গোদার-এর মাওবাদী পর্ব : একটি সমালোচনা
[ মাওইস্ট ইনটারন্যাশানালিস্ট মুভমেন্ট পত্রিকার ২৬ জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ]
‘চীনা, বা বরং, চীনা পদ্ধতিতে: ফিল্ম নির্মাণ’, সাধারণত ‘ল্যা চিনোয়া’ নামে পরিচিত, যা ১৯৬৭ সালের ফরাসি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে জাঁ-লুক গোদার পরিচালনা করেছিলেন।
১. লা চিনোয়া [ চীনা], পরিচালক জাঁ-লুক গোদার, ১৯৬৭
২. লে ভনদে [ পুর্ব দিকের বাতাস ], পরিচালক জাঁ-লুক গোদার, ১৯৬৯
৩. তু ভা বিয়ঁ [ সব ঠিক আছে ], পরিচালক জাঁ-লুক গোদার, ১৯৭২
২০০৪ সালে এই ফিল্মগুলো দেখে আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই এবং তা হল গোদার সিরিয়াস ছিলেন কি না । আজ আমরা যখন দেখি পশ্চিমে মাওয়ের ইমেজ অভিনব বিজ্ঞাপনের সাথে মিশে গেছে, তা আসলে মাওকে বিদ্রূপ করার কৌশল এবং তার মাধ্যমে সংস্কৃতিগুলোতে ভোক্তা আবেশের শক্তি প্রদর্শন করা হয়, এমনকি চীন থেকে দূরে থাকলেও। সর্বোপরি, আজ মাওয়ের ইমেজ মূল স্রোতোধারায় ব্যবহারটি বিপরীতমুখী, কারণ এটি চীনে দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন প্রচারের গুরুত্ব পায় আর সবাই জানেন যে মাও একজন কমিউনিস্ট ছিলেন। বিপরীতে, সংস্কৃতি বিপ্লবের (১৯৭৬ সালে) সময় গোদার একজন উন্নত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে মাওয়ের ইমেজগুলো পুরোপুরি গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করেছিলেন -- এবং এমনকি মাওয়ের জন্য একটা জিংগল তৈরি করেছিলেন। আমরা বলতে পারি যে এই ফিল্মগুলোতে যাথার্থ্য আছে, মাওবাদী রাজনীতি, তত্ত্ব এবং পদ্ধতির বোঝাপড়া আছে।
১৯৬৭ সালে "লা চিনোয়া" মুক্তি পেয়েছিল দেখে অবাক হতে হয় । গোদার যে কেবল মাও আর সোভিয়েত সংশোধনবাদী নেতাদের মাঝে ভাঙনকে ধরতে পেরেছেন তা-ই নয়, গোদার সেই ভাঙনকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।তিনি ছিলেন সময়োচিত । "লা চিনোয়া" এবং "উইন্ড ফ্রম দ্য ইস্ট" -এ গোদার সোভিয়েত সংশোধনবাদ, ফরাসী "কমিউনিস্ট পার্টি", সামাজিক-গণতন্ত্র এবং শ্রমিক আমলাতন্ত্রের নিন্দা করেছেন।
"পূর্ব দিকের বাতাস" ফিল্মে প্রচুর আকর্ষণীয় বিষয় রয়েছে তবে ফিল্মের সবচেয়ে বড়ো অবদান এবং তর্কসাপেক্ষভাবে গোদারের সামগ্রিক অবদানগুলি চলচ্চিত্র নির্মাণ-তত্ত্বের অন্তর্গত কারণ "পূর্ব দিকের বাতাস" এবং "লা চিনোয়া" ফিল্মগুলো সম্পর্কে গোদার জানান যে তিনি ঠিক কোন কারণে মাওবাদীদের বিশ্বাস করেন এবং কেমন করে ফিল্ম তৈরি করা উচিত । গোদার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন তা হল প্রলেতারিয়েত কীভাবে সংগ্রাম করবে এবং ফিল্মের দ্বারা কীভাবে সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে উপকার পাওয়া যায়, যদিও বর্তমানে আমরা যে সমস্ত ফিল্ম দেখি তাতে বেশিরভাগ উপস্থাপনা এবং পদ্ধতিগুলি শাসকদের উপকার করে।
