Sunday, May 12, 2019

জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো : ইল্যুমিনেশানস



জঁ আর্তুর র‌্যাঁবো : ইল্যুমিনেশানস
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
বানভাসির পর
ইল্যুমিনেশান ১
বানভাসির ধারনা শেষ হবার পরই, একটা খোরগোশ গোরুর গোয়ালে 
আর দুলতেথাকা ফুলগাছের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে, মাকড়সার জালের 
ভেতর দিয়ে রামধনুকে প্রার্থনা শোনালো।
ওহ ! যে দামি পাথরগুলো লুকিয়ে রেখেছিল, -- 
ফুলগুলো নিজেদের চারিধারে তাকিয়ে দেখছিল। 
নোংরা রাজপথে দোকান বসেছিল, তারা নৌকোগুলোকে 
টেনে নিয়ে গেল পরতে-পরতে ফুলে ওঠা সমুদ্রের ঢেউয়ে 
ঠিক যেমন পুরোনো ছবিগুলোতে দেখা যায় ।
যে নীলদাড়ি লোকটা নিজের বউগুলোকে 
একের পর এক মেরে ফেলতো, তার বাড়িতে রক্ত বইতে লাগল
 --- সারকাসের কসাইখানায়  ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা শাদা করে তুলছিল 
জানালাগুলোকে। রক্ত আর দুধ বইছিল ।
ভোঁদোড়েরা গড়েছিল । শুঁড়িখানায় কফির পেয়ালায় উঠছিল ধোঁয়া ।
চারাগাছের বিশাল কাচঘরে জলফোঁটা ঝরছিল তখনও, 
সুন্দর ছবিগুলোর দিকে চেয়েছিল শোকাতুর শিশুরা ।
দরোজার পাল্লার আওয়াজ, আর, গ্রামের সবুজে, 
এক খোকা দুই হাত নাড়ালো, বেগবান ঝর্ণার তলায়, 
সব জায়গাকার ঘণ্টাঘরের হাওয়ামোরগ আর আবহাওয়া 
নির্দেশকগুলো তা টের পাচ্ছিল।
ম্যাডাম অমুক আল্পস পাহাড়ে একটা পিয়ানো বসালেন । 
গির্জার একশো হাজার বেদির ওপরে উদযাপন করা হচ্ছিল
 খ্রিস্টের নৈশভোজনোৎসব-পর্ব আর প্রথম ধর্মসংস্কার ।
চলে গেল মরুযাত্রীদল । আর বরফ ও মেরুরাত্রির বিশৃঙ্খলায় 
তৈরি করা হলো  দীপ্তিশীল হোটেল।
তারপর থেকে, সুগন্ধগুল্মের মরুভূমিতে শেয়ালের ডাক শুনতে পেল চাঁদ
 -- আর ফলবাগানে কাঠের জুতো পরে চারণকবিতাদের অসন্তুষ্ট বিড়বিড়ানি । 
তারপর, থইথই বেগনি জঙ্গলে, বনানীর উপদেবী আমাকে বললো যে এটা বসন্তঋতু ।
ঝিলপুকুর, ফুলে ওঠো : ফেনায়িত হও, সাঁকোর ওপর 
আর গাছের তলা দিয়ে গড়িয়ে চলে যাও: -- 
কালো ঝালর আর অবয়ব -- বজ্র ও বিদ্যুৎ উঠে দাঁড়াও আর ঝাঁপাও :
 -- জল এবং দুঃখ ওঠো আর আরেকবার বানভাসিকে তুলে আনো ।
জল নেমে গিয়েছিল বলে -- ওহ, দামি পাথরগুলো নিজেরা চাপা পড়ে গিয়েছিল 
আর ফুটে ওঠা ফুলের দল ! -- তা বড়োই ক্লান্তিকর ! আর সেই ডাকিনী রানি, 
যিনি পৃথিবীর মাটি দিয়ে তৈরি পাত্রে আগুন জ্বালান, 
কখনও বলবেন না তিনি যা জানেন, আর আমরা কোন ব্যাপারে অবিদিত।

শৈশব
ইল্যুমিনেশান ২
পূর্বপুরুষহীন কিংবা দরবারহীন প্রতিমা, 
কালোচোখ আর হলুদ-চুল, কিংবদন্তির চেয়েও সম্ভ্রান্ত, 
মেক্সিকোর কিংবা ফ্লানডার্সের : তার দেশ দুর্বিনীত সোনালি আর সবুজ,
 ঢেউয়ের নামে আঁকা সমুদ্রতীরকে পাক দেয়, জলপোতহীন, 
যাদের নাম ভয়ানকভাবে গ্রিক, স্লাভ, কেল্টভাষী।
জঙ্গলের শেষে -- স্বপ্নেদেখা রুনুঝুনু ফুল : ফুটে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে 
-- কমলারঙা ঠোঁটের মেয়েটি, পশুচারণভূমি থেকে 
ছলকানো বানভাসির পরিষ্কার জলে হাঁটুমুড়ে, নগ্নতা ছায়ায় ঢাকা, 
তির্যক রামধনুর পোশাক পরানো ; ফুলের দল এবং সমুদ্র ।
সমুদ্রের ধারে ছাদের ওপরে যে নারীরা পায়চারি করেন : 
অনেকে খুকি আর বিশালদেহ, তামাটে শ্যাওলায় অসাধারণ কৃষ্ণাঙ্গী, 
তরুবীথিকার উর্বর মাটিতে সাজানো মণিরত্ন এবং 
ছোটোখাটো গলাতুষার বাগান -- তরুণী মায়েরা আর বড়োদিদিরা 
যাদের মুখময় তীর্থযাত্রার প্রলেপ, প্রজাপীড়ক সাজপোশাকে 
নবাবজাদীরা, রাজকন্যারা, ছোটোছোটো বিদেশী মেয়েরা আর 
সুশীল অসুখী জনসাধারণ ।
বড়োই একঘে্য়ে, ‘প্রিয়তম শরীর’ এবং ‘মহার্ঘ হৃদয়’ !

এ তো সে, গোলাপঝাড়ের পেছনে, মৃত খুকিটা ।
 -- কম বয়সী মা, মারা গেছে, সিঁড়ি দিয়ে নামে। --
 খুড়তুতো ভাইয়ের গাড়ি বালির ওপরে খোনাস্বর আওয়াজ তোলে ।
 -- ছোট্ট ভাই ( সে ভারতবর্ষে থাকে ! ) সেখানে, সূর্যাস্তের সামনে, 
কারনেশান ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে । দেয়ালের ফুলে ছেয়ে থাকা 
বাঁধের ওপরে বুড়োদের সোজা করে কবর দেয়া হয়েছে ।
সেনাপতির বাড়ির চারিপাশ ঘিরে আছে সোনালি পাতার ঝাড় । 
ওরা সবাই দক্ষিণে । -- তুমি লালরঙা পথ ধরে ফাঁকা সরাইখানায় 
পৌঁছে যাও । জমিদারের গ্রামের বাড়ি বিক্রি হবে : খড়খড়িগুলো ঢিলেঢালা । 
-- পাদরিসাহেব চাবি নিয়ে গির্জায় চলে গিয়ে থাকবেন । 
-- পার্কের কাছাকাছি পাহারাদারদের কুটিরগুলো ভাড়া দেয়া হয়নি । 
বেড়াগুলো এতো উঁচু যে তুমি গাছের মাথার ঘষটানি ছাড়া 
আর কিছুই দেখতে পাবে না ।
চারণভূমিগুলো  উঠে গেছে মুরগিবর্জিত গ্রামগুলোর দিকে, 
কামারের নেহাইও নেই । জলকপাট ওপরে তোলা । 
হে বনজঙ্গলের ক্রুশকাঠ আর হাওয়াকল, দ্বীপপূঞ্জ 
আর ধোঁয়া-চিমনির সারি ।
ম্যাজিক ফুলেদের গূঞ্জন । ঢালু জায়গা ওকে কোল দিয়েছিল । 
চারিদিকে ঘুরছিল রূপকথার বাহারঅলা প্রাণী । 
শাশ্বত উষ্ণ চোখের জলে তৈরি মেঘেরা জড়ো হচ্ছিল ফাঁকা সমুদ্রের ওপরে।

বনের ভেতরে একটা পাখি রয়েছে, তার গান তোমাকে থামিয়ে দেয় 
আর  আরক্তিম করে তোলে।
একটা দেয়ালঘড়ি রয়েছে যা কখনও বাজে না ।
একটা গর্তে রয়েছে শাদা প্রাণীর বাসা ।
একটা গির্জা রয়েছে যা নামছে, আর একটা ঝিল যা ওপরে উঠছে ।
বেড়ার ঝাড়ের আড়ালে রাখা রয়েছে রাঙা ফিতেয় সাজানো 
ছোট্ট ঘোড়ারগাড়ি, কিংবা গলি ধরে দৌড়োচ্ছে,
বনের আড়াল থেকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে পোশাকপরা 
ছোটো অভিনেতাদের দল ।
শেষ পর্যন্ত, কেউ তো রয়েছে, যখন তুমি ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত, 
যে তোমাকে তাড়িয়ে দিলো।

ছাদের ওপরে প্রার্থনারত আমিই সেই সন্ত --- 
যখন শান্তিময় জানোয়ারেরা প্যালেসটাইনের 
সমুদ্র পর্যন্ত চরে ঘাস খেতে গেছে ।
অন্ধকার আরামকেদারায় আমিই সেই পণ্ডিত । 
গ্রন্হাগারের জানালায় গাছের ডালপালা আর বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়ছে ।
বেঁটে গাছের বনের ভেতর দিয়ে যে পথ দেখা যাচ্ছে, 
আমিই তার পর্যটক : আমার পদধ্বনিকে নিঃশব্দ 
করে দিচ্ছে খোলা জলকপাটের গর্জন । আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখতে থাকি 
সূর্যাস্তের দুঃখি সোনালি প্রক্ষালন ।
আমি হয়তো সেই বালক যে সমুদ্রে ভেসে-যাওয়া জেটির ওপরে 
রয়ে গেছে, চাষিবাড়ির ছোটো ছেলে যে গলি ধরে হেঁটে যাচ্ছে 
তার চুলের ঝুঁটি আকাশ ছুঁয়েছে ।
পথগুলো অসমতল । ছোটো ঢিবিগুলো ঝাঁকড়াগাছে ঢাকা । 
হাওয়া নিশ্চল । পাখিগুলো আর ঝর্ণা আর কতো দূরে ! 
সামনে সেটাই হয়তো পৃথিবীর শেষপ্রান্ত ।

মাটির অনেক গভীরে --  রেখায় নকশাকাটা, 
চুনকামকরা, শেষের দিকের এই স্মৃতিস্তম্ভ  ওরা আমায় ভাড়া দিক ।
টেবিলে হেলে পড়ি, লন্ঠনের আলো ঝলমল করে তুলেছে 
যে পত্রিকাগুলো সেইগুলো আমি বোকার মতন দ্বিতীয়বার পড়ি, 
অথচ বইগুলোতে আর আগ্রহ নেই ।
মাটির তলায় আমার বাসার ওপরে অনেক দূরে বাড়িঘরের ভিতপোঁতা,
 কুহেলিকা জড়ো হয়। মাটির রঙ লাল কিংবা কালো । 
দানবিক শহর, শেষহীন রাত !
তলায় রয়েছে নর্দমা । পাশটা কেবল কাচের পাত্রের মতন পুরু । 
হয়তো স্হলবেষ্টিত আশমানি উপসাগর , আগুনের কুয়ো,  উপসাগর । 
হয়তো এই স্তরে চাঁদ আর ধুমকেতু, সমুদ্র আর কিংবদন্তির সাক্ষাৎ ঘটে ।
তিক্ত মানসিকতার সময়ে আমি ধাতুর, নীলকান্তমণির গোলকের কল্পনা করি । 
আমি নৈঃশব্দের প্রভূ । ধনুকের মতন ছাদের কোনায় কেনই বা 
কাচফোকরের মতন দেখতে জায়গাটার আলো ফিকে হয়ে আসবে ?

