Friday, August 4, 2023

অঁতনা আতোর চিঠি

 শ্রীমতি কোলেট টমাসকে লেখা অঁতনা আতো’র  চিঠি

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

  অঁরি তমাস, তরুণ ঔপন্যাসিক, যিনি আতো’র সাথে ‘থিয়েটার এবং তার ডাবল’ নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের বিষয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, ১৯৪৬ সালের ১০ই মার্চ  রোদেজে আতো’র সাথে দেখা করতে যান।তাঁর যুবতী স্ত্রী কোলেত তমাসকে  সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন একজন  উচ্চাকাঙ্ক্ষী  অভিনেত্রী। কোলেত যখন আঁতোর সাথে দেখা করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর এবং সেই সময়ে তাঁদের বিয়ে ভেঙে যাবার অবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল।  আতো’র মনে হয়েছিল যুবতিটি  নতুন সম্ভাবনা এবং স্বাধীনতার জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করছেন । শীঘ্রই তিনি তার "হৃদয়ের কন্যা" হয়ে ওঠেন এবং কিছু সময়ের জন্য অঁতনা আতোর কল্পনার জগতে একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান দখল করেন। এই সময়ে তাঁরা প্রায়ই একে অপরকে চিঠি লিখতেন এবং কোলেতকে লেখা আতোর এই চিঠিগুলি নিয়ে তাঁর একটি বই, ‘দ্য টেস্টামেন্ট অফ দ্য ডেড ডটার’, ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

কিন্তু আতোর প্রতি কোলেতের শ্রদ্ধা ভক্তি তাঁকে এবং তাঁর লেখার সাথে একটি অতিরিক্ত পরিচয়ের দিকে পরিচালিত করে, যা ছিল তীব্র এবং পুরুষটিকে দখলের প্রয়াস । আতোকে আর্থিক সাহায্যের জন্য, তিনি প্যারিসে ১৯৪৬ সালের জুন মাসে আতোর ‘ফ্র্যাগমেন্টেশন’ থেকে কিছু অংশ শ্রোতাদের  পড়ে শুনিয়ে ছিলেন । তাঁর উদ্বেগ এবং আতঙ্ক সত্ত্বেও তিনি অতি উত্সাহে , লোডশেডিঙের মাঝে, শ্রোতাদের করতালির মাঝে আতোর রচনা পাঠ  করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের শরৎকাল পর্যন্ত আতো  কোলেতের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু আতো তাঁর কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। আতো  অভিযোগ করতে শুরু করেছিলেন যে কোলেত দাবি করছেন যে আতোর রচনা নাকি কোলেত লিখেছেন আর কোলেত তাঁর রচনাগুলো  তাঁর কাছ থেকে চুরি করেছেন।

তিনি তাকে সন্তান ধারণের জন্য প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলেন বলেও অঁতনা আতো অভিযোগ করেন। সেই বছরের নভেম্বরে আতোর রচনা পাঠে  অংশ নিতে অস্বীকার করেছিলেন কোলেত। এতে ক্ষুব্ধ হন আতো,  যিনি বলেছিলেন যে এটি যুবতিটির  একটি "অযৌক্তিক আবদার"। কিন্তু আতোর কাছের লোকেদের  কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে বাস্তব বা কাল্পনিক চাপে যুবতিটির মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।কোলেট থমাসের মানসিক অবস্থা পরবর্তী বছরগুলিতে এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে তিনি আতোর কথা মনে করতে পারেননি। কোলেত তাঁর বাকি জীবন প্রাইভেট মানসিক চিলিৎসালয়ে কাটিয়েছেন। এই চিঠিগুলো  প্রথম সামান্থা মারেনজির গুরুত্বপূর্ণ বই, ‘অঁতনা আতো এত কোলেট থমাস’ বইতে প্রকাশিত হয়েছিল। 

[ প্রথম চিঠি ] প্যারিস, জুন ১৪, ১৯৪৬

আমার অত্যন্ত প্রিয় কোলেত,

 আমি আপনার জন্য রেইন ব্লাঞ্চে [১] দুই বা তিন ঘন্টা অপেক্ষা করেছি। আমি আপনার হোটেলে ফোন করেছিলুম কিন্তু তারা আমাকে বলল যে আপনি ওই হোটেলটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং আজ রাতে আপনার লাগেজ নিতে আসছেন।

আপনি কি প্যারিস ছেড়ে যেতে চান?

