্রিক পুরাণের খলনায়ক ট্যান্টালুম, ঠাণ্ডা মাংস, অসার :
প্রেমের মলম নাকি তেতো তলানি
তাজা শিশির নাকি তপ্ত সীসা ! -

অনিদ্রা, তুমি কি অতো সুন্দরী ?...
আর কেন, বোধহীন অক্ষতযোনি,
তোমার জঙ্ঘার ভেতরে জড়িয়ে ধরি ?
কেন কুকুরীর মতন করো আমাদের মুখের চারিপাশে,
কেন আমাদের দাবা-কলম ভেঙে দাও
আর...আমাদের সঙ্গে শোও না ?

কেন, রাতের কুমারী অসুদ্ধ,
তোমার মুখে এই কালো মুখোশ ?...
সোনালি স্বপ্নদের অবৈধপ্রেমে ফাঁসানোর জন্য ?...
তুমি কি শূন্যে ভালোবাসো না
ছিনাল মেসালিনার ক্লান্ত নিঃশ্বাস
কিন্তু প্রশংসায় তৃপ্ত হওনা !

অনিদ্রা, তুমি কি মৃগিরোগ….
তুমি কি চোঙার বাজনা
যা খ্রিস্টের স্বর্গে যাওয়ার উঞ্ছবৃত্তি করে ?...
কিংবা তুমি কি বীণার তার তোলার শাশ্বত হস্তিদন্ত
স্নায়ুতে অধঃপতনের চিঠি
কেবল তারা যা পড়েছে তাদেরই দিব্য কবিতা ।

অনিদ্রা, তুমি ব্যথার সময়ের গাধা
খিদে আর তেষ্টার মাঝে আটক কিংবা পোকার
নরক ?-- তুমি আগুনের চুমু
তপ্ত লোহার শীতল স্বাদ রেখে যাও…
ওহ ! আমার চলিষ্ণুতায় তোমাকে রেখে দিলুম !...
আমরা সবাই একটু ঘুমোবো ।

রাতের প্যারিস
এ এক শহর নয়, এ হলো জগতসংসার
--    সমুদ্র : শবশান্ত -- জোয়ার নিজেকে বাধ্য মনে করেছে,
দূরের গুরুগুরু আওয়াজে, তার উথাল ফিরিয়ে নেবার কথা ।
এর ঢেউয়েরা ফেরত আসবে, নিজেদের শব্দে গড়িয়ে গড়িয়ে ---
-- তুমি কি রাতের কাঁকড়াদের দাড়া-ঘষার শব্দ শুনতে পাচ্ছো...

-- এ হলো শুকনো অন্ধকারজগতের নদী : হাড়গিলে ছেঁড়াজামা ডায়োজেনেস,
হাতে লন্ঠন, এর মধ্যে নেমে ঘুরছে ; ও কখনও শরীর মোচড়ায় না
কিন্তু এর কালো নর্দমায় কলুষিত কবিরা আনন্দে
নিজেদের পংক্তি ভাসায়, তাদের ফাঁকা মগজের পোকাগুলোকে ।

--- এ হলো গমের ক্ষেত : বীভৎস আধানারী পাখিরা পাক-খেয়ে ছোঁ-মেরে নামে
তার ওপর যা অশুদ্ধ, জমে যাওয়া পুঁজে ঝকমকে ন্যাকড়াকানি ।
গলির বিড়াল, ইঁদুর ধরার ধান্দায়,  দলবেঁধে পালায়
পাঁকের বাচ্চারা, রাতের কাঁকর-ঘষটানির ফসল-কাটিয়েরা ।

-- মৃত্যুতে : এখানে পুলিশ যৌনতায় মাতে -- আর প্রেম, ওপরতলায়,
দুপুরের ঘুম দিয়ে, ভারি বাহুর মাংস চোষে
যেখানে পুরোনো প্রেম-কামড়ের কালশিটে -- প্রেম তো দুজনের জন্য --
সময় তো নিঃসঙ্গ -- শোনো : … স্বপ্ন পা হেঁচড়ায়….

--- এর জীবন : শোনো : হাওয়ায় জন্য বসন্তঋতুর জল,
চিরকালের গান গাইছে, মনে হয় তা পিছলে যাচ্ছে
সমুদ্রদেবতার চটচটে মাথায়, আর তার খোলা প্রসারিত
সবুজ অঙ্গ লাশকাটা ঘরের বিছানায়...দু’চোখ খোলা !