গল্প
ইল্যুমিনেশান ৩
মামুলি বদান্যতায় নিজেকে একবার দিয়ে ফেলা দক্ষতা সম্পর্কে 
একজন রাজপুত্র অত্যন্ত কূপিত ছিল । ভবিষ্যতে প্রেমের 
যে বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটবে তা ও দেখতে পাচ্ছিল, 
আর সন্দেহ করছিল যে ওর স্ত্রীদের রয়েছে বিলাসদ্রব্য 
আর আকাশের দেয়া সন্তোষ-উৎপাদন বাড়িয়ে তোলার চেয়েও বেশি চাহিদা । 
ও সত্য ঘটনা জানতে চাইছিল, আকাঙ্খা আর 
বাসনা চরিতার্থ করার প্রয়োজন জানতে চাইছিল । 
তা স্বধর্ম থেকে বিপথগমন হোক বা নাহোক ও জানতে চাইছিল। 
ওর অন্তত ছিল যথেষ্ট জাগতিক ক্ষমতা ।
প্রতিটি নারী যে ওকে জানতো, খুন হয়ে যেতো গুপ্তঘাতকদের হাতে । 
সৌন্দর্যের বাগানে কি যে ব্যাপক ধ্বংস ! 
খাঁড়ার তলায় তারা ওকে আশীর্বাদ করেছিল । 
ও আর নতুন করে কাউকে চায়নি । --সেই নারীরা আবার দেখা দিলো ।
যারা ওকে অনুসরণ করেছিল তাদের, 
শিকারের পর কিংবা মদে মাতাল হয়ে, সবাইকে ও হত্যা করল । 
-- সবাই ওকে অনুসরণ করা বজায় রাখল ।
বিরল প্রাণীদের গলা কেটে নিজেকে ও আনন্দ দিতো । 
প্রাসাদগুলোয় ও আগুন ধরিয়ে দিলো। জনসাধারণের 
ওপর দিয়ে গিয়ে তাদের কুটিকুটি করে ফেললো । 
-- জনসাধারণ, সোনালি ছাদ, সুন্দর প্রাণীরা তবু বেঁচে রইলো ।
কেউ কি ধ্বংসে খুঁজে পায় চরমানন্দ, নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে নিজেকে 
আবার তরুণ করে তুলতে পারে ? জনসাধারণ টুঁ শব্দও করেনি । 
কেউ ওর দৃষ্টিভঙ্গীকে সমর্থন করতে এগিয়ে যায়নি। 
এক সন্ধ্যায় ও গর্বে  ঘোড়ায় বসে তাকে ছোটাচ্ছিল । 
এক ডাকিনী দেখা দিলো, অনির্বচনীয়া এমনকি লজ্জাময়ী সুন্দরী । 
রাজপুত্রের মুখ আর ইশারায় দেখা গেল বহুবার জটিল প্রেম করার পুর্বলক্ষণ, 
বলার অযোগ্য এমনকি অসহিষ্ণু আনন্দ ! রাজপুত্র আর ডাকিনী 
সম্ভবত অন্তরজগতের ক্ষমতার দ্বারা পরস্পরকে হত্যা করল । 
কেমন করেই বা তারা পরস্পরকে এইভাবে মরতে সাহায্য করলো?  
লোকে যেমন বলে থাকে, ওরা মারা গেছে।
তবু রাজপুত্র নিজের প্রাসাদে বুড়ো হয়ে মারা গেল । 
রাজপুত্রই আসলে ডাকিনী ছিল । ডাকিনী ছিল রাজপুত্র ।
সূক্ষ্ম সঙ্গীত আমাদের চাহিদার তুলনায় কম  ।

প্যারেড
ইল্যুমিনেশান ৪
ভাঁড়গুলো বেশ পালোয়ান । অনেকে তোমার শব্দগুলোকে 
শোষণ করেছে । প্রয়োজনহীন,  তোমার বিবেক সম্পর্কে 
ওদের বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষমতা নিয়ে খেলা করার কোনো তাড়াহুড়ো নেই ।
কতো পাকতাড়ুয়া ওরা ! গ্রীষ্মরাতের মতন চোখদুটো হতবুদ্ধিময়,
 লাল আর কালো, তিনরঙা, ইস্পাতে সোনালি নক্ষত্র দেগে দেয়া ; 
আকৃতি বিকলাঙ্গ, সীসায় ভারি, ফ্যাকাশে, আগুনলাগা ; 
খসখসে গলার তড়িংবিড়িং নাচিয়েরা ! ফিকে হয়ে যাওয়া 
কারুকাজের নিষ্ঠুর দম্ভচলন ! --কেউ কেউ কমবয়সী--
চেরুবিনোকে ওরা কোন দৃষ্টিতে দ্যাখে ? -- 
বিপজ্জনক সঙ্গতি আর আতঙ্ক-জাগানো কন্ঠস্বরের মালিক ওরা । 
শহরের রাস্তায় ওদের পাঠিয়ে দেয়া হয় খদ্দের ধরার জন্যে,  
বিরক্তিকর অলঙ্কারে সাজিয়ে
ওহ পাগলামির ভেংচিকাটা নৃশংস পারিজাত !
 তোমার ফকির আর নাটুকে ভাঁড়ামো থেকে দূরে।
বিনা প্রস্তুতিতে তৈরি দুঃস্বপ্নে পাওয়া পোশাক পরে ওরা 
ডাকাতদের উপদেবতাদের  রোমান্টিক, বিয়োগান্তক, 
আধ্যাত্মিক ধর্মকাহিনির নাটক করে যে ঘটনাগুলো আদপে কখনও ঘটেনি । 
চীনা, হটেনটট, ভবঘুরে, মূর্খ, হায়েনা, রক্তখেকো দেবতা, 
পুরোনো পাগলামি, ভয়ংকর রাক্ষস, জনপ্রিয় গৃহস্হ প্রবণতাকে 
পাশবিক ভঙ্গী আর আদরের সঙ্গে মিশিয়ে ফ্যালে ।
 ওরা নতুন স্বরলিপি আর মিষ্টি গানের জন্যে অপেক্ষা করছে । 
ওস্তাদ ভোজবাজিকর, ওরা জনগণকে আর জায়গাকে 
বদলে ফেলে চৌম্বক মঞ্চপদ্ধতি দেখায় । ফুলে-ওঠা চোখে, 
রক্ত গান গায়, হাড় পুরু হয়ে ওঠে, চোখের জল আর গালের রুজ 
গড়িয়ে পড়ে । ওদের গরাদ আর সন্ত্রাস মুহূর্তের জন্যে বা কয়েক মাস বজায় থাকে ।
এই বর্বর প্যারেডের চাবিকাঠি আছে শুধু আমার হেফাজতে ।

সেকেলে
ইল্যুমিনেশান ৫
গ্রিক অধিদেবতা প্যান-এর করুণাময় ছেলে ! ধ
নুকের মতন তোমার ভ্রুযুগল ফুলের তোড়ায় ঢাকা 
আর চোখ যেন বৈঁচিফল, মহার্ঘ শ্রবণসঙ্গীত, এগিয়ে চলো । 
মদের বাদামি  তলানির রঙে রাঙানো ; তোমার গালগুলো ভেতরে ঢোকা ।
 তোমার চোখ-দাঁত ফ্যাকাশে । তোমার বুক এক বাদ্যযন্ত্র, 
তোমার ফ্যাকাশে হাতে তারগুলো বেজে ওঠে । 
তোমার পেটের ভেতরে স্পন্দন হয় যেখানে একজোড়া যৌনতা ঘুমোয় । 
রাতের বেলা, হেঁটে যাও, উরুকে সামান্য তুলে, তারপর অন্য উরু আর ওই বাঁ পা ।

শোভাময় হয়ে ওঠা
ইল্যুমিনেশান ৬
তুষারপাতের উল্টোদিকে, এক ঢ্যাঙা সৌন্দর্যের প্রতিমা । 
এই আদর-পাওয়া দেহকে মৃত্যুর বাঁশি আর ঘিরেফেলা 
মৃদু সঙ্গীত ফাঁপিয়ে তোলে, এমনভাবে ফুলে ওঠে আর কাঁপে যেন ভুত : 
অসাধারণ মাংস থেকে  রক্তবর্ণ আর কালো ঘা ফেটে বেরোয় । 
জীবনের জন্য যুৎসই রঙগুলো গভীর হয়ে ওঠে, 
নাচতে থাকে আর গড়ে উঠতে-থাকা এই দৃষ্টিপ্রতিভা থেকে 
নিজেদের আলাদা করে ফ্যালে । কাঁপুনি তোলে আর আর্তনাদ করে 
যন্ত্রণায় আর এদের মদমত্ত সুগন্ধের প্রভাব ভরে দেয় সেই জাগতিক
 আর ভাসন্ত সঙ্গীতকে যা জগতসংসার, অনেক পেছনে, 
আমাদের সৌন্দর্যমাতার দিকে ছুঁড়ে মারে -- সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, 
দুই পায়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ায় । ওহ, আমাদের হাড়ে পরানো হয়েছে 
এক নতুন প্রণয়োদ্দীপক দেহ ! ওহ, ফ্যাকাশে মুখশ্রী ; 
ঘোড়ার চুলে-সাজানো ঢাল, কেলাসিত বাহু ! গাছের জঙ্গল 
আর ওজনহীন বাতাসের ভেতর দিয়ে আমাকে কামান দাগতে হবে !

জীবনসমূহ
ইল্যুমিনেশান ৭

ওহ পবিত্রভূমির বিশাল অ্যাভেনিউগুলো, মন্দিরের চূড়াগুলো ! 
সেই ব্রাহ্মণের কী হলো যিনি আমাকে প্রবাদগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন ? 
আমি সেই বুড়িকে এখনও দেখতে পাই, একই সময়ে আর জায়গায় ! 
নদীদের রূপালি সময় আর আলোকমালা আমার এখনও মনে আছে, 
কাঁধের ওপরে আমার সঙ্গীর হাত, পরস্পরের আদর মনে আছে 
যখন আমরা দুজনে মশলার গন্ধেভরা মাঠে দাঁড়িয়েছিলুম । 
-- আমার চিন্তাকে ঘিরে একদল রক্তবর্ণ পায়রা বকবকম করে । 
-- এখানে নির্বাসিত, প্রতিটি সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট নাটক 
অভিনয় করার জায়গা আমার ছিল । 
আমি তোমাকে দেখাতে পারতুম অজানা ঐশ্বর্য । 
তুমি যে ধনসম্পদ খুঁজে পেয়েছিলে তার ইতিহাসকে আমি চিহ্ণিত করেছি । 
এবার দেখব কী ঘটতে যাচ্ছে ! বিশৃঙ্খলার মতনই আমার প্রজ্ঞাকে অবজ্ঞা করা হয় । 
কীই বা আমার শূন্যতা, তোমার জন্যে অপেক্ষমান নিশ্চলতার তুলনায় ?

আমার পূর্বজদের তুলনায় আমি একজন গুণসম্পন্ন আবিষ্কারক ; 
এমনকি, সঙ্গীতবিশারদ, যে প্রেমের সূত্রের মতন কিছু খুঁজে পেয়েছে । 
বর্তমানে, মনোরম আকাশের তলায় বিটকেল এক দেশের ভদ্রমানুষ, 
নিজের ভিখারিসূলভ শৈশবের স্মৃতির মাধ্যমে আমি বিচলিত হবার প্রয়াস করি, 
আমার শিক্ষানবীশি আর কাঠের জুতো পায়ে এখানে আসা, 
আমার তর্কপ্রিয়তা, আমার পাঁচ কি ছয়বারের বৈধব্য, 
আর আমার কয়েকবারের মহামাতলামি, যখন আমার বিচক্ষণ মগজ 
আমার বেরাদরদের  হট্টগোলে অংশ নিতে বাধা দিয়েছিল । 
যেহেতু এই সন্দেহপ্রবণতা আর প্রয়োগ করা যাবে না, 
আর এমনিতেও আমি তরতাজা উদ্বেগে সমর্পিত -- 
আমি আশা করছি যে অত্যন্ত বিদ্বিষ্ট উন্মাদ হয়ে উঠবো ।

বারো বছর বয়সে আমি যে চিলেকোঠায় বন্দী ছিলুম, 
আমি জগতসংসারের বিষয়ে জানতুম, আমি মানুষের হাস্যকর অবস্হা 
বর্ণনা করেছিলুম । মাটির তলাকার মদের ভাঁড়ারে আমি ইতিহাস শিখলুম । 
উত্তরের শহরের কোনো এক রাতের ভোজনোৎসবে আমি পূর্বসূরী 
মহান তৈলচিত্রকরদের নারীদের অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা পেয়েছিলুম । 
প্যারিসের এক প্রাচীন গলিতে, আমাকে ধ্রুপদী বিজ্ঞান শেখানো হয়েছিল । 
প্রাচ্যদেশ দিয়ে ঘেরা এক চমৎকার জায়গায় আমি সম্পূর্ণ করেছিলুম 
আমার প্রচুর কাজ আর কাটিয়েছিলুম আমার সুবিখ্যাত অবসরযাপনের দিনগুলো । 
নিজের রক্তকে করে তুলেছিলুম চঞ্চল । আমার কর্তব্য শেষ হয়েছে । 
সেই বিষয়ে আর ভাববারও দরকার নেই । 
আমি সত্যিই কবর অতিক্রম করে এসেছি, এবং কর্তব্য-বিষয়ে স্বাধীন ।

প্রস্হান
ইল্যুমিনেশান ৮
যথেষ্ট দেখা হলো । সমগ্র আকাশের তলায় দৃষ্টিপ্রতিভার সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাৎ।
অনেক পাওয়া হলো । শহরগুলোর আওয়াজ, সন্ধ্যাবেলা, 
এবং আলোয়, আর তা সদাসর্বদা।
অনেক জানা হলো । জীবনের নির্ণয়গুলো ।
 --হে দৃষ্টিপ্রতিভার ধ্বনিসমূচ্চয় !
নতুন অনুরাগ এবং ধ্বনি লক্ষ্য করে সেইদিকে প্রস্হান !

