Monday, May 24, 2021

জাঁ-লুক গোদার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর্মেনীয় পরিচালক আরতাভাজ পিলিশান-এর ---- অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

 

জাঁ-লুক গোদার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর্মেনীয় পরিচালক আরতাভাজ পিলিশান-এর 

অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

আরতাভাজ পিলিশান ( ১৯৩৮ ) একজন আর্মেনীয় চিত্রনির্মাতা, যাঁর কাজ সম্পর্কে ইউরোপে জাঁ লুক গোদারই প্রথম আগ্রহ দেখান । পিলিশান একাধারে তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্র নির্মাতা , চিত্রনাট্য রচয়িতা, চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস রচয়িতা এবং ফিল্ম তাত্ত্বিক । সিনেমাটিক দৃষ্টিকোণের  ‘ডিসট্যান্স মন্তাজ’ শৈলী প্রয়োগের জন্য তিনি খ্যাত, যেমন কৃষ্ণসার হরিণদলের সঙ্গে বিশাল পলায়নকারী মানুষদের তুলনামূলক দৃশ্য । চিত্রনির্মাতা সের্গেই পারাজানোভ বলেছেন যে, পিলিশান একজন বিরল প্রতিভাধর চিত্রনির্মাতা । পিলিশানের ফিল্মগুলো তথ্যচিত্র এবং ফিচার ফিল্মের মিশ্রণ, অনেকটা আভাঁ গার্দ চিত্রনির্মাতা ব্রুস কনারের মতন, প্রথানুগত তথ্যচিত্রের মতন নয়। কিন্তু তা মায়া ডেরেনের মতো আভাঁ গার্দ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, অর্থাৎ ওনার ফিল্মকে ‘অ্যাবসার্ড সিনেমা’ বলা যায় না । পিলিশানের ফিল্মগুলোকে বলা হয়েছে ‘কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গীকে ফিল্মে নামিয়ে আনার প্রয়াস’ । ফিল্মনির্মাণে উনি পুরোনো ফিল্মের সংগ্রহশালা থেকে কথাবস্তু নিয়ে মিশিয়েছেন, দুটি টেলিফোটো লেন্সের মাঝে তোলা দৃশ্যের মিশেল ঘটিয়েছেন । কিন্তু ওনার সংলাপহীন ফিল্মগুলো বেশ সংক্ষিপ্ত, ছয় মিনিট থেকে ষাট মিনিটের মধ্যেই আবদ্ধ । অবশ্য সঙ্গীত আর ধ্বনি-প্রয়োগকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন । ওনার বেশিরভাগ ফিল্ম কালো-শাদায় তোলা । গোদার-এর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা প্রকাশিত হয়েছিল ‘লে মন্দে’ পত্রিকার ২ এপ্রিল ১৯৯২ সংখ্যায় ।


জাঁ-লুক গোদার :  কেমন পরিস্হিতিতে আপনি কাজ করেছেন ?

আরতাভাজ পিলিশান : আমি আমার সব ফিল্মই আরমেনিয়ায় তুলেছি, তবে মসকো থেকে সাহায্য নিয়েছি । আমি পুরোনো ব্যবস্হার গুণগান করতে চাই না, কিন্তু তার বিরুদ্ধে নালিশও করতে চাই না । অন্তত ওদের একটা সিনেমাটিক ইন্সটিটিউট ছিল, যেখানে খুব ভালো প্রশিক্ষণ পাওয়া যেতো । চিত্রনির্মাণ আমরা কেবল সোভিয়েট ইউনিয়নেই শিখিনি বরং সারা পৃথিবীতে শিখেছি, আর সেসময়ে প্রত্যেকেরই  নিজের কন্ঠস্বর খুঁজে পাবার সুযোগ ছিল । আমি এতো কম ফিল্ম তৈরি করেছি বলে তখনকার এসট্যাবলিশমেন্টকে দায়ি করতে চাই না ; বলা যায় যে, আমার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল । আমি জানি না নতুন ব্যবস্হায় কী ঘটতে চলেছে । আশা করি আমি ফিল্মের কাজ চালিয়ে যেতে পারব ; সমস্যা তো সব সময়েই থাকে, যেমন ফ্রান্সে রয়েছে, প্রযোজনা সম্পর্কিত সমস্যা আর জনগণের মাঝে সম্পর্কের সমস্যা । এখন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল ফিল্ম তৈরি করার পর তার বিতরণ ।