এই খবর আমাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করেছে এবং আমি ভাবছিলুম যে আপনি তো হতাশার  প্রজাতি নন যে হারিয়ে যাওয়া বিভ্রমের মতো আপনাকে হঠাৎ প্যারিস ছেড়ে যেতে হবে।

তবু, আমি, যতদূর ব্যাপারটা আমার সাথে সম্পর্কিত, আমি আপনার কাচ থেকে কিছুই নিইনি এবং আপনাকে অযথা প্রতারিত করিনি।

আপনি যদি আজ বিকেলে আমাকে দেখতে আসতেন তবে নতুন প্রলয় বা সডোমের আরেক পতনের জন্য অপেক্ষা না করে আপনার হৃদয় পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে উঠত এবং আমার কাজের জন্য আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিল।

আমাকে কি নিজেকে চিরকাল একা ভাবতে হবে?

আমাকে লিখে জানান আর  প্যারিসে একটা সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করুন।

আমি নিশ্চিত যে আপনি মনে করেন আমি আপনার প্রতি নিজেকে পুরোপুরি নিবেদন করিনি।

আমি কিছু গোপন না করে আমার জীবন সম্পর্কে আপনাকে জানাতে  চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আসেননি।

আমি আপনার কাছ থেকে একটা চিঠির শব্দ অপেক্ষা করছি.

আমি আপনাকে আলিঙ্গন করি। 

অঁতনা আতো

[ দ্বিতীয় চিঠি ]প্যারিস, রবিবার, জুন ২৪, ১৯৪৬ [২]

কোলেত,

 আমি ৫০ বছর ধরে অপরিসীম কষ্ট সহ্য করেছি, যার মধ্যে নয় বছরের বন্দিত্ব কারোর চেতনায় আঘাত সহ্য করতে সক্ষম হবে।

 আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি ।এমন কিছু আছে যা আপনাকে পীড়িত করে, এটি আমাকে অবাক করে না, এটিই জীবন, বাকিদের জন্য, আমি স্থায়ীত্ব শব্দের অর্থ কী তা বুঝতে পারি না, এমনকি দর্শনে আমার কোনও স্নাতক ডিগ্রি নেই।

আপনার  শেষ কথার জবাবে আমার আর কিছু বলার নেই, আর কিছু বলার নেই     

অঁতনা আতো

[ তৃতীয় চিঠি ] প্যারিস, জুন 26, 1946

কোলেট,

 

কার্ডিয়াজলের চিকিৎসার সাথে বন সউভার [৪]-এ বন্দী থাকার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমি ভুলতে পারি না। [৫]

আমি সারাহ বার্নহার্ড থিয়েটারের ঘটনাটি ভুলতে পারি না [6] যেখানে ছিল শুভাকাঙ্খী কোলেত তমাস  অন্য কেউ নয় যে কিনা তাকে  বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্হা নিয়েছিল।

 আমিও ভুলতে পারি না, এবং বিশেষ করে একজন বিস্ময়কর চেতনাময়ী যে আমার সাথে কাজ করতে এসেছিল এবং ইভরি-সুর-সিয়েন [৭ ]-এ আমার  এস্পালিয়ন এবং রোদেজে সদ্য লেখা রচনাগুলো তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে সকলের কাছে পড়ে শুনিয়েছিল ।