বুকে-হাঁটা ব্যাঙ
বাতাসহীন রাতে কিছু গান…
চাঁদ টিনের পাতে স্পষ্ট আর ঝলমলে
বিষণ্ণ শ্যামলিমার কাট-আউট ।

….কিছু গান ; প্রতিধ্বনির মতন মারা যায়,
জীবন্ত গোরদেয়া গুরুভারে পড়ে থাকে…
--সমাপ্ত : ওইখানে ছায়ায়, দ্যাখো...

--একটা বুকে-হাঁটা ব্যাঙ -- কেনই বা এই ভয়
আমাকে, তুমি বুড়ো বিশ্বস্ত জিনিস ?
দ্যাখো : এক লোমছাঁটা কবি, ডানা নেই,
কাদাখোঁচা পাখি… --শুনতে বিরক্তিকর !

...তা গান গায়...বিরক্তিকর !! - বিরক্তিকর, কেন ?
ওর চোখের উজ্বল চাউনি কি দেখতে পাও না ?...
না : চলে গেছে, ঠাণ্ডা, নিজের পাথুরে ফাটলে ।
…………………………………………
শুভরাত্রি -- ওই ব্যাঙটা আমিই । শুভরাত্রি ।

এপিটাফ
ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীর আরম্ভ-করা আর শেষ-করা 
যা আরম্ভ করতে চায় শেষ হবার পর কতো কিছু রয়েছে 
যা শুরু দিয়ে শেষ হয় যা শুরু আরম্ভ হয় শেষ হতে চেয়ে 
শেষটা শেষটা যা হবে ভালোবাসার পাত্রপাত্রীর আর অন্যান্যদের 
শেষ করে আবার আরম্ভকে শুরু করতে চাইবে আরম্ভ দিয়ে 
যা শেষ হবে কিন্তু শেচ ফিরে যাবে যা আরম্ভ হবে 
অনন্তকালের সমান হয়ে যার কোনো প্রয়োজন নেই আর 
শুরুও নেই আর শেষ হবে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর পাক খাওয়ার  
যেখানে তুমি শেষ হবে পার্থক্যহীন যেখানে শেষ আরম্ভ হয় 
যেখানে শেষ হয়েছিল যা সবকিছুর আরম্ভের সবকিছু শেষ 
যার সমান সমস্ত শেষের সমস্ত আরম্ভ যা অনন্তের চূড়ান্ত আরম্ভ 
সজ্ঞায়িত করা যায় না তার দ্বারা সজ্ঞায়িত --- 
একটি এপিটাফের সমান একটি ভূমিকার সমান এবং তদ্বিপরিত
( রাষ্ট্রদের পাণ্ডিত্য )
ও নিজেকে উৎসাহে খুন করল, কিংবা আলস্যে মারা গেল।
বেঁচে থাকলে, ভুলে যাওয়াদের মাধ্যমে ; ও আমাদের জন্য এটা রেখে গেছে :
---ওর একটা অনুশোচনা যে ওনার রক্ষিতা হতে পারেনি ।--
ও এই দিক বা ওই দিক থেকে জন্মায়নি,
সব সময়ে বাতাস দিয়ে তাড়িত হতো শেষের দিকে,
এবং ছিল থালায়-এঁটো ঝোলের মিশেল,
সব রকম প্রবণতার ব্যভিচারী ভেজাল
জে-ই-সিস-কুইয়ের । কিন্তু কোথায় তা জানা নেই ;
সোনার, -- সঙ্গে এক কপর্দকও নেই ;
স্নায়ুর, -- দুর্বল । প্রাণশক্তি বড়ো খাটায় ;
অনুপ্রেরণার, -- মোচড়ের ব্যথা জাগায় ;
আত্মার, -- ওর বেহালা নেই ;
প্রেমের, -- কিন্তু সবচেয়ে বাজে পুংঘোড়া ;
---মুখভরা নাম, কোনও খ্যাতি নেই ।--
আদর্শের পেছনে দৌড়েছে, -- ধারণাহীন ;
নিখুট ছন্দ, -- অথচ একটি ছন্দের কাছেও নয় ;
কখনও ছিল না, -- ও ফিরে আসবে ;
ও সব সময়ে নিজেকে ভিনরাস্তায় পেয়েছে ।