জাঁ-লুক গোদার : আমি জানতে পারলুম কেননা নিয়নে তথ্যচিত্রের উৎসবে ওগুলো দেখানো হচ্ছিল, আমি যেখানে থাকি তার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে । লুসানের সিনেমাথেকের পরিচালক ফ্রেডি বশ, সেগুলোর কপি করার জন্য “সোভিয়েট নিয়ম” অনুসরণ করেছিলেন : উনি রাতের বেলায় কপি করতেন আর আমাদের দেখাতেন -- অ্যানে-মারি মিয়েভিল আর আমাকে । আমার ওপর সেগুলো গভীর প্রভাব ফেলেছিল, কিন্তু পারাদজানভের ফিল্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ; উনি মনে হয় পারস্যের জাজিম বোনা আর সাহিত্যের ঐতিহ্যের কাছাকাছি । আপনার ফিল্মগুলো, আমার মনে হয়েছে, কেবল সিনেমাটিক ঐতিহ্য থেকেই জন্মাতে পারে । যেমন আইজেনস্টাইন, দোভঝেঙ্কো আর ভেরতভ একটা ফিল্ম তৈরি করে এমন প্রভাব ফেললেন যাকে বলা চলে ফ্ল্যাহার্টি বা কিউবার তথ্যচিত্র নির্মাতা সানটিয়াগো আলভারেজের মতন । বলা যায় এক ধরণের ফিল্ম, যা  একই সঙ্গে মৌলিক এবং ঐতিহ্যময়, একেবারে আমেরিকার বাইরে, যেগুলো পৃথিবীর চলচিত্রজগতে বেশ ক্ষমতাধর । এমনকি রোম শহরও, খোলামেলা একটা মহানগর, আমেরিকার কাছে ঋণী । যখন দখলকারীর কবজায় দেশটা থাকে, তখন প্রতিরোধের সমস্যা হল কেমন করে তাকে প্রতিরোধ করা হবে । আমি যখন আপনার ফিল্মগুলো দেখলুম তখন মনে হয়েছিল, তথাকথিত সমাজবাদী ব্যবস্হার যতোই গলদ থাকুক, একটা সময়ে কয়েকজন ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব ভিন্নভাবে চিন্তা করতে সফল হয়েছিলেন । হয়তো তা বদলে যেতে চলেছে । আমার কথা যদি বলি, বাস্তবের , আর তাকে ব্যবহারের প্রতিনিধিত্বকারী উপায়গুলোর সমালোচক হিসাবে, আমি রুশ চিত্রনির্মাতদের টেকনিককে পুনরাবিষ্কার করলুম, যাকে ওনারা বলতেন মন্তাজ । গভীর চিন্তার ফসল হিসাবে মন্তাজ, যে অর্থে আইজেনস্টাইন এল গ্রেকোকে বলেছিলেন টোলেডোর সবচেয়ে বড়ো মন্তাজশিল্পী ।

আরতাভাজ পিলিশান : মন্তাজ সম্পর্কে আলোচনা করা কঠিন । শব্দটা নিঃসন্দেহে ভুল । হয়তো বলা উচিত “শৃঙ্খলার প্রণালী”। টেকনিকাল প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে, গভীরতার প্রতিফলন হিসাবে আলো ফেলা ।

জাঁ-লুক গোদার : মন্তাজের রুশ প্রতিশব্দ কী ? কোনো প্রতিশব্দ নেই ?