রাজকীয়
ইল্যুমিনেশান ৯
সুন্দর একটি দিনে, সুশীল মানুষদের মাঝে, 
চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন একজন মহিমান্বিত পুরুষ ও নারী :
 ‘বন্ধুগণ, আমি চাই ও রানি হোক !’ ‘আমি রানি হতে চাই !’ 
মহিলা হাসলেন আর কাঁপতে লাগলেন । পুরুষটি বন্ধুদের জানালেন 
রহস্যোদ্ঘাটনের কথা, কষ্টের জীবনের কথা । 
দুজনে পরস্পরের দেহে হেলান দিয়ে মূর্চ্ছা গেলেন ।
সত্যিই, তারা সারা সকাল রাজা হয়ে কাটালো, 
বাড়িগুলোয় ঝোলানো হলো গাঢ় লাল ফেস্টুন, 
আর সারা দুপুরও, তারা হেঁটে চলল পামগাছের বাগানের দিকে ।

যুক্তিযুক্ততার অভিমুখে
ইল্যুমিনেশান ১০
ড্রামের ওপরে তোমার একটা আঙুলের টোকায় সব 
আওয়াজ হারিয়ে যায় আর নতুন করে গড়ে তোলে ঐকতান ।
তোমার একটা পদক্ষেপ উদ্দীপ্ত করে নতুন মানুষদের 
আর তাদের সামনে দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
তোমার মুখ অন্য দিকে তাকায় : নতুন প্রেম ! 
তোমার মুখ নিজের জায়গায় ফেরে -- নতুন প্রেম!
‘আমাদের অদৃষ্ট পালটে দাও, মহামারী শেষ করো’, 
মহাসময়ের তালে তাল মিলিয়ে এই শিশুরা তোমাকে গেয়ে শোনায় । 
‘যেখানেই হোক না কেন, আমাদের বৈভব এবং ইচ্ছা লালিত হোক’, 
ওরা দয়াভিক্ষা করে ।
চিরকালীন থেকে তোমার আগমন, 
তুমি সব জায়গার জন্য প্রস্হান করবে ।

মদোন্মত্ত সকাল
ইল্যুমিনেশান ১১
হে আমার শুভ ! হে আমার সুন্দরী ! 
আমি ভয়ে পশ্চাৎপদ হই না এমন বর্বর তূর্যনিনাদ !
সন্মোহিত আরাম ! প্রথম বারের খাতিরে, 
সুন্দর দেহ আর অজানা কাজের জন্য হুররে !
আরম্ভ হয়েছিল বাচ্চাদের হাসিতে, শেষও হবে সেইভাবে । 
এই বিষ আমাদের শিরায় তখনও বইবে যখন তূর্যনিনাদ ফিরে আসবে, 
আমাদের আরেকবার পুরোনো বিশৃঙ্খলার হাতে তুলে দেয়া হবে । 
ওহ, আমরা এখন অমন দৈহিক শাস্তির উপযুক্ত, 
আমাদের দেহ আর আত্মাকে দেয়া মানবোত্তর 
প্রতিশ্রুতিকে সঠিক বুঝে উঠতে হবে : এই প্রতিশ্রুতি, এই পাগলামি ! 
সৌষ্ঠব, বিজ্ঞান, সন্ত্রাস ! ওরা অঙ্গীকার করেছে যে শুভ 
এবং অশুভর বৃক্ষকে অন্ধকারে পুঁতে ফেলা হবে, 
স্বৈরতান্ত্রিক সদগুণগুলোকে নির্বাসন দেয়া হবে, 
যাতে এখানে আমরা বিশুদ্ধ প্রেম নিয়ে আসতে পারি । 
এটা আরম্ভ হয়েছিল বিশেষ বিরক্তি নিয়ে এবং ফুরিয়েও গেলো 
-- আমরা এই শাশ্বতকে তক্ষুনি দখল করতে পারিনি বলে 
-- তা সুগন্ধের দাঙ্গায় শেষ হয় ।
শিশুদের হাসি, কেনা-গোলামদের বিচক্ষণতা, 
অক্ষতযোনি মেয়েদের আত্মসংযম, এখানকার মুখগুলো আর জিনিসপত্রের আতঙ্ক, 
সতর্কতার স্মৃতির দরুন তুমি পবিত্র । এটা আরম্ভ হয়েছিল
মূর্খতার সঙ্গে, এবার দ্যাখো, শেষ হচ্ছে আগুন আর বরফের দেবদূতদের দ্বারা । 
ক্ষণকালের মদ্যপ পবিত্র সতর্কতা ! 
যদি তুমি কেবল মুখোশের জন্য আমাদের বরাদ্দ করে থাকো ।
 সাধনপ্রণালী, আমরা তোমাকে সমর্থন করছি ! 
আমরা ভুলিনি কালকে তুমি আমাদের  প্রতিটি শতককে মহিমান্বিত করেছিলে । 
বিষে আমাদের বিশ্বাস আছে । আমরা জানি কেমন করে প্রত্যেক দিন 
আমাদের সমগ্র জীবন দিয়ে দিতে হবে ।
এই কালখণ্ড হলো গুপ্তঘাতকদের ।

প্রবাদসমূহ
ইল্যুমিনেশান ১২
আমাদের চারটে অবাক চোখের জন্যে এই জগতসংসারকে 
যখন ধ্বসিয়ে দেয়া হয়েছে একটিমাত্র অন্ধকার জঙ্গলে -- 
দুটি অনুগত বাচ্চার জন্য একটি সমুদ্রতীরে -- 
আমাদের সুস্পষ্ট সমবেদনার জন্য সঙ্গীতের ঘরে -- 
আমি তোমাকে খুঁজে বের করবো ।
এখানে তলায় কেবল একজনমাত্র বুড়ো লোক থাকুন, 
শান্ত আর সুন্দর, ‘অচেনা বিলাসে’ পরিবেষ্টিত -- 
আমি তোমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসবো ।
আমাকে তোমার স্মৃতিগুলো বাস্তবে পরিণত করতে দাও 
- আমাকে যুবতী হতে দাও, যে তোমার গলা টিপে ধরবে 
-- আমি তোমার দম বন্ধ করে দেবো ।
যখন আমরা যথেষ্ট বলশালী -- কে-ই বা পশ্চাদপসরণ করবে ? 
যথেষ্ট মৌজমস্তিতে থাকলে -- কে-ই বা ইয়ার্কি করতে ছাড়ে না ? 
যখন আমরা সবচেয়ে বেশি অসূয়াপূর্ণ -- ওরা আমাদের কি-ই বা বানাতে পারে ? 
নিজেকে সাজিয়েগুজিয়ে তোলো, নাচো, হাসো ।
 -- আমি কখনও ভালোবাসাকে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবো না ।
ভিখারিনী মেয়েটা, দানবী খুকি, আমার কমরেড ! 
তুমি এই হতভাগিনী নারীদের কতোটা মনোযোগ দাও, 
এই প্যাঁচপয়্জার, আর আমার সমস্যা । তোমার অসম্ভব কন্ঠস্বর দিয়ে 
নিজেকে আমাদের সঙ্গে বেঁধে ফ্যালো, সেই কন্ঠস্বরখানা ! 
এই জঘন্য বিষাদের একমাত্র আশা ।
জুলাই মাসের মেঘাচ্ছন্ন ভোর । বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ছাইয়ের স্বাদ
 -- বনানীর ঘামের গন্ধ ঝরে পড়ছে উনানের কোনে -- ভিজে ফুলগুচ্ছ
 -- তৃণাঞ্চলের ধ্বংসাবশেষ -- খেতের খালগুলো থেকে কুয়াশা
 -- তাহলে কেন খেলনাপাতি আর ধুপকাঠি নয় ?
আমি এক ঘণ্টাঘর থেকে আরেক ঘণ্টাঘর পর্যন্ত দড়ি টাঙিয়েছি ; 
জানালা থেকে জানালা পর্যন্ত ফুলের মালা ; 
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্র পর্যন্ত সোনার শেকল ; আর আমি নাচছি ।

ওপরের ঝিল থেকে অবিরাম বাষ্প ওঠে । 
সফেদ সূর্যের বিপরীতে কোন জাদুনারীরা জেগে উঠবেন? 
কোন বেগুনি পাতার পর্ণরাজি ঝরে পড়বে ?
জনগণের টাকা যখন ঢেলে দেয়া হচ্ছে ভাইবেরাদরদের ভোজনোৎসবে, 
মেঘের ভেতরে বাজতে থাকে গোলাপরঙা আগুন ।
চিনা কালির আকর্ষণ সুগন্ধকে গভীর করে তোলে, 
আমার নিশিপালনে ক্রমান্বয়ে ঝরে পড়ে কালোরঙের পাউডার । 
-- আমি গ্যাসের আগুন কম করে দিই, বিছানায় নিজেকে ছুঁড়ে ফেলি, 
আর ছায়াগুলোর দিকে ফিরে, দেখতে পাই তোমাদের, 
আমার কন্যারা, আমার রানিরা !

শ্রমিকেরা
ইল্যুমিনেশান ১৩
ওহ ফেবরুয়ারি মাসের সেই উষ্ণ সকাল ! 
আমাদের বিদকুটে অন্নবস্ত্রহীন স্মৃতি, আমাদের যৌবনের দারিদ্রদশা থেকে 
অসময়ের দখিনা বাতাস এসে জাগিয়ে তুললো ।
বাদামি আর শাদা চাককাটা সুতির স্কার্ট পরেছিল হেনরিয়েকা, 
গত শতকের ফ্যাশান, সন্দেহ নেই ; ফিতে বাঁধা শিরাবরণ, রেশমের স্কার্ফ । 
শোকসন্তাপের চেয়েও তা দুঃখজনক । আমরা শহরতলিতে ঘুরে  বেড়াচ্ছিলুম । 
আবহাওয়া ছিল মেঘলা, আর ওই দখিনা বাতাস চঞ্চল করে তুলছিল 
বিধ্বস্ত বাগান আর শুকনো তৃণভূমি থেকে উড়ে আসা দুর্গন্ধকে ।
এটা আমাকে যতোটা বিরক্ত করেছে ততোটা আমার স্ত্রীকে করতো না । 
ওপরের দিকের রাস্তায় গতমাসের বানভাসি তৈরি করে গেছে জলের  চাদর, 
ও আমাকে দেখালো তাতে কয়েকটা ছোট্ট মাছ ।
শহরটা, কারখানাগুলোর আওয়াজ আর ধোঁয়াসুদ্ধ, রাস্তা ধরে আমাদের পিছু নিয়েছিল । 
ওহ, অন্য জগতসংসার, আকাশ আর ছায়ায় আশীর্বাদপ্রাপ্ত বসতি ! 
দখিনা বাতাস আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল দুর্দশাময় শৈশবের ঘটনাগুলো, 
আমার গ্রীষ্মের বিষাদ, ভাগ্য আমার থেকে সদাসর্বদা 
যে ভয়ংকর বিপুল শক্তিমত্তা ও জ্ঞান  দূরে সরিয়ে রেখেছে । 
না ! আমরা এই কৃপণ দেশে গ্রীষ্ম কাটাবো না যেখানে 
আমরা বাগদত্ত অনাথ ছাড়া আর কিছুই হতে পারবো না। 
আমি এই শক্ত হাত দিয়ে প্রিয় দৃশ্যগুলোকে টেনে নিয়ে যেতে দেবো না ।