মাও-যুগের গোদার বলেছিলেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর অবস্হা নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক চলচ্চিত্রগুলো যদি সংঘর্ষের চিত্রণ বাদ দেয় তবে তারা কার্যকর হয় না।শ্রমিকদের ভয়াবহ অবস্থা প্রকাশের ফলে হতাশা ঘটবে কিন্ত পাশাপাশি কর্মকাণ্ডও ঘটতে পারে, সুতরাং কীভাবে বিদ্রোহ করা যায় তা ফিল্মে দেখানো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রাজনৈতিকভাবে এই ফিল্মগুলোতে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা আমাদের পছন্দ নয়, বিশেষত "তু ভাঁ বিয়ঁ"[ সব ঠিক আছে] ফিল্মটি, যা মূলত একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রকে ফরাসী কর্মীদল কর্তৃক অধিগ্রহণ সম্পর্কে । ফ্রান্সে গোদারের সময়ের ঘটনাগুলো আজকের দিনে যেমন, তার তুলনায় সেই সময়ের সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিকদের অবস্হা আরও ঘোলাটে ছিল ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ফরাসিদের তাদের অর্থনীতৈক অবস্হা পুনর্গঠন করতে হয়েছিল এবং এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও ভেবেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদী ঝোল টানা ভালো, কেননা তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছানোর পক্ষে সহায়ক হওয়া যাবে আর মার্কিন জীবনের মানদণ্ডে পৌঁছোনো যাবে।
গোদার তাঁর সময়ের অন্যান্য অনেকের মতো ভেবেছিলেন যে তিনি সম্ভবত এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন যেখানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে ফরাসিদের দেখাদেখি সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আসবে। যদি এটা সত্য হতো যে ফরাসি শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছিল, তবে তাদের সম্পর্কে গোদারের দৃষ্টিভঙ্গি মাওবাদী মানদণ্ড দ্বারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক হতো। অন্যান্য বেশিরভাগ ব্যাপারে গোদার সঠিক হলেও এই একটি ব্যাপারে তিনি ভুল ।
২০০৪ সালের সুবিধাজনক অবস্হান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ১৯৬৮ সালের মে মাসে সংঘর্ষময় ধর্মঘটে বিজয়ের দরুন বেতন অনেক বেড়ে গিয়েছিল এবং মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল যা কিনা ফ্রান্সে সাম্রাজ্যবাদী পরজীবিতার হাতকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। "তু ভাঁ বিয়ঁ"[ সব ঠিক আছে]-এর মাংস-প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মহিলা শ্রমিকের চরিত্র যা বলে তার চেয়ে বেশি কিছু প্রমাণ করার দরকার হয়নি, যে কিনা অলঙ্কৃত উক্তিতে জানায় যে, বস যদি এক ডলার দেয় তবে শ্রমিকরা প্রত্যেকে এক হাজার ডলার চায় -- যেন সেই পারিমাপের মান কোথাও থেকে উড়ে আসে। ফিল্মের শেষে একদল তরুণ একটি সুপার-মার্কেটে "ভাঙচুর" ধরণের গোলমালের আয়োজন করে যেখানে লোকেরা টাকাকড়ি না দিয়ে ঠেলা ভরে-ভরে জিনিসপত্র নিয়ে পালায়।