আরতাভাজ পিলিশান : হ্যাঁ, মন্তাজ ।

জাঁ-লুক গোদার : যেমন, উদাহরণ দিই, “ইমেজ” শব্দের দুটি প্রতিশব্দ আছে রুশ ভাষায়। সেগুলো কাজে লাগে । প্রতিটি দেশের সিনেমাটিক শব্দের একটা করে অভিধান হলে আগ্রহের ব্যাপার হবে । আমেরিকানদের দুটো শব্দ আছে : “কাটিঙ” আর “এডিটিঙ” ( শব্দটা “এডিটরদের” কাজের সঙ্গে যুক্ত, সেই লোকগুলো কিন্তু ফরাসি ভাষায় যাদের বলা হয় “editeur’, তা নয়, এই ফরাসি শব্দটা অনেকটা “প্রযোজক” বলতে যা বোঝায়, তাই। শব্দগুলো দিয়ে একই জিনিসকে বোঝায় না, আর ওরা “মন্তাজ” বলতে যা বোঝায় তার ধারেকাছে আসে না ।

আরতাভাজ পিলিশান : অভিধাগুলোর দরুণ কথা বলতে আমাদের অসুবিধা হয় । একই সমস্যা হয় “documentaire” ( documentary ) শব্দ নিয়ে । ফরাসি ভাষায় আপনারা যাকে বলেন “কাহিনিচিত্র”, রুশভাষায় আমরা তাকে বলি “শিল্পচিত্র” । অথচ ফরাসিতে সব ফিল্মই শৈল্পিক হতে পারে । রুশ ভাষায় আরও দুটি অভিব্যক্তি আছে, “played film” এবং “non-played film” ( গোদার শব্দদুটির প্রতিশব্দ করেছিলেন “le cinema joue” এবং “cinema non joue” -- এই সাক্ষাৎকারের পর গোদার একটা ছোটো ভিডিও তুলেছিলেন Les enfants jouent a la Russie অর্থাৎ ‘রাশিয়ায় শিশুদের খেলা’ নামে । )

জাঁ-লুক গোদার : ও ব্যাপারটা আমেরিকানদের মতন, যারা গল্পের চিত্রায়নকে বলে “ফিচার ফিল্ম” । ফিচার মানে মুখের বৈশিষ্ট্য, বাহ্যিক গঠন, যে ব্যাপারটা ‘তারকা’দের চেহারা থেকে এসেছে । এই সমস্ত ব্যাপার বুঝতে পারার জন্য অনেক কিছু করা দরকার, যেমন ধরা যাক ফরাসি “copie standard” ( যাতে শব্দ আর ছবি একত্রিত করা হয় ), ইংরেজরা তাকে বলে “married print”, আমেরিকানরা বলে “answer print”, ইতালীয়রা বলে “copia campoione” ( first-rate copy ) -- আর তা মুসোলিনির সময় থেকে চলে আসছে। কিন্তু সবচেয়ে সিরিয়াস ব্যাপার হল  documentaire/documentary-র ভুল ব্যাখ্যা । আজকাল তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্রের মধ্যে পার্থক্য, তথ্যচিত্র এবং কমার্শিয়াল ফিল্মের মধ্যে পার্থক্য, এমনকি তাকে শৈল্পিক ফিল্ম বললেও, তথ্যচিত্রের একটা নৈতিক ভঙ্গী থাকে যা ফিচার ফিল্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । “নিউ ওয়েভ” সব সময় দুটিকে মিশিয়ে ফেলেছে ; আমরা বলতুম যে রাউচ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক তার কারণ উনি কাহিনি তৈরি করতেন তথ্যচিত্রের গুণাগুণ দিয়ে, আর রেনোয়াও তাই করতেন, কেননা উনি তথ্যচিত্র তৈরি করতেন কাহিনির গুণাগুণ দিয়ে ।

আরতাভাজ পিলিশান : ব্যাপারটা আর পরিচালনার সমস্যা নয় । ফ্ল্যাহার্টিকে অনেক সময়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা বলে মনে করা হয় ।

