গোদারের দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানে উইয়াজেম্সকির আত্মজীবনী নিয়ে তৈরি ফিল্ম ‘রিডাউটেবল’ ( আমেরিকায় নাম ‘গোদার মোনামো” )
রিভিউ করেছেন ফিলিপ কেম্প
“গোদার মোনামো” ( Godard Mon Amour ), প্যাশটিশ-নির্মাতা মিশেল অ্যাজানাভিশ্যু ( ‘দি আর্টিস্ট’ এবং ‘ওএসএস : ১১৭’ খ্যাত Michel Hazanavicious ) জাঁ-লুক গোদারের জীবনের একটি ঘটনাবহুল সময়ের সালতামামি তৈরি করেছেন । যে সময়টা তিনি নিয়েছেন সেটি ৩৭ বছর বয়সী গোদারের সঙ্গে উনিশ বছর বয়সী অভিনেত্রী অ্যানে উইয়াজেম্সকির বিবাহিত জীবন, ফরাসি ছাত্রদের মে ১৯৬৮ সালের দ্রোহ, যে দ্রোহের কারণে সেই বছর কান ফিল্ম ফেস্টিভাল বাতিল হয়ে গিয়েছিল, ইত্যাদি নিয়ে। ফিল্মটি অ্যানে উইয়াজেম্সকির স্মৃতিকথা (Un An Après বা One Year After”)-এর ঘটনানির্ভর । গোদার, যখন তাঁর বয়স ৮৭ বছর, এবং তিনি “Le Livre d’Image” ফিল্মটি কান ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, মিশেল অ্যাজানাভিশ্যু তাঁকে নিয়ে ফিল্ম তৈরি করছেন বলা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, “মূর্খ, মুর্খের আইডিয়া।” ব্যাপারটা কিন্তু তা নয় । ধারণাটা অসাধারণ । তবে ফিল্মটা উৎকট । উইয়াজেম্সকির জন্ম ১৪ মে ১৯৪৭ এবং মৃত্যু ৫ অক্টোবর ২০১৭ ।
কিন্তু অস্বাস্হ্যকর মুগ্ধতা বাদ দিয়ে নয় । গোঁড়া গোদারপ্রেমীদের কাছে “গোদার মোনামো” একটি অপরিহার্য ঘৃণা-দর্শন । যাঁরা গোদার সম্পর্কে দোনামনা, সেই দলবাজদের দৃষ্টিতে ফিল্মটা একধরণের মজার খোরাক যোগাবে । কিন্তু গোদারকে তীব্র সমর্থন ছাড়াই আপনি এই ফিল্মে বেরঙা, হালকা, ঝকঝকে রঙের বাদামের গুঁড়ো-মাখানো বিস্কুট খেতে পাবেন । ফি্ল্ম আরম্ভ হলে আপনি গোদার সম্পর্কে দুয়েকটা কথা জানতে পারবেন -- কিংবা ফ্রান্স, রাজনীতি, যৌনতা আর সিনেমা ইত্যাদি -- কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেন যে ফিল্ম শেষ হলে আপনি টের পাবেন যে বিশেষ কিছুই জানতে পারলেন না ।
গোদার, ভালোর জন্য হোক বা খারাপ, একজন সিনেমাটিক চিন্তাবিদ, এমনই একজন যিনি চেষ্টা করেছেন, বহুপ্রসূ এবং বিতর্কিত কেরিয়ারে, ফিল্ম মাধ্যমের দার্শনিক সম্ভাবনা এবং বৌদ্ধিক সারবস্তু, তাকে যাতে করে তোলা যায় ধারণা এবং তর্কবিতর্কের, গল্পের, ছবির এবং আবেগের আধেয় । কিন্তু অ্যাজানাভিশ্যু তার সম্পূর্ণ উল্টো দেখিয়েছেন ও করেছেন : চিত্রকল্প এবং শৈলীর অভ্রান্তচিত্ত দক্ষ নির্মাতা যাঁর বিশেষ কিছু বলার নেই এবং বিশ্বাসও নেই যে কিছু একটা বলতে হবে । গোদারের সবচেয়ে অনুকরণীয় অবদানগুলোকে দখল করে নিয়ে--- বিভিন্ন সুরের মিশ্রণে ভয়েস-ওভার, পরিচ্ছদের টাইটেলগুলো পর্দায় ঝলকে-ওঠা, ফুর্তিবাজ সম্পাদনা, নগ্ন নারীদের ধাঁধায় কথাবার্তা -- এগুলোয় শ্রদ্ধার চেয়ে বেশি আছে প্রতিশোধের স্পৃহা । “গোদার মোনামো” অক্লান্ত প্রয়াস করেছে তার প্রধান চরিত্রকে নিজস্ব অগভীরতায় চুবিয়ে দিতে ।