সেতুগুলো
ইল্যুমিনেশান ১৪
স্ফটিকের ধূসর আকাশ । সাঁকোগুলোর অদ্ভুত নকশা, 
কখনও সোজা, কখনও বেঁকা, আবার কোনোটা কোনাকুনি বেঁকে গিয়ে 
আগেরটার সঙ্গে যোগ দিয়েছে, আর এই নকশাগুলো খালের আলোজ্বলা বাঁকগুলোয় 
আবার তেমন করেই পুনরাবৃত্তি করেছে, 
কিন্তু এতো দীর্ঘ আর হালকা যে নদীর তীর, 
গুম্বজের গুরুভারে, ডুবে গিয়ে ছোটো হয়ে আসে । 
এই সাঁকোগুলোর কয়েকটা এখনও চাদরে ঢাকা । 
অন্যগুলোয় রয়েছে মাস্তুল, সঙ্কেত, অপলকা নিচু পাঁচিল । 
পাতলা তারে মোড়া, আর মিলিয়ে গেছে ; তীর থেকে দড়িদড়া উঠে আসে । 
তুমি একটা লাল কোট দেখে চিনতে পারো, হয়তো অন্যান্য কোটও এবং সঙ্গীতযন্ত্র । 
এই জনপ্রিয় রেশগুলো কি, বিখ্যাত কনসার্টের টুকরো, 
জনগণের জাতীয়-সঙ্গীতের অবশিষ্টাংশ ? জলের রঙ ধূসর এবং নীল, 
সমুদ্রের বাহুর মতন চওড়া ।
একটা শাদা রশ্মি, অনেক ওপরে থেকে এসে, হাসির নাটককে লোপাট করে দ্যায় ।


শহর
ইল্যুমিনেশান ১৫

এক মহানগর যাকে এই জন্যে আধুনিক মনে করা হয় 
যে বাড়িগুলোর বাইরের দিক সাজানোয় আর নগরের পরিকল্পনায় প্রয়োগ করার জন্য 
পরিচিত উপলব্ধিগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ; 
তারই  আমি এক ক্ষণজীবী আর তেমন বিচ্ছিন্ন নাগরিক নই । 
এখানে তুমি কুসংস্কারের একটিও স্মৃতিস্তম্ভের হদিশ পাবে না । 
সংক্ষেপে, নৈতিকতা আর ভাষাকে সরলতম প্রকাশে নামিয়ে আনা হয়েছে ! 
লক্ষাধিক এই লোকজন যারা পরস্পরকে জানার প্রয়োজন অনুভব করে না, 
নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, কর্মকাণ্ড, বার্ধক্যে এতো মিল যে  তাদের আয়ু 
মহাদেশের গোলমেলে সংখ্যাতত্ব যা বলেছে তার চেয়েও বেশ কম । 
তাই, আমার জানালা দিয়ে, দেখতে পাই নতুন প্রেতরা শাশ্বত ঘন ধোঁয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে 
--- আমাদের বনানীঘেরা ছায়া, আমাদের গ্রীষ্মের রাত ! 
-- প্রতিহিংসর নতুন গ্রিক দেবতারা, আমার কুটিরের সামনে, 
যা আমার স্বদেশ, আমার সমগ্র হৃদয়, 
কেননা এখানে সবকিছুরই পরস্পরের সঙ্গে মিল আছে 
-- ক্রন্দনহীন মৃত্যু, আমাদের সক্রিয় কন্যা আর চাকরানি, 
রাস্তার কাদায় বেপরোয়া ভালোবাসা আর ফালতু অপরাধ ফুঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ।  

গাড়ির চাকার দাগ
ইল্যুমিনেশান ১৬
ডানদিকে বাগানের এই কোনে গ্রীষ্মের ভোর 
পাতাদের আর কুয়াশাকে এবং শব্দগুলোর ঘুম ভাঙায়, 
আর বাঁদিকের ঢালে স্যাঁতসেতে রাস্তায় বেগুনি ছায়ায় 
অগুন্তি দ্রুতগামী চাকার দাগ ধরে রাখে । ঐন্দ্রজালিক মিছিল । 
ওয়াগন, সত্যিই, ঝকমকে কাঠের তৈরি জানোয়ার তাতে, 
খুঁটি আর রঙবেরঙ চাঁদোয়া, কুড়িটা চিত্রবিচিত্র সার্কাস ঘোড়ার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল, 
আর পুরুষেরা আর বাচ্চারা তাদের অদ্ভুত জানোয়ারের পিঠে -- 
কুড়িটা গাড়ি, ঢেউখেলানো, ঢাকাখোলা আর ফুলে সাজানো প্রাচীন 
ঘোড়ারগাড়ির মতন কিংবা যেমন পরীর গল্পে থাকে, 
শহরতলির যাত্রাভিনয় দেখতে যাবার পোশাক-পরা বাচ্চায় ঠাশা : 
-- এমনকি কফিনও, তাদের রাতের আচ্ছাদনের তলায়, 
জাঁকালো আবলুস পালকে, নীল-কালো মাদিঘোড়ার দৌড়কে 
পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো ।

নগরেরা
ইল্যুমিনেশান ১৭
শহরসমূহই বটে ! এই সেই লোকগুলো যাদের জন্যে স্বপ্নেদেখা 
উত্তর-আমেরিকার আলেঘানি পাহাড় এবং লেবানন মঞ্চায়িত হয়েছিল ! 
স্ফটিক আর কাঠের তৈরি রাখাল-কুটির যা অদৃশ্য রেললাইন আর কপিকলে চলে । 
গ্রিক সূর্যদেবের মূর্তি দিয়ে ঘেরা মরা আগ্নেয়গিরির হাঁমুখ, 
আর তামার তৈরি পামগাছেরা আগুনশিখায় সুরেলা ধ্বনি তুলছে । 
রাখাল কুটিরের পেছনে খালের ধারে ভালোবাসার পানোৎসব প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল । 
গিরিসঙ্কটের ভেতরে শিকারের রুনুঝুনু বাজে । দৈত্যবৎ গায়কদের সমাবেশ ঘটে 
মধ্যযুগের ফরাসি রাজার সোনালি ঝিলমিলে পোশাকের মতন শীর্ষদেশের আলোয় ।
ঘুর্নিজলের ভেতরে পাটাতনের ওপরে, রাজা শার্লামেইনের 
বীরপুরুষেরা তাদের শৌর্যের ভেরীধ্বনি করে । অতলর ওপরের সাঁকোগুলোয়, 
আর সরাইখানার ছাদে, আকাশের তাপ মাস্তুলগুলোকে পতাকা দিয়ে ঢেকে ফ্যালে ।  
দেবতাপ্রতিম ভঙ্গুর মূর্তিগুলো চারণভূমি দখল করে ফ্যালে যেখানে দেবদূততুল্য 
নারীসিংহীরা হিমানী-সম্প্রপাতে প্রবেশ করে । সর্বোচ্চ চূড়াগুলোর সারির ওপরদিকে, 
রয়েছে ভিনাসের শাশ্বত জন্মের ঝড়ঝাপটায় আক্রান্ত এক সমুদ্র, 
অরফিউসের ক্ষণস্হায়ী সঙ্গীতে উদ্বুদ্ধ আর দামি মুক্তো এবং শঙ্খধ্বনিতে মথিত 
-- সেই সমুদ্র জাগতিক বজ্রবিদ্যুৎকে অনেক সময়ে অন্ধকার করে তোলে । 
ঢালু জায়গায়, ফুলের ফসল, আমাদের তরোয়াল আর পেয়ালার মতন, নিচের দিকে । 
পিঙ্গলরঙা মোটা কাপড়ে স্বপ্নদায়িনী পরীরানিদের মিছিল । 
তাদের পা ঝর্ণায় আর বনগোলাপের ঝাড়ে, 
ওইখানে উঁচুতে মৃগয়ার অধিষ্ঠাত্রীদেবীর দুধ খাচ্ছে এক হরিণ । 
শহরতলির মাতালনারীরা ফোঁপাচ্ছে, আর চাঁদ জ্বলে যাচ্ছে 
আর শেয়ালেরা হুক্কাহুয়া করছে । 
ভিনাস সন্ন্যাসী আর স্যাকরাদের সঙ্গে প্রবেশ করছে গুহার মধ্যে । 
সারিসারি ঘণ্টাঘর গেয়ে উঠছে জনগণের অভিপ্রায় । 
হাড়ের তৈরি দুর্গ থেকে ভেসে আসছে অজানা সঙ্গীত । 
যাবতীয় কিংবদন্তির প্রকাশ ঘটছে আর 
শহরগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে হরিণের দল । 
থেমে গেছে ঝড়ের পুণ্যালোক । রাতের পানোৎসবে অবিরাম নাচছে বর্বরেরা । 
এবং, একবার, আমি বাগদাদের রাস্তার গোলমালে নেমে পড়লুম, 
যেখানে ভিড়ের লোকেরা তরতাজা শ্রমের আনন্দ-গান গাইবার জন্য জড়ো হয়েছিল, 
নিস্তেজ হাওয়ায়, পাহাড়ের বিখ্যাত মায়াপুরুষদের এড়াবার জন্যে বিনা ক্ষমতায় পাক খাচ্ছিল । 
আমার তন্দ্রাভাব আর যৎসামান্য হেলডোল 
যে এলাকা থেকে আসে তা ফিরে পেতে কোন ধরণের অস্ত্র, 
কোন ধরণের মনোরম সময় প্রয়োজন ?

ভবঘুরের দল
ইল্যুমিনেশান ১৮
সমব্যথী ভাই ! ওর কাছে আমার কোনও নৃশংস নিশিপালন আছে ! 
‘আমি এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টাকে দখল করে নিতে বিফল হয়েছিলুম । 
আমি ওর অকর্মণ্যতা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম । যদি আমাদের নির্বাসনে যেতে হয়, 
কেনা-গোলমী করতে হয়, তা হবে আমার দোষ।’ 
অদ্ভুত দুর্ভাগ্য আর বোকামির জন্য ও আমার প্রশংসা করেছিল, 
আর তার সঙ্গে জুড়েছিল অশান্তিকর কারণ ।
এই শয়তান পণ্ডিতকে আমি বিদ্রুপ করে উত্তর দিয়েছি, 
আর জানালার কাছে গিয়ে তা শেষ করেছি । বিরল সঙ্গীতরেখার চালচলনের 
অপর পারের চারণভূমিতে আমি ভবিষ্যতের রাতের বিলাসের মায়াপুরুষ গড়েছি ।
এই অস্পষ্ট স্বাস্হবিধিসন্মত চিত্তবিক্ষেপের পর, আমি খড়ের মাদুরের ওপরে 
হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তুম । এবং, বলতে গেলে প্রতি রাতে, 
যেই আমি ঘুমিয়ে পড়তুম, বেচারা ভাইটি উঠে পড়তো, 
মুখে দুর্গন্ধ, চোখে দেখতে পাচ্ছে না -- যেমন ও নিজের সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতো 
-- আর নিজের নির্বোধ কান্নার স্বপ্নে বিভোর আমাকে ঘরের ভেতরে টানাটানি করতো !
বাস্তবিক, সত্যি বলতে কি, আমি ওকে ওর সূর্যসন্তানের 
প্রাগৈতিহাসিক স্হতিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলুম 
-- আর আমরা ঘুরে বেড়ালুম, গুহার মদে ভরণপোষণ করে, 
আর পথের বিসকিট খেয়ে, আমি পরিসর আর ফরমুলা খুঁজে পাবার জন্যে অধৈর্য ।

