Tuesday, March 24, 2020

জাঁ-লুক গোদার ও ওতেয়া তত্ব ( Auteur theory )

Image result for godard
জাঁ-লুক গোদার ও ওতেয়া তত্ব ( Auteur theory )
রিচার্ড ব্রডি
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
ওতেয়া তত্ব ( Auteur theory ) অনুযায়ী পরিচালকই একটি ফিল্মের স্রষ্টা, যেমন একটি বইয়ের স্রষ্টা একজন লেখক অর্থাৎ ক্যামেরাই হল কলম । অ্যান্ড্রু স্যারিস ওতেয়া তত্ত্ব জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ১৯৬২ সালে তাঁর  "নোটস অন দ্য ওতেয়া থিওরি" প্রবন্ধে ; তিনি জাঁ-লুক গোদার ও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর বন্ধু ছিলেন । ফরাসি নিউ ওয়েভ সিনেমার দুই তাত্বিক, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো এবং জাঁ-লুক গোদারকে মনে করা হয় ফিল্ম রচনার ওতেয়া, বিশেষ করে জাঁ-লুক গোদার, যিনি তাঁর প্রথম  ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’ নির্মাণের জন্য প্রায় সমস্ত কাজ নিজেই করেছিলেন । চিত্রনাট্য লেখকের তুলনায় পরিচালক যেহেতু ফিল্মের দৃশ্য ও শ্রাব্য উপাদানগুলোর সর্বময় কর্তা, তিনিই ফিল্মটির লেখক । ক্যামেরা কোথায় রাখা হবে, আলো কীভাবে ফেলা হবে, ক্যামেরা থেকে একটি  দৃশ্য কতো দূরে থাকবে, সম্পাদনা কেমন করে হবে, সম্পূর্ণ ফিল্মটা কেমন করে জুড়ে তোলা হবে, এই মৌলিক ব্যাপারগুলো নির্ণয় করেন পরিচালক এবং এর মাধ্যমেই ফিল্মটির বার্তা দর্শকদের কাছে পৌঁছোয় । এই দুই পরিচালকের আগে, বিশেষ করে গোদারের আগে, ফিল্মের প্লট ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনও লেখকের রচনা অনুসরণ করে ফিল্ম নির্মাণ করার চল ছিল । ওতেয়া তত্বের সমর্থকরা মনে করেন, যে সমস্ত ফিল্মগুলো সিনেমাটিকালি সফল হয়, তাতে পরিচালকের ব্যক্তিগত ছাপ ও একক অবদান অবশ্যই থাকবে ।  হলিউডি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের থেকে ফরাসি নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পার্থক্য করার জন্য ধারণাটিকে তাত্বিক ভিত্তি দেয়া হয়েছিল, এবং এরপরে জনপ্রিয় সংগীত নির্মাতাদের পাশাপাশি ভিডিও গেম নির্মাতাদের ক্ষেত্রেও তত্বটি প্রয়োগ করা হয়েছে ।


১৯৫৯ সালের মে মাসে, কান ফিল্ম ফেস্টিভালে, ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রী আঁদ্রে ম্যালরো বলেছিলেন, “এক বছরের মধ্যেই ফরাসি সিনেমা ( Cinematheque Francaise ) হয়ে উঠবে ফরাসি কমেডি ( Comedie Francaise ), তার কারণ উনি সবে সাতাশ বছর বয়সী ফিল্ম সমালোচক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ‘দি ৪০০ ব্লোজ’ ফিল্মটিকে প্রথম ফিচার ফিল্মের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেতে দেখেছিলেন কেননা তিনি জানতেন যে ত্রুফো কোনো ফিল্ম স্কুলে কিংবা ফিল্মের সেটে গিয়ে ফিল্ম করা শেখেননি ; শিখেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অঁরি লাংলয়ের সংগ্রহশালায় একটা ছোটো ঘরে বসে ফিল্ম দেখে-দেখে ।