কবি, ওর কবিতা সত্বেও ;
শল্পহীন শিল্পী, -- উলোটানো,
ভাবুক, -- প্রথমে জা জেনেই ।
সত্যকার এক মজার আত্মা, -- আত্মা ছাড়াই ।
অভিনেতা, যে তার ভূমিকা জানতো না ;
ছবি-আঁকিয়ে : ব্যাগপাইপ বাজাতো ;
আর সঙ্গীতকার : রঙের প্যালেট হাতে ।
একজন রসিক !--কেবল গর্ব যা স্বীকৃতি পায়নি ;
এমন মাথা-খারাপ যে এলেবেলে হতে পারেনি ;
জগতকেও দুটো বলে ভুল করেছে ।
--ওর নকল পংক্তিই ছিল ওর প্রকৃত সত্য ।
এক বিরল পাখি -- আর জঞ্জালে গড়া ;
বড়োই পুরুষালি...আর কখনওবা বেশ্যার মতন;
সবকিছু করার যোগ্য, -- কোনো কাজের নয় ;
ভালোভাবেই খারাপ --- খারাপ ভালো জিনিস ।
এক উড়নচণ্ডী সেই বাচ্চার মতো যে খরচ করেছে
বাইবেল কিনতে, -- কোনো সদিচ্ছা ছাড়াই ।
সাহসী, আর প্রায়ই, ঘুষিতে ছিটকে পড়ার ভয়,
ও পা এগিয়ে দিয়েছিল, তারপর চিৎপাত ।
রাগি রঙকরিয়ে, -- কিন্তু ফ্যাকাশে ভুত ;
ভুল বুঝেছে…---সবচেয়ে বেশি নিজের দ্বারা ;
ও কেঁদেছে, নিখুঁত ভুল গেয়েছে ;
---কোনো দোষ ছাড়াই ছিল একজন দোষী ।
কেউকেটা ছিল না, বা কোনোকিছু ছিল না
যেমন ওর সত্যকার অহং ওকে তুলে ধরতো।
কোনো ভঙ্গি নেই, -- একজনের ভঙ্গি করি ;
বড়োই কাঁচা, আর একই সঙ্গে বিশ্বনিন্দুক ;
বিশ্বাস নিয়ে কথা বলে না, খুবই বিশ্বস্ত ।
-- ওর রুচি ছিল অরুচিকরদের জন্য ।
বড়ি বেশি তরতাজা, --- নিজেকে নষ্ট করে ফেলেছে,
চেহারার মতন আর কিছু ছিল না, অবিচলিত থেকেছে,
নিজের মগজে বিষাদ নিয়ে খেলেছে,
যতক্ষণ না তা ওকে বিছানায় জাগিয়ে তুলেছে।
সমুদ্রে ভবঘুরে, -- যে ভেসে চলেছে,
এক ধ্বংসাবশেষ কখনও পৌঁছোয় না…
একা দাঁড়াবার জন্য বড়ো অহং
শুকনো আত্মা, মগজ অধ্যাত্মে মাতাল,
করা হয়ে গেছে, কিছু করিয়ে নিতে পারে না,
কাটিয়ে ওঠার আশায় ও মারা গেছে
আর বেঁচে রইলো, এগিয়ে যাবার আশায় ।
এখানে শুয়ে, -- হৃদয়হীন এক হৃদয়, অস্হানে রাখা,
অতীব সফল, -- হেরে যাওয়ায় ।

সময়
প্যাম্পলোনা থেকে, আমি সেই উন্মাদ
      ধড়িবাজ চাঁদের হাসির ভয়ে কাৎ
জগত-ব্যথার ব্যাণ্ডেজে যা ফুরোবার নয়…
      কেননা -- হে আতঙ্ক ! -- সবকিছুই কাচের বয়ামের তলায়

ক্ষুধার্ত ভিখারির চেয়েও বেশি ভিক্ষা করেছি
      আর আমার কদর্য রাজকন্যাকে বড্ডো মনে পড়ে
আর ধড়িবাজ চাঁদের হাসিতে ভয় পেয়ে,
      শিকারকে পাবার জন্য যে হিংস্র শিকারী ক্ষুধার্ত থাকে,
যে বিপদ শেষ হবে না তার চোখরাঙানিতে
      কেননা সব আতঙ্কই দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিচু নয়
তা আত্মপ্রকাশ  করে
    সেই কারাগারে যা নকল বাস্তব ।
        