নগরসকল
ইল্যুমিনেশান ১৯
আধুনিক বর্বরতার অপরিমিত ধারণাকে ছাপিয়ে যায় সরকারি নগরায়ন । 
পরিবর্তনাতীত ধূসর আকাশ যে অনুজ্বল আলো ছড়াচ্ছে তা বর্ণনা করা অসম্ভব ; 
স্হাপত্যের রাজসিক রোশনাই, আর মাটিতে অনন্তকালীন তুষার । 
ধ্রুপদী স্হাপত্যের বিস্ময়কর কাজগুলোকে, একান্ত আতঙ্কজনক রুচিতে, 
ওরা আবার গড়েছে । হ্যাম্পটক কোর্টের চেয়ে কুড়িগুণ বড়ো মিউজিয়ামে  
তৈলচিত্রের প্রদর্শনী দেখি । মন্ত্রালয়ের সিঁড়িগুলোর নকশা তৈরি করেছিল 
নরওয়ের এক নেবুচাদনেজ্জার ; যে অধস্তন অধিকারীদের দেখেছিলুম তারা, 
যেমন হয় আরকি, ব্রাহ্মণদের থেকেও গর্বিত, আর বিশাল মূর্তিগুলোর 
বৈশিষ্ট্য এবং এলাকার তত্ববধায়কদের দেখে আমি ভয়ে কেঁপে উঠছিলুম । 
চৌরাস্তার বাড়িগুলোর ঘেঁষাঘেঁষি, তাদের ছাদ, আর পাঁচিলঘেরা বারান্দা, 
তাদের ঘণ্টাঘরগুলো থেকে কোনঠাশা করে দিয়েছে । 
বিস্ময়কর  শিল্পচর্চায় পার্কগুলোয় উপস্হাপন করা হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক প্রকৃতি । 
ভালো জায়গাগুলোয় রয়েছে অনির্বচনীয় চৌহদ্দি : সমুদ্রের শাখা, 
নৌকাবর্জিত, তার নীল রঙের ঘষাকাচকে ছড়িয়ে দেয় 
মোমের তৈরি বিশাল গাছে গুরুভার জাহাজঘাটার মাঝবরাবর । 
একটা ছোটো সাঁকো চলে গেছে সন্ত চ্যাপেলের গোলাকার 
গম্বুজের ঠিক নিচের সিংদরোজা পর্যন্ত । গম্বুজটা পনেরোহাজার ফিটের 
ইস্পাতের কলাকৃতি দিয়ে গড়া ।
তামার তৈরি সাঁকো, মাচান, সিঁড়ি যা আচ্ছাদিত বাজারকে পাক খেয়ে উঠেছে, 
কয়েকটা দৃষ্টিভঙ্গীতে, আমি ভাবলুম হয়তো শহরের ব্যাপ্তি বিচার করে দেখব ! 
তা ছিল মস্তোবড়ো ব্যাপার যার সম্পর্কে নির্ণয় নিতে পারলুম না : 
নগরদুর্গের ওপরদিকে আর নিচে যে এলাকাগুলো রয়েছে তাদের স্তর কেমনতর ? 
আমাদের দিনকালে পর্যটকদের পক্ষে দেখে বেড়ানোটা অসম্ভব । 
ব্যবসার চৌহদ্দি, সেকেলে গ্যালারিসহ, একই রকমের শৈলীর সার্কাস । 
কোনও দোকান চোখে পড়ছে না, কিন্তু পথের তুষারে মাড়িয়ে যাবার দাগ ; 
কয়েকজন নবাব, লণ্ডনের রবিবারের সকালে হাঁটার লোকেদের মতন বিরল, 
হীরের তৈরি ঘোড়ারগাড়ির দিকে এগোয়। কয়েকটা লাল মখমলের পালঙ্ক : 
মরুদেশের পানীয় বিতরন করা হচ্ছে, যার দাম আটশো থেকে 
আটহাজার টাকার মধ্যে পড়ে। সার্কাসের ভেতরে 
নাট্যালয় খোঁজার ধারণা সম্পর্কে আমি নিজেকে বললুম যে 
দোকানগুলোতে নিশ্চয়ই যথেষ্ট বিষণ্ণ নাটক অভিনীত হয় । 
আমার মনে হয় পুলিশও আছে ; কিন্তু আইনগুলো নিশ্চয়ই এমন অদ্ভুত 
যে অ্যাডভেঞ্চার করার ভাবনা আমায় এড়িয়ে যায়।
শহরতলিগুলো, পারিসের যেকোনো সুন্দর রাস্তার মতন পরিচ্ছন্ন, 
সূর্যের আলোর সাদৃশ্যের আনুকূল্য পায় ; 
গণতান্ত্রিক উপাদানের সংখ্যা কয়েক হাজার আত্মা হবে । 
এখানেও, ঘোড়াগুলো সার বেঁধে নেই ; 
শহরতলিগুলো বিটকেলভাবে গাঁয়ের দিকে গিয়ে হারিয়ে যায়, 
যাকে বলে ‘প্রশাসনিক এলাকা’, যা ছড়িয়ে পড়েছে শেষহীন 
পশ্চিমদিকের জঙ্গল আর পাদপবাগান পর্যন্ত, যেখানে বর্বর কুলীনরা 
যে আলো নিজেরা তৈরি করেছে, সেখানে সংবাদ শিকার করতে বেরোয়।

নিশিপালন

ইল্যুমিনেশান ২০

এই হলো আলোয় আস্হা, বিছানার ওপরে কিংবা মাঠে, জ্বরে নয়, অবসন্নতাতেও নয়।
ইনি বন্ধু প্রদীপ্ত নন দুর্বলও নন । তিনিই বন্ধু ।
ইনি ভালোবাসবার ; যন্ত্রণা দেয়া হয়নি, এবং যন্ত্রণাদায়ক নন ।
চাওয়া হয়নি বাতাস এবং জগতসংসারকে । জীবন ।
--এটা কী, তাহলে ?
--আর শীতল হয়ে যায় স্বপ্ন ।

মাঝখানের স্তম্ভে আলো ফিরে আসে । 
ঘরের দুই প্রান্তসীমা থেকে, একরকম মঞ্চই বলা যায়, 
মিলবিশিষ্ট দ্রোহীদের সাক্ষাৎ ঘটে । 
পাহারাদারের মুখোমুখি দেয়ালে কার্নিসের মতন 
কোনাকুনি জায়গায় মনস্তত্বের পারম্পর্য, 
আবহাওয়ার চাদর এবং ভূতাত্বিক ঢেউ -- 
গভীরভাবে অনুভুত গাঢ় এবং দ্রুত দলাদলি, 
যেখানে সব ধরনের প্রাণী তাদের যাবতীয় দর্শনানুপাত নিয়ে রয়েছে।

নিশিপালনের লন্ঠন এবং চাদর, ঢেউয়ের শব্দ তোলে, 
রাতের বেলায়, জাহাজের কাঠামোর পাশে, হালকে ঘিরে ।
সমুদ্রের নিশিপালন যেন খেটে-খাওয়া অ্যামেলির স্তনযুগল ।
কারুকার্য-শোভিত পর্দাগুলো, কিছুটা ওপরদিকে তোলা, 
পান্নারঙা লেসের ঝালর, যাকে লক্ষ্য করে নিশিপালনের পায়রারা উড়ে যায় ।
কালো উনানের সামনের পাথর, সমুদ্রতীরের প্রকৃত সূর্য : 
আহ, ইন্দ্রজালের ঝর্ণা ; ভোরের একমাত্র দৃশ্য, ঠিক এখনই !


অতীন্দ্রিয়
ইল্যুমিনেশান ২১
তীরের ঢালুতে দেবদূতেরা তাদের পশমের পোশাকে 
ইস্পাত আর পান্নার চারণভূমিতে পাক খায়।
পাহাড়ের গোলাকার মাথার ওপরে লাফাতে থাকে আগুনশিখার মাঠ । 
বাঁদিকে খেতের আলগুলোকে পদদলিত করেছে পাক থেকে বেরিয়ে প্রতিটি হত্যা, 
প্রতিটি যুদ্ধ, প্রতিটি বিপর্যয়ের ধ্বনি। প্রান্তরেখার ওপারে ডানদিকে আরোহণরেখা, প্রগতির দিকে ।
এবং,  যখন শীর্ষের কার্নিস দিয়ে গড়ে উঠছে 
ছবির মোচড় আর লাফিয়ে ওঠা  মানবসমুদ্র আর রাত্রির শঙ্খধ্বনি ।
নক্ষত্র এবং আকাশের ফুলেল মিষ্টতা আর বাদবাকিরা নেমে আসে বাঁধের উল্টোদিকে, 
যেন চুবড়ির ভেতরে -- আমাদের মুখোমুখি, এবং গড়ে তোলে অতল মঞ্জরী এবং নিচের নীল ।

ঊষা
ইল্যুমিনেশান ২২
আমি গ্রীষ্মের ভোরকে গ্রহণ করে নিলুম ।
প্রাসাদগুলোর সামনে এখনও কোনোকিছুর নড়চড় নেই । 
জল মারা গিয়েছিল । বনানিঘেরা পথকে ভিড়ের ছায়া এখনও ছেড়ে যায়নি । 
আমি হাঁটছিলুম, তপ্ত শ্বাস নিচ্চিলুম, আর দামি পাথরগুলো ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলো, 
আর ডানাগুলো শব্দ না করে উড়লো ।
প্রথম অভিযানে, শীতল ফিকে আলোয় আগে থেকেই আলোকিত রাস্তায়, 
একটা ফুল  আমাকে তার নাম জানালো ।
দেবদারু গাছে ঘেরা ফর্সা আলুলায়িত ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে হাসলুম : 
চাঁদির শীর্ষভূমির ওপরকার ঈশ্বরীকে চিনতে পারলুম ।
তারপর একের পর এক অবগুন্ঠন সরালুম । গলির ভেতরে ঢুকে, হাত নাড়ালুম । 
 সমতলভূমিতে গিয়ে আমি মেয়েটিকে মোরগের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করলুম । 
শহরে ঢুকে, মেয়েটি ঘণ্টাঘর আর গম্বুজের মাঝে পালিয়ে গেল, 
এবং, ভিখারির মতন শ্বেতপাথরের জেটি পেরিয়ে, আমি ওকে ধাওয়া করলুম ।
রাস্তার ওপর দিকে, জলপাই বনের কাছে, 
ওর  অবগুন্ঠনসুদ্ধ ঘিরে ফেললুম মেয়েটিকে, 
আর অনুভব করলুম ওর বিশাল শরীর বেশ ছোটো । 
জঙ্গলের পাদদেশে পড়ে গেল ভোর আর বালকটি ।
ঘুম ভাঙতে, দুপুর ।

ফুলগুলো
ইল্যুমিনেশান ২৩

সোনার ছাদ থেকে -- রেশমের সুতো, ধূসর পাতলা কাপড়, 
সবুজ মখমল এবং স্ফটিকের চাকার মাঝে যা রোদ্দুরে ব্রোঞ্জের মতন কালো হয়ে যায় 
-- আমি লক্ষ্য করি চাঁদির সুতোর কারুকাজ-করা জাজিমের ওপরে ফেলেরাখা শেয়ালকাঁটা, 
চোখ এবং চুল ।
হলুদ সোনার টাকায় মণিরত্নের গুঁড়ো, 
পান্নার গম্বুজকে ধরে রেখেছে মেহগানি থাম, 
গোলাপজলকে ঘিরে সাদা সাটিনের টুকরো আর চুনীর মিহিন জল ছেটানো হয়েছে ।
বড়ো নীল চোখ আর তুষার-আঙ্গিকের কোনো দেবতার মতন,
 শ্বেতপাথরের ছাদে সমুদ্র ও আকাশ ডেকে আনছে কচি ও তরতাজা গোলাপগুচ্ছ ।

পার্থিব রাত্রি
ইল্যুমিনেশান ২৪
দেয়ালের প্রহসনমূলক ফাটল খুলে ফেলছে এক দমকা ঝড় 
-- ভাঙাচোরা ছাদগুলোর কড়িবরগাকে ঢেকে ফেলছে 
-- এলোমেলো করে দিচ্চে বাঁধের পাঁচিল -- অন্ধকার করে ফেলছে জানালাগুলো ।
দ্রাক্ষালতার থেকে দূরত্বে, সিংহমুখ নর্দমার ওপরে আমার পা রেখে 
--- আমি এই জুড়িগাড়িতে চাপলুম যার সময় সুস্পষ্টভাবে উত্তল কাচে লেখা, 
বাইরে বেরিয়ে আসা প্যানেল, আর ঢেউখেলানো বসার জায়গা । 
আমার তন্দ্রার শবযান, আলাদা করে দ্যায়, আমার বোকামির মেষপালকের কুঁড়েঘর, 
বাতিল রাজপথের মাটিতে  আমার শকট বাঁক নেয় : 
এবং ঝাঁকুনির দরুণ ডানদিকের জানালায় ফিকে চাঁদনি আকারগুলো, 
গাছের পাতা, স্তন পাক খেতে থাকে।
--একটা সবুজ আর একটা নীল, বেশ গভীর, দৃশ্যটাকে আক্রমণ করে । 
জোড়াতালি দেয়া নুড়িপথের ফলে ঘোড়ার বর্ম খুলে যায় ।  
-- এখানে কেউ ঝড়ের জন্যে সিটি বাজায়, সোডোমের লোকজন 
আর জেরুজালেমের লোকজন, বন্য পশু এবং সৈন্যবাহিনী ।
( -- ঘোড়ারগাড়ির চালক এবং স্বপ্নের প্রাণীরা কি আবার নিয়ে যাবে 
শ্বাসরুদ্ধকর ঝোপঝাড়ে, রেশমি বসন্তঋতুর চোখে আমাকে ছুঁড়ে ফেলার জন্যে । )
--এবং আমাদের,  চাবুক মেরে, লেহ্য জল আর ছড়িয়ে পড়া খরায়, 
কুকুরদের চিৎকারে গড়াগড়ির জন্যে পাঠানো হবে…
--বাঁধের পাঁচিলগুলো এক নিঃশ্বাসে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ।

সামুদ্রিক
ইল্যুমিনেশান ২৫
তামা ও চাঁদির রথ --
চাঁদি ও ইস্পাতের জাহাজমুখ--
সমুদ্রের ফেনায় লাঙল চালানো---
কাঁটাগাছের খুঁটি ওপড়ানো ।
উষর প্রান্তরের বিস্তার,
আর জোয়ার-ভাটায় আঁকা রেখা,
পূর্বদিকে ঘুরতে-ঘুরতে বয়ে চলে যায়,
জঙ্গলের থামগুলোর দিকে,
জেটির খুঁটিগুলোর দিকে,
যার লোহার বাতাগুলো আলোর ঘুর্ণিঝড়ে চূর্ণ ।

