Wednesday, May 29, 2019

পল ভালেরি-র কবিতা ( ১৮৭১ - ১৯৪৫ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী




পল ভালেরি’র কবিতা ( ১৮৭১ - ১৯৪৫ )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
       
তন্বীপরী
অদেখা অজানা,
আমি সুগন্ধ
বাতাসের ওপরে জন্মেছি,
ফভাকাশে, বেঁচে আছি !
অদেখা অজানা,
প্রতিভা না সৌভাগ্য ?
যখনই এসে পড়ো
কাজ হয়ে যায় !
অপঠিত অনুপলব্ধ,
সর্বশ্রেষ্ঠ মন
সেখানে হোঁচট খাবে !
অদেখা অজানা,
বুকের উঁকি
ঢিলে পোশাকের ফাঁক দিয়ে !

ভুল মৃত্যু

হৃতমান, অভিমানী, চমৎকার সমাধির গায়ে,
           অননুভূত স্মৃতিসৌধ
যা ছায়ার বাইরে, পাতঝোপে, প্রেমোৎসর্গ করেছিল
           তোমার বিষণ্ণ মাধুর্য জাদুবিস্তার করেছে
আমি পড়ি যাই, মারা যাচ্ছি তোমার পাশে, মারা যাচ্ছি -- তবু,
নীচু কবরে পড়ে যেতেই
যার বাগানে ছড়ানো ছাই আমায় ডাক দেয়,
তার প্রতীয়মান মৃত্যুতে জীবন আরেকবার জেগে ওঠে ;
মেয়েটি স্পন্দিত হয়, আলতো চোখ মেলে ধরে, আর কামড়ায়,
আর আমার বুক থেকে অন্যান্য মৃত্যুকে মোচড় দিয়ে বের করে
জীবনের চেয়ে মূল্যবান ।

হারিয়ে যাওয়া মদ
একদিন আমি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিলুম
( মনে নেই কেমন আকাশের তলায় )
শূন্যতায় উৎসর্গ করার মতন,
দামি মদের যতোটা বাকি ছিল তার পুরোটা…
কে তোমার ক্ষতির নির্দেশ দিয়েছিল, হে সুরাসার ?
স্বর্গ কি আমার হাতকে প্ররোচিত করেছিল ?
হয়তো আমার হৃদয়ের আচ্ছন্নতা,
রক্তের স্বপ্ন দেখে, মদ চলকে ফেলেছিল ?
কিছুক্ষণের জন্য গোলাপি উদ্গীরণ হয়েছিল
ধোঁয়ার, আর তারপর সমুদ্র হয়ে উঠল
স্বচ্ছ, যেমন আগে থেকে ছিল…
মদ হারিয়ে গেল...ঢেউগুলো মাতাল !
আমি দেখতে পেলুম অস্বাভাবিক আকৃতিরা
তিক্ত বাতাসে লাফিয়ে উঠছে...

মৌমাছি
তোমার হুল যতোই ধারালো হোক,
যতোই মারাত্মক, হলুদ মৌমাছি,
আমার ডালাকে ঢেকে রেখেছি
ভাসমান লেসের সহজ স্বপ্ন দিয়ে ।
অতএব ফোলা লাউয়ে হুল ফোটাও, আমার বুক
প্রেম যেখানে ঘুমিয়ে আছে, কিংবা মারা গেছে।
আমার আমি যৎসামান্য উঠে যাবে
লাল থেকে ফোলা, দ্রোহী মাংস !
এক আচমকা যন্ত্রণা হল যা আমার প্রয়োজন :
এক যন্ত্রণা যা দ্রুত ঘটে আর মিলিয়ে যায়
আমি চাইবো এই তন্দ্রাময় দুঃখ ।
আমার ইন্দ্রিয়দের দীপ্তিময় করে তুলবো
তোমার সূক্ষ্ম সোনালি সঙ্কেত দিয়ে
যাকে বাদ দিলে প্রেম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় বা মারা যায় !