তা ছিল ম্যালরোর ভবিষ্যবার্তা । ১৯৬০ সালের মার্চ মাসে ত্রুফোর বন্ধু জাঁ-লুক গোদার, আরেকজন ফিল্ম সমালোচক, তাঁর ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’ প্যারিসে রিলিজ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সে ও অন্যান্য দেশে অভূতপূর্ব প্রশংসা পেলেন । বলা হল যে শেষ পর্যন্ত ফিল্মনির্মাণকে হলিউডের ইনডাস্ট্রি থেকে বের করে এনে শিল্পের মর্যাদা দেয়া হল । এই সাফল্য জন্ম দিলো একটি ফিল্ম আন্দোলনের । ১৯৫৭ সালে একটি প্রবন্ধে ফ্রাঁসোয়া জিরো Nouvelle Vogue বা নিউ ওয়েভ নামে একটি শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন, এবং বলেছিলেন যে একদল নতুন ফিল্মনির্মাতার আবির্ভাব হয়েছে যারা ফরাসি সমাজকে ফিল্মনির্মাণ সম্পর্কে একেবারে নতুন ভাবনা ও দৃষ্টিকোণ দিচ্ছে । কিন্তু পিয়ের বিলার্দ নামে এক সমালোচক লিখলেন যে এই নতুন চিত্রনির্মাতারা নিউ ওয়েভের নামে যা করছেন তা অপ্রতিভ আর অতিষ্ঠ করে ।


গোদার আর ত্রুফো, তখনও তাঁদের বয়স বিশের কোঠায়, আলোচকদের নাস্তিক্য ও সংশয়কে কোনও তোয়াক্কা করলেন না । তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল চিত্রপরিচালকের ভূমিকাকে একক গুরুত্ব দেয়া, এবং তেমনই অন্তরঙ্গ, নমনীয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কে গড়ে তোলা যেমন একজন লেখকের তাঁর উপন্যাসের সঙ্গে হয় । গোদারের নিউ ওয়েভ ফিল্মনির্মাণের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি, ব্রাজিল, পোল্যাণ্ড, জাপান, তাইওয়ান, ইরান, ভারত, এমনকি হলিউডেও । পরিচালক হয়ে উঠলেন ( Auteur ) ‘ওতেয়া’ । ১৯৬৯ সালে, ‘গ্রিটিংস’ ফিল্মের পরিচালক ব্রিয়ান দ্য পাল-মা ঘোষণা করলেন যে তিনি যদি মার্কিন গোদার হয়ে উঠতে পারেন তাহলে ব্যাপারটা দারুণ হবে । সেই বছরই গোদার সম্পর্কে তেইশ বছর বয়সী জর্জ লুকাস গোদার সম্পর্কে বললেন, “আপনি যখন দ্যাখেন যে আরেকজন আপনার পথেই এগোচ্ছেন, তখন আপনি একা বোধ করেন না ।” ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা স্বীকার করেছেন যে তিনি গোদারকে অনুসরণ করেছেন এবং নিউ ওয়েভ ফিল্ম করতে চেষ্টা করেছেন । অর্থাৎ এনারাও ক্যামেরাকে কলমের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ।


গোদার এবং ত্রুফো দশ বছর যাবত নিকটবন্ধু ছিলেন, কিন্তু তারপর তাঁদের বন্ধুবিচ্ছেদ হয়। সিনেমা সম্পর্কে তাঁদের একই মতামত ছিল এবং সেই মতামতে নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল নিউ ওয়েভের ‘ওতেয়া তত্ব’ । তাঁরা ক্রমশ পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেলেন, যাকে বলা হয়েছে ‘ওতেয়া যুদ্ধ’ । গোদারের বয়স এখন সাতাত্তর ; বসবাস এবং কাজ করেন সুইজারল্যাণ্ডের রোলে নামের গ্রামে, এবং ত্রুফো, যিনি ১৯৮৪ সালে বাহান্ন বছর বয়সে মারা যান, তাঁদের দুজনের পরিচয় হয়েছিল ১৯৪০ দশকের প্যারিসে, সম্ভবত লাতিন কোয়ার্টারের ফিল্ম ক্লাবে, যেটি চালাতেন মরিস শেরে নামে একজন স্কুল শিক্ষক, যিনি তাঁর ছদ্মনাম এরিক রোমার হিসাবে বেশি পরিচিত । গোদার এক সময়ে বলেছিলেন যে তাঁরা দুজনে ছিলেন দুটি পরিত্যক্ত শিশুর মতন ।