আমি জানি, কোলেত, একটি দীর্ঘ এবং ভয়ানক ইতিহাস এবং বায়ুবিজ্ঞান সংক্রান্ত [8] ব্যাপারে যা  আপনি আমাকে অ্যানি সম্পর্কে পাঠিয়েছেন তা আমাকে এমন  দেখায় যেন আপনি নানাভাবে এটা নিয়ে সচেতন ছিলেন, কিন্তু আপনি যাতে আপনার সঠিক অবস্থান দেখতে পান এবং আমারও অবস্হান স্পষ্ট হয় তাতে বিরাট উথালপাথাল ঘটে যাবে।  ইতিমধ্যে আমি চাইবো যে আপনার আত্মা যেন অন্যায়ভাবে যন্ত্রণায় আক্রান্ত না হয়, তবে আমি আপনার কাছ থেকে অনেক অন্যায় এবং বিশেষত অযাচিত কথা শুনেছি। যেহেতু আমি সচেতন ছিলুম যে  আপনাকে শুধুমাত্র বাঁচতে সাহায্য করতে চেয়েছিলুম এবং খারাপভাবে পুরস্কৃত হওয়ার ছাপ নিয়ে সচেতন নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে আপনি এখন এটি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, তবুও আপনি সারাহ বার্নহার্ডে আমার রচনা ‘দি চিলড্রেন অফ দি মিসে-এন-সিন প্রিন্সিপল’ [৯] পড়েছেন আমি চাই আপনি বাকিটা রেডিওতে ধারাবাহিক পড়ুন, এবং আমি চাই না আপনি এই শেষ সুযোগটি হারাতে চাইবেন। আমি ডাক্তারদের বিরুদ্ধে  অনুসরণ করার মতন একটা নতুন লেখা লিখেছি [১০] 

এই বিষয়ে একটি মিটিং এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাকে একটা লেখা পাঠাতে [ ১১ ] পাঠাতে হবে।

 আপনার

অঁতনা আতো

পুনশ্চ. আমি বিশেষভাবে বিশ্বাস করি না যে আপনি অ্যানির জায়গা নিয়েছেন [৩ ], তবে আমি মনে করি এমন কেউ যিনি সত্তার স্থায়ীত্বে বিশ্বাস করেন, যদিও আপনি পরোয়া করেন না, আপনার জায়গা নিয়েছেন, তবে ব্যাপারটা অ্যাপোকালিপসের জিঘাংসা দ্বারা সমাধান  হবে। যদিও আমি ভেবেছিলাম যে আমরা শেষবার দেখা করার সময় মঁপারনাস স্টেশনের সামনে পরস্পরের প্রতি আগ্রহী ছিলুম কিন্তু তাতে আপনার কাছে কী আসে যায়। 