কৌশলী ইঙ্গিত
ওহ বাঁক যা সর্পিল
গোপন মিথ্যার মতো।
শ্লথতা নয় তা
কি কোমলতম শিল্প ?
আমি জানি কোথায় যাচ্ছি,
তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো,
আমার কালো অভিসন্ধিগুলো
তোমার ক্ষতি করবে না…
( যদিও মেয়েটি হাসে
ঝলমলে গর্বে,
অতো স্বাধীনতা
মাথা খারাপ করে দ্যায় ! )
ওহ বাঁক যা সর্পিল
গোপন মিথ্যার মতো,
আমি তোমায় অপেক্ষা করাবো
কোমলতম শব্দের খাতিরে ।

কোমরবন্ধ
যখন, গালের মতো রক্তিম হয়, আকাশ
শেষ পর্যন্ত চোখের শ্রদ্ধাকে স্বীকৃতি দ্যায়
এবং সময়, সোনালি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে
গোলাপের মাঝে কিছুক্ষণ খেলা করে,
এক ছায়া, ঢিলে কোমরবন্ধ পরে, নাচে
আহ্লাদের নিরবতার মাঝে
অমন ছবি যে প্রেরণা দিয়েছে,
সন্ধ্যা মেয়েটির হেমসেলাইতে টান দিয়েছে।
কোমরবন্ধ, সরল ভেসে চলেছে
বাতাসের শ্বাসের ওঠা-নামায়,
একক সূত্রকে পেঁচিয়ে
যা এই পৃথিবীর সঙ্গে আমার নৈঃশব্দকে বাঁধে ।
অনুপস্হিতি, উপস্হিতি...আমি সত্যিই
ছায়ায় একা, মৃতের চাদরকে লোভ দেখাই ।