গোদার ১৯৩০ সালে একটি বৈভবশালী সংস্কৃতিমান পরিবারে জন্মেছিলেন ( তাঁর দাদামশায় ছিলেন পারিবাস ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং কবি পল ভালেরির বন্ধু ও সচিব ) ; ফ্রান্স আর সুইজারল্যাণ্ডের বিশাল জমিদারিতে তাঁর শৈশব কেটেছিল । তিনি ছিলেন গণিতে পারদর্শী এবং  বইপোকা । ১৯৪৬ সালে প্যারিসে যান স্কুল শিক্ষা শেষ করার জন্য । তাঁর ছিল সাহিত্যিক ও শিল্পী হবার উচ্চাকাঙ্খা, এবং তাঁর পারিবারিক সম্পর্কের দরুন সমাজের সাংস্কৃতিক শৌর্যকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন ; কিছুদিনের জন্য তিনি ছিলেন জাঁ শ্লামবারগারের বাড়িতে ছিলেন আর সেখানে তাঁর সঙ্গে আঁদ্রে জিদের পরিচয় হয়েছিল । কিন্তু বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে তিনি পড়াশুনায় অবহেলা আরম্ভ করেন এবং সিনেমা দেখে আর টোটো কোম্পানি করে সময় কাটাতেন, তার জন্য অগ্রজদের থেকে টাকার জন্য নাছোড় ধরাধরি করতেন । টাকার জন্য তিনি একবার তাঁর ঠাকুর্দার সংগ্রহ থেকে রেনোয়ার তৈলচিত্র চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিলেন ।


ত্রুফোর জন্ম ১৯৩২ সালে, প্যারিসে ; তাঁর বাবা মায়ের বিয়ে হয়নি । তাঁকে তাঁর মায়ের বাপের বাড়িতে গ্রামে  পাঠিয়ে দেয়া হয় একজন সেবিকার তত্বাবধানে ; পরে তাঁর মা তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে যান, দত্তক নেন এক ভদ্রলোক, যিনি ত্রুফোর পালক-পিতা । যুদ্ধকালীন প্যারিসে অবহেলিত, স্কুল পালাতেন, চুরি করতেন, ভবঘুরের জীবন কাটাতেন । আট বছর বয়সে আবেল গানসের “পারাদিস পেরদু’ ফিল্ম দেখার পর তাঁকে সিনেমা দেখার নেশায় পায় ; প্রতিদিন তিনচারটে ফিল্ম দেখতেন । ১৯৪৮ সালে, ষোলো বছর বয়সে, টাইপরাইটার চুরি করার দায়ে বিপদে পড়েন । ফৌজে যোগ দেন, কিন্তু সেখান থেকে পালান ; তাঁকে জেল খাটা থেকে বাঁচান ফিল্ম সমালোচক আঁদ্রে বাজিন, যিনি ত্রুফোর চাকরি আর বাসস্হানের ব্যবস্হা করেন । এই সময়ে গোদারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় এবং দুজনে নিয়মিত সিনেমা দেখে সময় কাটাতেন । ত্রুফো ছিলেন সংস্কৃতিতে বহিরাগত, যিনি প্রবেশ করতে চাইছিলেন ; গোদার ছিলেন সংস্কৃতির ভেতরের লোক যিনি ভেঙে বাইরে বেরোতে চাইছিলেন । দুজনে মিলে বালজাকের রোমান্টিক কাহিনির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিলেন, এবং স্বপ্ন দেখছিলেন নিজেদের প্রতিভার জোরে প্যারিস জয় করার। ১৯৫১ সালে আঁদ্রে বাজিন প্রতিষ্ঠা করলেন কাইয়ে দ্যু সিনেমা ; কিছু কালের মধ্যেই এরিক রোমার তাতে যোগ দেয়ায় গোদার আর ত্রুফো ফিল্ম-সমালোচকের কাজ পেয়ে গেলেন ।