অবশ্যই এটি একটি ভাল প্রসঙ্গ যে কেনই বা লোকেরা সুপার মার্কেটের দোকানগুলোকে টাকা দেবে, যখন সমাজ অর্থ যোগাতে পারে না, কিন্তু ফিল্মটির পুরো সুরটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবির দিকে খুব বেশি ঝুঁকে ছিল - সাম্রাজ্যবাদীরা কীভাবে নিজের এবং তাদের দালালদের সুবিধার জন্য তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করে তা দেখানোর পরও গোদার সামাজিক-গণতন্ত্র এবং সংশোধনবাদ থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে পেরেছিলেন ।
ফরাসী শ্রমিকদের প্রতি গোদারের বিশ্বাসকে বাদ দিয়েও, যাদের শোষণ করা হচ্ছে এবং তাদের সমর্থন করার উপযুক্ত কারণ আছে, এই চলচ্চিত্রগুলোর সাথে আমাদের খুব কমই দ্বিমত রয়েছে। একথা বলা একটা কঠিন শর্তের মতো মনে হতে পারে, তবে বাস্তবে, গোদার তাঁর চলচ্চিত্রগুলোয় চিন্তা করার পদ্ধতিগুলো শেখান। "লা চিনোয়া" দর্শকদের বোঝাবার চেষ্টা করে যে তাঁর সময়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কীভাবে বিজ্ঞান ছিল। অতএব অর্থনৈতিক জীবনের তথ্যগুলি পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু সত্যে পৌঁছানোর কয়েকটি প্রাথমিক পদ্ধতি বদলায় না । এই কারণেই আমরা এখনও গোদারের মাওবাদী পর্বকে, ফরাসি শ্রমিকদের প্রকৃতির সাথে তাঁর সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ সত্ত্বেও তরতাজা হিসেবে দেখি । ফ্রান্স সম্পূর্ণরূপে একটি পরজীবী জাতিতে পরিণত হয়েছিল, তবে গোদার এই ফিল্মগুলোতে যা বলেছিলেন তার বেশিরভাগ আজও বর্তমান।
“পূর্ব দিকের বাতাস” ফিল্মে যখন গোদার তত্বনির্মাণকে ফিল্ম প্রোডাকশনের মূল কাজ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, তখন তাঁর সময়ে ফরাসি কর্মীদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী তার গুরুত্ব ছিল না। চলচ্চিত্রের প্রধান দায়িত্বের প্রশ্নটি এখনও অবধি অনুত্তরিত রয়ে গেছে। আরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ফরাসি কর্মীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভুল ছিল, তবে মূল কাজটি নিয়ে প্রশ্ন এখনও থেকে গেছে।
প্রধান দায়িত্বের বিষয়ে গোদারের সঙ্গে আমরা একমত নই, কারণ আমরা একে বলি, "জনগণের মতামত সৃষ্টি এবং ক্ষমতা দখলের জন্য নিপীড়িতদের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নির্মাণ"। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, "লা চিনোয়া"-র চেয়ে "ম্যাট্রিক্স" এর অবদান বেশি । তবে, আমরা যদি গোদারের মাপকাঠিকে গ্রহণ করি তবে বলতে পারি যে "লা চিনোয়া" ফিল্মটা "ম্যাট্রিক্স" এর চেয়ে বড় অবদান রেখেছে, কারণ "লা চিনোয়া" সাংস্কৃতিক বিপ্লবে উৎপন্ন মাওবাদী পদ্ধতি এবং নির্দিষ্ট তত্ত্বগুলিকে সরাসরি সামলায়। বিপরীতে, "ম্যাট্রিক্স" সম্ভবত বাইরের ভারী হস্তক্ষেপ ছাড়া মাওবাদের গুরুত্বর বিবেচনা করতে পারে না। এর মধ্য দিয়ে আমাদের এই প্রশ্নটি উত্থাপনের অর্থ হল যে, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণি এবং এর সাম্রাজ্যবাদী দেশ বিশেষত মিত্রদের, আসলে কী প্রয়োজন। তত্ব নির্মাণ বা আরও দ্রুত এবং বিস্তৃত আবেদন সহ এমন কোনও কিছুর মধ্যে আমাদের বেছে নিতে হবে। এটিও একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন - মূল কাজটি সম্পর্কে আমরা অথবা গোদার সঠিক কিনা। হয় এক বা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।