সমুদ্রের ধারের গোরস্তান       
“খুঁজো না, আমার আত্মা, অবিনশ্বরদের জীবন;
বরং যা আয়ত্তে তার সমস্ত উপাদানের
আনন্দ নিন” ( পিনডার, ফিথিকস ।।। )
১.
পাইনের ওপর দিয়ে এই মনোরম ছাদ স্পন্দিত হয়
পায়রারা পাল ভাসিয়ে দেয় স্মৃতিমন্দিরের ওই পারে ;   
তখন উদাসীন দুপুর সমুদ্রকে আগুনের সঙ্গে রাংঝালে জুড়ে দ্যায় :       
সমুদ্রের পুনরারম্ভ চিরকাল হবে
কিংবা এক চিন্তার পর ক্ষতিপূরণ দেবে আর আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে
যা পাবার জন্য দেবতারা দীর্ঘ শান্তিময় দৃষ্টি মেলে ধরেন।
সূক্ষভাবে বোনা বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ যা উপভোগ করতে পারে
ক্ষণজীবী ফেনায় অজস্র হীরক,   
আর কোন আপাতশান্তি তা এনে দিতে পারে !   
যখন, গভীর ও গভীরের ওপরে, এক সূর্য থমকে দাঁড়াতে পারে   
তার শাশ্বত কর্তব্যের বিশুদ্ধ কাজে,
সময় ঝলমল করে আর চাহিদা হলো জানার ।
মিনার্ভার স্মৃতিমন্দির, ঐশ্বর্য, সরল নিশ্চয়,   
শান্তির বিস্তার, দেখা যায়, অটল,
ঢেউখেলানো জল । চোখ যা নিজেই ধরে রাখতে পারে
আগুনের ঘোমটার তলায় বহুক্ষণের ঘুম
হে আমার নৈঃশব্দ !...আত্মার কাঠামোয় গড়া,
কিন্তু আকরিকে ঠাশা, সহস্র সোনার পাত ।
আমি সময়ের মন্দির থেকে এক একক দীর্ঘশ্বাস, আরম্ভ করি
বিশুদ্ধতার চূড়ায় পৌঁছোতে আর নিজের ঐক্যবিধানে
ঘিরে-থাকা সমুদ্রের সমগ্র বীথি ;
আর দেবতাদের প্রতি আমার সরাসরি উৎসর্গ
উচ্চতায় শান্তিময় স্ফূলিঙ্গের বীজ বপন করে
যেখানে সর্বময় কর্তৃত্ব সুযোগ করে দ্যায় অবজ্ঞার ।
ফলের মতন, স্বাদ নিলে, আহ্লাদের বিগলিত হয়,
কামড়ের সাথে-সাথে সৃষ্টি করে অনুপস্হিতি,
যখন তার আঙ্গিক ঠোঁটের ওপরে মারা যাচ্ছে,
আমি এখানে ধোঁয়ায় আমার ভবিষ্যতের গন্ধ পাই
কন্ঠরুদ্ধ আত্মাকে যখন ধূসর আকাশ গান শোনায়
নিঃশব্দে কাঁদতে-থাকা স্পন্দিত সমুদ্রতীরে বদল ঘটিয়ে ।
সুন্দর স্বর্গ এবং সত্য, দ্যাখো আমি কেমন বদলে যাই !
অমন গর্বের পরে, যা অতো অদ্ভুত তার পরে,
এক আলস্য অথচ তবু ক্ষমতায় ভরপুর,
অমন পরম শূন্যতায় যেমন আমি পরিত্যক্ত,
মৃতদের বাড়ির ওপরে আমার ছায়া অনুসরণ করতে পারে
এক পথ যা আমায় পোষমানায় যেখানে আমি গিলে ফেলতে পারি ।
আত্মা উত্তরায়ণের আগুনে মেলে ধরে,
আমি তোমাকে সমর্ধন করি, প্রশংসনীয় বিচার
আর তোমার মমতাহীন ছুরির ঔজ্বল্যকে !
বিশুদ্ধ, আমি তোমাকে তোমার প্রাথমিক জায়গায় ফিরিয়ে দিই
নিজের দিকে তাকাও !... কিন্তু অনুমতি দাও আলোকে খুঁজে নেবার
অর্থেক ছায়া তার দুর্বল আড়ালে ।
ও আমার ভেতরে ছাড়াও আমার থেকে আর তারপর,
আমি, কবিতার উৎসে, এর নিশ্চিত হৃদয়,
শূন্যতা ও ঘটনার মাঝে কতো বিশুদ্ধ,
আমার অন্তর্গত খ্যাতির অপেক্ষায় থাকে,
তা প্রতিধ্বনির হৃদ যা, লজ্জায় কর্কশ,
ভবিষ্যতের আত্মায় ফাঁকা মনে হয় !৯
তুমি কি, এই বনানীর নকল বন্দী, জানো
কেমন করে এই সরু ডালগুলো বাইরের ঔজ্বল্যকে গিলে খায়,
কেমন কে গোপনীয়তা আমার বন্ধ চোখ দিয়ে ঝলমল করে ।
কোন ক্ষমতা আমার প্রলম্বিত শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়,
হাড়ের টুকরো পৃথিবীতে তাকে ঝোঁকাতে পারবে ?
একটা স্ফূলিঙ্গ আমাকে ভাবাতে পারে কি হারিয়েছি ।
১০
আগুন গুরুত্বহীন, পবিত্র ও ঘেরাটোপে,
পার্থিব টুকরো আলোয় উন্মুক্ত,
মশাল দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, এই জায়গাটা আমাকে আনন্দ দেয়,
সোনায় গড়া, পাথরের তৈরি আর ছায়াময় বনমাঝে,
যেখানে বহু ছায়ারঙে শ্বেতপাথর কাঁপে ;
আর সেখানে, আমার সমাধিগুলোর ওপরে, ঘুমন্ত, বিনীত সমুদ্র !

No comments:

Post a Comment