শীতকালের ভোজনোৎসব
ইল্যুমিনেশান ২৬
নাটুকে-মজার বস্তির পেছনদিকে আওয়াজের প্রপাত । 
গোলোকধাঁধার পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা অ্যাভেনিউ আর বাগানে, 
চক্রাকার বাজি অনেকক্ষণ জ্বলে -- সূর্যোদয়ের সবুজ আর লাল । 
চুল-সাম্রাজ্যের  বিনুনিতে হোরেসের কবিতার উপদেবীর দল 
-- গোলগাল সাইবেরিয় মহিলা, ফরাসি চিত্রকরের আঁকা ছবির মতন চিনা মেয়েরা ।

মানসিক যন্ত্রণা
ইল্যুমিনেশান ২৭
এরকম কি হতে পারে যে মেয়েটি আমাকে  ক্ষমা পাইয়ে দেবে 
শাশ্বতভাবে বিধ্বস্ত  উচ্চাকাঙ্খা থেকে-- 
বহুকালের দারিদ্র্যকে মেরামত করে  আরামদায়ক সমাপ্তি ঘটাবে 
-- আমাদের মারাত্মক আলস্যের লজ্জায় ঘুম পাড়িয়ে দেবে সাফল্যের দিন ?
( ও পামগাছ ! হীরক ! ভালোবাসা ! প্রাণশক্তি ! 
-- প্রতিটি আনন্দ ও গরিমার চেয়ে উচ্চতর !-- 
সবরকমের, সব জায়গায় -- রাক্ষস, দেবতা -- এখানে বসবাসের যৌবন ! )
ঐন্দ্রজালিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক ভাতৃত্বের আন্দোলনকে কি আদি স্বাধীনতার 
প্রগতিশীল পুনর্বাসন হিসাবে যত্নে পালন করা হবে ?...
কিন্তু এই রক্তচোষা মেয়ে যে আমাদের শায়েস্তা করে সে হুকুম দেয় যে 
আমরা যেন ওর দেয়া খুদকুঁড়োয় নিজেদের মজায় রাখি, 
নয়তো আরও মজা চালিয়ে যাও ।
ক্লান্ত বাতাস এবং সমুদ্রের মাঝ দিয়ে জখমের গমন ; 
যন্ত্রণায়, খুনি জল এবং বাতাসের নৈঃশব্দের ভেতর দিয়ে ; 
হাসিমুখ অত্যাচারের মাঝ দিয়ে, তাদের কোলাহলপূর্ণ স্তব্ধতার দিকে ।

মেট্রপলিটান
ইল্যুমিনেশান ২৮
নীলাভ খাঁড়ি থেকে ওসিয়ানের সমুদ্র পর্যন্ত, 
গোলাপি ও কমলারঙের বালুকাবেলায়, মদের রঙের আকাশ যাকে ধুয়ে দিয়েছে, 
স্ফটিকের বীথি ওপরে উঠে গিয়ে আড়াআড়ি ভাগ করে ফেলেছে, 
যা তখনই দখল করে নিয়েছে গরিব কমবয়সী পরিবারেরা 
যারা ফলবিক্রেতাদের দোকানে কেনাকাটা করে । বৈভব নেই । -- এই নগর !
আলকাতরার মরুভূমি থেকে, সরাসরি উড়াল দিয়ে কুয়াশার আতঙ্কজনক পরতগুলোর তলায় 
যে আকাশ বাঁক নেয়, পিছিয়ে যায়, নেমে যায়, 
তাকে গড়ে তুলেছে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া 
যা  শোকার্ত সমুদ্র বিলিয়েছে, হেলমেট পরে পালিয়েছে, 
চাকা, জাহাজ, ঘোড়ার লেজের তলায় বাঁধা চামড়া -- সেই সংগ্রাম !
মাথা তোলো : ওই ধনুকাকৃতি কাঠের সাঁকো ; সামারিয়ার শেষ সব্জি-উঠোন, 
শীতল রাতের দ্বারা কাঁপানো লন্ঠনের আলোয় উজ্বল মুখোশ ; 
আওয়াজ-তোলা পোশাকে বোকা জলপরী, নদীর তলদেশে ; 
মটরখেতে জ্বলজ্বলে করোটি -- এবং অন্যান্য অলীক ছায়ামূর্তির প্রবাহ 
-- গ্রামগুলো। রাস্তার দুই কিনারে রেইলিঙ আর দেয়াল, 
ঝোপঝাড়ের প্রসারণ থামাতে পারেনি, 
আর নৃশংস ফুলের দল যাকে তুমি বলবে আত্মা আর সহোদরা । 
একঘেয়েমি জাগানো নাটক-- রাইননদীর অতিঅভিজাতদের  
পরীদের গল্পের সম্পত্তি, জাপানি, প্যারাগুয়ের গুয়ারানি, 
ওরা প্রাচীনকালের সঙ্গীত বুঝতে পারার জন্যে এখনও যোগ্য 
-- সরাইখানা আছে যা আর সবসময় খোলা থাকে না-- 
আছে রাজকুমারীরা, আর যদি তুমি বেশি অভিভূত না হয়ে থাকো, 
নক্ষত্রদের অধ্যয়ন করো-- আকাশ ।
সকালে যখন, যুবতীটির সঙ্গে, তুমি তুষারের ফুলকির মাঝে লুটোলুটি খেয়েছিলে. 
সবুজ ঠোঁট, বরফ, কালো পতাকা আর নীলাভ আলোর রশ্মি, 
আর মেরু-সূর্যের বেগুনিরঙা সুগন্ধ -- তা তোমার জীবনীশক্তি ।

অমার্জিতের দল
ইল্যুমিনেশান ২৯
ঋতুদের আর দিনগুলোর অনেক পরে, লোকজন আর দেশগুলো, 
রক্তমাখা মাংসের পতাকা সমুদ্রের রেশম এবং সুমেরুর ফুলগুলোতে 
( তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই । )
বীরত্বের পুরোনো তূর্যনিনাদ কাটিয়ে ওঠার পর 
-- আমাদের হৃদয়ে আর মাথায় আক্রমণ অব্যহত রেখেছে 
-- প্রাচীন গুপ্তঘাতকদের থেকে বেশ দূরে ।
--ওহ ! রক্তমাখা মাংসের পতাকা সমুদ্রের রেশম এবং সুমেরুর ফুলগুলোতে 
( তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই । )
ভাবাবেশসমূহ !
তুষারের ঝাপটায় ঝরছে আলোকচ্ছটা -- ভাবাবেশসমূহ ! 
-- জাগতিক হৃদয় থেকে ছোঁড়া হীরকের হাওয়ায় বৃষ্টিতে আগুন, আমাদের পোড়াবার জন্যে । 
-- হে জগতসংসার !--
( পুরোনো আশ্রয় এবং পুরোনো আগুনশিখা থেকে, যা তুমি শুনতে পাও আর অনুভব করো, )
আলোকচ্ছটা এবং সামুদ্রিক ফেনা । সঙ্গীত, খাঁড়ির মন্থন আর নক্ষত্রে জমাটবাঁধা ঝুলন্ত তুষার।
হে ভাবাবেশ, হে জগতসংসার, হে সঙ্গীত ! 
এবং এখানে, আকৃতি, ঘাম, চুল এবং দুই চোখ, ভেসে যায় । 
এবং শ্বেত অশ্রুজল, ফুটন্ত -- হে ভাবাবেশসমূহ ! 
-- এবং নারীকন্ঠস্বর পৌঁছে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির তলদেশে এবং সুমেরুর গুহাগুলোয় ।
পতাকা...

অভিক্ষিপ্ত সৈকতাংশ
ইল্যুমিনেশান ৩০
আমাদের গ্রামের বাড়ি আর তার বাগানের উল্টোদিকে 
সোনালি সকাল আর শিহরিত সন্ধ্যা খুঁজে পেল আমাদের দুই মাস্তুলঅলা পোত, 
সমুদ্র থেকে কিছুটা দূরে, তৈরি করে ফেলেছে শৈলান্তরীপ যা এপিরাসদেশ 
কিংবা গ্রিসের পেলোপনিজ, জাপানের প্রধান দ্বীপ, কিংবা আরবের মতন ছড়ানো!
ফিরে-আসা তত্বে আলোকিত মন্দিরগুলো ; 
উপকূলের আধুনিক প্রতিরক্ষার অমেয় দৃশ্য ; 
উষ্ণমণ্ডলের ফুলদল আর গ্রিকদের আসবদেবতার নকশাকাটা বালিয়াড়ি ; 
কার্থেজের বড়ো খাল আর নোংরা ভেনিসের বাঁধ ; 
এটনা আগ্নেয়গিরির হালকা উদ্গীরণ, ফুলের আর গ্লেসিয়ারের জলের তৈরি তুষার-ফাটল ; 
জার্মান পপলার গাছে ঘেরা ধোপারঘাট ; 
জাপানি গাছের ঝাঁকড়া মাথায় ছাওয়া ঢালের ওপরে বর্ণনাতীত বাগান ; 
এবং স্কারবরো ও ব্রুকলিনের ‘রাজকীয়’ এবং ‘অভিজাতদের’ প্রাসাদের সামনেদিক ; 
আর তাদের দুই পাশে  রেললাইন , খোঁড়াজমি, হোটেলের চড়াই, ইতালি, আমেরিকা, 
এশিয়ার সবচেয়ে মনোরম সবচেয়ে বিশাল নির্মাণ, বর্তমানে দামি আলোকমালায় ঝিলমিলে, 
পানীয় এবং মৃদুমন্দ বাতাস, ভ্রমণকারী ও সম্ভ্রান্তদের দ্বারা প্রভাবান্বিত-- 
যারা দিনের আলোয়, অনুমতি দ্যায়, সাগরতীরের দ্রুতলয়ী নাচিয়েদের -- 
এমনকি শিল্পের মঙ্গলময় অলঙ্কারের সঙ্গীতকে, যাতে প্রাসাদের সৈকতাংশের 
সামনেদিককে অবিশ্বাস্যভাবে সাজিয়ে তোলা যায় ।

দৃশ্যাবলী
ইল্যুমিনেশান ৩১
প্রাচীন মিলনানন্তক নাটক তার সমন্বয়কে অনুধাবন করে, 
তার রাখালিয়া কাহিনিকে বিভাজন করে : তক্তায় গড়া প্রশস্ত পথ ।
পাথুরে জমির ওপরে একদিক থেকে আরেকদিক পর্যন্ত কাঠের দীর্ঘ বাঁধ, 
যেখানে অসভ্য ভিড় পাতাহীন গাছের তলায় চলাফেরা করে ।
কালো পাতলা কাপড়ে তৈরি দরদালানগুলোয়, লন্ঠন-হাতে আর ফেলে যাওয়া 
পথচারীদের অনুসরণ,
নাটুকে পাখি ঝাপট মেরে নেমে আসে রাজমিস্ত্রির তৈরি নৌকাসাঁকোয় 
যা দুলে ওঠে নামতে-থাকা দর্শকদের ভিড়ে ঢাকা দ্বীপপূঞ্জে ।
বাঁশি আর মদ্যপানে-ভরা গীতিকবিতামূলক দৃশ্য, ছাদের মাপের 
উঁচু ঢালের কোনাকুনি আধুনিক আড্ডার বৈঠকখানায় কিংবা প্রাচ্যদেশের প্রাচীন হলঘরে ।
ঝোপঝাড়ের ঝুঁটিতে ঘেরা অ্যামপিথিয়েটারের প্রান্তে 
ঐন্দ্রজালিক দৃশ্যাবলী কৌশল করে -- কিংবা সরে যায় 
এবং গ্রিসের বোয়েটিয়ানদের জন্যে সুর বাঁধে, 
দীর্ঘ গাছেদের সঞ্চরণশীল ছায়ায়, খেতের কিনারায় ।
শিলা-বিভাজনের কাছে মজার অপেরা 
আমাদের মঞ্চের ওপরে টুকরো হয়ে যায়  
যেখানে দশটা বিভাজক পরস্পরের সঙ্গে মেলে, 
যা গ্যালারি থেকে আলোর পাদদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ।