কেউ কেউ বলতে পারেন যে এই ফিল্মগুলো উপদেশ দেবার মতো "ডাইডাকটিক", তবে বাস্তবে গোদার দর্শকদের বিভিন্ন শিবিরের পার্থক্য করার চেষ্টা করেছেন: ১) পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শিবির ; ২) ব্রেজনেভের সোভিয়েত সহ সামাজিক-গণতান্ত্রিক / সংশোধনবাদী ও শ্রম আমলা শিবির ইউনিয়ন ; ৩) সর্বহারা শিবির। প্রতিটি শিবির এই সিনেমাগুলিতে তার বক্তব্য রাখে এবং গোদার দেখান যে প্রথম দুটি একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত । মানুষ এই সংঘর্ষগুলোর দিকগুলো আলাদা করতে পারার সময়, গোদার সম্ভবত "ডাইডাকটিক" চলচ্চিত্রটিকে বুর্জোয়া চলচ্চিত্র হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন, সংঘর্ষ ছাড়াই উপস্থাপনা করেছিলেন।
গোদারের তত্ত্ব নির্মাণের প্রধান কাজটা, দর্শকদের আর অর্থ-বিনিয়োগকারীদের এড়াবার খাতিরে চলচ্চিত্র পরিচালকদের উপর একটি ভারী বোঝা চাপিয়ে দেয়। সম্ভবত তাঁর কাজের অনুরণনটির বেশিরভাগ অংশই "শৈল্পিক বিশ্বস্ততা"র প্রশ্নে মাথা গলানো থেকে উদ্ভূত, এটা এমন একটা প্রশ্ন যা যে-কোনও শৈল্পিক পাতি-বুর্জোয়াকে ক্ষুব্ধ করে । তত্ব নির্মাণের দায়টা গোদারের জনপ্রিয় "আর্টসি" বা "হাই ব্রাউ" ভাবমূর্তির সঙ্গে খাপ খায়।
ওনার এই ফিল্মগুলোর সাথে আমাদের উপরোক্ত কয়েকটি মতবিরোধ সত্ত্বেও, আমাদের এও বিশ্লেষণ করা উচিত যে গোদারের মাওবাদী পর্বটি সঠিক ছিল কিনা। সোভিয়েত সংশোধনবাদকে বারবার মারাত্মকভাবে আক্রমণ করাটা সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির মতন উপগ্রহ দলগুলোর দেউলিয়াপনা প্রমাণ করেছে । কেবলমাত্র সবচেয়ে বিভ্রান্ত রুশপ্রেমীগুলোই বিশ্বাস করত যে খ্রুশ্চেভ / ব্রেজনেভ যুগটি ছিল "সমাজতন্ত্র"।
"পূর্ব দিকের বাতাস"-এ দেখা যায় ফিল্মটি স্ট্যালিনকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে। তখনকার দিনে এবং আজকালও একটা জনপ্রিয় চর্চা হল - স্টালিনের কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পদ্ধতির বিপরীতে "স্বায়ত্তশাসন"। গোদার "স্বায়ত্তশাসন" আন্দোলনের ইতিহাসে আলোকপাত করে দেখিয়েছেন, কীভাবে তা সর্বহারা শ্রেণিকে অবহেলা করে পাশ কাটিয়েছে।গোদার স্টালিনের সময়কার শিল্পকে দোষারোপ করার সময় স্ট্যালিনের অধীনে সমস্ত শিল্পীদের তার জন্য দায়ি করেছিলেন -- এমনকি তখন থেকে ট্রটস্কির অত্যধিক শৈল্পিক প্রভাব লক্ষ করে ব্রেস্ট-লিটোভস্কের সন্ধি হওয়ার পরেও লেনিনকে খোঁচা দিয়েছেন - “স্বায়ত্বশাসনের” প্রশ্নে গোদার পুরোপুরি স্ট্যালিনের পক্ষ নিয়েছেন এবং টিটোর যুগোস্লাভিয়ায় "স্বায়ত্তশাসন" এর আদর্শগত অভিব্যক্তি প্রদর্শন করেছেন। মাও ১৯৬৩ সালে তাঁর প্রবন্ধে শ্রমিক আভিজাত্য, শ্রমিক আমলাতন্ত্র এবং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নগুলিকে একসাথে যুক্ত বলে প্রতিপাদন করে কড়া জবাব দিয়েছিলেন । গোদার সম্ভবত " যুগোস্লাভিয়া কি সমাজতান্ত্রিক দেশ? " প্রবন্ধটা পড়েছিলেন।