জাঁ-লুক গোদার : ওহ, নিশ্চয়ই । উনি একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা, যিনি সবাইকে এবং সমস্তকিছুকে পরিচালনা করেছেন । নানুক, ম্যান অফ আরান, লুইজিয়ানা স্টোরি -- প্রতিটি শট পরিচালনা করা হয়েছে অত্যন্ত সাবধানে । ওয়াইজম্যান যখন বড়ো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোকে নিয়ে ফিল্ম তৈরি করলেন, ‘দি স্টোর’, উনি ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোর নিজেদের পরিচালনা আর কাহিনিকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন ।

আরতাভাজ পিলিশান : একই কারণে আমি কখনও ফিল্মস্টুডিও বা টেলিভিশন স্টুডিওর কাঠামোর ভেতরে কাজ করার প্রস্তাব দিইনি । আমি এমন জায়গা খোঁজার চেষ্টা করেছি যেখানে শান্তিতে ফিল্ম তোলা যায় । অনেক সময়ে তা টিভির জন্যেও করতে হয়েছে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারা, নিজের ফিল্মের ভাষায় । অনেক সময়ে লোকে বলে যে ফিল্ম হল অন্যান্য শিল্প আঙ্গিকের সমন্বয় । আমি তাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করি না । আমার ধারণা, ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ‘টাওয়ার অফ ব্যাবেল’-এ, যেখানে আরম্ভ হয়েছিল ভাষার বিভাজন । টেকনিকাল কারণে অন্যান্য শিল্প আঙ্গিকের পর তা দেখা দিয়েছে, কিন্তু বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তা আগে এসেছে । আমি বিশুদ্ধ সিনেমা তৈরির চেষ্টা করি, যার জন্য অন্যান্য শিল্প থেকে কিছুই নিই না ।  আমি একটা এমন সেটিঙ খোঁজার চেষ্টা করি যার চারিধারে আবেগের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র গড়ে তোলা যায় ।

জাঁ-লুক গোদার : কিছুটা নিরাশাবাদী হবার কারণে, আমি সমস্ত ব্যাপারের আরম্ভের আগেই শেষটা দেখতে পাই । আমার কাছে, সিনেমা হল শিল্পের শেষ প্রতিভাস, যে ধারণাটা পাশ্চাত্য জগতের । অসাধারণ পেইনটিঙের যুগ শেষ হয়ে গেছে, অসাধারণ উপন্যাস উধাও হয়ে গেছে। সিনেমা ছিল, আপনি যদি মানেন, ব্যাবেলের আগেকার ভাষা, যা সবাই বিষয়টায় শিক্ষা ছাড়াই বুঝতে পারতো । মোৎসার্ট রাজকুমারদের সামনে বাজাতেন, চাষারা তা শুনতো না, যখন কিনা চ্যাপলিন সকলের জন্য অভিনয় করতেন । ফিল্মনির্মাতারা এই অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন যে ফিল্মের ভিত্তির জন্য কী মৌলিক, আর এই ধরণের অনুসন্ধান, আমি আরেকবার মনে করিয়ে দিই, অনেকটা পাশ্চাত্য জগতের ব্যাপার । এটা একটা মন্তাজ । এই বিষয়ে লোকে অনেক আলোচনা করেছে, বিশেষ করে পরিবর্তনের সময়ে । বিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন ছিল রুশ সাম্রাজ্যের সোভিয়েত রাষ্ট্রে রূপান্তরণ ; স্বাভাবিকভাবে, রুশরাই সেই অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি প্রগতি করেছিল, তার কারণ বিপ্লবের ফলে সমাজ নিজেই আগের আর পরের মন্তাজ তৈরি করে ফেলছিল ।

আরতাভাজ পিলিশান : ফিল্ম নির্ভর করে তিনটি ব্যাপারে : পরিসর, সময় এবং বাস্তব বিচলনে । এই তিনটি উপাদান প্রকৃতিতে বর্তমান, কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সিনেমা তাদের পুনরাবিষ্কার করতে পারে । তাদের ধন্যবাদ যে বস্তুর গোপন ক্রিয়াকে আবিষ্কার করা সম্ভব। আমি নিশ্চিত যে ফিল্ম দর্শনের, বিজ্ঞানের, শিল্পের ভাষায় যুগপৎ কথা বলতে পারে । প্রাচীন যুগ হয়তো এই অভেদের সন্ধান করতো ।