ঐতিহাসিক সন্ধ্যা
ইল্যুমিনেশান ৩২
যে সন্ধ্যাই হোক, বলতে গেলে, আমাদের আর্থিক আতঙ্ক থেকে যে পর্যটক ফিরে যাচ্ছেন, 
নিজেকে আবিষ্কার করেন, একজন গুরুর হাত চারণভূমির বীণাকে জাগিয়ে তোলে ; 
পুকুরের তলায় তাস খেলা হয়, আয়না, রানি আর অনুগতদের প্রিয় ; 
সেখানে রয়েছেন সন্তেরা, পালতোলা জাহাজ, ঐকতানের সূত্র, 
এবং সূর্যাস্তের কিংবদন্তিপ্রতীম সঙ্গীতময়তা ।
শিকারিদের আর দলবলকে দেখে ও ভয়ে কেঁপে ওঠে । 
নাটক ঝরে পড়ে তৃণাচ্ছাদিত ভূমির চাপড়ায় । 
এবং গরিব ও দুর্বলদের এই বোকামির স্তরে বড়োই অপর্যাপ্ত !
ওর কেনা-গোলাম চোখে, জার্মানি চাঁদের দিকে মিনার তুলে উঠে যায় ; 
তার্তারদের মরুভূমিতে আলো জ্বলে ওঠে ; 
দিব্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে প্রাচীন বিদ্রোহ প্ররোচিত হতে থাকে ;  
সিঁড়ি আর পাথরের তৈরি আরামকেদারায় একটি ছোট্ট জগতসংসার, 
ফ্যাকাশে আর সমতল, তৈরি করা হবে । তারপর পরিচিত সমুদ্র ও রাত্রির নৃত্যানুষ্ঠান ; 
সদগুণহীন রসায়ন, এবং অসম্ভব সঙ্গীত ।
সেই একই বুর্জোয়া ইন্দ্রজাল যেখানে আমাদের ছোটো নৌকা নামিয়ে দ্যায় ! 
সবচেয়ে সাধারণ ডাক্তারও মনে করে যে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে 
নিজেকে সমর্পণ করা আর সম্ভব নয়, এ হলো দৈহিক আত্মগ্লানির কুহেলিকা, 
যার নিরীক্ষণ ইতিমধ্যে এক দুর্দশা হয়ে উঠেছে ।
না ! বাষ্পঘরের মুহূর্ত, বাষ্পীভূত সমুদ্র, ভূগর্ভস্হ অগ্নিকাণ্ড,  
অনুবর্তী অগ্নিকাণ্ড, ঘুরে-বেড়ানো গ্রহ এবং তার ফলে উন্মূলন, 
বাইবেলে বর্ণিত যৎসামান্য ঈর্ষার নিশ্চয়তা এবং যে নিয়মশৃঙ্খলায় 
তা মৌলিক সাক্ষ্যপ্রদান করবে -- যাই হোক, তা কিংবদন্তির ব্যাপার নয় !

বিচলন
ইল্যুমিনেশান ৩৩
জাঙ্গালের কিনারায় কারুকার্যময় ফিতের অবস্হানভঙ্গিমা,
স্টিমারের পেছনদিকে খাঁড়ি,
ঢালের দ্রুতি,
স্রোতের বিস্তারিত দোল
অসাধারণ আলোর মাঝ দিয়ে আকর্ষণ করে ভ্রমণকারীদের
এবং রাসায়নিক পরিবর্তন
উপত্যকার জলে পরিবেষ্টিত
এবং ঝড় ।
এরা পৃথিবীকে জয় করেছে
অন্বেষণ করেছে তাদের ব্যক্তিগত রাসায়নিক ধনসম্পদ ;
তাদের ভ্রমণে সঙ্গ দ্যায় আমোদপ্রমোদ আর আরাম ;
তারা নিজেদের সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে যায়
জাতিদের সম্পর্কে, শ্রেনির এবং প্রাণীদের, এই জাহাজে
বিশ্রাম করে এবং ঘুর্নি
পাললিক আলোয়,
অভীষ্টসন্ধানের ভয়ঙ্কর রাত্রিগুলোতে ।
কেননা জিনিসপত্র, রক্ত, ফুলদল, আগুন, রত্নাবলীর পারস্পরিক কথোপকথন থেকে,
ধাবমান জাহাজের বারান্দায় উদ্বিগ্ন বিচার-বিবেচনা,
--দেখতে পাওয়া যায়, জলের গতি দিয়ে চালিত 
পথের ওই দিকে খাতের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে
দানবরা, অফুরান আলোয় আলোকিত করছে -- তাদের অভিষ্টসন্ধান ;
নিজেদের সমন্বিত পরমানন্দের লক্ষ্যে,
এবং আবিষ্কারের বীরত্বে ।
বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনার মধ্যে
কমবয়সী যুগল জাহাজের কোনায় একা,
--তা কি ক্ষমার যোগ্য আদিম লজ্জা ?-
আর গান গাইছে ও পাহারা দিচ্ছে ।

তলদেশ
ইল্যুমিনেশান ৩৪
আমার মহান ব্যক্তিত্বের পক্ষে বাস্তব যেহেতু কন্টকময়
 --- তবু আমি নিজেকে আবিষ্কার করলুম, আমার প্রেয়সীর ডেরায়, 
তখন বেশ বড়ো এক নীল-ধূসর পাখি ছাদের আলসের দিকে উড়ে আসছিল 
কিংবা সন্ধ্যার ছায়ায় আমার ডানাকে অনুসরণ করছিল ।
বিছানার শিয়রের দিকের পায়ার কাছে, আমি তখন সামলাচ্ছিলুম, 
মেয়েটির আদরের মণিরত্ন  এবং তার সেরা পার্থিব শিল্পকর্ম, 
বেগুনি মাড়ির এক বড়ো ভাল্লুক, লোমে দুঃখমাখানো, 
স্ফটিকের চোখ আর কনসোল-টেবিলের ওপরে রাখা চাঁদির বাসনপত্র
তারা সব পরিণত হলো ছায়ায় এবং অগ্নিগর্ভ অ্যাকোয়েরিয়ামে ।
সকাল বেলায় -- জুনমাসের মারমুখো ভোর -- 
দৌড়ে চলে গেলুম মাঠে, যেন গাধা, 
যতোক্ষণ না ইতালির শহরতলির স্যাবাইন তরুণীরা এসে আমার ঘাড়ের ওপর পড়ছেন, 
আমার অভিযোগগুলো নিয়ে হাঁক পাড়লুম আর তড়পালুম ।

এইচ
ইল্যুমিনেশান ৩৫
যাকিছু দানবিক তা মালিনীর বিদকুটে অঙ্গভঙ্গীর অবমাননা করে ।
মেয়েটির একাকীত্ব হলো যৌনতার যন্ত্র ; ওর অবসন্নতা, প্রণয়োদ্দীপক কর্মশক্তি ।
 শৈশবের দ্বারা কড়া নজরে রাখা, মেয়েটি ছিল, বিভিন্ন কালখণ্ডে, 
জাতিগুলোর অত্যুৎসাহী সুস্বাস্হবাহিকা । ওর দুয়ার গরিবিয়ানার জন্য অবারিত । 
সেখানে, যারা বেঁচে আছে তাদের নশ্বরতা মেয়েটির কামোচ্ছ্বাসে ও ক্রিয়ায় বিমূর্ত হয়ে ওঠে ।
--ওহ, রক্তে জবজবে মেঝেতে আনাড়ি প্রেমের ভয়ঙ্কর কাঁপুনি 
এবং স্বচ্ছ উদযানে খুঁজে পাবে মালিনীকে ।

প্রার্থনা
ইল্যুমিনেশান ৩৬
আমার সহোদরা ভোরিংঘেমের লুইজি ভানেনকে: 
-- উত্তর সমুদ্রের দিকে ফেরানো তার নীল খোঁপা। -- জাহাজডুবির কারণে ।
আমার সহোদরা লেওনি অবোয় দ্য’অ্যাশবিকে । ওটস দিয়ে তৈরি মদ ! 
-- গুঞ্জরিত, জঘন্য, গ্রীষ্মের ঘাস । -- মায়েদের এবং বাচ্চাদের অসুখের খাতিরে ।
লুলুকে -- রাক্ষসী -- যে ‘লেস অ্যামিস’ যুগের বাগ্মীতার প্রতি তার আকর্ষণ 
এখনও বজায় রেখেছে আর তার অসম্পূর্ণ শিক্ষার উদ্দেশে । পুরুষদের জন্য । --মাদাম অমুককে।
যে বয়ঃসন্ধি আমার ছিল তার উদ্দেশে । এই বুড়ো সন্তকে, সন্ন্যাস কিংবা ধর্মপ্রচার । 
গরিবের প্রতিভাকে । এবং উচ্চপদস্হ যাজকদের ।
প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসকে, ধর্মবিশ্বাসের স্মৃতিস্হানকে 
এবং সেই সমস্ত ঘটনা যার কাছে লোকে আত্মসমর্পণ করে, 
সেই মুহূর্তের আকাঙ্খা অনুযায়ী কিংবা আমাদের নিজস্ব সঙ্কটপূর্ণ পঙ্কিলতার উদ্দেশে ।
এই সন্ধ্যায়, সুমেরুর তুষারচূড়ার সিরসেটোকে, মাছের মতন মোটা, 
আর দশ মাসের লালচে আলোর মতন ঝলমলে -- 
( মেয়েটির হৃদয় পীতাভ তৈলস্ফটিক এবং স্ফুলিঙ্গসম )
 -- আমার একমাত্র প্রার্থনা রাতের এলাকার মতন নিঃশব্দ 
এবং এই মরুঅঞ্চলের বিশৃঙ্খল  সন্ত্রাসের চেয়েও দুঃসাহসী ।
যে কোনো মূল্যে এবং প্রতিটি পোশাকে, এমনকি আধ্যাত্মিক যাত্রাতেও । 
কিন্তু তারপর আর নয়।

গণতন্ত্র
ইল্যুমিনেশান ৩৭
‘পতাকা এগোয় অপরিচ্ছন্ন ভূদৃশ্যের মাঝে, 
আর আমাদের দেশোয়ালি বুলি ড্রামের আওয়াজকে মৃদু করে দ্যায় । 
দেশের মধ্যাংশে আমরা সবচেয়ে নিন্দিত বেশ্যালয়কে লালন করবো । 
যুক্তিপূর্ণ বিদ্রোহগুলোকে নির্বিবাদে নিকেশ করবো ।
মশলাদার এবং মদে বেহুঁশ দেশগুলোর উদ্দেশে ! -- সবচেয়ে দানবিক
 শোষণ, শিল্পোৎপাদনকারী বা মিলিটারি সেবার উদ্দেশে । 
এখান থেকে বিদায়, জানা নেই কোথায় । 
স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে আমরা গড়ে তুলব হিংস্র দর্শন : 
বিজ্ঞান সম্পর্কে অবিদিত, আমাদের আরামের জন্যে ছলনাময় : 
গলায় দড়ি দিক জগতসংসার । সেটাই আসল প্রগতি । ফরোয়ার্ড -- মার্চ !’

পরী
ইল্যুমিনেশান ৩৮
নাক্ষত্রিক নৈঃশব্দে, হেলেনের জন্যে কুমারী ছায়ায় 
এবং অকম্পমান ঔজ্বল্যে সঞ্চারিত হচ্ছে প্রাণশক্তি । 
গ্রীষ্মের তাপ বোবা পাখিদের সোপর্দ করা হয়েছিল এবং অপরিহার্য আলস্য, 
একটা শোকাতুর দামের অতীত মৃত ভালোবাসা আর ডুবন্ত সুগন্ধের উপসাগরে 
এক বজরাকে উদ্দেশ্য করে।
কাঠুরিয়াদের স্ত্রীদের  চলনছন্দের পর, ধ্বংস হওয়া জঙ্গলের নীচের জলস্রোতের কলধ্বনিতে, 
এবং প্রতিধ্বনিত উপত্যকায় গোরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজে, 
আর নিষ্পাদপ প্রান্তরের কান্নায়।                
হেলেনের শৈশবের কারণে কেঁপে উঠতো ঝোপঝাড় আর ছায়ারা, 
গরিবের বুক, আর স্বর্গীয় কিংবদন্তি।
আর ওর চোখদুটি এবং নৃত্য,  দামি রশ্মির চেয়েও উন্নত, 
শীতের প্রভাব, আর মুহূর্তটির একক দৃশ্যের আনন্দ ।

যুদ্ধ
ইল্যুমিনেশান ৩৯
বাল্যকালে, আমার দর্শনানুপাতকে পরিশুদ্ধ করে দিয়েছিল বিশেষ আকাশ : 
যাবতীয় চরিত্রেরা আমার অবয়বে ছায়া ফেলেছিল । প্রপঞ্চরা সরে যেতো । 
এখন, মুহূর্তদের শাশ্বত সংক্রমণ
এবং গণিতের অশেষ আমাকে এই জগতসংসারের মাঝ দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায় 
যেখানে আমি প্রতিটি নাগরিক সন্মানে আত্মসমর্পণ করি, 
অপরিচিত বাচ্চাদের দ্বারা এবং পরিব্যপ্ত অনুভূতির দ্বারা । 
আমি যুদ্ধের স্বপ্ন দেখি, যা সঠিক তার কিংবা শক্তিমত্তার, অভাবিত যুক্তি ছাড়াই। 
গানের একটা কলির মতন এটা অত্যন্ত সরল ।