ঘুমের প্রার্থনাসঙ্গীত
ঘুম, সেই মাঝরাতের আলোপতঙ্গ অন্ধকারে ওড়ে, 
বন্ধুত্বহীন ডানা ঝাপটানিতে, চৌকাঠে তোমাকে ছেড়ে চলে যায়, 
একা, তার চোখের পাতাহীন উৎরাই-পাত্রে ।


অমঙ্গলকারী প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য
পুরোনো হাড়ের বালুকা -- সমুদ্র টানে
মরণশ্বাস : তার স্ফীতি ফেটে পড়ে, ধ্বনির ওপরে ধ্বনি…

-- রাতে কাটিয়ে ওঠার জন্য, চাঁদ ছাঁকি-জাল ফ্যালে
ফ্যাকাশে জলাভূমিতে, গিলে খায় মোটামোটা পোকা ।

-- প্লেগরোগের শান্তি, জ্বরের ইঁটভাটা..
অভিশপ্ত আলেয়া হতাশায় মনমরা ।
-- পূতিগন্ধময় ঘাসের ভেতর দিয়ে লিলি-কলজের
খরগোশের মতন মায়াবি উধাও হয়ে যাচ্ছে…

--শ্বেতাঙ্গিনী ধোপানি মেলে দিচ্ছে
মৃতের নোংরা কাপড়
নেকড়ে সূর্যের তলায়….--স্কুলগুলো

বুকেহাঁটা ব্যাঙদের, ছোটো, দুঃখি
যাজকেরা, তাদের শূলবেদনার থলে হাতে
ব্যাঙের ছাতায় বিষ মাখাচ্ছে, তাদের বিষ্ঠা ।

প্রতিবন্ধকের ওইপারে বুনো অক্ষতযোনি জুলমার স্মৃতিতে এবং এক লুই

মেয়েটির ছিল যৌবনের কুড়িটি সোনালি বছর !
ছিল কুড়ি টাকার যৌবন ।
আর আমরা তা একই থলেতে ভরে নিলুম,
দুজনের যুগ্মকাজে নিবেশ করলুম
এক অবিশ্বস্ত রাতে ।
চাঁদ তাতে একটা ফুটো করে দিলো,
পয়সার মতন গোলাকার,
যার ভেতর দিয়ে আমাদের ভাগ্য গলে পড়ে গেল…
কুড়ি বছর ! কুড়ি টাকা ! -- আর চাঁদ !
খুচরো পয়সা, হায়, ওই কুড়িটা টাকা ।
আর খুচরো পয়সা, তাও, ওই কুড়িটা বছর !
আর ফুটোর ভেতরে ফুটো করে দিলো চাঁদ
একটা যুগ্ম নিবেশের পর আরেকটায়…
---তা ছিল যেন যুগ্মভাগ্য………………………
আমি ওকে আবার খুঁজে পেলুম -- বহু বসন্তঋতুতে,
বহু কুড়ি বছর, বউ কুড়ি টাকা,
বহু ফুটো আর বহু চাঁদ---
তবু অক্ষতযোনি, তবু কেবল কুড়ি বছর
এবং-- বিপ্লবী শাসনতন্ত্রের একজন কর্নেল……………….
আর পরে : পথচারিদের ধাওয়া করেছে
কুড়ি পয়সার জন্য, এখন আর কুড়ি টাকা নেই…
আর পরবর্তীকালে : এক যৌথ কবর,
স্বাধীন রাতে চাঁদের ফোটো আর নেই

বিপরীত কবি
আরমোরিকার সাগরতীরে । একটি নির্জন মঠ ।
ভেতরে : বাতাস অভিযোগ করছিল : আরেকটা হাওয়াকল ।
এলাকার সমস্ত গাধা বীজসুদ্ধ আইভিলতায় তাদের দাঁত ঘষতে এসেছিল
ফুটোয় ভরা এমনই এক দেয়াল থেকে যা কোনও জীবন্ত মানুষ
দরোজার ভেতর দিয়ে ঢোকেনি।

একা--- তবু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, ভরসাম্য বজায় রেখে,
একজন বুড়ির থুতনির মতন ঢেউখালানো
তার ছাদ কানের পাশে চোট দিয়েছিল,
হাবাগবা মানুযের মতন হাঁ করে, মিনারটা দাঁড়িয়েছিল ।




No comments:

Post a Comment