জায়মান নিউ ওয়েভের তরুণরা খোলাখুলি ঘোষণা করলেন যে  তথাকথিত বড়ো পরিচালক আর চিত্রনাট্য লেখকদের থেকে তাঁরা ফরাসি ফিল্মজগতকে কেড়ে নিয়ে দখল করতে চলেছেন। ১৯৫৪ সালে কাইয়েতে প্রকাশিত “ফরাসি সিনেমার একটি নির্দিষ্ট প্রবণতা” প্রবন্ধে ত্রুফো আক্রমণ করলেন জাঁ অরেনশে এবং পিয়ের বোস্ত নামের দুই খ্যাতিমান চিত্রনাট্য রচয়িতাকে, সিনেমাকে অবজ্ঞা করার দোষে, এবং তীব্র সমালোচনা করলেন পরিচালক ক্লদ অতাঁ-লারা ও জাঁ দেলানয়কে, তাঁদের "ভীরু কৌশল, চলতি ফ্রেমিংস, জটিল আলোকসজ্জা, পালিশকরা ফটোগ্রাফি, ইত্যাদি, “গুণমানের ঐতিহ্যের নামে চালাবার” জন্য । ফরাসি সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠা পেলো কাইয়ে দ্যু সিনেমা পত্রিকা, ত্রুফোর বিতর্কিত প্রবন্ধের কারণে যার দরুন দক্ষিণপন্হী সাপ্তাহিক ‘আর্টস’ পত্রিকায় চাকরি পেয়ে গেলেন তিনি । প্রবন্ধটি তাঁকে আর তাঁর বন্ধুদের ‘পোলিটিক দেস ওতেয়া’ বা “লেখকের রাজনীতি” বা ‘ওতেয়া তত্ব”র প্রণেতা হিসাবে অন্যান্যদের থেকে পৃথক চিহ্ণিত করে দিতে সফল হলো । সিনেমা আলোচনার বিভিন্ন জমায়েতে তাঁরা ঘোষণা করতে লাগলেন যে শ্রেষ্ঠ পরিচালকরা হলেন লেখক, চিত্রকর, সঙ্গীতকারের মতনই গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যক্তিপ্রাতিস্বিক শিল্পী ।
ত্রুফো তখন প্যারিসে, আর গোদার সুইজারল্যাণ্ডে বাঁধ-নির্মাণ প্রকল্পে বেলচা-কোদাল নিয়ে কাজ করছেন, তারপর রাতের ডিউটিতে সেখানকার সুইচবোর্ডে,  প্রকল্পটা নিয়ে একটা প্রথাগত তথ্যচিত্র তোলার জন্য টাকা রোজগারের ধান্দায় । ফিল্ম তুলে তা বিক্রি করলেন একটা কোম্পানিকে, আর তারপর ১৯৫৬ সালে পাড়ি মারলেন প্যারিসের উদ্দেশে, কাইয়ে দ্যু সিনেমার আড্ডার জমায়েতে যোগ দেবার জন্য । রোবের্তো রোসেলিনি, যাঁকে কাইয়ে দ্যু সিনেমার আলোচকরা তারিফ করেছিলেন, যখন অন্যেরা ওনাকে উপেক্ষা করতো, স্ত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যানকে নিয়ে মেলোড্রামাটিক ফিল্ম তুলেছিলেন, প্যারিসে পৌঁছোলেন আর তরুণ সমালোচকদের একত্রিত করে বাস্তববাদী, কম বাজেটের ফিল্ম তৈরি করায় উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেন, যে ধরণের ফিল্মের কারণে এক দশক আগে উনি খ্যাতি পেয়েছিলেন । ত্রুফো ভাবছিলেন যে সংবাদপত্রে পাওয়া প্রকৃত ঘটনার মিশেল পোরতেল নামে এক ছিঁচকে অপরাধী আর তার মার্কিন বন্ধুনিকে নিয়ে ফিল্ম করবেন । ১৯৫২ সালে পোরতেল একটা সরকারি গাড়ি চুরি করেছিল, একজন মোটরসাইকেল আরোহী পুলিশকে গুলি মেরেছিল আর প্যারিসে কেটে পড়েছিল, সেখানে দুসপ্তাহ দিব্বি লুকিয়েছিল, তারপর সিন নদীতে একটা ডিঙিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল । ত্রুফো গোদারকে বললেন ওনাকে সাহায্য করতে । কাহিনিটাকে ফিল্মের আদল দেবার জন্য দুই বন্ধু বসলেন বটে কিন্তু টাকা যোগাড় করতে পারলেন না । ফলে প্রকল্পটা তাঁরা বাতিল করলেন।