দৈত্য
ইল্যুমিনেশান ৪০
ও হলো অনুরাগ এবং বর্তমান কেননা 
ও ফেনায়িত জলরাশির  এবং গ্রীষ্মের শব্দাবলীর সামনে বাড়িটা গড়ে তুলেছে, 
ও যে কিনা খাদ্য আর পানীয়কে বিশুদ্ধ করেছে, 
ও যে কিনা অপসৃয়মান জায়গাগুলোর আকর্ষণ এবং সাময়িক নিবৃত্তির অতিমানবিক আনন্দ। 
ও হলো ভবিষ্যতের অনুরাগ, যে ক্ষমতা ও ভালোবাসায় আমরা, 
ক্রোধ ও ক্লান্তিকে ধরে রাখি, দেখি আমাদের পাশ কাটিয়ে পতাকাগুলোর মহোল্লাসের ভেতর দিয়ে 
ঝোড়ো আকাশের পানে চলে যাচ্ছে।
ও হলো ভালোবাসা, নিখুঁত এবং পুনরাবিষ্কৃত পরিমাপ, 
দারুণ এবং অপ্রত্যাশিত ফলাফলে,  এবং অসীম-অনন্ত : 
মারাত্মক ক্ষমতার প্রিয়তম যন্ত্র । আমাদের নিজেদের এবং ওর আত্মসমর্পণের ত্রাস সম্পর্কে 
আমরা জানি : হে আমাদের স্বাস্হ্যের আনন্দ, 
আমাদের মৌলিক মানসিক শক্তির প্রেরণা, 
ওর জন্যে স্বার্থপর অনুরাগ ও আবেগ, 
ও যে কিনা ওর অনন্তকালীন জীবনে আমাদের ভালোবাসে… । 
এবং আমরা ওকে ডাকি আর ও সঙ্গ দেয় আমাদের...। 
এবং যদি আদর ফুরিয়ে যায়, তা অনুরণিত হয়, ওর প্রতিজ্ঞা প্রতিধ্বনিত হয় :
 ‘এই সমস্ত কুসংস্কার দূর হোক, এই পুরোনো দেহগুলো, এই বাড়িঘর এবং এই সমস্ত কালখণ্ড ।
 আসলে এই নবযুগ  অন্ধকার !’
ও যাবে না ; ও আবার কোনো স্বর্গ থেকে নেমে আসবে না, ও নারীর ক্রোধ ও পুরুষের হর্ষকে, 
এবং যাবতীয় পাপের মুক্তি খুঁজে পাবে না : কেননা তা ফুরিয়ে গেছে, 
ওর অস্তিত্ব আছে, আর ওকে লোকে ভালোবাসে ।
হে ওর শ্বাসপ্রশ্বাস, ওর মস্তক, ওর ছুটে চলা : 
আঙ্গিক ও কর্মশীলতার পূর্ণতাপ্রাপ্তির অসম্ভব দ্রুতি!
হে মননশক্তির এবং বিশ্বলোকের বিশালতার বহুপ্রসূতা !
ওর দেহ ! স্বপ্নে দেখা উত্তরণ, নব্য-সন্ত্রাসের মুখোমুখি চুরমার ঐশ্বরিক করুণা !
ওকে নাগাল পাওয়া, ওর নাগাল পাওয়া ! 
ও পাশ দিয়ে চলে গেলে পুরোনো হাঁটুগাড়া আর ব্যথা উধাও হয় ।
ওর আলো ! যাবতীয় নাকিসুর এবং অসহ্য কষ্ট গভীর সঙ্গীতে বিলুপ্ত হয় ।
ওর পদক্ষেপ ! প্রাচীন আক্রমণের তুলনায় প্রচরণশীলতা আরও অস্বাভাবিক ।
হে ও আর আমরা ! অন্যের পরিত্যক্ত সেবার চেয়ে গর্ববোধ বেশি দয়ালু ।
হে জগতসংসার ! এবং নতুন দুর্ভাগ্যের সুস্পষ্ট গান !

ও আমাদের সবাইকে জেনেছে এবং ভালোবেসেছে । 
আজকের এই শীতের রাতে হয়তো আমরা জানতে পারবো, 
অন্তরীপ থেকে অন্তরীপে, বিক্ষুব্ধ মেরু থেকে জমিদারের পল্লীভবন পর্যন্ত, 
ভিড় থেকে বালিয়াড়ি পর্যন্ত, চাউনি থেকে চাউনি পর্যন্ত, 
শক্তি ও অনুভব ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কেমন করে ওকে অভিবাদন জানানো হবে আর দেখা হবে, 
এবং আবার পাঠিয়ে দেয়া হবে ওর যাত্রায়, আর জোয়ারের তলায় 
ও তুষারের মরুভূমির ওপরে, ওর দৃষ্টিপ্রতিভাকে অনুসরণ করে, 
ওর নিঃশ্বাস, ওর দেহ, ওর আলো ।

যৌবন

ইল্যুমিনেশান ৪১

রবিবার
সমস্যা তো আছেই, আকাশ থেকে অবধারিত পতন 
আর স্মৃতির আগমন এবং একত্রিত ছন্দ বাসাকে দখল করে নেয়, 
মাথাকে আর জগতসংসারের মনকে ।
--বনানী আর খেত পেরিয়ে একটা ঘোড়া শহরতলির ঘাসে দৌড়োতে আরম্ভ করে, 
প্লেগের অঙ্গারে ঝাঁঝরা । কোনো নাটকে একজন দুস্হ মহিলা, জগতসংসারের কোথাও, 
পরিত্যক্ত হবার অসম্ভাব্যতায় দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে । বেপরোয়া লোকেরা ঝড়ের , 
মাতলামির  আর আঘাতের জন্যে অপেক্ষা করে আছে । 
নদীর ধারে ছোট্ট বাচ্চারা অভিশাপের কন্ঠরোধ করে ।
এবার আমাদের সমীক্ষা আবার শুরু করা যাক যা জনগণের মাঝে জেগে-ওঠা 
ক্লান্তিকর কাজের দ্বারা জড়ো করা হয়েছে ।

সনেট
স্বাভাবিক গড়নের পুরুষ, বাগানে ঝুলন্ত ফলের মাংসে তৈরি নয়, 
ওহ শৈশবের দিনগুলো ! দেহ হলো হেলাফেলায় নষ্ট করার ধনসম্পদ ; 
ওহ, প্রেমে, মননের দোষ না শক্তি ? রাজপুত্র এবং শিল্পীতে পৃথিবীর ঢালু অংশ ছিল উর্বর, 
এবং বংশধররা ও জাতি আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেছে অপরাধ ও শোকে : 
জগতসংসার, তোমার ভাগ্য ও তোমার বিপদ । কিন্তু এখন, সেই খাটুনির পুরস্কার, 
তুমি, তোমার হিসেবনিকেশ, তুমি, তোমার ধৈর্যহীনতা, 
তোমার নাচের ও কন্ঠস্বরের চেয়ে বেশি কিছু নয়, স্হিরীকৃত নয়, 
বলপ্রয়োগ করেও নয়, যদিও আবিষ্কার ও যুক্তির দ্বিগুণ সাফল্যের ফলাফলের দ্বারা, 
নিজেকে জাহির না করে এবং ভাতৃত্ববোধের মানবিকতায়, চিত্রহীন ভূমণ্ডলে 
-- শক্তিমত্তা ও অধিকার প্রতিফলিত করে সেই নৃত্য ও কন্ঠস্বরকে, যা কেবল এখনই প্রশংসিত...

কুড়ি বছর

নির্দেশক কন্ঠস্বর নির্বাসিত...দৈহিক অকপটতা তিক্তভাবে বাসি...ধীর লয়ের সঙ্গীত । 
আহ, বয়ঃসন্ধির অশেষ অহংকার, সাগ্রহ আশাবাদ : 
সেই গ্রীষ্মে, কতো ফুলে ভরা ছিল জগতসংসার ! 
বাতাস ও আদল শুকিয়ে যাচ্ছে...
নপুংসকতা ও অনুপস্হিতিকে প্রশান্ত করার জন্যে গির্জার ঐকতান গায়কমণ্ডলী । 
কাচের ঐকতানমণ্ডলী রাতের সুর...সত্যিই স্নায়ুরা সত্বর শিকারে বেরোবে।

তুমি এখনও অ্যান্টনির প্রলোভনে আকর্ষিত । 
ছেঁটে-ফেলা উৎসাহের সঙ, তুচ্ছ গর্ববোধের আক্ষেপ, 
দুর্বল হয়ে চলেছো, এবং সন্ত্রস্ত । কিন্তু তুমি নিজেকে কাজে লাগাবে : 
তোমার উচ্চাসনের চারিধারে যাবতীয় ঐকতানময় ও স্হাপত্যের সম্ভাবনা ঘুরে বেড়াবে । 
অদেখা নিখুঁত প্রাণীরা তোমার নিরীক্ষায় আত্মসমর্পণ করবে । 
তোমার চারিপাশে জড়ো হবে প্রাচীন জনগণের স্বপ্নালু কৌতূহল এবং অলস বৈভব । 
তোমার স্মৃতি এবং তোমার ইন্দ্রিয়েরা তোমার সৃষ্টির আবেগের খোরাক হয়ে উঠবে । 
আর যদি জগতসংসারের কথা বলো, তুমি উঠে দাঁড়াবে, তাতে কীই বা হবে ? 
কিচ্ছু নয়, যতোই যাই হোক, বর্তমানে যা আঁচ করা যাচ্ছে ।

বিক্রয়
ইল্যুমিনেশান ৪২
বন্ধকী কারবারিরা যা বিক্রি করেনি তা বিক্রয়ের জন্যে, আভিজাত্য ও অপরাধ 
যে অভিজ্ঞতা আস্বাদন করেনি, 
যা প্রেমের কাছে এবং জনসাধারণের নারকীয় সততার কাছে অজানা; 
তাকে সমসময় ও বিজ্ঞানের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই :
কন্ঠস্বরগুলোর পুনর্গঠন হয়েছে ; তাবৎ ঐকতানীয় ও সুরসংযোজিত কর্মচাঞ্চল্য 
এবং তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োগ ; উপলক্ষ, একক, আমাদের ইন্দ্রিয়কে মুক্ত করার জন্য !
দামের চেয়ে বেশি দরে দেহ বিক্রির জন্যে, অপরিচিত জাতির, জগতের, 
যৌনতার, কিংবা অধঃপতনের জন্য !
প্রতি পদক্ষেপে ধনদৌলতের উৎসার ! হীরের অবাধ বিক্রি !
জনগণকে বিক্রির জন্য নৈরাজ্য ; রসপণ্ডিতদের জন্য অদম্য আনন্দ ;
 প্রেমিক-প্রেমিকার জন্যে, অনুগতদের জন্যে নৃশংস মৃত্যু !
বিক্রির জন্য রয়েছে বসত এবং স্হানান্তর, খেলধুলা, নিখুঁত পুলক ও আরাম, 
এবং শব্দাবলী, প্রণোদন ও যে ভবিষ্যৎ তারা গড়ে তুলবে !
বিক্রির জন্যে রয়েছে শোনা যায়নি এমন গণনা ও ঐকতান-ধাবনের প্রয়োগ
আকস্মিকতা আবিষ্কার করে অভাবিত স্হিতিকাল, তার তাৎক্ষণিক মালিকানাসহ।
অদৃশ্য সমারোহ, অননুভবনীয় পরমানন্দের প্রতি আরণ্যক ও অশেষ আবেগ, 
সঙ্গে তাদের প্রতিটি পঙ্কিলতার জন্যে 
এবং ভিড়ের ভয়াবহ চালচলনের জন্যে পাগলকরা গোপনীয়তা।
বিক্রির জন্য রয়েছে দেহ, কন্ঠস্বর, প্রচুর প্রশ্নাতীত ধনদৌলত, 
সবকিছুই যা কখনই বিক্রির জন্যে নয় । 
বিক্রেতারা এখনও পর্যন্ত তাদের মাল শেষ করতে পারেনি !
 বহুদিন পর্যন্ত দোকানদাররা তাদের বেতন দাবি করতে পারবে না !

[ রচনাকাল ১৮৭৩ - ১৮৭৫ ]
[ অনুবাদ : ২০১৯ ]
                                               Malay Roychoudhury

No comments:

Post a Comment