১৯৬৭ এবং ১৯৬৮ সালে গোদার একজন বিখ্যাত ও বিতর্কিত চিত্রপরিচালক, নিজের সময়ের একজন সাংস্কৃতিক নায়ক, নিজের খ্যাতিকে ঘষে তুলে ফেলতেও যিনি পেছপা নন এবং নিজের শিল্পকে সমসাময়িক রাজনৈতিক আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াবার চেষ্টা করছেন । উইয়াজেম্সকি ( যাঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্টেসি মার্টিন ), রক্ষণশীল লেখক ফ্রাঁসোয়া মরিয়াকের নাতনি, তখন সবে আরম্ভ করেছেন La Chinoise ফিল্মে অভিনয়, বামপন্হী ফরাসি যুবা-সংস্কৃতির মাওবাদী বাঁক-সম্পর্কিত ফিল্ম, গোদারের ব্যাঙ্গাত্মক অবদান । মেয়েটি বিয়ে করেন গোদারকে এবং মহানন্দে তার পরাণসুন্দরী ও যৌনতার আদর্শ হয়ে ওঠেন, গোদারের তিরিক্ষি মেজাজকে আকর্ষক আর তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিকে যৌনতাবর্ধক মনে হয় মেয়েটির ।
লুই গারেলের অভিনয়ে আংশিকভাবে গোদারের অনন্যসাধারণ প্রতিভা বাকচাতুর্যে মনোহর হয়ে ওঠে, কিন্তু ফরাসি ফিল্মে তাঁকে নেয়াটা বেশ হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার । ( লুই গারেলের বাবা, ফিলিপে, একজন চিত্রপরিচালক, যাঁকে বলা হয় ককতো আর গোদারের সন্তান ) । লুই গারেল একজন শক্তিশালী অভিনেতা, তাছাড়া, দেখে মনে হয়, তিনি যশস্বী লোকেদের বেশ চালাকচতুর ছদ্মবেশী । পপুলার সংস্কৃতির ভিন্ন মহাবিশ্বে, ওনার অভিনীত গোদার, একটি বোকা পুরুষব্যাঙের ক্যাঁকো কন্ঠস্বর আর হালকা বদহজমের মেজাজ নিয়ে, ‘শনিবার রাতের শো’ এর অ্যাঙ্করের মতন সপ্তাহশেষের ঘোষক বা ‘নোংরা বিপদের’ প্রতিযোগীর মতন দেখায় ।
ফিল্মটিতে গোদারকে নিয়ে যে মজা করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, তিনি কাচের গেলাস ভাঙছেন, অনেক সময়ে প্রদর্শনকারীদের দিকে ছুঁড়ে, যা থেকে মনে হয় যে অ্যাজানাভিশ্যু সুযোগ খুঁজেছেন ভিড়ের অজস্র মানুষের কথা তুলে ধরার । অনেকসময়ে, ঝাণ্ডা ওড়ানোর গুঞ্জনে, একজন গোদার-প্রেমী এসে গোদারের ষাট দশকের ফিল্মের, যেমন ‘ব্রেথলেস’ ও ‘কনটেম্পট-এর গুণগান’ করে যাবে । বিশ্রী ভদ্রতা থেকে সরাসরি নোংরামিতে নেমে যাওয়াটা পরিচালক অ্যাজানাভিশ্যুর প্রতিক্রিয়াশীল বিচ্যুতি এবং তাঁর সৃজনশীল, আদর্শিক এবং মানসিক সংকটের লক্ষণ।
গোদার চেয়েছেন ফিল্মনির্মানণে এমনই এক অভিমুখ হয়ে উঠুক যা তাঁর রাজনৈতিক গরজের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবে, এক দ্রোহী সিনেমার জন্ম হোক যা সমস্ত বুর্জোয়া ও পরম্পরাগত ব্যাপারকে সমালোচনায় অনড় থাকবে । বর্তমানে, এই উচ্চাকাঙ্খাকে টিটকিরি মারা ছাড়া, কোনোকিছুই তেমন সহজ নয়, এবং ষাটের দশকের রাজনীতি-প্রভাবিত শিল্পগুলোকে সেই সময়েও অনেকের মনে হয়ে থাকবে নির্বোধ, কৌতুকপূর্ণ বা অতিমাত্রায় অভিব্যক্ত। তবে এই ধারণা যে চলচ্চিত্র পুঁজিবাদী মৌজমস্তির চেয়ে বেশিকিছু দিতে পারে এবং ব্যক্তি-এককের আত্মপ্রকাশকে ছাপিয়ে যেতে পারে--- তা শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে কিংবা সমবেত কল্পনার পথ প্রশস্ত করার কথা ভাবতে পারে-- তাকে বাতিল করা চলে না । ১৯৬৮ সালের পর গোদারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা অলস-চিন্তায় এই ফিল্মে একটি রুদ্ধপথ হিসাবে দেখানো হয়েছে, মনে হবে সেই পথে যাত্রা করা হয়নি ।