১৯৬০ এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত প্রতিবিপ্লবীরা মার্কস ও লেনিনের অনুগামীদের মতামতকে সরিয়ে যুগোস্লাভিয়াকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন যাতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ থেকে পুঁজিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এমন লোকদের মাঝ-পথের ঘর হিসাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন । যুগোস্লাভিয়া ছিল “স্বায়ত্বশাসিত উদ্যোগের” সঙ্গে "বাজার সমাজতন্ত্র "। লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল মাও বা স্ট্যালিন ধাঁচের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক শক্তি।তবু যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনের প্রভাব শেষ হয়ে গিয়েছিল আর গর্বাচভ/ইয়েল্তসিন বুর্জোয়াজি খোলাখুলি আবির্ভুত হল, তখন সবচেয়ে হিংস্রভাবে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল । সেই গণহত্যার সন্ত্রাস আমাদের মতন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন এবং মাওয়ের অনুসারীদের অবাক করেনি, কারণ যুগোস্লাভিয়ার জনগণের বৈষয়িক ভিত্তি এবং পথনির্দেশক ছিল স্হানীয় স্তরে। "বিশ্বব্যাপী চিন্তাভাবনা করুন, স্থানীয়ভাবে কাজ করুন" স্লোগানের এটা একটা গভীর ভুলের উদাহরণ হতে পারে । অর্থনৈতিক "স্বায়ত্তশাসন" যা করেছিল তা হ'ল প্রদেশগুলোকে একে অপরের ঘাড়ে চাপতে উৎসাহিত করেছিল। সেটাই সংকীর্ণ প্রাদেশিক যুদ্ধের বৈষয়িক ভিত্তি তৈরি করেছিল।
"স্বায়ত্তশাসন" প্রিয় যুগোস্লাভিয়ার ভয়ংকর পতন প্রমাণ করে যে পুঁজিবাদের পর তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি হল কেন্দ্রিয় সমাজতন্ত্র এবং তা সম্পর্কে মার্কস এবং এঙ্গেলসের তত্ত্বগুলি একেবারে সঠিক। সর্বহারা শ্রেণীর সংহতি ভঙ্গ করার জন্য "স্বায়ত্তশাসন" আরেকটি শব্দ। "স্বায়ত্তশাসন" আসলে সর্বহারা ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর উভয়ের ওপরে লাঠি ঘোরাতে চাইছে এমন পাতি-বুর্জোয়া শ্রেণীর শব্দ। নারীদের প্রশ্নের ক্ষেত্রেও একই কথা। অবশ্য, জেনডার ব্যাপারটা শ্রেণীর প্রশ্ন থেকে তুলনামূলকভাবে স্বায়ত্তশাসিত, কারণ সমস্ত নারীই শ্রমিক নন, তবে একথা সত্য যে স্বায়ত্তশাসন এবং জেন্ডার প্রশ্নে ব্যক্তিবাদ নিপীড়িত ও শোষিতদের একতা ভঙ্গ করে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক গোষ্ঠী-স্তরের উত্তর খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। এটা ব্যক্তির স্বতন্ত্র অনুভূতি, বা স্বতন্ত্র ক্ষমতা বা এমনকি বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্ন নয় ।