পরিচালক হবার স্বপ্ন তবু তাঁদের ছাড়ছিল না । ১৯৫৮ সালে ত্রুফো প্যারিসের বাইরের লোকেশানে আশু রচনা করা একটা ফিল্ম তুললেন । জায়গাটা বানভাসিতে ডুবে গিয়েছিল, যার দরুন ছবি তুলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল, আর গল্পটা ছিল এক তরুণীকে নিয়ে যে গাড়িতে লিফ্ট চাইছিল আর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গাড়ি সরবরাহকারী যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ফিল্ম তোলার সময়ে ত্রুফোর মনে হল যে তিনি বিপদে পড়া মানুষগুলোকে নিয়ে তামাশা করছেন, ফলে বাতিল করলেন প্রকল্প । গোদারের মনে হল যেটুকু  তোলা হয়েছে সেই ফুটেজ কাজে লাগানো যেতে পারে । উনি সম্পাদনা করলেন আর বহু প্রসঙ্গ, প্রশ্ন, ইয়ার্কি, ও ফিসফিসে মন্তব্য জুড়ে যোগ করলেন খেলাচ্ছলে ভয়েস-ওভার । এমনকি টাইটেলটাও “Une Histoire d’Eau” ( জলের একটি গল্প ) ছিল শ্লেষ -- সেই সময়ের যৌন বেস্ট সেলার “Histoire d’O” ( O-এর গল্প ) নকল করে । দুই বন্ধুর ফিল্ম করার একটা আদরা গড়ে উঠল : ত্রুফো বলবেন গল্প আর গোদার গল্পকে ব্যবহার করবেন তাঁর খেদোন্মত্ত আবিষ্কার উড়াল হিসাবে ।


১৯৫৭ সালে ত্রুফো, ম্যাডেলিন মরগেনস্টার্ন নামে এক যুবতীকে বিয়ে করলেন, যাঁর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে । মেয়েটির বাবা, ইগনাস মরগেনস্টার্ন ছিলেন ফিল্ম ডিসট্রিবিউটর এবং পরের বছর কান ফেস্টিভালে ত্রুফো তাঁকে পরামর্শ দিলেন মিখায়েল কালাতোজভের “দি ক্রেনস আর ফ্লাইঙ” কিনে নিতে । ফিল্মটা গ্রাঁ প্রি পুরস্কার পেলো । প্রতিদান হিসাবে মরগেনস্টার্ন ত্রুফোকে প্রথম ফিল্ম পরিচালনার ব্যবস্হা করে দিলেন । গোদার ত্রুফোকে লিখেছিলেন যাতে মরগেনস্টার্ন তাঁকেও একটা ফিল্ম পরিচালনার ব্যবস্হা করে দেন কিন্তু তা সম্ভব হয়নি । ১৯৫৮ সালের নভেম্বরে ত্রুফো তোলা আরম্ভ করলেন “দি ৪০০ ব্লোজ” ফিল্ম। পাঁচ মাস পরে ফিল্মটা নির্বাচিত হল কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ফ্রান্সকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য । গল্প প্রায় পুরোটাই ত্রুফোর নিজের বয়ঃসন্ধির ঘটনা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি ।


“দি ৪০০ ব্লোজ” এর গল্পটা এইরকম : ১৯৫০-এর দশকে প্যারিসে বেড়ে ওঠা আঁতোয়া দোনিয়েল নামে একটি  ছেলে স্কুল থেকে পালিয়ে যেতো আর বাবা-মাকে মিথ্যাকথা বলত । তার বাবা-মায়েরা তাকে ভুল বুঝেছিলেন এবং তার শিক্ষক  শৃঙ্খলাজনিত সমস্যার জন্য তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন ( আঁতোয়া বলেছিল যে তার অনুপস্থিতি তার মায়ের মৃত্যুর কারণে হয়েছিল) । আঁতোয়া প্রায়ই স্কুল আর বাড়ি থেকে দূরে পালিয়ে যেতো। শেষে তার শিক্ষক বালজাক থেকে নকল করে লেখার অভিযোগ করেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার খরচ তোলার জন্য আঁতোয়া তার সৎ বাবার অফিস থেকে একটি রেমিংটন টাইপরাইটার চুরি করে, তবে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করার সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সৎ বাবা আঁতোয়াকে পুলিশে ধরিয়ে দেন । আঁতোয়া  সারারাত জেলখানায় কাটায়, বেশ্যা এবং চোরদের সাথে একটা ঘরে তাকে থাকতে হয় । বিচারকের কাছে সাক্ষ্য দেবার সময়, আঁতোয়ার মা স্বীকার করেন যে তাঁর স্বামী আঁতোয়ার আসল বাবা নন। তার মা যেমনটা চেয়েছিলেন, সমুদ্রের তীরের কাছে আঁতোয়ার মতন অবাধ্য ছেলেদের জন্য একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে তাকে রাখা হয় । অন্য ছেলেদের সাথে একদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে আঁতোয়া একটা বেড়ার তলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে পালিয়ে যায়, যা ও চিরকাল দেখতে চাইতো। আঁতোয়া সমুদ্রের তীরে পৌঁছে যায় । আঁতোয়ার একটা ফ্রিজ-ফ্রেম শট দিয়ে ছবিটি শেষ হয়েছে । ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকে আঁতোয়া, আর ক্যামেরাটা তার মুখকে  জুম করে বাড়িয়ে তোলে।