জাঁ-পল গোদার : এই একই ব্যাপার পাওয়া যাবে যদি আমরা অভিক্ষেপের ধারণা সম্পর্কে ভাবি, যেমন তা উদ্ভূত আর বিকশিত হয়েছিল যতক্ষণ না আমরা তা টেকনিকালি অভিক্ষেপের যন্ত্রাদির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছি । গ্রিকরা প্ল্যাটোর বিখ্যাত গুহার তত্বের কথা কল্পনা করতে পেরেছিলেন । এই পাশ্চাত্য ধারণা, যা বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাসীরা অনুমান করেননি, অ্যাজটেকরাও করেননি, খ্রিষ্টধর্মে অবয়ব পেলো, যা গড়ে উঠেছে কোনও বৃহৎ আশার  বনেদের ওপরে । পরে তা গণিত বিশেষজ্ঞদের মাঝে ব্যবহারিক আঙ্গিকের বিষয় হয়ে উঠলো, যাঁরা আবিষ্কার করলেন -- আবার সেই পশ্চিমের ব্যাপার -- বর্ণনামূলক জ্যামিতি । পাসকাল এই ব্যাপারে অনেক খেটেছিলেন, সেই একই ধার্মিক, আধ্যাত্মিক অনুচিন্তন, মোচক সম্পর্কে তাঁর ধারণার ব্যাখ্যা দিয়ে । পরে আমরা পেলুম জাঁ-ভিক্টর পোন্সলেট, নেপোলিয়ানের সৈন্যবাহিনীর এক বিদ্বৎজন। তাঁকে রাশিয়ার কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, আর সেখানেই তিনি আকারের বৈশিষ্ট সম্পর্কে  তাঁর তত্ত্বের ছক কষতে পারলেন, যা কিনা বস্তু সম্পর্কে আধুনিক তত্বের বনেদ। কারাগারে ওনার আবিষ্কার কাকতালীয় ছিল না । ওনার সামনে ছিল একটা দেয়াল, আর সব কারাবন্দীরা যা করে তিনিও তাই করছিলেন: উনি দেয়ালে অভিক্ষেপ ঘটালেন । পালাবার উগ্র ইচ্ছে । গণিতবিদ হবার দরুণ তিনি নিজেকে সমীকরণে প্রকাশ করলেন । উনিশ শতকের শেষে এলো প্রযুক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গতি । সেই সময়ে একটা আগ্রহব্যঞ্জক ব্যাপার ছিল ফিল্মে শব্দের অনুপ্রবেশ । এডিশন প্যারিসে এসেছিলেন ডিস্কের সঙ্গে চোখে দেখা যায় এমন দর্শনীয় টেপ নিয়ে। তা এখনকার মতনই কমপ্যাক্ট ডিস্কের ব্যাপার ছিল, যা আজও কিছু স্টুডিও ব্যবহার করে, তার সঙ্গে ফিল্মের ডিজিটাল শব্দাবলীকে মেশাবার খাতিরে । আর তা একটা প্রচলিত ধারা হয়ে উঠল ! অসম্পূর্ণতা নিয়েই, অন্যান্য ছবির মতন, তা চলতে লাগল, আর টেকনিকে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল । কিন্তু লোকেরা তা চাইতো না । লোকেরা সাইলেন্ট সিনেমা পছন্দ করত ; তারা কেবল দেখতে চাইতো ।