টীকা : [১] প্যারিসের হোটেল হোয়াইট কুইন । [ ২ ] প্রকৃতপক্ষে রবিবার ছিল ২৩ জুন । [ ৩ ] অ্যানি বেসনার্ড - আতোর বন্ধুনি এবং তাঁর "হৃদয়ের কন্যা ড়ৈ এখনো অজাত।" আতো এবং অ্যানি বেসনার্ডের মধ্যে ১৯৩৩ সালের প্রথম বৈঠকটি একটি রূপকথার মতন। রাতের বেলা আতো অ্যানিকে দেখলেন মঁপারনাসের বুলেভার্দে, মেয়েটি একটি বেঞ্চে বসে কাঁদছে। তার বয়স ষোল বছর, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এবং ক্ষুধার্ত। তাঁর নিজের দারিদ্র  সত্ত্বেও, আতো মেয়েটিকে খাওয়াতে এবং তাকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছিলেন এবং তারা বন্ধু হয়ে ওঠেন। স্টিফেন বারবার লিখেছেন, "পিতৃত্বের বিশুদ্ধতা এবং অনাচারী ঈর্ষার মধ্যে সীমানা অ্যানি বেসনার্ডের প্রতি আতোর মনোভাবের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। আতো নিজের পরিবারের প্রতি সর্বদা প্রতিরোধী, অ্যানির সাথে সমান্তরাল সম্পর্কের মাধ্যমে এই অনুপস্থিতি পূরণ করেছিলেন।[ ৪ ] কায়েনে একটি চিকিৎসালয় । [ ৫ ]  কোলেতকে তার ছাত্রাবস্থায় একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল যেখানে তাকে দুই হাত বাঁধা অবস্হায় রাখা হয়েছিল এবং কার্ডিয়াজল দেওয়া হয়েছিল, যা একটি খিঁচুনি-দমনকারী ওষুধ সাধারণত ইলেক্ট্রোশকের আগে  দেওয়া হয়। আতো ৩ এপ্রিল, ১৯৪৬-এ তাঁর  একটি চিঠিতে লেখেন: “আশ্রয়, চিকিত্সা এবং কার্ডিয়াজলের গল্প, যখন আমি এটি ভাবি, তখন আমার দম বন্ধ হয়ে যায়, কারণ এটি বয়ঃসন্ধিকাল থেকে আমার অভিজ্ঞতার সমস্ত গল্পের সাথে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে। [ ৬ ]  কোলেত তমাস ৭ জুন, ১৯৪৬-এ সারাহ বার্নহার্ড থিয়েটারে আয়োজিত গালা বেনিফিট-এ আতোর ‘ফ্র্যাগমেন্টেস’ থেকে পড়েন। [ ৭ ] ১৯৪৬ সালে আতোকে তাঁর বন্ধুদের কাছে রেকৈ দেওয়া হয়েছিল, যাঁরা তাকে আইভরি-সুর-সেইনের সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে ভর্তি করে দেন।[ ৮ ] আতো প্রেসারাইজড এয়ার টিউবের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্হাকে নির্দেশ করছেন, যাকে বলা হয় নিউমেটিক মেল বা পোস্ট। আতো ১৯৪৬-১৯৪৮ সালের শেষের দিকে খুব কমই সাধারণ পোস্টে মেইল পাঠাতেন। সাধারণত এগুলি নিবন্ধিত চিঠি ছিল যা প্রাপককে সই করে নিতে হয়। [ ৯ ]   এই শিরোনামের আরেকটি সামান্য পরিবর্তন করা রচনা ছিল। দুটিই ছিল একই পাঠ্যের মূল শিরোনাম যা ‘ফ্র্যাগমেন্টস’ নামেও বইয়ে ছিল। শিরোনাম "ফ্র্যাগমেন্টেশনস" দিয়ে শেষ হয়েছিল।[ ১০ ] ক্লাব ডি'এসাই-এ রোগী এবং ডাক্তারদের রেকর্ড করার পর (৮ জুন, ১৯৪৬ ), আতো রেডিও রিডিং, এলিয়েনেশন এবং ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য আরেকটি রচনা প্রস্তুত করেন; তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে কোলেত পাঠে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি ১৬ জুলাই একাই রচনাটি পড়েন এবং তারপর এটি ‘আতো দ্য মোমোতে’ ঢোকান।[ ১১ ] আতোর "নিউ" শব্দের ব্যবহার  "নিউমেটিক" শব্দটিকে স্মরণ করায়। "Pneu" বায়ুসংক্রান্ত মেইলের জন্য সংক্ষিপ্ত এবং ঘন ঘন ব্যবহৃত নাম ছিল। তিনি তাঁর শেষ মাসগুলিতে লেখা চিঠিতে প্রায়শই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আতোর জন্য, শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য ছিল, যা শ্বাসের শক্তির কথা বলে। প্রাচীন গ্রীক ভাষায়, "নিউমা" শব্দটি ছিল, যা শ্বাস নেওয়া বা প্রস্ফুটিত হওয়াকে বোঝায়। 













 






                                                                                                              

                                            

                                                                        




                                                                                                              

                                                                                         

                                                                                    

                                                                             


No comments:

Post a Comment