ফিল্মটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে “আর্টস” পত্রিকায় গোদার লিখলেন, “ফিল্ম ওতেয়াদের যুদ্ধে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে । আমাদের এই বক্তব্যকে গ্রহণ করা হয়েছে যে হিচককের ফিল্মে তিনি ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ যতোটা আরাগঁর বইয়ের জন্য আরাগঁ । আমাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য, ফিল্মের যাঁরা ওতেয়া, নিঃসন্দেহে শিল্পের ইতিহাসে স্হান করে নিয়েছে । কিন্তু আমরা লড়াই জিতলেও যুদ্ধ জয় করা এখনও বাকি।” মরগেনস্টার্ন-এর নিবেশ দুই দিনেই দ্বিগুণ হয়ে গেল এবং ফিল্মটির প্রচারের দরুণ ত্রুফো ও তাঁর সঙ্গীদের নিউ ওয়েভের পুরোধা হিসাবে ঘোষণা করা হল ।


গোদার বুঝতে পারলেন যে ফিল্ম নির্মাণের মতো সময় তাঁরও এসেছে, আর মনে হল বেশি দেরি করলে সুইযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে । কাইয়ে দ্যু সিনেমার তহবিল থেকে ট্রেন ভাড়া যোগাড় করে তিনি কান পৌঁছোলেন, আর যোগাযোগ করলেন সংঘর্ষরত অথচ সাহসী প্রযোজক জর্জ দ্য বোরেগারের সঙ্গে, যাঁর জন্য তিনি একসময় একটা সংক্ষিপ্ত চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন । গোদার ত্রুফোকে অনুরোধ করলেন, ওনার গাড়ি চোরের কাহিনিটা দেবার জন্য । ত্রুফো তাঁর নাম কাহিনিলেখক হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি দিলেন, এবং ক্লদ শাবরল অনুমতি দিলেন তাঁর নাম প্রযুক্তি পরামর্শদাতা হিসাবে ব্যবহারের জন্য । এই দুজনের নামের দরুন প্রযোজককে প্রভাবিত করতে সুবিধা হল গোদারের । গোদার ফিল্মটার নাম রাখলেন À bout de souffle অর্থাৎ “ব্রেথলেস” ।
“ব্রেথলেস” ফিল্মটা “দি ৪০০ ব্লোজ” থেকে একেবারে ভিন্ন ধরণের প্রমাণিত হল । ত্রুফো ব্যবহার করেছিলেন সম্পূর্ণ পেশাদার কর্মীদের এবং আগে থাকতে লেখা চিত্রনাট্য, মার্সেল মুসি নামের চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে পরামর্শ করে । ত্রুফো প্রমাণ করার প্রয়াস করেছিলেন যে ফরাসি সিনেমা একটি উপন্যাসের চেয়েও ব্যক্তি-এককের নিজস্ব হবে, ততোটাই অন্তরঙ্গ ও ব্যক্তিগত যতোটা একজনের আত্মজীবনী হয় । গোদার “ব্রেথলেস” ফিল্মে যে কাহিনি রূপায়িত করলেন, তা হলিউডের ফিল্মের মতন ছিল, ব্যক্তিগত ছিল না মোটেই, কিন্তু যা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন তা হল : অভিগমনের কারণে গল্পটি হয়ে উঠল তাঁর ব্যক্তিগত । 