আরতাভাজ পিলিশান : শেষ পর্যন্ত যখন শব্দ এলো, বিশ শতকের শেষে, মহান চিত্রনির্মাতারা, যেমন গ্রিফিথ, চ্যাপলিন আর আইজেনস্টাইন, ব্যাপারটা সম্পর্কে তাঁদের ভীতি ছিল । তাঁদের মনে হয়েছিল শব্দের অনুপ্রবেশ তাঁদের এক পা পেছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । তাঁরা ভুল ছিলেন না, কিন্তু তাঁরা যে বিষয়ে ভাবছিলেন, তা সেই কারণে নয় ; শব্দ মন্তাজের মাঝে মাথা গলায়নি, তা ইমেজকে সরিয়ে তার জায়গায় আসতে চেয়েছিল ।

জাঁ-লুক গোদার : ইউরোপে ফ্যাসিজমের উথ্থানের সঙ্গে টকিজের প্রযুক্তি এসেছিল, আর সেই সময়েই আবির্ভাব হয়েছিল বক্তাদের । হিটলার ছিল একজন বড়ো বক্তা, মুসোলিনিও তাই, চার্চিল, দ্য গল আর স্ট্যালিন । টকি ছিল ভাষার ওপরে থিয়েটারের দৃশ্যের বিজয়, আপনি একটু আগে যে কথা বলছিলেন, ব্যাবেলের অভিশাপের আগে ভাষা যে অবস্হায় ছিল ।

আরতাভাজ পিলিশান : ভাষাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য আমি যা ব্যবহার করি তাকে বলব “চিত্রকল্পের অনুপস্হিতি” । আমার মনে হয় লোকে ছবিগুলো শুনতে পায় আর আওয়াজকে দেখতে পায় । আমার ফিল্মগুলোতে ছবিগুলো আওয়াজের পাশেই সংশ্লিষ্ট হয়ে অবস্হান করে আর আওয়াজগুলো ছবির পাশে । এই পারস্পরিক বিনিময়গুলো থেকে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা নির্বাকযুগের ফিল্মের মন্তাজ থেকে আলাদা, কিংবা বলা ভালো, যে “ফিল্মগুলো কথা বলত না” তাদের থেকে ।

জাঁ-পল গোদার : আজকালকার দিনে ছবি আর আওয়াজ পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ; লোকে টেলিভিশন সম্পর্কে বেশি ওয়াকিবহাল । একদিকে ছবি আর আরেক দিকে আওয়াজ, এবং এখন আর এই দুটির পরস্পরের সঙ্গে স্বাস্হ্যকর ও বাস্তব সম্পর্ক নেই । তারা নিছক রাজনৈতিক প্রতিবেদন হয়ে গেছে । সেই কারণেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বিশ্ব-টেলিভিশন এখন রাজনীতির কবজায় । আর এখন রাজনীতি নতুন ধরণের ছবি গড়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ( তথাকথিত “হাই ডেফিনিশন” ), এমনই একটা আঙ্গিক যা বর্তমানে কেউই চায় না । এই প্রথমবার রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীরা বলতে বাধ্য হয়েছেন : তোমরা এই জানালা দিয়ে এই ফিল্মের ছবিগুলো দেখতে পাবে । এমন ছবি, যার আঙ্গিক একতলার ছোটো জানালার মাপের, ফুটপাথের স্তরে একটা ছোটোখাটো ব্যাপার, যার আঙ্গিক চেকবইয়ের মতন ।

আরতাভাজ পিলিশান : আমি ভেবে অবাক হই যে টেলিভিশন আমাদের কী দিয়েছে। তা দূরত্বকে নিশ্চিহ্ণ করে দিতে পারে বটে, কিন্তু কেবল সিনেমাই সময়কে পরাজিত করতে পারে, মন্তাজ টেকনিকের দরুন । সময়ের এই জীবাণু -- সিনেমা তার ভেতর দিয়ে যেতে পারে । কিন্তু টকি আসার আগে ওই পথে তা বেশ দূরে সরে গেছে । সন্দেহ নেই যে তার কারণ হল মানুষ ভাষার চেয়ে বড়ো, শব্দের চেয়ে বড়ো । আমি মানুষের ভাষার চেয়ে মানুষকে বেশি বিশ্বাস করি।

[ ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী ]


No comments:

Post a Comment