মার্কসের মূল্যের শ্রম তত্ত্ব জোর দিয়েছিল যে শ্রমিকরা কীভাবে একটি নিরপেক্ষ প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে - অর্থাৎ যা তাদের নিজস্ব শ্রম। কারা শোষিত এবং কারা নয় সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপায় না থাকলে সর্বহারা ঐক্যের ক্ষতি হবে। শোষণ এবং ক্ষতিপূরণের প্রশ্নগুলিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে তা না হলে এর পরিণতি হবে গণহত্যার যুদ্ধ যেমন যুগোস্লাভিয়ায় দেখা গিয়েছিল। কেবলমাত্র তাদের কারখানা বা প্রদেশে নয় পুরো দেশ এবং পুরো পৃথিবীর অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে কীভাবে চলতে হবে তা শেখা শ্রমিকদের একটি মূল কাজ। "স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে" শোষিতদের "মূল্যমানের শ্রম তত্ত্ব" প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই একে অপরের পরিস্থিতি দৃঢ়ভাবে জানতে সহায়তা করতে সফল হতে হবে। শ্রমিকরা যদি একে অপরের বস্তুগত অবস্থা দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে অক্ষম হয়, তবে তারা পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ হতে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য স্তরে ব্যর্থ হবে। একটি কেন্দ্রিয় অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে শ্রমিকরা একে অপরের মধ্যে তাদের সম্পর্কগুলোর সামঞ্জস্য করতে পারে। সেই ক্ষমতা না থাকলে যুগোস্লাভিয়া-ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হতে বাধ্য।
এই ফিল্মগুলোর সংলাপসমূহের শব্দাবলী মাও-যুগের গোদারের চলচ্চিত্রগুলিতে অগ্রগতির প্রধান বোঝা বহন করে। দ্বিতীয়ত, গোদার সীমাবদ্ধ ক্রিয়া ব্যবহার করেন, রক্ত-লাল রঙ নিক্ষেপ করে এবং চরিত্রগুলোকে রক্তাক্ত করে তুলে ফিল্মে তুলে ধরা তাঁর পরিচিত ক্রিয়া। তৃতীয়ত, গোদার এছাড়াও দর্শকদের বোঝাবার জন্য ব্যবহার করেছেন এবং দেখিয়েছেন ফটোগ্রাফি বা ফিল্মের ছবিগুলো কীভাবে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে সহজেই কাজে লাগানো যেতে পারে ।”তু ভাঁ বিয়ঁ" ফিল্মের শেষে, গোদার ফ্রান্সের এমন ফুটেজ দেখিয়েছেন যার পটভূমিতে নির্বোধ ট্যুরিজম বা ফরাসী জাতীয়তাবাদী জিংগলগুলো বাজিয়ে শুনিয়েছেন । "পূর্ব দিকের বাতাস" ফিল্মে গোদার সাধারণ ফুটেজ ব্যবহার করে বুর্জোয়া চলচ্চিত্র নির্মাণকারী দুটি চরিত্রের অভিনয় উপস্হাপন করেছেন। আমরা দুর্দান্ত মেক-আপ, প্রপস এবং ম্লান আলো দিয়ে একটি কংকুইস্তাদর ফিল্মের ভাবনা কল্পনা করে নিই, তবে গোদার আমাদের দেখিয়েছেন একজন লোক একজন বন্দীকে, প্রকাশ্য দিনের আলোয়, বিশেষ ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই টেনে নিয়ে চলেছে --যা প্রকৃত অভিনেতারা দেখতে পায় কোনোরকম প্রপস ছাড়াই --- যা বেশ সাদামাটা। বুর্জোয়ারা যখন কিনা দর্শকদের দুর্দান্ত পটভূমির সৌন্দর্য দেখায়, তাঁর মাওবাদী পর্বে গোদার আমাদের দেখান যে সৌন্দর্য আসলে থাকে সংগ্রামে ।
[ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী ]
No comments:
Post a Comment