‘ব্রেথলেস’ ফিল্মের সংলাপ এবং কার্যকলাপ তিনি প্রতিদিন ফিল্ম তোলার সময়ে নির্ণয় নিতেন, বা রাতের বেলায় কোনো রেস্তরাঁ কিংবা কাফেতে বসে ; স্মৃতিকে আর ডায়রিকে কাজে লাগিয়ে--- সিনেমাটিক, সাহিত্যিক এবং ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থেকে তুলে এনে মালার মতন বুনে দিলেন-- যা সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র ছিল,  এমন একটি ব্যাপার গড়ে তুললেন যা সম্পূর্ণরূপে ছিল তাঁর আবিষ্কার । মাথা কাজ না করলে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন আর চটিয়ে দিতেন প্রযোজকমশায়কে । 
গোদার ছবিটি তুললেন নতুন আঙ্গিকহীন উপায়ে । টেক্সটা তিনি আনতেন অভিনেতাদের কাছে-- নায়ক জাঁ-পল বেলমোন্দো আর নায়িকা জাঁ সেবার্গ-- ফিল্মের লোকেশানে, কিংবা সংলাপগুলো তাঁদের পড়ে শোনাতেন আর অভিনেতারা শুনে শুনে বলত, ক্যামেরা চলতে থাকত। ওনার ক্যামেরাম্যান রাউল কুতার্দ আগে ছিলেন তথ্যচিত্র তোলার সঙ্গে যুক্ত, এবং গোদার নির্ভর করলেন কুতার্দের অভিজ্ঞতার ওপর, পথের আলো বা ভিড় নিয়ন্ত্রণের বালাই বাদ দিয়ে । শঁজেলিজের পথে অভিনেতাদের হাঁটার সময়ে কুতার্দ ক্যামেরা নিয়ে একটা ডেলিভারি-গাড়িতে বসে রইলেন, যাতে একটা ফুটো ছিল, আর গাড়িটা ঠেলতে লাগল একজন সহকর্মী ; গোদার তাদের চুপচাপ অনুসরণ করলেন । শেষ দৃশ্যে, বোলমিন্দোর চরিত্র যখন রাস্তায় পড়ে, বুলেটের আঘাতে মারা যাচ্ছে, কাছের রেস্তঁরাগুলো থেকে এসেজনসাধারণ অভিনেতার কাছে জড়ো হয়ে গিয়েছিল, যখন কিনা ক্যামেরা তুলছিল সেই দৃশ্য ।
সম্পাদনার ঘরে গোদারের কাজ ছিল আরও দুঃসাহসী । আড়াই ঘণ্টা থেকে কমিয়ে নব্বুই মিনিট করার আদেশের দরুণ, গোদার কেবল সেই অংশগুলোকেই রাখলেন যেগুলো ওনার পছন্দের ছিল, আর ছাঁটাই করতে থাকলেন নানা দৃশ্য, ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দিয়ে, শটের মধ্যের ছাঁটাই করলেন যা পরে ‘জাম্প কাট’ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠল । ঝাঁকুনির ফলে গড়ে উঠল চাক্ষুষ করা যায় এমন জ্যাজ সঙ্গীত । গোদার পরে স্বীকার করেছেন যে, তিনি দর্শকের আকর্ষণ করে দেখাতে চেয়েছিলেন যে পুরোনো ঐতিহ্যকে কেমন দর্শনীয় উপায়ে বাতিল করা যায় । 
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো এবং জাঁ-লুক গোদারের যাত্রা এই দুটি ফিল্ম থেকে দুই দিকে ধাবিত হওয়া আরম্ভ হল । জনসাধারণ ও পরিচিতদের সামনে তাঁরা পরস্পরের সুখ্যাতি করলেও ভাঙন আর লুকিয়ে রাখা গেল না । প্রতিভাবান লেখকদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দিতার মতন, এই দুই প্রতিভাবান পরিচালক নিজস্ব ‘ওতেয়া’র পথে যাত্রা করলেন ।
নিউ ইয়র্কার পত্রিকার ৭ এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত । ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী

No comments:

Post a Comment