অ্যাজানাভিশ্যুর যদি সিনেমা ও রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য ধারণা থাকত, তাহলে তাঁর এই পরামর্শ যে গোদারের উচিত ছিল সিনেমা অথবা রাজনীতির মধ্যে কোনও একটা বেছে নেওয়া, তাহলে অমন বিধেয়কে মান্যতা দেয়া যেতে পারত । প্রেমের বিষয়ে বলতে হলে, যা কিনা এই ফিল্মের প্রতীয়মান কেন্দ্রবিন্দু, তাও আরেকটা সুযোগ নষ্ট করার উদাহরণ। কেউই তর্ক জুড়বে না যে গোদার একজন ভালো মানুষ । ফিল্ম সমালোচক হিসাবে আবির্ভাবের সময় থেকে মানববিদ্বেষ তাঁর ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে আছে, এবং তাঁর জীবনীতে বন্ধুত্বভঙ্গ ও পোড়ানো সেতুর ছড়াছড়ি । কিন্তু গোদারের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, সেই লুই গারেলের নষ্টামি সত্ত্বেও, এই ফিল্ম তাঁকে মোটেই একজন আকর্ষণীয় পাজি-লোক করে তোলে না ।
স্টেসি মার্টিন, যিনি অ্যানে উইয়াজেম্সকির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তিনি একজন কমনীয় ও নিবেদিত অভিনেত্রী, কিন্তু ফিল্মটা গোদারের নিজের দৃষ্টিতে উইয়াজেম্সকিকে সম্পূর্ণ আয়তনিক নারী হিসাবে দেখার চেয়েও খারাপ । মেয়েটি নিজের স্বামীকে ততোদিন ভালোবাসেন যতোদিন না তাঁর স্বামী সম্পর্কটাকে অসম্ভব করে তুলছেন । লোকটি নার্সিসিস্টিক, পেশায় হিংসুটে আর যৌনতায় পজেসিভ ; সে বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে যখন তার স্ত্রী একটি ইতালীয় ফিল্মে অভিনয় করার সুযোগ পায় যাতে তাকে নগ্ন হতে হবে । এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে অ্যাজানাভিশ্যু দেখিয়েছেন এমন একটি দৃশ্য যাতে লুই গারেল ( গোদার ) এবং স্টেসি মার্টিন ( উইয়াজেম্সকি ) দুজনেই উলঙ্গ হয়ে সিনেমায় নগ্নতার নান্দনিকতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছেন । এই ধরণের আত্ম-প্রসঙ্গ উথ্থাপনকে “গোদারীয়” হিসাবে ফিল্মের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পর্বের ক্লাসে চালিয়ে দিতে পারে । এই ব্যাপারটা অ্যাজানাভিশ্যুর পরিচয় সহজেই ফাঁস করে ।
মিশেল অ্যাজানাভিশ্যু নিউ ওয়েভ আইকন গোদার ও তাঁর প্রেরণাময়ী দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানে উইয়াজেম্সকির বিয়ে ভাঙার গল্প তুলে ধরেছেন খেলাচ্ছলে, অযৌক্তিকভাবে আর অনেক সময়ে ঘৃণ্য আক্রমণ করে । অভিনেত্রী উইয়াজেম্সকি ১৯৬৬ সালে সিনেমাজগতে প্রবেশ করেছিলেন রবার্ট ব্রেসঁর Au hasdard Balthazar ( এলোমেলো বালথাজার ) এবং পরের বছর অভিনয় করেন গোদারের La Chinoise ( চীনারা ) ফিল্মে । তিনি গোদারকে বিয়ে করেন এবং ১৯৭০ সালে আলাদা হয়ে যান, যদিও আইনি ডিভোর্স কার্যকরী হয় নয় বছর পর । Un an Apres ( এক ছর পর )কে বলা যেতে পারে গোদারের বিরুদ্ধে উইয়াজেম্সকির প্রতিশোধগ্রন্হ । আর মিশেল অ্যাজানাভিশ্যুর ফিল্মকে বলা যেতে পারে একজন নিম্নমানের পরিচালকের ঈর্ষা প্রণোদিত কর্মকাণ্ড ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
No comments:
Post a Comment